ষষ্ঠ পর্ব
নতুন দারোগাবাবু গুছিয়ে বসে নানান ভাবনাচিন্তা করছিলেন একটু আগে। তাঁর পূর্বসূরী খাসা একখানা চেম্বার বানিয়ে রেখে গেছেন। নরম গদিওয়ালা চেয়ারে বসে হালকা ঠাণ্ডা আমেজে তাঁর চোখ জুড়িয়ে গেল ধীরে ধীরে।
বেয়ারা সবুজলাল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল তার নতুন সাহেবকে। ভুঁড়েলবাটির জলবাতাসের প্রভাবেই হবে হয়তো, এ ক’দিনেই সাহেবের গায়ে বেশ গত্তি লেগেছে। যখন এসেছিলেন, একেবারে প্যাঁকাটির মতো চেহারা ছিল। ফুঁ দিলেই যেন উড়ে যাবেন, এরকম একটা ভাব। ওদিকের পুলিশবাবুর সাথে চেহারার তুলনাতেই আসতেন না।
পুলিশবাবুর কথা মনে পড়তেই একহাত জিভ কাটে সবুজলাল। ছি! ছি! পুলিশবাবুরা কতক্ষণ আগে তাকে দিয়ে সাহেবকে খবর পাঠিয়েছে, আর সে ভুলেই মেরে দিয়েছে! মিহি কণ্ঠে সবুজলাল ডাকে, “বড়োবাবু! ও বড়োবাবু!”
ভারি খাসা একখানা স্বপ্ন দেখছিলেন নতুন দারোগাবাবু। পুলিশবাবু তাঁর চেম্বারে এসেছে, আর তিনি তার চেম্বারের কার্পেটে পুলিনকে ঘোড়া বানিয়ে তার পিঠে চড়ে বসে বলছেন, “এই ঘোড়া, হ্যাট! হ্যাট!” পুলিন বলছে, “দারোগাবাবু, একটু আস্তে! ভুঁড়ি যে মেঝেতে ঘষে গেল!” তিনি উত্তরে ধমকাচ্ছেন, “চোপ! অমন করলে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর কেস দিয়ে দেব!” পুলিন কাতরস্বরে বলেছে, “বড়োবাবু, ও বড়োবাবু!” তিনি ধমকে উঠে বলেছেন, “চোপ! আমি এখন বড়োবাবু- টাবু কেউ নই, আমি এখন ঘোড়ার মালিক!” বলামাত্রই পুলিনের মুখটা ঘোড়ার মতো হয়ে গেল, আর সে সমানে বলতে লাগল, “বড়োবাবু, ও বড়োবাবু!”
আস্তে আস্তে ঘোড়ার মুখটুখ সব মুছে গিয়ে কানের কাছে একটাই স্বর বাজতে থাকলো, “বড়োবাবু, ও বড়োবাবু!”
বড়োবাবু চোখ মেলে তাকালেন। সামনে কে ওটা দাঁড়িয়ে? পুলিশবাবু? মৃদুস্বরে ডাকলেন, “পুলিশবাবু?”
উত্তর দিল সবুজলাল, “এজ্ঞে সার, আমি সবুজলাল। পুলিশবাবুরা সব বাইরেই দাঁড়িয়ে আছেন। আমায় অনেকক্ষণ খবর পাঠিয়েছেন। আপনি ঘুমোচ্ছেন বলে আর ডাকিনি।”
এতক্ষণে ধাতস্থ হয়েছেন দারোগাবাবু। টেবিলের উপরে গেলাসে রাখা জল এক চুমুকে সাবড়ে নিয়ে বললেন, “তা বেশ। ডেকে দাও। আমার তো অফিসে বসে ঘুমোনোর অভ্যেস নেই, খালি চোখটা বুজে আইনের ধারাগুলো একটু ভাবছিলাম, এই যা। কে বলেছে, আমি ঘুমোচ্ছিলাম?”
