আজকাল এই একটা কঠিন রোগ হয়েছে আমার। বলা নেই, কওয়া নেই, পটাং পটাং মুখ দিয়ে সত্যি কথা বেরিয়ে যায়। আর তার জন্য ভারি মুশকিলে পড়তে হচ্ছে প্রায়ই। কে না জানে, সদা সত্য কথা বলিও না!
এই তো সেদিন, দুপুরবেলা বাড়ির সবাই ঘুমোচ্ছিল। ফ্রিজে ল্যাংচা ছিলো খানকয়েক। খোদ শক্তিগড়ের। এরকম পরিস্থিতিতে বুদ্ধিমান লোক মাত্রেই যা করা উচিত, আমিও তাই করলাম। বেশি না, মাত্র দুখানা। কিন্তু ওই যে বলে, আত্মঘাতী গোল! আমারো তাই হল।
বিকেলে মা ফ্রিজ খুলেই আর্তনাদ করে উঠল, “ল্যাংচা দুখানা কম কেন?”
তারপরই সটান আমার ঘরে, “গুলে, তুই খেয়েছিস?”
আমি না শোনার ভান করে অঙ্কখাতার দিকে মাথাটা আরো ঝুলিয়ে দিলাম ইঞ্চিখানিক।
মা আবার হাঁকড়াল, “গুলে, শুনতে পাচ্ছিস না?”
বদ্ধ কালা না হলে এমতাবস্থায় যে কেউ শুনতে পায়। কিন্তু নেহাত আমার শিরে সংক্রান্তি! তাই না শোনাই সাব্যস্ত করলাম।
কিন্তু মাকেও মোটামুটি রবার্ট ব্রুসের ভাবশিষ্য বলা চলে। গলার শিরটির ফুলিয়ে চেঁচাল, “গুলে! ল্যাংচাগুলো কে খেয়েছে?”
ভাবখানা দ্যাখো! যেন জেনারেল নলেজের দিদিমণি শুধোচ্ছেন, ‘এভারেস্টে কে প্রথম চড়েছে?’! শুনলেই মেজাজ চড়ে যায়। বাধ্য হয়ে মাথা তুললাম, “অতো চেঁচাচ্ছ কেন?”
মুশকিলটা হল, মা আবার পুলিশে চাকরি করে। জেরার ব্যাপারটা দিব্যি ভালো বোঝে। ঠাণ্ডা চোখে আমার দিকে তাকাল, “ল্যাংচা দুটো তাহলে তুইই খেয়েছিস?”
মাথার ভেতরে কিরকম জানি তালগোল পাকিয়ে সটান বলে ফেললাম, “খেয়েছি তো খেয়েছি। বেশ করেছি। তাই নিয়ে অত বাড়ি মাথায় করার কী হয়েছে?”
আর সাথেসাথেই পুলিশি হাত এগিয়ে এসে আমার কান ধরল। “চল, তোকে আমি আজ পুলিশেই দেব”, রাগের চোটে বেদম চেঁচাচ্ছে মা।
ততক্ষণে আমিও বুঝতে পেরেছি ঐতিহাসিক ভুল করে ফেলেছি। যথাসাধ্য ড্যামেজ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলাম, “কত দাম হবে তোমার ঐ ল্যাংচা দুটোর? খুব বেশি হলে দশ দশ কুড়ি টাকা। ও আমি তোমাকে যেভাবে হোক, ফেরত দিয়ে দেব।”
ফল হল উল্টো। কর্ণের আকর্ষণ প্রবলতর হল, “হতভাগা! একটু পরেই জয়িতামাসীরা চার পাঁচজন আসবে। তাদের কি আমি প্লেটে তোর ঐ কুড়ি টাকা সাজিয়ে দেবো?”
