প্রথম পর্ব
আজকাল খুব ভুঁড়ি চুরি হচ্ছে চারদিকে। এই তো সেদিন, চিন্তাহরণবাবু বিকেলে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। বয়স প্রায় পঁয়ষট্টি হতে চলল। হরিপদ কোবরেজ বলেছে, রোজ বিকেলের দিকটায় একটু হাঁটাহাঁটি করতে। প্রেসার, সুগার আয়ত্তের মধ্যে থাকবে। তা তিনি সেজন্য রোজই বেলা পড়লে তাঁর ভুঁড়িটিকে নিয়ে একটু মাঠের দিকে হাওয়া খেতে যান। আরো লোকজন আসে, গল্পগাছা হয়। ছেলেছোকরারা মাঠে ফুটবল খেলে, মেয়েরা মাঠের একদিকে ক্যারাটে শেখে। খানিকক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন। নিয়মমতোই রোজ একবার সকলে তাঁর ভুঁড়ির তারিফ করে, তিনিও গর্বভরে মাথা দোলান। তা এদিনও সব ঠিকঠাকই চলছিল। ফুটবল ম্যাচ ছিল একটা। নতুন দারোগাবাবু প্রাইজ দিলেন, তাঁর সাথে করমর্দনও হল। খুশিমনেই বাড়ি ফিরলেন তিনি। ফেরার পথে শরীরটা বেশ হালকা লাগছিল, কিন্তু সেটাকে তখন বিশেষ পাত্তা দেননি। বাড়ি ফেরার পর দ্যাখেন, সবাই তাঁর দিকে কিরকম একটা দৃষ্টিতে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। বেজায় অদ্ভুত লাগছিল। কোথাও একটা কিছু গণ্ডগোল ঘটছে, কিন্তু সেটা কেউই যেন ঠিক ধরতে পারছে না। শেষমেষ যখন তাঁর ছোট নাতনি বুঁচকি হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠল, ‘কী মজা! কী মজা! দাদুর ভুঁড়ি ভাজা ভাজা!’ , তখন সবাই চমকে দেখে, তাইতো! চিন্তাহরণবাবুর ভুঁড়িটা নাইতো!
সাথে সাথেই তিনি একশ মিটার স্প্রিন্ট টানলেন আয়নার উদ্দেশে, আর নিজের প্রতিবিম্ব দেখে তাঁর চক্ষু চড়কগাছ! ভুঁড়িখানা সত্যিই গায়েব!
কীভাবে হল? কীভাবে হল? চিন্তায় চিন্তায় চিন্তাহরণবাবুর সারারাত ঘুমই হল না। ভোর হতে না হতেই ছুটলেন কোবরেজমশাইয়ের বাড়ি। কোবরেজমশাই তাঁকে দেখে একগাল হেসে বললেন, “কী ব্যাপার, চিন্তাহরণবাবু, হেঁটে হেঁটে ভুঁড়ি ঝরিয়ে ফেলেছেন যে? আমি আপনাকে কতদিন ধরেই বলছি। খুব ভালো, খুব ভালো। তা মুখচোখ অমন শুকনো যে?”
চিন্তাহরণবাবু কেঁদেই ফেলেন আর কী! কোনরকমে সামলে-সুমলে হাঁউমাঁউ করে বললেন, “না, না, কোবরেজমশাই, হাঁটাহাঁটি করে কমেনি। কাল হাঁটতে যাবার আগেও সব ঠিকঠাক ছিল। এমনকি, মাঠে সবাই প্রশংসাও করল। বেরিয়ে এসে দেখি, এই কাণ্ড!”
কোবরেজমশাই সান্ত্বনা দিলেন, “আহা! মনখারাপ কোরো না, চিন্তাহরণ! ওতে তোমার ভুঁড়ি আরো কমে যাবে। তবে যা হয়েছে, ভালোই হয়েছে। অতো বড়ো ভুঁড়ি থাকাটা কোন কাজের কথা না। এবার তোমার প্রেসার, সুগার সব কন্ট্রোলে থাকবে। যাও, বাড়ি ফিরে মাথা ঠাণ্ডা করে একঘুম দাও দেখি।”
ফোঁসফোঁস করে বারকতক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন চিন্তাহরণবাবু। ভুঁড়েলবাটির লোকজন তো এবারে তাঁকে দুয়ো দেবে। কিন্তু কিন্তু করে কবিরাজমশাইকে বলেও ফেললেন সেকথা।
চিন্তাহরণবাবুর চিন্তাটা অমূলক নয়। ভুঁড়েলবাটির এককালে নাম ছিল মহুলবাটি। কিন্তু বাসিন্দাদের ভুঁড়ির দাপটে সে নাম লোকজনের মুখে মুখে কবেই ভুঁড়েলবাটি হয়ে গেছে, কারুরই আর খেয়াল নেই। আশপাশের দশটা গ্রামগঞ্জের মানুষ ভুঁড়েলবাটির ভুঁড়িধারীদের রীতিমতো সমীহ করে। এমতাবস্থায় ভুঁড়ি খোওয়া যাওয়া মানে রীতিমত মানসম্মান নিয়ে টানাটানি।
কবিরাজমশাই দেখলেন, চিন্তাহরণবাবুকে বাড়ি পাঠানোটা আশু কর্তব্য। সান্ত্বনার সুরে বললেন, “আর ভেবো না, চিন্তাহরণ। এই গন্ধচূড় তেলটা দিচ্ছি, বাড়ি গিয়ে এটা মাথায় মেখে চানটান করে ভালো করে এক ঘুম দাও দিকিন।”
আরো একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভুঁড়ির কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ির পথ ধরলেন চিন্তাহরণবাবু।
ক্রমশঃ……
(পরবর্তী সংখ্যার জন্য চোখ রাখুন www.utolodhara.com এ পরের শুক্রবারে)