সবুজলাল উত্তর না দিয়েই বেরিয়ে গেল। আর তার পরপরই বড় একটা ব্যাটেলিয়ান ঢুকল। সবার প্রথমে পুলিন, তারপর পয়মন্ত, তারপর হ্লাদিনী দেবী আর সবার শেষে চিন্তাহরণবাবু। সকলকেই চেনেন। কিন্তু একসঙ্গে সবাইকে ঢুকতে দেখে মনে মনে একটু বিব্রত বোধ করলেও কিছু প্রকাশ করলেন না। বরং দেঁতো হাসি হাসলেন, “ হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ। আপনারা সব এত বিশিষ্ট মানুষ একসঙ্গে? কী ব্যাপার? কোন সমস্যা হয়েছে?”
হ্লাদিনী দেবীই মুখ খুললেন, “হ্যাঁ, সমস্যা একটা হয়েছে। এবং আমাদের ভুঁড়েলবাটির পক্ষে গুরুতর সমস্যা।”
চিন্তাহরণবাবু বলে উঠলেন, “মানসম্মান সব যেতে বসেছে। গভীর চিন্তার বিষয়।”
পয়মন্ত বলল, “গোঁফপলসার লোকেরা এবারে আমাদের দুয়ো দেবে। অশুভ ব্যাপারস্যাপার ঘটছে।”
পুলিন হাতজোড় করল, “আপনি না দেখলে বড়োই বিপদ। আপনার ভরসাতেই এসেছি। পুলিশ না দেখলে কে দেখবে বলুন?”
দারোগাবাবু ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, “বুঝতে পারছি ঘোরতর কিছু ঘটেছে। কিন্তু খুলে না বললে তো ঠিক ধরতে পারছি না।”
হ্লাদিনী দেবীই খুলে বললেন। ভুঁড়েলবাটির মানুষজনের গর্ব, তাদের সাধের ভুঁড়িগুলি এক অজানা কারণে উধাও হয়ে যাচ্ছে। তাঁরা কেউ ডায়েটিং করেন না, ভুঁড়ির বহর কমাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তাঁদের কারো নেই, বরং কী করলে ভুঁড়ির সৌকর্য বৃদ্ধি হবে, তাই তাঁদের ধ্যানজ্ঞান। এই যেখানে অবস্থা, সেখানে ভুঁড়ি উধাও হওয়াকে নিছক সমাপতন বলে মানতে তাঁরা নারাজ। তাঁদের দৃঢ় ধারণা, এর পেছনে কোন দুষ্টচক্র কাজ করছে এবং তাঁরা কোন গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার। তাই দারোগাবাবুর কাছে তাঁদের আবেদন, তিনি যেন দয়া করে ভুঁড়ি চুরির একটি কেস রুজু করেন এবং অপরাধী বা অপরাধীদের ধরার ব্যাপারে সমুচিত পদক্ষেপ করেন।
বড়োবাবু গুম মেরে শুনলেন। চিন্তাহরণবাবুর মনে হল, বড়োবাবু যেন শুনতে শুনতে বারকয়েক তাঁর গোঁফের আড়ালে মুচকি হাসলেন। কিন্তু সেটা তাঁর মনের ভুলও হতে পারে।
হ্লাদিনী দেবীর বলা শেষ হতে দারোগাবাবু গলাখাঁকারি দিলেন বারকয়েক। তারপর হাতে করে গোঁফে তা দিতে দিতে বললেন, “কিন্তু আমি কী করতে পারি?”
চিন্তাহরণবাবুর ভয়ানক রাগ হল। বললেন, “কী করতে পারি মানে? আপনি এলাকার দারোগা, আপনার এলাকা থেকে একের পর এক ভুঁড়ি চুরি হয়ে যাচ্ছে, আপনি তার বিহিত করবেন না?”
দারোগাবাবু বোঝানোর ভঙ্গিতে বললেন, “আহা, আপনি শুধু শুধু উত্তেজিত হচ্ছেন? বিষয়টা একটু ভাবার চেষ্টা করুন। দেখুন, ভুঁড়ি চুরি নিয়ে যে আমি কেস শুরু করব, কিন্তু কোন্ আইনে করব? পিনাল কোড কি ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোডে তো ভুঁড়ি চুরি নিয়ে কোথাও কিছু বলা নেই।”
পুলিন রাগের চোটে প্রায় দাঁড়িয়েই পড়ে আর কী! “আইনে নেই বলে কি ভুঁড়ি চুরি হতে পারে না?”