শুনেটুনে আমি ভেবলে গিয়ে মাথাকান ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে দার্শনিকের মতোই মন্তব্য করে বসলাম, “বিষয়টা ভাবার মতো।”
ব্যস, ঐ হল কাল। ভালো কথা কোনকালেই বা মায়েদের সহ্য হয়? বিষয়টা আরো কতদূর গড়াত জানি না, কিন্তু তার আগেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। জয়িতামাসীরা এসে গেছে! আমিও যঃ পলায়তি স জীবতি অবলম্বন করলাম। ল্যাংচার ঘাটতি মা কী করে পূরণ করেছিল, জিজ্ঞেস করতে আর সাহসে কুলোয়নি।
পরের দিন স্কুলে গিয়ে টিফিন টাইমে ধরলাম ঈশানীকে। সব স্কুলে সব ক্লাসেই মোটামুটি এক বা একাধিক বিজ্ঞজন থাকে, বিপদে আপদে লোকে যার পরামর্শের ওপর নির্ভর করে। ঈশানী আমাদের ক্লাসের সেই পরামর্শদাতা। সে কিন্তু আমার সমস্যাটাকে আমলই দিল না। বলল, “তোর তাও অল্পের ওপর দিয়ে গেছে। ফুটকির সেদিন কী হয়েছে জানিস? বেচারি তো এমনিতেই নাটক নাটক করে পাগল। তা সেদিন একটা দুর্দান্ত নাটক নাকি এসেছিল রবীন্দ্র সদনে। আর টাইমটাও ফুটকির অঙ্ক প্রাইভেটের সাথে দুর্দান্ত ম্যাচ করে গেছে। তা বুঝলি তো, ফুটকি যথারীতি তার কর্তব্যপালন করেছে। তারপরে শোন, বাড়ি ফিরে যেই না সাইকেলটা ঘরে ঢুকিয়েছে, কাকীমা দাবড়েছেন, “ফুটকি, আজকাল সারাদিন খালি তোর টই টই। কতটুকু পড়াশুনো করিস সারাদিনে?” আর ফুটকিকে তো জানিসই। সে সাথে সাথে কাঁধের ব্যাগ খুলে একটা খাতা বের করতে করতে বলে, “কেন? এইমাত্র গোপালস্যারের কাছ থেকে কতো অঙ্ক করে ফিরলাম!”
আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুধোলাম, “তারপর?”
ঈশানী হাসল, সবজান্তার হাসি, “তারপর আর কী? খুলে দেখে ওটা বায়োলজির খাতা।”
আমি প্রায় বেঞ্চ থেকে পড়েই যাচ্ছিলাম আর কী! কোনমতে সামলালাম। আমার অবস্থা দেখে ঈশানীর বোধহয় করুণা হল, “তাহলেই বুঝে দ্যাখ! তোর কেস তো অতদূর যায়নি।”
আমি খাবি খেয়ে শুধোলাম, “তারপরে ফুটকির কী হল?”
“কী হল, আমি আর জিজ্ঞেস করিনি। তুই ওর জায়গায় থাকলে কী হত ভেবে নে। তাহলেই বুঝতে পারবি।”
এবারে আমার গলা দিয়ে চিঁ চিঁ-র বেশি কিছু বেরোলো না, “ওকে কী প্রেসক্রিপশন দিলি?”
ঈশানী হাসল, বিজ্ঞের হাসি, “কী আর দেব? বললাম, সব ভুলে এখন তেড়েফুঁড়ে পড়াশুনো করতে থাক। আর টিউশন ভুলেও কামাই মারবি না। হাফ-ইয়ারলিতে ভালো রেজাল্ট করলে দেখবি তোর অবস্থার উন্নতি ঘটেছে।”
আশার আলো দেখতে পেলাম, “আমাকে কি সাজেশান দিবি?”
“তোকে? তুই তো জন্ম-হ্যাংলা। নোলাটা কন্ট্রোল কর। আর হ্যাঁ, কথা বলার সময় ভেবেচিন্তে বলিস।”
বলেটলে আমার মাথায় একটা গাঁট্টা মেরে কোনদিকে যে হাওয়া হয়ে গেল, আর পাত্তাই পেলাম না।”
ঈশানীর পরামর্শ মতোই চলার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ওই যে বলে, ভবি ভুলবার নয়। আমারো তাই হল। সেদিন রাতে পড়ার বইয়ের মধ্যে সযতনে একখানা গল্পের বই নিয়ে প্রেমসে পড়ছিলাম। দুর্দান্ত দুশমন কালাকান্তকে গোয়েন্দা বটকৃষ্ণ প্রায় পেড়ে ফেলেছে, এমন সময় পাশের ঘর থেকে বাবা ডেকেছে, “গুলে!”
