দ্বিতীয় পর্ব
পুলিশবাবুর আজকাল ঘুম থেকে উঠতে বেশ একটু বেলাই হয়ে যাচ্ছে। সবাই তাঁকে ‘পুলিশবাবু’ বলে ডাকে ঠিকই, কিন্তু আদতে তিনি পুলিশ নন। আর তাঁর দুঃখটা ওখানেই। ছোটবেলা থেকেই তাঁর বাসনা ছিল পুলিশ হবার। বাচ্চাবেলায় তাঁর বন্ধুরা ‘বড় হয়ে কী হতে চাও’ প্রশ্নের উত্তরে যেখানে ‘ডাক্তার হব’, ‘ইঞ্জিনীয়ার হব’, বা ‘বিজ্ঞানী হব’, ‘শিক্ষক হব’ বা বড়োজোর ‘পাইলট হব’ বা ‘আই এ এস হব’ এসব বলত, সেখানে তাঁর একমাত্র উত্তর ছিল ‘পুলিশ হব’। শুনে গুরুজনেরা মুচকি হেসে বলতেন, ‘বাবা, পুলিশের মত পুলিশ হও, ভুঁড়ির মতো ভুঁড়ি বাগাও’।
তা সেই গুরুজনদের আশীর্বাদের অর্ধেকটা ফলেছে, বাকী অর্ধেকটা আর ফলেনি। তিনি পুলিশ হতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু দুর্দান্ত একখানা ভুঁড়ির মালিক হয়েছেন। দুর্ভাগ্য একটাই যে, বহু চেষ্টাচরিত্র করেও পুলিশের চাকরি আর তিনি জোটাতে পারলেন না। কোনবার দৌড়ে আটকালেন, কোনবার হাইজাম্প, লং জাম্পে। একবারই মাত্র তিনি ইন্টারভিউ অব্দি পৌঁছেছিলেন, কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারেননি।
মাঝখান থেকে তাঁর নিজের নামটাই হয়ে গেল ‘পুলিশ’। কচিকাঁচারা ডাকে ‘পুলিশকাকু’, তাঁর চাইতে বয়সে সামান্য ছোটরা ডাকে ‘পুলিশদা’, পাড়াতুতো বৌদিরা ‘পুলিশঠাকুরপো।’ এমনকি শ্বশুরবাড়িতে পর্যন্ত সবাই ‘পুলিশজামাই’ বলে ডাকে। তাঁর পিতৃদত্ত নাম যে পুলিন, সেকথা তাঁর নিজেরই মাঝেমধ্যে বিস্মরণ হয়ে যায় ইদানীং।
পুলিশে চাকরির যে কখনো কোন পরীক্ষা দিয়েছিলেন, সেটাই আজকাল পারতপক্ষে চেপে যেতে চান তিনি। ‘আমি পরীক্ষা দিলে পাশ করতাম না, এরকম আবার হয় নাকি’, ‘আমি পুলিশের চাকরিতে ঢুকলে আসলে অনেক পুলিশকেই চাকরি ছাড়তে হত কিনা, হেঁ হেঁ’ ইত্যাদি। একবারই পাশের গাঁয়ের নন্দলাল কাহার জোর চেপে ধরেছিল, “বললেই হল? আমার ছোটকাকার ছেলে নবু তোমার সাথেই পরীক্ষা দিয়েছিল। স্বচক্ষে দেখেছে সে তোমায়। তোমার পরেই তার রোল নাম্বার ছিল। আর তুমি দৌড়ের পরীক্ষায় সবার শেষে দৌড়েছিলে, সেটাও সে বলেছে।”
পুলিন তাতেও দমেনি, “আমিও শুনেছি ওকথা। আমার মতো দেখতে একজন নাকি পরীক্ষা দিচ্ছে। ভেবেছিলাম, একবার সাইকেলে চেপে গিয়ে দেখাসাক্ষাৎ সেরে আসব। কিন্তু সময়ের অভাবে আর হয়ে ওঠেনি।”
গাঁয়ের লোকেরাও এখন আর বিশেষ মাথা ঘামায়না ওসব নিয়ে। তাছাড়া তার বিষয়সম্পত্তিও প্রচুর। ফলে তাকে সবাই একটু সমীহই করে চলে। আর তাছাড়া কবে কোথায় কোন থানার পুলিশ প্রীতি ফুটবল ম্যাচ খেলল লোকাল ক্লাবের ছেলেদের সাথে, কবে রাখীপূর্ণিমায় স্কুলে স্কুলে রাখি পরাল, কোন থানার বড়োবাবু, মেজোবাবুর স্বভাবচরিত্র কেমন- এসবই তার নখদর্পণে।
তা সে যাই হোক, রোজ সকালে তার পুলিশভুঁড়িখানাকে নিয়ে সাইকেলে চেপে সে একবার মর্নিং সাইকেলে বেরোয়। কেউ জিজ্ঞেস করলে অত্যন্ত গম্ভীরভাবে বলে, ‘রাউণ্ডে বেরিয়েছি।’
