তৃতীয় পর্ব
পয়মন্তর মনটা আজ একটু ভার ভার। উপস্থিত ক’দিন যাবত ভুঁড়েলবাটিতে তেমন কোন ঘটনাই নেই। পরীক্ষা-টরিক্ষাও শেষ হয়ে গিয়েছে, কেউ কোন শুভকাজে বেরোচ্ছে না। ছোটখাটো দুর্ঘটনাও ঘটছে না। কিন্তু এরকম চললে তারই বা চলে কি করে? মনটা তাই আজকাল তার খারাপ হয়েই আছে।
পয়মন্তর নামের একটা ইতিহাস আছে। সে যেবছর জন্মায়, সেবছর নাকি আমের রেকর্ড ফলন হয়েছিল, ধানের বিক্রিবাটা ব্যাপক হয়েছিল, আলুর সিজনে আলু নষ্ট হয়নি, আর তাদের বংশের ইতিহাসে কখনো যা ঘটেনি, তাই ঘটেছিল। তার জেঠুর মেয়ে বুঁচকিদি মাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছিল। তার ঠাকুমা বাড়িশুদ্ধু সকলকে ডেকে বলেছিলেন, “ওরে, এ যে সে ছেলে নয়। আমাদের বংশের গৌরব। ওকে ভালো করে যত্নআত্তি কর। ও পয়মন্ত ছেলে। ও আসায়, দেখেছিস, ঘরদোরের কেমন শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে, বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। ওলে আমাল পয়মন্ত সোনা”, বলেটলে তার গালে টকাস করে একটা চুমু খেয়েছিলেন তিনি।
ব্যস, সেই থেকে তার নাম হয়ে গেল পয়মন্ত। বয়স যত বাড়তে থাকল, তার সম্পর্কে নানারকম কথাও শোনা যেতে লাগল। তাকে দিয়ে একবার ছুঁয়ে নিলেই নাকি রোদ্দুরে শুকোতে দেওয়া বড়ি- আচারে কাকেরা পর্যন্ত মুখ দেয় না। ইন্টারভিউ দিতে যাবার আগে তার ছোঁয়া পেলে নাকি চাকরিলাভ অনিবার্য। দূরদেশে যাত্রার আগে তার সাথে দুটো কথা বলে গেলে কোন বিপদ আপদ ঘটে না। পরীক্ষার আগে একবার তার ছোঁয়া পেলে পাশ অবধারিত ইত্যাদি ইত্যাদি।
তা এসবের কল্যাণে পয়মন্তের বাড়িতে প্রায়ই বড়িটা-আচারটা, মিষ্টি- ফল প্রভৃতির আনাগোনা লেগেই থাকে। টাকাপয়সাও গুঁজে দেয় কেউ কেউ। কৃতজ্ঞতা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে।
সে যখন স্কুলে পড়ত, তখন পরীক্ষার দিন তো রীতিমতো হুড়োহুড়ি পড়ে যেত তাকে ঘিরে। সবাই তাকে একবারটি দেখতে চায়, একটু ছোঁয়া পেতে চায়। অবস্থা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছে গেলে একজন-দুজন শিক্ষক এসে পরিস্থিতি সামাল দিতেন। তবে কিনা তার ফাঁকে তাঁরাও একবার টুক করে ছুঁয়ে নিতেন পয়মন্তকে। এইসব করে করে আর ভক্তদের চাহিদা সামাল দিতে দিতে পয়মন্তের নিজেরই আর কোনদিন ভালো করে পরীক্ষা দেওয়া হল না।
যাইহোক, পরীক্ষায় যে সবাই পাশ করত, তা তো নয়। ফেলটুসরা ভাবত, পয়মন্ত নির্ঘাত তার দিকে ভালোভাবে তাকায়নি বা ভালোভাবে ছোঁয় নি। পাশকরারা ভাবত, ভাগ্যে পয়মন্ত আমার দিকে ভালো করে তাকিয়েছে বা স্পর্শ করেছে। মোটকথা, দুপক্ষই পরের বছর সিধের পরিমাণ বাড়িয়ে দিত।
এতসব সিধের দৌলতেই কিনা কে জানে, পয়মন্তের দিব্যি নাদুসনুদুস একখানা ভুঁড়ি গজিয়েছে। তাতে অবশ্য তার চেহারাখানা আরো খোলতাই হয়েছে। একটা গুরুজি-গুরুজি ভাব ফুটে উঠেছে সর্বাঙ্গে। বয়স্ক পুরুষ- মহিলারা তাতে আরো বেশি বেশি আপ্লুত হচ্ছেন। তার পুরোনো বন্ধুবান্ধবেরা যদিও মাঝেমধ্যে তাকে হালকা রসিকতার চালে ‘পয়ভুঁড়িবাবা’ বলে ডাকে, তবে সে ওসবে বিশেষ পাত্তা দেয় না। কে না জানে, গোলাপ ফুলকে চিরকালই কাঁটার বোঝা বইতে হয়!
