কম তো বয়স হল না স্বাধীনতার। ইংরেজ শাসন কি অবলুপ্ত, নাকি শেষ হয়েও হইল না শেষ? আমাদের চলনে- বলনে, আচার- আচরণে, বেশভূষায়, ভাষা- কথাবার্তায় ইংরেজের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের প্রমাণ প্রতি পদে দিয়ে চলেছি। সিম্পল লিভিং, হাই থিংকিং-র যুগ থেকে হাই লিভিং অ্যাণ্ড সিম্পল থিংকিং-র এক সর্বনাশা যুগে ক্রমশঃ প্রবেশ করছি আমরা। দাসত্ব জিনিসটা খারাপ, আরো বেশি খারাপ হল মন যখন স্বেচ্ছায় সেই দাসত্ব স্বীকার করে নেয়। ব্রিটিশ শাসনে বাঙালীর শৌর্যবীর্যের প্রচুর প্রমাণ যেমন বিদ্যমান, তেমনই বাঙালির পদলেহনের নমুনাও নিতান্ত কম নয়।
শিক্ষিত বাঙালি আজকাল সকালে ‘ব্রেড বাটার’ দিয়ে ‘ব্রেকফাস্ট’ সারে, লাঞ্চে রাইস-চিকেন হলে জমে যায়, বিকালে বার্গার- প্যাটিস- স্যাণ্ডুইচ না হলে রাতের ডিনারের অ্যাপেটাইটটাও ঠিক আসে না। ইংলিশ মিডিয়ামের বাঙালি দিদিমণিরা আর কিছু পারুন নাই পারুন, সদ্য বোল ফোটা বাচ্চাদের ‘থ্যাংক ইউ’ আর ‘সরি’ শেখাতে বদ্ধপরিকর। বোকার মত মনে প্রশ্ন জাগে, প্রবল জ্বরে বাচ্চার কপালে জলপট্টি দেওয়া বাঙালি মাকে বাচ্চা কখন ‘থ্যাংক ইউ’ দেবে? জ্বরের ঘোরেই বিড়বিড় করে নাকি সেরে গেলে? যতগুলো জলপট্টি ততগুলোই কি থ্যাংক ইউ দিতে হবে? এমনকি আমাদের অনেক স্কুলের পোশাকও সেই গলাবন্ধ, দমচাপা। ভারতের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশের পক্ষে যা একেবারেই অনুপযোগী। প্রবল গরমে কোট- প্যান্ট- টাই পরে গলদঘর্ম হয়ে ইন্টারভিউ দিতে ছোটে আমাদের স্বাধীন নাগরিকেরা। ময়ূরপুচ্ছধারী কাক হওয়াটা যেমন হাস্যকর, তেমনি কাকপুচ্ছধারী ময়ূর হওয়াটাও কাজের কথা নয়। রাশিয়া বা জার্মানদের জাত্যভিমানের কথা বাদই দিলাম, কিন্তু ঘরের পাশের ভুটানকে দেখেও তো শেখা যেত।
অথচ আমাদের সামনে সুযোগ ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী দশকগুলোতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যা কিছু ভালো, তার মেলবন্ধনে এক নতুন ভারত গড়ার। আমরা বেশি করে বিদেশের বাজে জিনিসগুলো অনুকরণ করেছি এবং হেলায় হারিয়েছি আমাদের নিজস্ব সম্পদ। তাগা- তাবিজ আমরা সযত্নে ধারণ করে রেখেছি, আবার ‘টাচ উড’ বলেও শিখেছি অবলীলাক্রমে। ফল, আমাদের আকাশে বিষ, খাবারে বিষ, মাটিতে বিষ। গ্রামীণ বাংলার স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতি আজ কার্যতঃ ধ্বংসপ্রাপ্ত। গ্রাম-বাংলার কামার-কুমোর-কলু-তাঁতি মোটামুটি মিউজিয়ামে যাবার পথে পা বাড়িয়েছে। একদিকে পারিবারিক জীবিকার উপর নির্ভরশীল মানুষগুলো যেমন বংশানুক্রমিকভাবে চলে আসা কাজে আগ্রহ হারিয়েছেন( আগ্রহ থাকলেও পেট চালানো মুশকিল), একই সঙ্গে চাপ বাড়ছে শহরগুলির ওপর।