আজও বেরিয়েছিল সে। চমৎকার সকাল। চারিদিকে নরম মিঠে রোদ হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে। দু-চারটে পাখিও শিস দিচ্ছে। মেজাজটা বেশ খুশ হয়ে গেল তার। গুনগুন করে দু-এক কলি গাইতে গাইতে সাইকেলে চেপে এগোচ্ছে। গুপ্তিপাড়ার সিংহদের বাড়ির পেয়ারাগাছে দুটো পেয়ারা পেকেছে, গতকালও কাঁচাই দেখেছিল। সরকারপাড়ার বেড়ালে আর কামারডাঙার কুকুরে জোর কাঁইকিচির লেগেছে। ওপাড়ার মিনি আর এপাড়ার গাবু মিশন স্কুলের রাস্তার পাশে বকুলগাছের তলায় গল্প করছে। নবু যথারীতি মার্বেল নিয়ে স্কুলমাঠে আপনমনে খেলছে- এসব পর্যবেক্ষণ করতে করতে আপনমনে এগোচ্ছিল পুলিন। সবে লিচুতলার মোড়ে পৌঁছেছে, উল্টোদিকে চোখে পড়ল দারোগাবাবুর গাড়ি। গাড়িটা ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল তার ঠিক সামনেই। আর সাথেসাথেই তিনজন পুলিশ নেমে সটান তার দিকেই এগিয়ে এল। সবার সামনে যিনি, রোগা লিকলিকে চেহারা। পুলিন অনুমান করল, ইনিই নতুন বড়োবাবু।
বড়োবাবু গটগট করে হেঁটে এসে থামলেন তারই সামনে। তাঁর পাশে থাকা বরেন ঘাড়টা তার দিকে হেলিয়ে বলল, “স্যার, ইনিই পুলিশবাবু।”
বড়োবাবু তার হাতটা ঝাঁকিয়ে দিতে দিতে সপ্রশংস চোখে তাকান, “সত্যিই পুলিশের মতো চেহারা। আপনি এ লাইনে এলে উন্নতি করতে পারতেন মশাই।”
বের হতে থাকা দীর্ঘশ্বাসটাকে কোঁত করে গিলে ফেলে পুলিন, “অন্য লোকের ভাত মারতে চাইনি বলেই আর ও লাইনে যাইনি। তা’ আপনিই বুঝি নতুন দারোগাবাবু?”
দারোগাবাবু আত্মপ্রসাদের হাসি হাসেন, “হ্যাঁ, এর আগে ছিলাম বীরভানপুরে। সবে কয়েকদিন হল এসেছি এখানে। আর আসা ইস্তকই সবারই কাছে আপনার নাম শুনছি। আপনিই নাকি এলাকার অলিখিত গার্জেন। রোজ ঘুরে ঘুরে টহল দেন। আর তাতেই নাকি এলাকায় অপরাধপ্রবণতা কম থাকে।”
পুলিন অপ্রস্তুতের হাসি হাসে। দারোগাবাবু আরো একবার তার হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলেন, “একদিন সময় নিয়ে থানায় আসুন। ভালো করে গল্পসল্প করা যাবে।”
লাল মোরামের ধুলো উড়িয়ে চলে যায় দারোগাবাবুর গাড়ি। মনভরা ঝিলিমিলি গান নিয়ে পুলিনও বাড়ির পথ ধরে। দারোগাবাবু আজ তার মনটা সত্যিই ভালো করে দিয়েছেন।
গুনগুন করে গান ভাঁজতে ভাঁজতে বাড়ি ঢুকছিল সে। সাইকেলটা সিঁড়ির নিচে ঢুকিয়ে বারান্দায় উঠতে উঠতে দ্যাখে, তার বৌ সীমা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। চোখাচোখি হতে বলে, “কী ব্যাপার, তোমায় আজ এত ঝরঝরে লাগছে?”
“সে লাগতেই পারে। মন ঝরঝরে থাকলে শরীরও ঝরঝরে থাকারই কথা”, এই বলে বেশ আয়েস করে ভুঁড়িতে হাত রাখতে গেল সে। কিন্তু হাতটা নির্মেদ পেটের ওপর দিয়ে সড়াক করে নেমে গেল।
আর্তনাদ করে ওঠে সে, “কী হল? কী হল? এটা কী হল?”
দৌড়ে এল সীমা, “ক্কী হয়েছে?”
কোনক্রমে সে শুধু বলতে পারে, “ভুঁড়ি! আমার ভুঁড়ি!”
সীমা বলে, “তাইতো! তোমার ভুঁড়িটাকে আজ সকালেও দেখেছিলাম। কোথায় গেল?”
পুলিন আর ভাবতে পারে না। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে থপ করে। তার ফোঁপানির আওয়াজ চাপা পড়ে যায় সীমার মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হি হি হাসির শব্দে।
ক্রমশঃ……
(পরবর্তী সংখ্যার জন্য চোখ রাখুন www.utolodhara.com এ পরের শুক্রবারে)
আগের পর্বে চোখ রাখার জন্য ক্লিক করুন – ধারাবাহিক লিঙ্কে