‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’, ‘স্ট্রাইক’, ‘ইভান দ্য টেরিবল’, ‘অক্টোবর’-এর মতো বিশ্বনন্দিত চলচ্চিত্রের নির্মাতা সের্গেই আইজেনস্টাইন চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক চিরস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। মাত্র আটটি ছবি ও চলচ্চিত্রের তত্ত্বের উপর কয়েকটি বই লিখে তিনি চলচ্চিত্র জগতে চিরস্থায়ী আসন পেয়েছেন। আইজেনস্টাইন শুধু একজন চলচ্চিত্র নির্মাতাই নন, চলচ্চিত্রের জগতে তাঁর অবদান পরিমাপ করা সম্ভব নয়। তিনি ছিলেন একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালক, তাত্ত্বিক, বোদ্ধা এবং চিত্রনাট্যকার। চলচ্চিত্রের বিভিন্ন পদ্ধতিগত দিক নিয়ে তাঁর তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ পরবর্তীকালের প্রায় সব চলচ্চিত্র নির্মাতাদেরই অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। একটি বৃহৎ সময়কাল বা ঘটনাপ্রবাহকে বড় পর্দায় সহজে ফুটিয়ে তোলার ‘মন্তাজ’ নামক অভিনব পন্থাটির আবিষ্কারক তিনিই। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি তিনি শিল্পের অন্যান্য ধারা, যেমন সঙ্গীত, চিত্রশিল্প, ভাস্কর্য প্রভৃতিতে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন। এ ছাড়া বিজ্ঞান, দর্শন, ভাষাতত্ত্ব ও সাহিত্যেও তাঁর আগ্রহ ছিল। বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির পঠন-পাঠন তাঁকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করতো। তিনি বুঝেছিলেন চলচ্চিত্রই একমাত্র শিল্পমাধ্যম যাতে তাঁর আগ্রহের সবক’টি ক্ষেত্রকে একসাথে এনে কাজ করতে পারবেন। সেই উপলব্ধি থেকেই তিনি বলেছিলেন – “The hieroglyphic language of the cinema is capable of expressing any concept, any idea or class, any political or tactical slogan, without recourse to the help of a rather suspect dramatic or psychological past.”
সের্গেই আইজেনস্টাইন ১৮৯৮ সালের ২২ জানুয়ারি লাটভিয়ার রাজধানী রিগা-তে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মিখাইল ওসিপোভিচ আইজেনস্টাইন ছিলেন একজন বিখ্যাত স্থপতি, মা ছিলেন একজন বিদুষী নারী। শৈশব থেকেই তিনি রাশিয়ান, জার্মান, ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায় লিখতে-পড়তে শিখেছিলেন। দশ বছর বয়স থেকেই তিনি চিত্রাঙ্কনে পারদর্শী হয়ে ওঠেন এবং পরবর্তীকালে তাঁর চলচ্চিত্রে এর ছাপ সুস্পষ্টভাবে পড়েছিল। পিতার কর্মসূত্রে সের্গেই-কে পরিবারের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়েছিল। কিন্তু কোনওখানেই তাঁদের বেশি দিন থাকা হত না। কৈশোরে তাঁর পরিবার সেন্ট পিটার্সবার্গে বাস করতে চলে আসে। পরিবারের উৎসাহেই সের্গেই পিতার মতো স্থপতি হতে চেয়েছিলেন। সেই ইচ্ছা থেকেই স্কুলজীবন শেষ হলে তিনি পেট্রোগ্রাদ ইন্সটিটিউট অব ইঞ্জিনায়ারি-এ স্থপতিবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনার জন্য ভর্তি হন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে রাশিয়া ছিল প্রধানত হলিউড এবং ইউরোপীয় ছবির বাজার। এই ছবিগুলো দেখে জার এবং অন্যান্য পুঁজিপতিরা ছবি তৈরির ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে রাশিয়ায় বাইরের ছবি আসা বন্ধ হয় এবং সে দেশে ছবি তৈরির হার দ্রুত বেড়ে যায়। মায়াকোভস্কি, মেয়ারহোল্ড ইত্যাদি কয়েকজন শিল্পী-সাহিত্যিক এ ক্ষেত্রে উৎসাহী হলেও পুরো ব্যাপারটাই ছিল জার এবং পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রণে। উল্লেখযোগ্য কোনও ছবি সে সময় তৈরি হয়নি। ১৯১৭ সালে উনিশ বছরের যুবক আইজেনস্টাইন রুশ বিপ্লবের ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেন। লেনিনের নেতৃত্বে যে দিন বলশেভিকরা উইন্টার প্যালেস আক্রমণ করেন সে দিন আইজেনস্টাইন সেই শহরেই ছিলেন। এ ঘটনা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় এবং ১৯১৮ সালে বাবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে রুশ বিপ্লবে সামিল হওয়ার জন্য তিনি বিপ্লবী লালফৌজে যোগ দেন। ১৯১৮ সালের গৃহযুদ্ধের সময় তিনি লালফৌজের হয়ে দেশের পূর্বপ্রান্তের রণাঙ্গনে রেলগাড়িতে প্রচারমূলক ছবি আঁকতেন।
বিপ্লব পরবর্তীকালে সোভিয়েত নাটকের প্রয়োজনে প্রলেটকাল্ট থিয়েটারের সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯২০ সালে লালফৌজ থেকে ফিরে এসে আইজেনস্টাইন মস্কোতে থিয়েটারে যোগ দেন। বলতে গেলে তখন থেকেই তাঁর শিল্পী সত্তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটে। তিনি থিয়েটারে ডিজাইন এবং সেট তৈরির কাজ করতেন। একজন থিয়েটারকর্মী হিসেবে তাঁর নাম গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব মেয়ারহোল্ড-এর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। মেয়ারহোল্ড তখন নাটকে ছবির ব্যবহার করতেন। এই ব্যক্তির মাধ্যমেই ক্যামেরার সঙ্গে আইজেনস্টাইনের পরিচয় ঘটে। প্রলেটকাল্টে অস্ত্রভস্কির ‘এনাফ সিমপ্লিসিটি ইন এভরি ওয়াইজম্যান’ নাটকে কুড়ি মিনিটের একটি ভিডিওর মাধ্যমে আইজেনস্টাইনের চলচ্চিত্রে হাতেখড়ি হয়। সেই সময় শ্রমিকদের নিয়ে বাস্তবভিত্তিক নাটক করার উদ্দেশ্যে তিনি ‘গ্যাস মাস্কস’ নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। বাস্তব জীবনের শ্রমিকদের নিয়ে সত্যিকারের কারখানায় মঞ্চস্থ এই নাটকটি সাফল্য পায়নি। তিনি বুঝলেন নাটকে যা দেখানোর সুযোগ নেই চলচ্চিত্রে তা দেখানো সম্ভব। তখন থেকে তিনি নাটক ছেড়ে পুরোপুরি সিনেমার দিকে ঝুঁকলেন। ইতিমধ্যে রাশিয়ায় কুলেশভ, ভের্তব, পুদভকিন প্রমুখরা চলচ্চিত্র নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। আইজেনস্টাইনও তার সঙ্গে যুক্ত হলেন।