আমি তখন গল্পে পুরো ডুবে। কালাকান্ত হাঁসফাঁস করছে, আর সেই মুহূর্তেই একটা হুলো বেড়াল ঝাঁপ দিয়েছে বটকৃষ্ণের ওপর। ফলতঃ বাবার কথায় আমার জিভ প্রত্যুত্তর করল, “হ্যাঁ, হুলো।”
বাবা কী বুঝল জানি না, আবার জিজ্ঞেস করল, “হরেকৃষ্ণ ঘোষ আর রমাকান্ত পোদ্দারের ‘বাংলার ইতিহাস’ পড়লি?’’
আমি আধো গল্পে আধো জাগরণে উত্তর দিলাম, “বটকৃষ্ণ-কালাকান্ত উপাখ্যানই পড়ছি।”
তারপর কী হল, আমার এখনো ধাঁধার মতো লাগে। কালাকান্তের হাতে হাতকড়া পড়তে যাবে, এমতসময়ে আমার কানেই যেন তালা লাগল। বজ্রগর্জনের সঙ্গে সঙ্গেই যেন বইখানা নিমেষে শূন্যে উঠে গেল।
আমার তখনো ঘোর কাটেনি। চেঁচিয়ে উঠলাম, “স্টপ ইট, কালাকান্ত।”
কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, কর্ণ পার্শ্বে যেন দৈত্যবাণী হল, “কালাকান্ত নয়, কালাকান্দ! হতভাগা, তোকে আজ আমি পিটিয়ে কালাকান্দই বানাবো।”
ঈশানী শুনে বলল, “আসলে তুই তো পোড় খাওয়া অপরাধী নোস। অপরাধপ্রবণতাও তোর মধ্যে নেই। তাই তুই সত্যিটা গোপন করতে পারছিস না। অবশ্য তোর কাজগুলোকে ঠিক অপরাধও বলা চলে না। তবে কিনা, এইসব অপকর্ম তোর নিজের জন্যই খারাপ।”
এত জ্ঞান আর কাঁহাতক সহ্য হয়? গম্ভীরমুখে বললাম, “ছেঁদো কথা ছেড়ে বল, এখন আমার কী করণীয়?”
ঈশানীর জামায় কোত্থেকে একটা পাখির পালক এসে পড়েছিল। হাতের টুসকিতে সেটা ফেলতে ফেলতে বলল, “তাহলে আমার মতামতটা শোন। ওইসব ফালতু গপ্পের বই পড়ে সময় নষ্ট না করে ভালো সাহিত্য পড়তে পারতিস না?”
বেরসিক কি আর গাছে ফলে? চটেমটে বললাম, “তুই সাহিত্যের কী বুঝিস র্যা? পড়িস তো ছাইপাঁশ খানকতক ইংরেজি জার্নাল। সাহিত্যের বুঝিস কিছু?”
বলেটলে ঈশানীর মাথায় আগের দিনের গাঁট্টাটার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া দিয়ে কেটে পড়লাম।
কিন্তু এদিকে আমার সমস্যার সমাধান হয় কী করে? ঈশানীর সঙ্গে স্কুলে আরো দু-চার বার কথা বলার চেষ্টা করলাম বটে, কিন্তু সে আমাকে দেখলেই মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। এদিকে আমার সমস্যা কমার বদলে বারবার বেড়েই চলেছে। ভূগোলের দিদিমণি সেদিন ক্লাসে পড়ানোর সময় ভারতের ম্যাপ আঁকছিলেন। কিন্তু তাঁর অপরূপ অঙ্কনশৈলীতে সেটা মোটামুটি একটা ল্যাংড়া আমের আকার নিল। কিংবা বড়োজোর ভদ্রতা করে সেটাকে একটা কাকতাড়ুয়ার সাথে তুলনা করা যেতে পারে! সবাই খিকখিক করে হাসছিল। তবে আমার হাসিটা বোধহয় কিঞ্চিৎ বেশি ডেসিবেলে হয়ে থাকবে। কারণ উনি সটান আমাদের বেঞ্চের দিকে তাকিয়ে তড়পালেন, “এই, কে, কে হাসছে ওখানে?”
আমার মাথার ভেতরে যথারীতি কিসব যেন ঘুরপাক খেতে থাকল, এবং সটান উঠে কান এঁটো করে হাসলাম, “এই যে, আমি।”
যে ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছি, হলফ করে বলতে পারি, জর্জ ওয়াশিংটনও লজ্জা পেতেন।
দিদিমণি বোধহয় এরকম সদুত্তর আশা করেননি। কিরকম একটা ঘোরের মধ্যে থেকে পুনরায় পুছিলেন, “তুমি? তুমি হাসছিলে?”এমনভাবে বললেন যেন বলতে চাইছেন, “ব্রুটাস, দাউ টু?”