পয়মন্ত বলে, “এতগুলো মানুষের জলজ্যান্ত ভুঁড়ি গায়েব হয়ে গেল, আর আপনি বলেছেন, আইন নেই? এরকম অশুভ কথা বলবেন না বড়বাবু।”
দারোগাবাবু পড়লেন ফাঁপরে। এতগুলো মান্যগণ্য লোকের মুখের ওপরে বেশি বলাও মুশকিল, অথচ তাঁকে তো তাঁর আইন মেনেই কাজ করতে হবে। হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, “ঠিক আছে। একটা কমপ্লেন দিয়ে যান তাহলে।”
হ্লাদিনী দেবীর ওপরেই দায়িত্ব পড়ল কমপ্লেন লেখার। লিখতে শুরু করেই তিনি কলম দিয়ে মাথা চুলকোতে শুরু করলেন। চিন্তাহরণবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “এনি প্রব্লেম, হ্লাদিনীদি?”
হ্লাদিনীদেবী মাথা চুলকোতে চুলকোতেই উত্তর দিলেন, “হেডিংটা কী দেব? থেফট অব টাম্মি? নাকি মিসিং অব বেলি? নাকি অন্য কিছু?”
চিন্তাহরণবাবু ভেবেচিন্তে বললেন, “ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স অফ টাম্মি” লিখলে কেমন হয়?”
এইসব ভয়ানক ভয়ানক ভাবনায় সবাই যখন জেরবার, তখন সমাধানের উপায় বাতলালেন বড়োবাবু নিজেই। বললেন, “এক কাজ করুন। অভিযোগটা বরং আপনারা বাংলায় লিখুন।”
প্রস্তাবটা সবারই মনে ধরল। বিস্তর কাটাছেঁড়ার পর যে অভিযোগপত্রটা দাঁড়াল, সেটা এরকমঃ
প্রতি
মাননীয় ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক,
ভুঁড়েলবাটি থানা
ভুঁড়েলবাটি
বিষয়ঃ ভুঁড়ি চুরি
মহাশয়,
আমরা ভুঁড়েলবাটির শোকব্যাকুল জনগণ আপনার নিকট বিচারপ্রার্থী। যদি জিজ্ঞাসা করেন, শোক কেন, তাহার উত্তরে বলিতে হইবে যে আমরা, ভুঁড়েলবাটির বাসিন্দারা এক ভয়ানক সমস্যার সম্মুখীন। আমাদের বিখ্যাত বিখ্যাত ভুঁড়িগুলি আশ্চর্যজনকভাবে উধাও হইয়া যাইতেছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা সমীচীন যে খোওয়া যাওয়া ভুঁড়িগুলির সবকটিই ভুঁড়েলবাটির ঐতিহ্যশালী ভুঁড়ি অর্থাৎ হেরিটেজ ভুঁড়ি। এইসকল হেরিটেজ ভুঁড়ি চুরি করা যে সে চোরের কর্ম নহে। আমাদিগের অনুমান, প্রকৃতপক্ষে ভুঁড়িগুলি কোন দুষ্টচক্রের হাতে চুরি হইয়া যাইতেছে। বিদেশের বাজারে চড়া দামে বিক্রি হইলেও আশ্চর্যের কিছুই নাই। আমাদের ভুঁড়েলবাটির সমষ্টিগত সম্মান তথা আমাদের নিজ নিজ ব্যক্তিসম্মান পুনরুদ্ধারের স্বার্থে আপনাকে যথাযথ পদক্ষেপ করিতে অনুরোধ করা হইতেছে।
নমস্কারান্তে,
ভুঁড়েলবাটির হতভাগ্য ‘ভুঁড়িহীন’ জনগণ
থ মেরে যাওয়া দারোগাবাবুর হাতে অভিযোগপত্রটি ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলেন সবাই।
………০………
ক্রমশঃ……
(পরবর্তী সংখ্যার জন্য চোখ রাখুন www.utolodhara.com এ পরের শুক্রবারে)
আগের পর্ব গুলি দেখুন – ধারাবাহিক লিঙ্কে