বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছি। ত্রাহি-ত্রাহি রবে একটা মানুষের স্তূপ এলো! কার কোনটা মাথা, কোনটা বডি বোঝা যাচ্ছে না! শুধু ভেতর থেকে একটা ক্ষীণ কন্ঠস্বর ভেসে আসছে – “খালি বাস, খালি বাস !” এ অঞ্চলে বাসের ফুল স্টপ করার পারমিট নেই। স্লো মোশেনে যাবে, আমাকে গতি বাড়িয়ে ঝপ করে পাদানিতে ঝুলে পড়তে হবে। তারপর প্রজাতি পরিবর্তন। একটু আগেই ছিলাম মানুষ আর এখন হয়ে গেলাম ষাঁড়। দুটো হাত এনগেজড, তাই মাথায় দুটো অদৃশ্য সিং কল্পনা করে সামনের ব্যক্তিকে গুঁতোতে থাকি! চিন্তার কিছু নেই, তিনি কিছু মনে করবেন না, কারণ তিনিও গুঁতোচ্ছেন। এভাবেই গুঁতোগুঁতি করতে করতে একসময় বাসের গর্ভজাত হবো। শরীরের সবচেয়ে মূল্যবান অঙ্গ মাথা, ওটি গলাতে পারলেই বাকীটুকু অটোমেটিক গলে যাবে। কিছু মহাপূণ্যবান, ব্রহ্মার বরপুত্র, সীটে বসার সুযোগ পান। তাঁরা অর্ধনিমীলিত নেত্রে, তপস্যারত অবস্থায় চলেছেন। তাঁদের বিরক্ত করলে অগ্নিদৃষ্টিতে আমার ইহকাল চুলকে দিতে পারেন। তাই আমার মতো পুঁচকে পাপীদের খুব সন্তর্পণে বডি মাসাজ করাতে করাতে এগিয়ে যেতে হবে।
কন্ডাক্টর কাকা বিশুদ্ধ বৈদান্তিক। তিনি মানুষের দেহতত্ত্বে বিশ্বাস করেন না, শুধু আত্মার অস্তিত্ত্বে বিশ্বাসী। বায়বীয় আত্মার তো জায়গা জোড়ার কথা নয়, তাই “কোথায় দাঁড়াবো কাকা!” এই অবান্তর প্রশ্নের উত্তরে তিনি ভ্রূ কুঁচকে তাকান। তিনি কোনো অদ্ভুত মায়া কৌশলে, যেখানে ভাইরাস গলবে না সেখানেও গলে যান, বাসের আগাগোড়া চষে বেড়ান, টিকিট কাটেন আবার চেঁচিয়ে স্টপেজ মনে করিয়ে দেন। অপার প্রাণশক্তি! যেখানেই স্পেস পাই বডি পার্ট গুঁজে দিয়ে অষ্টবক্র মুনি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। গাড্ডাওয়ালা রাস্তার দুলুনিতে ঠিক সেট হয়ে যাবো। এভাবেই তো সংসারে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়। গণতান্ত্রিক দেশের রাস্তায় চলেছে একটি সমাজতান্ত্রিক মিনিবাস। রোগা-মোটা, লম্বা-বেঁটে, ধনী-গরীব, সাদা-কালো, সব তালগোল পাকিয়ে আছে। কার কোথায় পা, কোথায় হাত, কোথায় বগল, বোঝা দুঃসাধ্য ! তাও কারো কোনো আক্ষেপ নেই, ভ্রূক্ষেপ নেই, বিক্ষোভ নেই, প্রতিবাদ নেই।
এই তো আদর্শ সমাজ। ধর্ম নেই, জাত-পাত বৈষম্য নেই, তেঁতুল পাতার সুজন হয়ে চলেছে সবাই। এক ঠ্যাংএ টিকে থাকার প্রাণান্তকর প্রয়াসের মধ্যে দিয়েই উপলব্ধি করলাম, স্বার্থত্যাগই সহাবস্থানের একমাত্র উপায় !!