Home / গল্প / ঘুমন্ত ভালুকের কিংবদন্তি – নূপুর রায়চৌধুরী

ঘুমন্ত ভালুকের কিংবদন্তি – নূপুর রায়চৌধুরী

ঘুমন্ত ভালুকের কিংবদন্তী
ছবি সৌজন্যঃ গুঞ্জা

 

বহু বহু দিন আগে, সমুদ্রপথ যাত্রীদের নদ-নদী ও জল স্রোতের মধ্য দিয়ে শাল্তি করে পথবাহনের আগে, তীক্ষ্ণ, চকচকে কুড়াল দিয়ে শক্তিধর কাঠুরেদের বন পরিষ্কার করার আগে, কাঠের জাহাজ নাবিকদের বয়ে নিয়ে যাওয়ার আগে, এক বিপুল হ্রদের ধার ঘেঁষে একটা সুন্দর বন ছিল। আজ, আমরা সেই বনকে উইসকনসিনের অংশ হিসাবে জানি এবং শক্তিশালী হ্রদটিকে মিশিগান হ্রদ বলা হয়।

 

কিন্তু এই সময়টা ছিল অনেক আগে, যখন বহু জায়গার কোনো নামকরণই হয়নি বা জায়গাটা জনবিরল ছিল | এটা এমন একটা সময় ছিল যখন চাষিরা এবং রেডইন্ডিয়ানরা টানা নিটোল সারিতে চেরি এবং আপেল গাছ লাগায়নি। এটা এমন এক সময় ছিল যখন পথিকৃতেরা কুমড়ো, আলু এবং ভুট্টার রঙিন বাগান তখনও রোপণ করেনি ।

 

হ্রদের ধারের এই জঙ্গলে বাস করত মা ভালুক। তার গায়ের লোম ছিল অন্ধকার রাতের চেয়েও বেশি কালো, চোখ ছিল তার বড় বড়, গোলাকার । মা ভালুকের দুটো বাচ্চা ছিল, তুলতুলে নরম আর বেজায় হুল্লোড়ে। তারা তিনজন ব্লুবেল এবং বাটারকাপের মাঝে অবস্থিত ছোট, আরামদায়ক এক গুহায় একসাথে বসবাস করত।

রোজ সকালে, যখন জল-পিপির ঝাঁক মৃদু স্বরে পিপ-পিপ-পিপ গাইত, চিকাডিরা গাছ থেকে চিক-আ -ডি-ডি-ডি ক’রে ডাকত, তখন মা ভালুক আর তার বাচ্চারা বনের মধ্য দিয়ে বার্চ গাছের সারি-ঘেরা  জল-স্রোতের তীরে দুলকিচালে হেঁটে বেড়াত । হরিণগুলো তাদের ফিনফিনে ঘাড় আলতো করে বাঁকিয়ে ঠান্ডা জলে চুমুক দিত, রাকুনগুলো টুক ক’রে তাদের মুখ ধুয়ে নিত। মা ভালুক আর তার বাচ্চারা স্রোতের মধ্যে সাবধানে পা রাখত এবং ঝকঝকে, স্বচ্ছ, জলের স্রোত যখন তিরতির করে বয়ে যেত, মা ভালুক তখন তার বাচ্চাদের শেখাত কী ভবে সকালবেলার জলখাবারের জন্য নধর, রঙিন ট্রাউট মাছ ধরতে হয়।

 

তারপরে, তারা অলসভাবে তীরে বসে বসে, ব্লুবেরি আর হ্যাজেল নাট চিবোত।

 

প্রতি বিকেলে, মা ভালুক তার ছানাদেরকে বনের মধ্য দিয়ে পথ দেখিয়ে দেখিয়ে সুবিশাল হ্রদের ধারে নিয়ে যেত। এই হ্রদ এতটাই বড় ছিল যে তারা উল্টো দিকের পার দেখতেই পেত না, এবং তাদের মনে হতো জলরাশি যেন আকাশের মাঝেতেই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।