আমি ঘাবড়ালাম না। সবিনয়ে নিবেদন করলাম, “বেশি জোরের হাসিটা আমার।”
দিদিমণি এবারে যেভাবে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালেন, তাতে ওনাকেই একটা জ্বলজ্যান্ত ভারতের ম্যাপ বলে মনে হচ্ছে আমার। “বটে? আর কারা কারা আস্তে হেসেছিল?”
গত অ্যানুয়ালে প্রশ্ন এসেছিল, আকবর সম্পর্কে যাহা জান লিখ। প্রশ্নটা সেই ধাঁচেরই বলে মনে হচ্ছে। এসব উত্তর আমি খুব ভালো পারি। তাও একবার যাচাই করে নিলাম, “বলি তাহলে? বলব?”
এদিক ওদিক থেকে দেখি সবাই ঠোঁটে তর্জনী ঠেকিয়ে ইশারায় নিষেধ করছে, এমনকি ঈশানীও। কিন্তু আমি এদিকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যুধিষ্ঠিরকে, হাতছানি দিয়ে ডাকছেন। কী করি? মহা দোটানা।
দিদিমণি আবার হুংকার দিলেন, “কী হলো, বলো।”
বাধ্য হয়ে ওনাকেই শুধোলাম, “কিন্তু ওরা যে বারণ করছে?”
উনি এগিয়ে এসেছেন আমার কাছে, “ওরা কারা?”
“ওই যে যারা আস্তে হেসেছিল”, মরীয়া হয়ে বলে ফেলি।
“সেই নামগুলোই তো জানতে চাইছি। তাড়াতাড়ি বল্। আমার আবার দেরি একদম সহ্য হয় না।”
ক্লাস ভর্তি প্রবল ফিসফাস আর ইশারার প্রবল ভ্রূকুটি। কিন্তু আমাকে তখন সত্যি কথায় পেয়েছে। ফলে হাসি সংক্রান্ত যাহা জানি বলতে শুরু করলাম।
শিরে বজ্রাঘাত টের পেলাম ছুটির ঠিক পরেই। ক্লাসশুদ্ধু ছেলেমেয়ে যাকে বলে চূড়ান্ত ল্যাজেগোবরে করে ছাড়ল। যদিও আমার লেজ নেই এবং কস্মিনকালে গোবর উৎপন্ন করিনি, তবুও। সত্যি কথার উপকারিতা সম্পর্কে একটা নাতিদীর্ঘ ভাষণ দেবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কেউ কোন কথাই কানে তুলল না। মীরজাফর, বিভীষণ যে যা পারে বলল। সিরাজদ্দৌল্লা বা রাবণও যে রোল মডেল হিসেবে আহামরি কিছু নয়, সেটা ওদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু ওদের এসব ভালো কথা সহ্য হলে তো?
এতোই অপমানিত হলাম যে আর কহতব্য নয়। ঘরে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে জামাকাপড় বদলে সাইকেল নিয়ে সোজা বেরিয়ে পড়লাম। আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ব। কিন্তু যাবোটা কোথায়? ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছি, হেনকালে কলেজ মোড়ের কাছে এসে আচমকাই একটা হোর্ডিং চোখে একদম সূচের মতো বিঁধল। রোজই দেখি, কিন্তু খেয়াল করিনি। জ্বলজ্বল করছে বিজ্ঞাপন, ‘যেকোন সমস্যার সমাধানে চলে আসুন পণ্ডিত সত্যানন্দ শাস্তির কাছে।’ পাশে ‘শাস্তিজী’র ছবি, চুল-দাড়ি-গোঁফ-জটাজূটে ঢাকা চেহারা। দেখলেই মনে হয়, পারিলে ইনিই পারিবেন!