বছরে দুটো দিন আমাদের দেশভক্তির জোয়ার ওঠে, তার বন্যায় হোয়াটসঅ্যাপ- ফেসবুকের কূল ভাসিয়ে ফোনের মেমরি উপচে পড়ে। আসল কথা, আমরা আমাদের দাস মনোবৃত্তির কাছে নিজেরাই গোহারান হেরে বসে আছি। আমাদের ভাষা, আমাদের খাদ্যাভ্যাস, দৈনন্দিন জীবনযাপনের ধরনধারণ যে কোন অংশেই হীন নয়, বরং অনেকাংশেই শ্রেয়- এই উপলব্ধিটুকু আসা একান্ত প্রয়োজন। বাংলা বাক্যের মধ্যে অকারণে যিনি যত বেশি ইংরেজি শব্দ গুঁজতে পারেন, তিনি তত বেশি ‘প্রেস্টিজ’ ‘এনজয়’ করেন। ‘ট্যাগোর’ ইংরেজিতে পড়লে অবশ্যই পাণ্ডিত্যের আরও ভারবৃদ্ধি হয়।
আজকাল আর একটা ফ্যাশন খুব দেখি চারদিকে। ‘আমি এটা করেছি’, ‘বাট’, ‘আমি ওটা করতে চাই।’ হঠাত করে ছুরির বাঁটের মত ‘বাট’ ঢুকল কেন, ভেবে ভেবে আকুল হতে হয়। ‘কিন্তু’ বেচারি নিশ্চয়ই খুব বড় কোন দোষ করে বসে আছে। কিন্তু সে বেচারিকে ফাঁসিকাঠে কেন যে ঝুলতে হোল, সেটা ভেবে ভেবে থল কূল পাইনা। অনেকে আবার পরম নিশ্চিন্তে অভয় প্রদান করেন, “ঠিক আছে, আমি অমুককে আস্ক করে নেবো।” এই আস্ক করাটাও ‘হোম টাস্কে’র মত বড় কঠিন লাগে।
পদে পদে যেচে এই যে পরাধীনতাকে বরণ- এ দেখলে লর্ড কার্জন বোধহয় আজ একটা তৃপ্তির শ্বাস ফেলতেন। আচার- আচরণে বেশভূষায় কে কত পাশ্চাত্যের কাছাকাছি যেতে পারি এবং তাই দেখিয়ে প্রাণপণে নিজেদের ‘আধুনিক’ প্রমাণ করার তাগিদে নিজেদের সবটুকু বিকিয়ে দিয়েই যেন আমাদের পরম আনন্দ। বাইরের জগতের আড়ম্বরপ্রিয়তা যত বাড়ছে আমাদের, পাল্লা দিয়ে কমছে আমাদের চিন্তাশীলতা। কোন বিষয় নিয়েই গভীরভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা এবং ধৈর্য দিনে দিনে কমছে আমাদের। অবশ্য, ফেসবুকে একটা ছবি দিলেই যদি লাইক এবং কমেন্টের বন্যায় ভেসে যাওয়া যায়, তাহলে সমাজ, বিজ্ঞান, দর্শন, গানবাজনা ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে গভীর গভীরতর ভাবনা বা আলোচনার সময় কোথায়?
ভারতীয় সংবিধানের কথা সামান্য বলি। ভারতীয় সংবিধানে কিন্তু ভারতের নাগরিকদের অধিকার, রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়ে সুনির্দিষ্ট বার্তা দেওয়া আছে, একইসঙ্গে নাগরিকদের তাদের পালনীয় কর্তব্যটুকুও স্মরণ করিয়ে দেওয়া আছে। আরো অনেক কিছুর সঙ্গে নাগরিককে মনে করিয়ে দেওয়া আছে তার সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য রক্ষা করার কর্তব্যটুকু। আমরা জানি না, জানার চেষ্টাটুকুও করি না। নিজেদের পল্লবগ্রাহিতায় আমরা নিজেরা এতই সন্তুষ্ট যে আর বেশি কিছুর দরকারই পড়ে না।
যাই হোক, এদেশের বুকে কেক- বার্গার- স্যাণ্ডুইচ করুণাধারায় নেমে এসেছে। ভরসা আছে, জাতীয় পতাকা উত্তোলনান্তে আধুনিক পোশাকে সজ্জিত বাঙালী সেসব গলাধঃকরণ করে শ্রাবণবেলার ছুটি উপভোগ করবে। দাসত্ব শৃংখল আর কেউ পরুক না পরুক, আমরা যে পরতে সদা প্রস্তুত।
আশায় আছি, ইংরেজ জাতি একদিন ভাত- মাছ খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলবে। ততদিন অব্দি অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় কি?
………০………