কিন্তু গত কয়েকদিন ধরেই তার কাছে সেরকম লোকজন আসছে না। সেও তাই ভারি ঝিমিয়ে পড়েছে। হলটা কী? খোঁজ করতে করতে জানা গেল, ধুমনিবুড়ির ছাগল হারিয়েছিল দিনপনেরো আগে। পয়মন্তকে ছুঁয়ে যাবার পরও তার ছাগল মেলেনি। কানুজ্যাঠা তাঁর বাড়ির কাজ শুরু করেছিলেন তার ভুঁড়ি স্পর্শ করে। কিন্তু ছাদ ঢালাই অর্ধেকটা হবার পরই ছাদ ধসে পড়েছে। নিবারণ কোনার বিয়েবাড়ি খেতে যাবার আগে তার সাথে দেখা করে গিয়েছিল। গিয়ে জুটেছে, পচা রসগোল্লা আর টকগন্ধ দই।
এইসব কারণ অনেকেই মনে করছে, পয়মন্তের ফর্ম আর ঠিক আগের মতো যাচ্ছে না। ফলে সেও যথেষ্ট বিচলিত বোধ করছে ইদানীং। ইতস্ততঃ ছিটকে ছাটকে যাওয়া মনটাকে নিয়েই ঘরের মধ্যে থুম মেরে বসেছিল সে।
উতলা মনটায় নানারকম দুশ্চিন্তা ক্রমাগতঃ ধাক্কা মেরে যাচ্ছে। এরকম যদি বেশিদিন চলতে থাকে তাহলে তার হবেটা কী? সেই বাচ্চা বয়স থেকে নাগাড়ে শুনতে শুনতে তার নিজেরও বদ্ধমূল ধারণা জন্মে গেছে যে, তার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে পয়া হাওয়া বেরোয়। কিন্তু হালে যে কী ঘটছে, সেটা সে নিজেও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। ‘এই বেশ ভালো আছি’ ভেবে জীবিকার্জনের বিশেষ চেষ্টাপাতিও করেনি। অবশ্য জমিজমা আছে। কিন্তু সেসবের মধ্যে ঢোকার তাগিদও অনুভব করেনি সে কখনো। ধুমনিবুড়িকে সে হাত তুলে বেশ প্রাজ্ঞের ভঙ্গিতেই আশীর্বাদ করেছিল বলে মনে পড়ছে। দিনদুয়েকের মধ্যেই হারানো ছাগলের প্রাপ্তিযোগ আছে- এরকম আশ্বাসবাণীও দিয়েছিল বলেই স্মরণ হচ্ছে। তবে কানুজ্যাঠার আঙুলগুলো বোধহয় ঠিকঠাক তার ভুঁড়ি ছোঁয়নি। পুরো পাঁচ আঙুল ছুঁলে হয়তো ছাদটা ধসত না। আর নিবারণ কোনারের কেসটা…
ভাবনায় ছেদ পড়ল। মা ওদিকের ঘর থেকে হেঁকে উঠল, “পয়, ও পয়, এদিকে একটু আয় তো বাবা।”
কুয়াশা-জমা মন নিয়েই ভেতরের বারান্দায় এল সে। মা এক ধামা সিধে নামাচ্ছে। সামনে একটা সিড়িঙ্গে মত লোক দাঁড়িয়ে বিগলিত ভঙ্গিতে হাত কচলাচ্ছে। বেশ গ্রাম্ভারি চালে ভারিক্কি গলায় পয়মন্ত প্রশ্ন করল, “মা, কী ব্যাপার?”
“এই যে বাবা, উনি তোর চাড্ডি পায়ের ধুলো নিতে এসেছেন।”
“চাট্টি কেন, দশটি ধুলো নিলেও আমার আপত্তি নেই।”
পয়মন্তের কথা শুনে লোকটা “হেঁ হেঁ কত্তা, কী যে বলেন”, বলে সটান তার পা জড়িয়ে ধরে রইল অনেকক্ষণ। তারপর মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল। তারপর “এজ্ঞে কত্তা, আসি তাহলে” বলেটলে মাথায় হাতটা ধরে রেখেই বিদায় নিল।
তার গমনপথের দিকে হাঁ করে খানিক তাকিয়ে রইল পয়মন্ত। লোকটা যে কে, তাই বোধগম্য হচ্ছে না। “মা, লোকটা কে? ঠিক চিনতে পারলাম না।”, কিন্তু কিন্তু করে প্রশ্নটা করেই ফেলল সে।
মায়ের জিনিস গোছানো ততক্ষণে প্রায় শেষ। একগাল হেসে উত্তর দিলেন, “ভারি ভালো লোক , বাবা। এই দ্যাখ না, কতো ভালো ভালো সিধে পাঠিয়েছে। সব তোর পছন্দের জিনিস। মুড়কি, মোয়া, খাজা, গজা, খাঁটি ঘি। নলেন গুড়ের সন্দেশ, তালের পাটালি, তালশাঁস। ছানার পায়েসও দিয়েছে দেখছি। তুই দিব্যি আয়েস করে খেতে পারবি।”
“তা নাহয় হল”, পয়মন্ত হাঁক ছাড়ল, “কিন্তু বলি লোকটা কে?”
“অত তো আর জিজ্ঞেস করিনি, বাবা। ভাবলাম তুই চিনিস। তাছাড়া কত লোক কত সময় তোর কাছে কত ধরনের উপকার পেয়ে যাচ্ছে, তার কি ঠিকঠিকানা আছে? হবে তাদেরই একজন। তবে লোকটা ভাল। কত সুখদুঃখের কথা কইল। নে না বাবা, একটা পাটালি খা।”
পয়মন্ত বুঝল, মায়ের কাছে আর বেশি কিছু জানা যাবে না। অতএব সে, ভরপেট খেয়ে মুখটুখ ধুয়ে গদাইলস্করি চালে এসে দাঁড়াল তার ঘরের প্রমাণ সাইজের আয়নাটার সামনে।
এ কী? এ কাকে দেখছে সে আয়নায়? এটা সত্যিই সে তো? যদি সত্যিই সে হবে, তাহলে তার অত সাধের ভুঁড়িখানা গেল কোথায়?
চুপসে যাওয়া পেটের উপর হাত দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে মাটিতেই বসে পড়ল পয়মন্ত।
ক্রমশঃ……
(পরবর্তী সংখ্যার জন্য চোখ রাখুন www.utolodhara.com এ পরের শুক্রবারে)
আগের পর্ব গুলি দেখুন – ধারাবাহিক লিঙ্কে