এই তো পেয়েছি! উল্লাসের চোটে সাইকেল থেকে পড়েই যাচ্ছিলাম আর কী! একজন বয়স্ক ভদ্রলোক পেরোচ্ছিলেন পাশ দিয়ে, কটমট করে তাকালেন। আমি গায়ে মাখলাম না। যখের ধন এখন আমার প্রায় হাতের মুঠোয়! প্রায় উড়তে উড়তেই স্কুলডাঙ্গা পৌঁছে একে ওকে তাকে জিজ্ঞেস করে যখন সঠিক ঠিকানায় সাইকেল ভেড়ালাম, তখন বিকেলের আলো নিভতে আর বেশি বাকী নেই।
গিয়ে ব্যাপারস্যাপার দেখে আমার চোখ পুরো দইবড়া! ডাক্তারখানার মতোই প্রায় রকমসকম। বাইরে একটা বসার ঘর, অনেকগুলো বেঞ্চ পাতা। দেওয়ালে বিভিন্ন ঠাকুরদেবতা, রাশিচক্র হ্যানাত্যানার ছবি। একটা বাহারি টেবিল চেয়ার নিয়ে একটা কুড়ি-বাইশ বয়সী এক ছোকরা বসে। এ বোধহয় ডাক্তারখানার কম্পাউণ্ডার। তার সামনে অনেকগুলো মোটা মোটা খাতা। একবার এই খাতার উপর ওই খাতা চাপাচ্ছে, তো আর একবার অন্য খাতায় কিসব আঁকিবুঁকি কাটছে।
আমাকে দেখে সে এগিয়ে এল। দেখলাম তারও দুই হাতে জ্বলজ্বল করছে কম করেও খানদশেক আংটি। কাছে এসে কম্পাউণ্ডার-সুলভ একটা দৃষ্টি হানল আমার দিকে। আর তার সাথে ভয়ানক গম্ভীর গলা, “মহারাজের সাথে দেখা করবে?”
আমি ঢক করে ঘাড় নাড়লাম।
“আগে রেজিস্ট্রেশন করানো আছে?”
আমি দুপাশে ঘাড় নাড়লাম। না।
“তাহলে রেজিস্ট্রেশন ফর্ম নিয়ে পূরণ করে জমা দাও। নিজের সম্পর্কে সব তথ্য দেবে। গোপন করবে না কিছু। রেজিস্ট্রেশন ফি পাঁচশো টাকা।”
উত্তরের প্রতীক্ষায় লোকটা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। এই রে! আমার কাছে পাঁচশো কেন, পঞ্চাশটা টাকাও নেই।
এই রে! এ তো ঘোর বিপদ! আর এ কম্পাউণ্ডারটাকে কাকুতি-মিনতি করেও কোন লাভ নেই বোঝাই যাচ্ছে।
আমাকে চুপ দেখে সে গলা ওঠাল, “কী ব্যাপার? চুপ মেরে গেলে যে?”
ফস করে কাঁচুমাঁচু হয়ে বলে ফেললাম, “কিন্তু সতুকাকু যে আমাকে বলল, কিছুই লাগবে না। তুই সটান আমার কাছে চলে আসবি।”
“সতুকাকু? সতুকাকুটা আবার কে?”
“কেন? সত্যানন্দ শাস্তিজি।”
বলেই খেয়াল হল, আরে আমি তো বেমালুম সত্যি কথা চেপে যেতে পারলাম! ওনার কাছে ঢুকতে পারিনি, তাতেই এত! তাহলে সত্যিই আশা আছে!
কম্পাউণ্ডারটার মনে হয় আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে। কোনমতে চিঁ চিঁ করে বলল, “শাস্তিজি তোমার কাকু হন? আগে বলবে তো? দাঁড়াও, আগের জন বেরিয়ে আসুক, তারপর তোমাকে ঢোকাচ্ছি।”
একটু পরেই ‘সতুকাকু’র চেম্বার থেকে একজন বেরিয়ে এলেন। মাঝবয়সী মহিলা, কমলা রঙের শাড়ি পরা, মাথায় ঘোমটা। বারবার নমস্কার ঠুকছেন নিজের কপালে। বোঝাই যাচ্ছে, শাস্তিজির মহিমায় তিনি বিগলিত।
কম্পাউণ্ডার আমাকে ঠেলল, “হাঁ করে দেখছ কী? যাও, তাড়াতাড়ি ঢোকো।”
যন্ত্রচালিতের মতো হলঘরের অপর প্রান্তের সুইং ডোর ঠেলে ঢুকলাম। ঢুকেই প্রথমটায় চোখে যেন ঘোর লেগে গেল। মিহি গোলাপী-নীল আলো খেলে বেড়াচ্ছে চারদিকে। বেশ রহস্যঘন পরিবেশ। মাঝখানে বিশাল একটা অর্ধবৃত্তাকৃতি টেবিল। ঠাণ্ডা মেশিনের শীতল হাওয়ায় প্রাণমন জুড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যাঁর দর্শনে আসা, তিনি কই? চোখ একটু সয়ে গেলে দেখলাম, গুরুজি চেয়ারে হেলান দিয়ে মহানন্দে ঘুমোচ্ছেন।
কাছে গিয়ে প্রাণকাড়া স্বরে ডাকলাম, “প্রভু!”