ভালুকরা বালুকাময় তীরে আনন্দে মেতে উঠত, অগভীর জলে নেমে জল ছোঁড়াছুড়ি করত, এবং হেরিং-খেকো শঙ্খচিলগুলোকে তাড়া করে বেড়াত। তারা একে অপরের ল্যাজ ধরে টানাটানি করত এবং ঠান্ডা জলে অনেকক্ষণ ধরে চান করত । প্রতি সন্ধ্যায়, মা ভাল্লুক তার শাবকদের তাদের উষ্ণ আরামদায়ক গুহায় ফিরিয়ে নিয়ে যেত, যেখানে সে তার বড় কালো থাবায় জড়িয়ে ধরে তাদেরকে আদর করত এবং যখন তারা ঘুমিয়ে পড়ত, তখন তাদেরকে সে আলতো ক’রে ধরে রাখত ।

 

একদিন সকালে, যখন তারা বার্চের সার দেওয়া জলস্রোতের পার ধ’রে ধ’রে হেলেদুলে ঘোরাফেরা করছিল, তখন একটা বিকট বজ্রপাত হল আর একটা তীক্ষ্ণ, হিসহিসে শব্দ উঠল!

ফট ফট! ফটাশ!

মা ভালুক তার পিছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বাতাসে নাক শুঁকল । একটা উজ্জ্বল কমলা ঝলকানি গাছগুলোর মধ্য দিয়ে জ্বলে উঠল, এবং কালো মেঘে আকাশ ভরে উঠল…

আগুন!

মা ভালুক ঝটিতে তার ছানাদের জল স্রোতের তীরে নিয়ে গেল, এবং সেটাকে অনুসরণ ক’রে শক্তিশালী হ্রদের তীরে পৌঁছে যেতে বাচ্চাদের নির্দেশ দিল । ভালুকেরা দ্রুত ছুট লাগল, হরিণেরা আগুপিছু লাফঝাঁপ মারতে লাগল এবং নেকড়েরা পাগলের মতো দৌড় লাগল । এমনকি তারা-ওয়ালা নাকের ছুঁচোগুলোও হাঁকপাঁক করে জঙ্গলের মেঝের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল ।

যখন তারা তীরে পৌঁছেছে, মা ভালুক তখন তার বাচ্চাদেরকে এক জায়গায় জড়ো করে চিৎকার করে বলল, ”বাচ্চারা, আমাদের যেতেই হবে! আমাদেরকে অবশ্যই এই শক্তিশালী হ্রদ সাঁতরে পার হতে হবে, আমার বাচ্চারা, আমি তোমাদের খুব ভালবাসি!”

তারা সকলে মিলে জলেতে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং সাঁতার কাটতে শুরু করল। হ্রদটা খুব খুব গভীর ছিল। জল ছিল হিমশীতল | ঢেউগুলো ছিল ইয়া ইয়া লম্বা আর বাতাস ছিল দুর্বার । তারা মরিয়া হয়ে দ্রুত জল কাটতে থাকল |

মা ভালুক অনুনয় করে, ”আমার বাছারা, তোমরা কি প্রতিজ্ঞা করবে যে তোমরা তোমাদের সর্বশক্তি দিয়ে সাঁতার কাটবে? যদি আমরা অন্য প্রান্তে পৌঁছতে চাই তবে আমাদের অবশ্যই সারা রাত ধরে সাঁতার কাটতে হবে!” বিশ্বস্ত শাবকগুলি তাদের মাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, তারা তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে সাঁতার কাটবে।

তারা সাঁতার কেটে চলল আর সাঁতার কেটে চলল, আস্তে আস্তে তারা পরিশ্রান্ত ও ক্লান্ত হয়ে পড়ল । দ্বিপ্রহরের সূর্য যখন বড় আর গরম হয়ে উঠল, তারা তখনও সাঁতার কাটছিল। যখন সূর্য দিগন্তের নীচে চলে গেল, আর বাতাস ঠান্ডা হয়ে এল, তখনও তারা সাঁতার কেটে চলেছিল ।

 

