নবম পর্ব
নিশুত রাত। নতুন দারোগাবাবু পোশাক আশাক পরে বাইরে বেরোবার জন্য তৈরি। অভ্যাসমত সার্ভিস পিস্তলটা একবার নেড়েচেড়ে দেখে নিলেন। এবার দাঁড়ালেন আয়নার সামনে। নিজের চেহারা দেখে নিজের মনেই আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলেন একটু। পুলিশবাবু আজকেও থানাতে এসছিল। ভুঁড়ি চুপসে গিয়ে আগের সেই জৌলুসটাও নেই। বলতে নেই, একটু মায়াই হচ্ছিল তাঁর। সে অনেকক্ষণ নিজেদের দৈন্য দুর্দশার কথা বলে গেল। তাঁর একবার ইচ্ছে হচ্ছিল যে বলেন, ভুঁড়ির জন্য শোকসভা ডাকুন, আমাকে ডাকবেন, শোকপ্রস্তাব পাঠ করিয়ে দিয়ে আসব। কিন্তু নেহাত বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে ভেবে বলেননি।
নিজের মনেই একটু হেসে নিলেন দারোগাবাবু। তারপর দেওয়ালে ঝোলানো একটা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
আর একজনও বেরিয়েছেন। তিনি বিডিও। আপাদমস্তক কালো ওভারকোটে ঢেকে, নিজের বাইকে চেপে। বাইকে সাইলেন্সার লাগানো। আওয়াজ প্রায় হয়ই না। প্রথম গন্তব্য হ্লাদিনীদেবীর বাড়ি। প্রাক্তন বড়দিমণির বাড়ি থেকে একটু দূরে একটা ঝুপসি আমগাছের তলায় বাইকটাকে রেখে তার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। এখান থেকে হ্লাদিনীদেবীর দোতলার শোবার ঘরটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হ্লাদিনীদেবী ড্রেসিং টেবিলের সামনে মেদহীন পেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। বিলাপ যে করছেন, সেটা এত দূর থেকেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এরপর পাশে রাখা একটা থালা থেকে কিসব খাবার নিয়ে গপাগপ খেতে শুরু করে দিলেন তিনি।
পয়মন্তর বাড়ির বাইরে থেকেই আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল চেঁচামেচির। পয়মন্তের মা বলছেন, “আমার পয়সোনাটাকে নির্ঘাত কেউ বাণ মেরেছে। নাহলে এরকম করে কখনো দিনে দিনে শুকিয়ে যায়? আহা রে, অমন সোনার বন্ন কালি হয়ে গেল গো! আমার সাধের বাছাটার দিকে মুখ তুলে যে আর তাকানো যায় না গো- ও- ও- ও!”
পয়মন্তের গলা পাওয়া গেল, “আঃ মা, তুমি চুপ করো তো! এ তল্লাটে এমন কে আছে যে আমাকে বাণ মারবে? তার চেয়ে ঘরে মণ্ডা মিঠাই যা আছে দাও, খাই। তাতে যদি কোন কাজের কাজ হয়!”
একটা দীর্ঘশ্বাসই যেন ছাড়ল পয়মন্ত। বিডিও- ও চুপিসাড়ে সরে এসে আবার বাইকে স্টার্ট দিলেন।
চিন্তাহরণবাবুর বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছতেই সমবেত হাসির আওয়াজ ভেসে এল। চিন্তাহরণবাবু বলছেন, “আঃ,ছাড়, ছাড়! উঃ হু হু হু! ওরে, আর কাতুকুতু দিস না রে!”
চিন্তাহরণবাবুর বাচ্চা নাতনির গলা ভেসে এল, “দাদু, কাতুকুতুর ইংরেজি কী?”
বিডিও উঁকি মারলেন। নাতনি দাদুর পেটের ওপর চেপে বসে কাতুকুতু দিচ্ছে। আরো কয়েকজন পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে।
চিন্তাহরণবাবু কোনমতে যেই না বলেছেন, “টিকলিং”, অমনি নাতনি চেপে ধরে বলল, “দাদু, তাহলে আমি তোমাকে ইংরেজিতেই কাতুকুতু দিই। টিকলিং…টিকলিং…” বলে সে মহানন্দে আবার কাতুকুতু দিতে শুরু করল। চিন্তাহরণবাবুও শুয়ে শুয়ে লাফাতে শুরু করে দিলেন।
মুশকিলটা হল পুলিনের বাড়ি গিয়ে। ঘরদোর অন্ধকার। কোনদিক দিয়ে নজর চালানো যায় বুঝতে না পেরে যেই রাস্তার ধারের টিউবওয়েলটার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন, অমনি কে যেন বলে উঠল, “তুই কে র্যা? এই রাতে?”