প্রভু প্রায় ধড়মড়িয়ে উঠোলেন। “অ্যাঁ, কে? কে? ধ্যানের সময় বিরক্ত করে?”
আমি প্রায় চিনিমাখা সুরে বললাম, “এই যে স্যার, আমি।”
ঝট করে একটা বড়ো লাইট জ্বলে উঠল। আর সেই হঠাৎ জ্বলে ওঠা আলোতে দেখলাম, আরে, গুরুজীর বয়স তো নিতান্তই কম। হোর্ডিং-র ছবিতে অতোটা বোঝা যায়নি। আমার ছোটকাকার বয়সীই হবেন।
ছোটকাকার কথা মনে হতেই গুরুজীকে অসম্ভব চেনা চেনা লাগল। তিনিও দেখি, গোল গোল চোখে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। আচমকা বলে উঠলেন, “অ্যাই, তোর ডাকনাম কী বল দেখি? চেনা চেনা লাগে।”
আমার মাথাটাও পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। বললাম, “গুলে।”
“গুলে? ইয়েস। মন্তুর ভাইপো?”
আমিও ততক্ষণ পুরোদস্তুর চিনে ফেলেছি। সোৎসাহে চেঁচিয়ে উঠলাম, “ভুতুকাকা!”
ভুতুকাকা ওরফে সতুকাকু, ওরফে সত্যানন্দ শাস্ত্রীজী দন্তবিকশিত করলেন। সতুকাকু যে সত্যিসত্যিই ভুতুকাকু জেনে বেজায় আনন্দ হল।
ভুতুকাকু বলল, “তুই এখানে? কী ব্যাপার?”
আমি সমস্যা নিবেদন করলাম। ভুতুকাকু ওরফে সতুকাকু শুনেটুনে বারকয়েক গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল। তারপরে বলল, “হুমম।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “হুমম কী, ভুতুকাকা?”
ভুতুকাকা বলল, “বলছি। আগে বল, মন্তু কেমন আছে?”
“কাকা? সে তো এখন টিস্কোতে চাকরি করছে, জামশেদপুরে থাকে। মাঝেসাঝে আসে।”, বলে পেটের মধ্যে এতক্ষণ জমে থাকা কৌতূহলটা উগরে দিলাম, “কিন্তু ভুতুকাকা, তোমার এই বেশ কেন?”
ভুতুকাকা সোজাসুজি আমার দিকে তাকাল, একেবারে সত্যানন্দ শাস্ত্রীজীর দৃষ্টি, “দ্যাখ গুলে, তুই বলেই বলছি। বাইরে খবরদার কাউকে এসব বলিস না। আমার ব্যবসার ক্ষতি হয়ে যাবে।”
আমি মাথা নাড়লাম, “না, না, কাউকে বলবো না। তুমি বলো।”
ভুতুকাকা হাসল, ঘরের অতো উজ্জ্বল আলোতেও হাসিটা অসম্ভব ম্লান ঠেকল আমার, “শোন তবে। তোর নিশ্চয়ই মনে আছে, বি এস সি ফাইনাল ইয়ারে মন্তু পাশ করে গেল, আমি পারলাম না।”
আমি টকাত করে ঘাড় নাড়লাম, “হ্যাঁ, মনে আছে। তার পরের বার পরীক্ষার আগে তুমি কাকার নোটপত্র সব আমার থেকে নিয়ে গেলে!”