ওদিকে যখন তারা সাঁতার কাটছিল, মা ভালুক বারে বারে তার বড়, কালো মুখ ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল যে তার বাচ্চারা যেন খুব বেশি পিছনে পড়ে না থাকে। যখন বাচ্চাদের থাবাগুলো জলের সাথে পাঞ্জা লড়ছিল, সে তা লক্ষ করছিল । শক্তিশালী হ্রদের ঢেউয়ের ফাঁকে ফাঁকে যখন তাদের নরম গোলাকার মুখগুলো ছোট থেকে ছোট হতে লাগল, মা ভালুক তখন চিন্তিত হয়ে উঠল ।

শীঘ্রই, রাত্রি নেমে এল । আকাশ অন্ধকার হয়ে গেল, তারারা জ্বলতে লাগল। হঠাৎ, মনে হলো বাতাস যেন কেমন শান্ত হয়ে গেছে, জল হয়ে উঠেছে খুব স্থির । দূর থেকে, মা ভালুক কালপেঁচার কাঁপাকাঁপা চিৎকার এবং জঙ্গুলে নেকড়েদের হুঙ্কার শুনতে পেল।

সারা রাত সাঁতার কাটতে কাটতে মা ভালুক সমানে পিছনে ফিরে তাকাচ্ছিল । ক্লান্ত চোখে, সে একসময় লক্ষ্য করল ভোরের সূর্য উঠতে শুরু করেছে, গভীর নীল জলের উপর তার উজ্জ্বল রশ্মি এসে পড়ছে।

সে আরও একবার পিছন ফিরে তাকাল কিন্তু তার বাচ্চাদের সে দেখতে পেল না।

মা ভালুক তীরে এসে এক্কেবারে নেতিয়ে পড়ল । তার ভেজা, ভারী থাবাগুলো গভীর বালিতে ডুবে গেল । সে দেখল তার চারপাশে ঘোরানো ঘোরানো পাহাড় আর বালির বিশাল বিশাল ঢিবি, জায়গাটাকে খুব অদ্ভুত বলে মনে হচ্ছিল।

মা ভালুক জলের ধার ধ’রে ধ’রে দ্রুত পায়ে আগুপিছু করতে লাগল, কিন্তু তার বাচ্চাদের কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। সকালের নবীন সূর্যের আলোয় তার ভেজা লোমগুলো চকমকিয়ে উঠল, আর তার চোখে কান্না চকচক করতে লাগল।

মা ভালুক কেঁদে উঠল,

‘’আমার বাচ্চারা, তোমরা কি আসছ?

তোমরা শক্তিশালী, আর তোমরা চতুর!

আমার বাচ্চারা, তোমরা কি শুনতে পাচ্ছ?

আমি তোমাদের জন্য চিরকাল অপেক্ষা করব।”

মা ভালুক সব থেকে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেল। সে অন্ধকার, গভীর জলের দিকে তাকিয়ে রইল, কিন্তু তার বাচ্চাদের কোন চিহ্ন দেখতে পেল না।

সারাদিন ধরে মা ভালুক ডেকে চলল, –

“আমার বাচ্চারা, তোমরা কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

আমি জানি তোমরা নিশ্চয়ই কাছাকাছি রয়েছ!

আমার বাচ্চারা, আমি অপেক্ষা করছি,

এখানে এই উঁচুতে অপেক্ষা করছি।”

 

সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত মা ভালুক অপেক্ষা করল, আরেকটা রাত নেমে এল। সে অপেক্ষা করতে থাকল, সকালের সূর্য আবারও উঠল ।

সে অপেক্ষা ক’রে চলল, তার চারপাশ জুড়ে বুনো গোলাপী গোলাপ ফুটে উঠল, বাচ্চা সাদা গলাওয়ালা চড়ুইগুলো কীভাবে উড়তে হয় তা শিখে গেল। সে অপেক্ষা করতে থাকল, দেখতে দেখতে দূরের টিলার ঘাসগুলো হলদেটে আর নিস্তেজ হয়ে এল ।

মা ভালুক অপেক্ষা করতে থাকল, বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে এল; ঘন, কালো শীতের মেঘ থেকে বেরিয়ে এসে তুষার কণারা ভেসে বেড়াতে থাকল। সে অপেক্ষা করে চলল, আরও অপেক্ষা করে চলল। মা ভালুক অপেক্ষা করে থাকল, কিন্তু তার বাচ্চারা কোনোদিনই তীরে এসে পৌঁছাল না ।

