আস্তে, লেডিজ!

জলছবি

www.utoldhara.com

          পশ্চিমবঙ্গের কোন এক শহরের বুকে ছেলেদের স্কুলে ছুটি হয়েছে সবে। ছেলেরা বেরিয়ে আসছে দলে দলে। তিনটি ছেলেও বেরিয়ে এল সাইকেল নিয়ে। দুটি ছেলে লম্বা, তাদের সাইকেলও বড়ো। তৃতীয়জনও ছোটোখাটো, তার সাইকেলটিও তুলনায় খর্বকায়। সে সাইকেলে চাপার সময় অন্য দুজনের হো হো করে হাসি। “কেমন করে সাইকেল চালায় দ্যাখ। একদম মেয়েদের মতো।” অন্যজন তৎক্ষণাৎ সায় দিল, “লেডিজ!” যাকে উদ্দেশ্য করে বলা, তার মুখখানা নিমেষে কালো হয়ে গেল। আরও অপমানের হাত থেকে বাঁচতে পাঁইপাঁই করে চালিয়ে দিল সাইকেল। কে জানে, হয়তো ‘মেয়েদের’ মতো করেই। বাকি দুজনের হাসি তখন অপরাহ্ণবেলায় আছড়ে আছড়ে পড়ছে। দিনটা? ৮ই মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ২০১৯ সাল।

          সেই ছেলেটি সম্ভবতঃ ‘লেডিজ’ হবার এই অপমান সারাজীবন বয়ে বেড়াবে। শিক্ষাক্ষেত্রে, কর্মক্ষত্রে হয়তো যথেষ্ট যোগ্যতা অর্জন করবে, হবে সন্তানের পিতা- কিন্তু কোন এক নিদাঘবেলায় বন্ধুকণ্ঠে ‘লেডিজ’-এর মতো অপমানবাক্য শোনার যন্ত্রণা হয়তো ফালাফালা করে দেবে তার বসন্ত-বিকেল!

          সত্যিই তো, ‘মেয়ে’ হবার মতো অপমান আর হয় না কি? ছেলেরা কাঁদলে শুভার্থীদের তিরস্কার শোনে ‘মেয়েদের মত কাঁদছিস’ কিংবা ‘ছেলেদের কাঁদতে নেই’। পথে- ঘাটে, বাসে- ট্রামে, হাটে- বাজারে, শিক্ষিত পুরুষই হোক, অশিক্ষিত শ্রমজীবীই হোক বা অর্শিক্ষিত রাজনৈতিক কর্মীই হোক- এক কথা শুনতে পাওয়া যায়, ‘চুড়ি পরে কাজ করি না, বুঝলেন?’ অর্থাৎ, মেয়েদের মতো ঠুনকো বা পলকা নয়, রীতিমতো বলশালী পৌরুষের দাপট। এই পৌরুষের দাপটই চারিয়ে যায় সমাজে মেয়েদের প্রতি বিভিন্ন ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত অপমানে। মেয়েটি স্কুলের পরীক্ষায় প্রথম হলে ‘সেকেণ্ড বয়’কে অবধারিতভাবে শুনতে হয়- একটা মেয়ের কাছে হেরে গেলি? কিংবা, ‘ও মেয়ে হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তুই ছেলে হয়ে পারছিস না?’ ঠিকই তো, ছেলে হারবে ছেলের কাছে, তাতে কোন লজ্জা নেই। কিন্তু একটা মেয়ের কাছে পরাজয় যে বড়োই গ্লানির।

          এর বিপরীত দিকও আছে। কর্মকুশলতার নিরিখে এগিয়ে থাকা মেয়েটি প্রশংসাবাক্য শোনে, “আপনি মেয়ে হয়েও যেভাবে কাজ করেন’, কিংবা ‘উনি মহিলা হয়েও  এত দক্ষ’। অর্থাৎ, এমনটি তো হবার কথা ছিল না। দক্ষতা, কর্মকুশলতা ইত্যাদি প্রশংসার যোগ্য কথাগুলি তো পুরুষেরই একচেটিয়া- একজন মেয়েও সেখানে ভাগ বসাবে! ভারি আশ্চর্যের ব্যাপার তো! সমাজের মাথারা মাথা চুলকোতে বসেন। ‘রানী লক্ষ্মীবাঈ’ বা ‘ইন্দিরা গান্ধী’কে ‘পুরুষ’ বলে দাগানো হয়েছিল। অবশ্যই প্রশংসাচ্ছলে। কিন্তু সেটা কি আদৌ প্রশংসা নাকি সর্বকালীন নারীত্বের অপমান? কারণ, এই সব তথাকথিত ‘প্রশংসা’র আড়ালে লুকিয়ে থাকে অন্তর্নিহিত বার্তা- মেয়েরা তো এত ‘যোগ্য’ হবার যোগ্যই নয়, কর্মদক্ষতার অধিকার তো একমাত্র পুরুষেরই।      