“মনে পড়েছে তাহলে। তুই তো ছিলি তোর কাকার তল্পিবাহক। যাইহোক, তারপরে ওসব নিয়ে দেখলাম, পড়ে পাশ করা আমার কম্মো নয়। আর তাছাড়া, তখন আমি রাতদিন ফুটবল মাঠে পড়ে থাকতাম, তুই তো দেখেইছিস। শেষমেষ ঠিক করলাম, টুকলি করব। তা পরীক্ষার তিনটে পেপার ভালোই উতরে দিয়েছিলাম, গণ্ডগোল বাধল লাস্ট পেপারে। কড়া গার্ড ছিল, একদম হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলাম। পরীক্ষা তো গেলোই, বাড়িতে অব্দি খবর গেল। আমার আমার বাবাকে তো জানিসই, কিরকম কড়া। বেদম পেটাল, বেদম। রাতেই বাড়ি ছাড়লাম, মহাভিনিষ্ক্রমণ যাকে বলে। তারপর এদিকওদিক অনেক ঘাটের জল খেয়ে অবশেষে এখানে।”
একটানা এতক্ষণ বলে ভুতুকাকু থামল। আমি জিজ্ঞেস না করে পারলাম না, কিন্তু তুমি যে আমাদের শহরেই আছো, তোমার বাবা জেনে গেলে?”
“সে চান্স নেই। আমার বাবার জ্যোতিষ- টোতিষে একদম বিশ্বাস নেই। আর তাছাড়া ছদ্মবেশে আছি তো, শিবের বাবারও সাধ্যি কি যে আমাকে চেনে?”
ভুতুকাকুর কথা শেষ হতে না হতেই কম্পাউণ্ডার ছেলেটি পর্দা সরিয়ে উঁকি মারল, “মহারাজ, এক ভদ্রলোক অনেকক্ষণ ধরে তাড়া দিচ্ছেন। তাঁর নাকি খুব জরুরী দরকার।”
ভুতুকাকা দেখলাম আবার সত্যানন্দ শাস্ত্রীজী হয়ে গেছে। জলদ্গম্ভীর স্বরে বলল, “ঠিক আছে, নিয়ে এসো।”
প্রায় সাথে সাথেই এক বয়স্ক ভদ্রলোক ডুকলেন। সবিস্ময়ে দেখলাম, তিনি আর কেউ নন, ভুতুকাকার বাবা! তিনি হয় আমাকে খেয়াল করেননি, নাহয় চিনতে পারেননি। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম, সত্যানন্দ শাস্ত্রীজীর চোখমুখ গোলগোল হয়ে গেছে। কোনমতে পালাতে পারলে যেন বাঁচে! ভুতুকাকার বাবা ততক্ষণে চারদিকে বারচারেক ঝলক দিয়ে গম্ভীর গলায় হাঁক পেড়েছেন, “এই যে শাস্ত্রীজী! আমার ছেলেটা আজ দুবছর হল নিরুদ্দেশ। একটু খোঁজ করে দাও দেখি। আমার যদিও এসব বুজরুকিতে বিশ্বাস নেই, কিন্তু নেহাত ওর মায়ের কথা ফেলতে পারলাম না বলে এলাম।“
ধরণী দ্বিধা হলে বোধয় এই মুহূর্তে ভুতুকাকার বিশেষ সুবিধা হত! কোনমতে মেঝের মার্বেল বা মার্বেলের মেঝের দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বলল, “আপনি বাড়ি যান। কথা দিচ্ছি, সাতদিনের মধ্যে আপনার ছেলে বাড়ি ফিরবে!”
“বটে? কথা দিচ্ছ মানে? তোমার গলাটা , গলাটা যেন…”, বলতে বলতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভুতুকাকাকে জরিপ করতে থাকেন তিনি। আর ভুতুকাকা? পারলে তখনই পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাসে যায়।
হঠাত করে একটা লাফ মারলেন ভুতুকাকার বাবা, আর তার সাথে খামচে ধরলেন সত্যানন্দ শাস্ত্রীজীর সাধের জটা। নিমেষের মধ্যে জটা খুলে গিয়ে স্বামীজীর আসল রূপ আরো প্রকট হয়ে পড়ল।
বাজখাঁই স্বরে চেঁচালেন সত্যানন্দ শাস্ত্রীজীর পিতা, “হতভাগা , পরীক্ষায় টুকলি করে ধরা পড়ে তারপরে তুই আবার এসব বুজরুকি শুরু করেছিস?”
নিমীলিত চক্ষে মাথা ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে সত্যানন্দ শাস্ত্রীজী বললেন, “সত্যি কথা!”