পাহাড়ের উঁচু উপরে, মা ভালুক বুকে দুঃখ নিয়ে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ল । বছর কেটে গেল, এবং মিশিগান হ্রদের বাতাস তার শরীরের উপর বালির চাদর বিছিয়ে দিল, তাকে তার ঘুমের মধ্যে উষ্ণ এবং নিরাপদ রাখল।

সময়ের সাথে সাথে, জায়গাটার মহান আত্মা তার দুঃখ অনুভব করতে পারলেন, সন্তানদের প্রতি তার উত্সর্গ এবং ভালবাসাকে তিনি স্বীকৃতি দিলেন। একটা প্রচন্ড দমকা হাওয়ার সাথে, তিনি বাচ্চাদেরকে তীরের কাছে নিয়ে আসলেন, দুটো দুর্দান্ত দ্বীপ হিসাবে তাদেরকে জল থেকে তুলে এনে, চিরকালের জন্য মা ভালুকের সতর্ক ও যত্নশীল চোখের সামনে তাদেরকে স্থাপন করলেন ।

বাচ্চারা এখন উত্তর এবং দক্ষিণ ম্যানিটু দ্বীপ হিসাবে সময়ের কোলে স্থির হয়ে আছে।

মায়ের কাছে আবারও থাকতে পেয়ে খুশি হয়ে তারা তাদের মায়ের ভালবাসার চেতনায় বিশ্রাম নিচ্ছে; জলের ধারে চকচকে বালির দুটো দ্বীপ, সূর্যের আলোতে তারা ঝকঝক করে ও নেচে ওঠে ।

অবশেষে এখন, মা ভাল্লুক খুব সুখের সাথে বিশ্রাম নিতে পারছে, সে জানে যে তার বাচ্চারা তার কাছেই রয়েছে। এবং আজ, যখন পৃথিবী শান্ত এবং সূর্য অস্তমিত হতে শুরু করেছে, মিশিগান হ্রদের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসে তুমি এখনও তার কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি শুনতে পাবে ।

 

‘’আমার বাচ্চারা, অনেক বছর পার হয়ে যেতে পারে,

এবং আমাদের হাতের ফাঁক দিয়ে সময় পিছলে যেতে পারে,

কিন্তু আমার ভালবাসা তীরের কাছাকাছি থাকবে

এবং বয়ে যাওয়া বালির মধ্যে থাকবে |

আমি বাতাসে করে তোমাদের চুম্বন পাঠাব

তোমাদের জানাতে যে আমি এখানেই আছি,

জলের কিনারায় আমি ঘুমাচ্ছি,

আমি সবসময় কাছাকাছি রয়েছি |

আমার বাচ্চারা, তোমরা নিশ্চিন্ত থেকো,

আমরা এখন একসাথে রয়েছি,

আমি তোমাদের উপর নজর রাখছি,

এবং চিরকাল তোমাদেরকে ভালোবেসে যাব।’’

……০……

 

Leave a comment

Check Also

স্বীকারোক্তি

স্বীকারোক্তি- ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য্য

    আজই ফোনটা ডেলিভারি দিয়ে গেলো। অনলাইনে একবার দেখেই ভারি পছন্দ হয়ে গেছিল সমীর …

দর্পণে

দর্পণে – নির্মাল্য ঘরামী    

    -চল, আমি জোরের সঙ্গে বললাম, -ওসব একদম ভাবিস না। তোকে এতদিন পরে পাচ্ছি, …

ফয়সালা

ফয়সালা – নির্মাল্য ঘরামী

  -দেখুন স্যার। বলে সিকিউরিটি গার্ডটি বিজয়ীর দৃষ্টিতে মহাকুলসাহেবের দিকে তাকালো। তার হাতে ধরা ব্যাগটির …

রক্তগোলাপ/ মৌসুমী পাত্র/ পুণ্যতোয়া ধর

রক্তগোলাপ – মৌসুমী পাত্র

  একটা মোটা দড়ি থেকে পাশাপাশি ঝোলানো সারি সারি মৃতদেহ। ছাল ছাড়ানো। গত কদিন ধরেই …