          পঞ্চায়েত স্তরের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে, তাঁরা জানেন ‘মহিলা’ প্রধান ব্যাপারটি কিঞ্চিৎ গোলমেলে। দেশের নিয়মে পঞ্চায়েতের এক- তৃতীয়াংশ আসন মহিলা- সংরক্ষিত, ‘প্রধান’ পদও তার মধ্যেই পড়ে। সংরক্ষণের ফলে নারীর ক্ষমতায়ন কতটুকু হয়েছে সেটা পণ্ডিতদের বিচার্য বিষয়, কিন্তু গ্রামবাংলার কাজের খতিয়ানে কাজ না হবার কারণ হিসেবে অনেকক্ষেত্রেই ঢুকে পড়েছে ‘মহিলা।’ ‘প্রধান তো মহিলা, কী করে কাজ হবে?’ বাঁধা বুলি পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র। যেন, ‘মহিলা’ বলে তাঁর অদক্ষতা এমন সীমাহীন প্রশ্নাতীত যে পঞ্চায়েতের তাবৎ কর্মচারী, অন্যান্য জনপ্রতিনিধি মিলেও তা ঢাকা যায় না। একবার পঞ্চায়েতের এক পুরুষ উপপ্রধানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কাজ হয় না কেন? উত্তরে সেই বাঁধাধরা উত্তরই এসেছিল- ‘প্রধান তো মহিলা।’ পালটা প্রশ্ন করেছিলাম, – “এর আগে তো আপনাদের পুরুষ প্রধান ছিলেন, তখন নিশ্চয়ই আপনাদের সবকিছুই খুব দুর্দান্ত চলত। নিশ্চয়ই অসাধারণ সব কাজ হয়েছে! কোথাও নিশ্চয়ই কোন সমস্যা ছিল না।” উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটি এই কথার পর আর কথা বাড়াননি। ক্ষমা চেয়েছিলেন।

          দোষ হয়তো তাঁরও পুরোপুরি নয়। দোষ কিছুটা আমাদের এই সামাজিক মানসিকতার। ‘মহিলা’দের ঘাড়ে খুব সহজেই দোষ চাপানো যায় কিনা। আরও একটা কারণ আছে। গ্রাম বাংলায় শিক্ষিত মহিলা এখনো সবসময় সহজলভ্য নয়। বিশেষ করে যিনি পরিবারের অনুমোদন- সাপেক্ষে ভোটে লড়বেন। তার ফলে হয়তো শুধুমাত্র নাম সই করা বা অল্পশিক্ষিত বা সারাজীবন গৃহকর্ম করা চুপচাপ মেয়েটির ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে। যাতে হয়তো তাঁর নিজের মতামতের বিশেষ বালাইও থাকে না। এবং তারপর কর্মস্থলে গিয়ে ‘মহিলা’ তকমাকে সমুজ্জ্বল করে তোলেন।

          বিপরীত চিত্র নেই কি? আছে, অবশ্যই আছে। কিন্তু তাঁদেরও পদে পদে প্রমাণটা দিতে হয় যে মহিলা হয়েও তাঁরা ঠিকঠাক ‘মহিলা’ নন অর্থাৎ যে ‘মহিলা’র সঙ্গে বুদ্ধিহীনতা, কর্মহীনতা ইত্যাদি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

আসলে মাতৃমূর্তির উপাসনা বাঙালিজীবনের বহিরাবরণের অঙ্গ হয়েই থেকেছে, তার আন্তর- জীবনের সঙ্গে একীভূত হতে পারেনি একেবারেই। তার জন্যই সমাজ মাতৃমূর্তির পূজার্চনা করে, কিন্তু উপাসকের আসনে বসার অধিকার একমাত্র পুরুষেরই। সব ধর্মের ক্ষেত্রেই কম- বেশি সেই একই ব্যাপার। অবশ্য শুধু ধর্মই বা কেন, জীবনের সর্বত্রই তো একই জিনিস। এমনকি সৈন্যবাহিনীতে মেয়েদের উচ্চপদে আসীন হওয়া নিয়েও রাষ্ট্রের তরফে সেই বার্তাই আসে- সাধারণ সেনারা মেয়েদের উচ্চপদে দেখতে অভ্যস্ত নয়, অতএব… বাদ দাও মেয়েদের। উচ্চতম ন্যায়ালয়ের বিচারের বাণীটি এক্ষেত্রে বড়ো প্রাসঙ্গিক। 

          ‘দ্বন্দ্ব’ শব্দের দুটি অর্থ হয়- এক অর্থে দ্বৈরথ, অন্য অর্থে মিলন। ‘মেয়ে’ বলে বিদ্রূপের বিষ না ঝেড়ে নারী- পুরুষ হাতে হাত মিলিয়ে ঘরে- বাইরে সমানতালে কাজ করলে দেশ ও দশের কিঞ্চিৎ বেশি উপকার হয় না কি? সম্মানের যোগ্য তো সেই-ই, যে অন্যকে সম্মান করতে জানে। ফলে ‘মহিলা’ , ‘মেয়ে’, ‘চুড়ি পরা’ এ জাতীয় মন্তব্যগুলির বিরুদ্ধে একটু বেশি বেশি প্রতিবাদ ভেসে আসুক না। পুরুষ- মহিলা উভয় তরফেই। কে জানে, ‘মহিলা’রাও হয়তো তখন পুরুষদের একটু বেশি সম্মান করতে পারবেন!

……০……

Leave a comment

Check Also

Tagore কে আমি like করি

Tagore কে আমি like করি – মৌসুমী পাত্র

  হ্যাঁ, এটা ট্রু যে আমি টেগোরকে লাইক করি। আর করবো নাই বা কেন? এই …

শিল্পী- পুণ্যতোয়া

এত যুদ্ধ কেন ? – সুমেধা ভৌমিক

                              …

ঈশ্বরঃএজেন্ট ও মার্কেটিং

ঈশ্বরঃ এজেন্ট ও মার্কেটিং – সুদীপ্ত বিশ্বাস

    যে কোনও প্রোডাক্ট মার্কেটে বিক্রির জন্য ভালো মার্কেটিং এর জুড়ি নেই। মার্কেটিং ঠিকঠাক …

হেসে কেশে ভালোবেসে

হেসে কেশে ভালোবেসে- সোমক সেনগুপ্ত

    বড়, উন্নত শহর মানেই পেল্লাই সব বাড়ি। যেমন বই এর তাকে বই রাখা …