আইজেনস্টাইন শিল্প তাত্ত্বিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ১৯২৩ সালে, ‘মন্তাজ অব অ্যাট্রাকশন’ বইটির মাধ্যমে। একই বছর ‘গ্লুমভস ডায়েরি’-র মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন। নির্বাক যুগের চলচ্চিত্র দিয়েই তাঁর কাজের শুরু। ১৯২৩ সালে সোভিয়েত সরকার একটি ইস্তাহার জারি করে সমস্ত বেসরকারি চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান তুলে দেয় এবং সরকারই চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিবেশনার দায়িত্ব নেয়। এই নির্দেশনার ফলে সোভিয়েত দেশে চলচ্চিত্র শিল্পের পথ অবারিত হয় এবং নির্বাক যুগের সোভিয়েত পরিচালকরা বেশ কয়েকটি অসাধারণ চলচ্চিত্রের জন্ম দেন। এই পথ ধরেই মুক্তি পায় কুলেশভের ‘মিঃ ওয়েস্ট’, পুদভকিনের ‘ডেথস রে’ ও ‘মেকানিকস অব দ্য ব্রেইন’, ভের্তবের ‘কিনো আই’ এবং আইজেনস্টাইনের ‘স্ট্রাইক’।
আইজেনস্টাইন তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র ‘স্ট্রাইক’ নির্মাণ করেন ১৯২৪ সালে। সোভিয়েত দেশে চলচ্চিত্রের জাতীয়করণের পর রাশিয়ার সংগ্রামী ইতিহাস তুলে ধরে নানা চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। তারই অংশ হিসেবে ১৯০৫-এর বিপ্লবের পূর্ববর্তী শ্রমিক আন্দোলনকে উপজীব্য করে ‘স্ট্রাইক’ ছবিটি নির্মিত হয়। এই ছবিতে প্রচলিত অর্থে কোনো কাহিনি ছিল না। বিপ্লব-পূর্ব রাশিয়ার একটি কারখানায় একদল শ্রমিকের ধর্মঘটকে চিত্রায়িত করাই এই ছবিটির উদ্দেশ্য ছিল। কতকগুলো বিচ্ছিন্ন ইমেজকে একত্রে সন্নিবেশিত করে এই ছবিটি নির্মিত হয়। এই ছবির আলোকচিত্রী হিসেবে অসাধারণ কাজ করেছিলেন এডওয়ার্ড টিসে, যিনি পরবর্তীকালে আইজেনস্টাইনের সব ছবিতে ছিলেন। এই ছবিতেই তাঁর বহুল আলোচিত ‘মন্তাজ অব অ্যাট্রাকশন’ তত্ত্বের প্রথম প্রযোগ হয়।
আইজেনস্টাইনের ‘স্ট্রাইক’ সর্ব অর্থেই একটি বৈপ্লবিক চলচ্চিত্র, যেখানে কোনও একজন ব্যক্তির পরিবর্তে জনসাধারণ নায়ক হিসেবে দেখা দেয়। চলচ্চিত্রে বুর্জোয়া নায়কের ব্যক্তিত্ববাদী ধারণাকে বাতিল করে নায়ক হল জনতা। এই যে ব্যক্তির পরিবর্তে জনগণই নায়কের ধারণা, এটা আইজেনস্টাইনের ছবির একটি তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। তাঁর শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত ১৯০৫ ও ১৯১৭ সালের বিপ্লবের প্রস্তুতি পর্বে রাশিয়া তখন জেগে উঠেছে। লেনিন তখন তাঁর বিপ্লবী চেতনাকে ক্রমাগত শাণিত করে চলেছেন। সমগ্র রাশিয়া তখন শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবের আন্দোলনে উত্তাল। তাই তাঁর চিন্তা ও কর্ম জুড়ে রয়েছে শ্রমিকদের লড়াই তথা মুক্তি। তাঁর সব চলচ্চিত্রে অজস্র মানুষের সমবেত উপস্থিতি, তারা সকলেই নায়ক।