ভালো করে নজর চালিয়েও কিছুই দেখতে পেলেন না বিডিও। এগোতে যাবেন, পুনরায় যেন কে বলে উঠল, “আবার? যাবি না।”
আবার হেথাহোথা তাকিয়ে দেখলেন। ভালো করে তাকিয়ে দেখে নজরে এল, একটা টিয়ে পাখি পেয়ারাগাছের ডালে বসে।
ভালো করে বাড়ির চারধারটা ঘুরে দেখলেন তিনি। কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই। ভালো করে দেখেশুনে বেরিয়ে এলেন তিনি। পরবর্তী গন্তব্য রামরতনবাবুর বাড়ি।
রামরতনবাবুর বাড়ির ঠিক পেছনেই একটা বিরাট পুকুর। পুকুরপাড়ে বাইকটা দাঁড় করাতেই নজরে এল, আরে! রামরতনবাবুর বাড়ির পাশের ল্যাম্পপোস্টটাতে হেলান দিয়ে কে যেন বেশ দাঁড়িয়ে না? আদলটা চেনা চেনা লাগে? বাইকটা রেখে অতি সন্তর্পণে সেদিকে এগোলেন বিডিও।
দশম পর্ব
মনমেজাজ বেজায় খারাপ রামতারণবাবুর। সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠেই যদি কেউ দেখে যে তার আগের রাতে বিছানার ওপর জেগে থাকা নধর ভুঁড়ি সাতসকালে ঝরে গেছে, তাহলে কি কারুর আনন্দে নাচার কথা? কোথায় ভেবেছিলেন, সাতসকালে উঠে ভুঁড়িটাকে একটু মাঠের খোলা হাওয়া খাইয়ে আসবেন, তা না যত্ত বিপত্তি। খিঁচড়ে যাওয়া মন নিয়েই মশারির মধ্যে উঠে বসলেন তিনি। এখনো অব্দি বাড়ির লোকেরা খেয়াল করেনি, কিন্তু একটু পরেই করবে। তার পরে করবে পাড়াপ্রতিবেশী আর আত্মীয় স্বজন। আর তার পরে ভুঁড়েলবাটির বাকি সবাই। অন্যদিন এতক্ষণে তাঁর বিছানা থেকে নেমে হাতমুখ ধোওয়া, চা খাওয়া, খবরের কাগজ পড়া সব সারা হয়ে যায়, কিন্তু আজ বিছানা থেকে নামার ইচ্ছেটাই চলে গেছে। নামলেই তো সবাই জানতে পারবে। তখন? বাড়ির লোকজন এসে বারকয়েক তাড়া দিয়ে গেছে। তাও নামেননি। চক্ষুলজ্জা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। এতদিন ঘনিষ্ঠ মহলে বলে এসেছেন, ভুঁড়ি চুরি-টুরি ফালতু কথা। নিজেদের ভুঁড়ি নিজেরা সামলে- সুমলে রাখতে পারে না, লোকের নামে দোষ দেয়। আরে বাবা, ভুঁড়ি শুধু বাগালেই হবে? তাকে ঠিকঠাক লালন পালন করতে হবে তো?
কিন্তু এবার? তাঁর ভুঁড়িহীন চেহারা দেখে এবারে যে সবাই টিটকিরি দেবে! বেশি কিছু আর ভাবতে পারেন না রামতারণবাবু। আরো একবার ধপাস করে বিছানায় গড়াতে যাবেন, রান্নার মাসি এসে হাঁফাতে হাঁফাতে খবর দিল, “বাবু, অ বাবু, মাস্টর দিদিমুণির ফোন এয়েচে। আপনারে ডাকতিচে।”
বাধ্য হয়েই বিছানা ছেড়ে ওঠেন রামতারণবাবু। মাস্টার দিদিমণি মানে হ্লাদিনী। তার আবার কী দরকার পড়ল কে জানে? একটা উদ্গত দীর্ঘশ্বাস চেপে বসার ঘরে গিয়ে ফোন কানে চাপেন তিনি, “হ্যালো!”
ওপ্রান্তে হ্লাদিনী দেবীর গলা পাওয়া যায়, “রামতারণদা! একবার বিডিও অফিস বেরোতে হবে যে!”
আকাশ থেকে পড়েন রামতারণবাবু, “কেন, কী ব্যাপার?”
হ্লাদিনী দেবীর গলায় কেজো সুর, “বিডিও অফিস থেকে ফোন করেছিল। বলেছে, যাদের যাদের ভুঁড়ি চুরি হয়েছে তাদের সবাইকে নিয়ে বিকেল পাঁচটায় যেতে।”
কী কারণে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও আটকে গেলেন রামতারণবাবু। কোনমতে তোতলাতে তোতলাতে বললেন, “আ- আমার ভুঁ-ভুঁড়ি চুরু হয়েছে তা তু-তুমি জানলে কী করে?”
উত্তেজনার চোটে চুরিকে যে চুরু বলে ফেলেছেন, তা আর তাঁর খেয়াল নেই। হ্লাদিনী দেবীও গায়ে মাখলেন না বিষয়টা, “আমি আর জানব কী করে, দাদা? আপনি তো আর আমাদের কাউকে জানাননি। বিডিও ম্যাডামই বললেন।”, শেষের দিকে খানিকটা অভিমানী হয়ে ওঠে হ্লাদিনী দেবীর গলা।
রামতারণবাবু বিব্রতই হলেন কিছুটা, “আরে না! না! খবর তো দিতামই। আসলে কাল রাতে কখন চুরি হয়েছে, জানতেই পারিনি। এই সকালে ঘুম ভেঙে উঠে দেখছি। তোমার ফোনেই বিছানা ছাড়লাম।”
ওপারে হ্লাদিনী দেবীর অভিমান প্রশমিত হল কিনা ঠিক বোঝা যায়না, “ঠিক আছে, দাদা। তাহলে বিকেল চারটে নাগাদ আমার বাড়িতে চলে আসুন। বাকিরাও আসবে। সবাই মিলে একসঙ্গে যাওয়া যাবে।”
ফোনটা রেখে পেছনে ফেরেন রামতারণবাবু। দেখেন, বাড়ির সবাই জড়ো হয়ে চোখ গোল গোল করে তাঁকেই দেখছে!
………০………
ক্রমশ…
(পরবর্তী সংখ্যার জন্য চোখ রাখুন www.utolodhara.com এ পরের শুক্রবারে)
আগের পর্ব গুলি দেখুন – ধারাবাহিক লিঙ্কে