১৯২৫ সালে নির্মিত হয় আইজেনস্টাইনের সব থেকে বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’। ১৯২৫ সাল ছিল ১৯০৫ এর বিপ্লবের ২০ বছর পূর্তি। সাধারণভাবে দেখতে গেলে এই বিপ্লব হয়তো ব্যর্থ হয়েছিল, কিন্তু তা ১৯১৭ সালের বিপ্লবের পথকে প্রশস্ত করেছিল। এর ইতিহাস চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ধরে রাখার দায়িত্ব পড়েছিল আইজেনস্টাইনের ওপর। প্রথমে পুরো ঘটনা নিয়ে চিত্রনাট্য তৈরি হলেও পরে পটেমকিন যুদ্ধজাহাজের নাবিকদের বিদ্রোহের ঘটনাকে নিয়ে চিত্রনাট্য রচিত হয়। বিপ্লবকে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতে এবং তার মর্মার্থ বুঝতে তিনি বিপ্লবের জীবিত কুশীলবদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল তাঁর নিজের গবেষণাধর্মী শিল্পগুণ এবং এডওয়ার্ড টিসের অসামান্য কাজ। এভাবেই তৈরি হয়েছিল বিশ্বের সর্বকালের সেরা ছবিগুলির মধ্যে অন্যতম ‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’, সমালোচকদের বিচারে যাকে তাবৎ দুনিয়ার শুদ্ধতম চলচ্চিত্র বলে ধরা হয়ে থাকে।
‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’-এর পটভূমিকা ও কাহিনি নিয়ে একটু বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা দরকার। ১৯০৫ সাল নাগাদ রাশিয়ান সম্রাজ্য অস্থির হতে শুরু করেছে, ততদিনে জারের শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দানা বাঁধছে। রাশিয়ার নৌবাহিনির কৃষ্ণসাগর নৌবহরেও (ব্ল্যাক সী ফ্লিট) এর প্রভাব পড়ে। সেখানকার জাহাজগুলোর মধ্যেও অসন্তোষের আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আবার ১৯০৪-০৫ সালের রুশ-জাপান যুদ্ধের কারণে ঊর্ধ্বতন অফিসারদের বেশিরভাগই সে সময় সেখানে ছিলেন না। তাঁদের যুদ্ধক্ষেত্রে প্রশান্ত মহাসাগরের জাহাজগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে সুশিমার যুদ্ধে রাশিয়ান নৌবাহিনির শোচনীয় পরাজয় যেমন দেশের জনগণকে ক্ষুব্ধ করেছিল, তেমনই বিপ্লবীদের উৎসাহিত করেছিল। সব মিলিয়ে কৃষ্ণসাগর নৌবহরের জাহাজগুলোর মধ্যে বিদ্রোহ করার জন্য একটা গোপন শলা-পরামর্শ চলতে থাকে, ঠিক হয় বিদ্রোহ করা হবে আগস্ট মাসে। এই নৌবহরের অন্যতম জাহাজ হল পটেমকিন। জাহাজটা সাগরে ভাসার কয়েকদিন পরেই ২৭ জুন সকালে কিছু নাবিকরা আবিষ্কার করল, তাদের খাওয়ার জন্য যে গোমাংস রাখা আছে তাতে পোকায় ধরেছে। সঙ্গে সঙ্গে অফিসারদের কাছে অভিযোগ জানানো হল। জাহাজের ডাক্তার এসে রায় দিলেন পোকা ধরায় তেমন কিছু বয়নি, এ মাংস এখনও খাওয়া যাবে। ডাক্তারের এই রায় শুনে জাহাজের নাবিকদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। মাতিউশেঙ্কো ও ভাকুলেঞ্চুকের নেতৃত্বে নাবিকরা একত্রিত হল। সমবেত সিদ্ধান্ত হল এই মাংস দিয়ে তৈরি খাবার তারা খাবে না। দুপুরে যখন তারা সত্যিই মাংসের স্যুপ খেল না, তখন ক্যাপ্টেন ইভগেনি গোলিকভ সবাইকে জাহাজের ডেকে হাজির করলেন। ক্যাপ্টেন এবং ফার্স্ট অফিসার গিলিয়ারোভস্কির ধারণা হলো এ সব নিশ্চিতভাবে বিদ্রোহীদের ষড়যন্ত্র। ফলে জাহাজের অফিসার এবং সাধারণ নাবিকরা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল। ব্যাপারটা বিদ্রোহীদের ষড়যন্ত্র না হলেও ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে শুরু হয়ে গেল বিদ্রোহ, জুনের ২৭ তারিখেই, অনেকটা অপরিকল্পিতভাবে। জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়েই গোলিকভের ধমক-ধামক ও হুমকির মধ্যে মাতিউশেঙ্কো তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করল। আধ ঘন্টার মধ্যেই পটেমকিন জাহাজ নাবিকদের কব্জায় চলে এল, উড়িয়ে দেওয়া হলো বিপ্লবীদর লাল পতাকা। পটেমকিনের এই বিপ্লবী অভিযাত্রা মাত্র ১১ দিন স্থায়ী হয়েছিল। পরে রোমানিয়ায় গিয়ে তারা আত্মসমর্পণ করে।
রুশ বিপ্লবের ইতিহাসে যুদ্ধজাহাজ পটেমকিনের এই বিদ্রোহকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। একে চিহ্নিত করা বিপ্লবের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে। পরে ১৯২৫ সালে যুদ্ধজাহাজ পটেমকিনের এই বিদ্রোহের পটভূমিতে আইজেনস্টাইন নির্মাণ করেন তাঁর বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’। নির্বাক যুগের এই সাদা-কালো চলচ্চিত্রটি বিশ্বের চলচ্চিত্রপ্রেমী ও সমালোচকদের কাছে অত্যন্ত সমাদৃত। এমনকী সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রের তালিকাতেও এটি অবিসংবাদিতভাবে স্থান পায়। সমালোচকরা অনেকেই মনে করেন ‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’ শুধু আইজেনস্টাইনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজই নয, চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজগুলির মধ্যেও একটি। পাঁচটি অংশে বিভক্ত চলচ্চিত্রটি তাঁর অসাধারণ শিল্পবোধ, কুশলী পরিচালনা ও সম্পাদনার জন্য চলচ্চিত্র শিল্পের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় সৃষ্টি হিসেবে খ্যাত। এই চলচ্চিত্রটির একটি দৃশ্য তাত্ত্বিক ও সমালোচকদের কাছে ‘দ্য স্টেপ সিকোয়েন্স’ নামে পরিচিত এবং বহুল বিশ্লেষিত। ‘ওডেসার সিঁড়ি’ নামেও পরিচিত এই অংশটিতে শট বা দৃশ্যের মধ্যে দ্বন্দ্বের মাধ্যমে চলচ্চিত্র সম্পাদনাকে তিনি অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। আমেরিকান চলচ্চিত্র সমালোচক রজার এগবার্ট বলেছেন – “That there was, in fact, no tsarist massacre on the Odessa Steps scarcely diminishes the power of the scene . . . It is ironic that [Eisenstein] did it so well that today, the bloodshed on the Odessa Steps is often referred to as if it really happened.” বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই বিশেষ দৃশ্যটি আজও একটি বিশেষ জায়গা জুড়ে রয়েছে। তিনি বুঝিয়েছেন চলচ্চিত্রের প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি ধ্বনি, প্রতিটি অভিব্যক্তি ও গতির ব্যবহার দর্শকদের চিন্তাকে নাড়িয়ে দেবে এবং সে ছবির প্রতিটি উপাদান সম্পর্কে ভাববে।
১৯২৭ সাল ছিল রুশ বিপ্লবের দশম বার্ষিকী। এই উপলক্ষে জন রিডের বিখ্যাত রচনা ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’ অবলম্বনে তিনি তিনি নির্মাণ করেন ‘অক্টোবর : টেন ডেজ দ্যাট শুক দ্য ওয়ার্ল্ড’। ১৯১৭ সালের বিপ্লবের উপর নির্মিত এই পৌনে তিন ঘন্টার চলচ্চিত্রটিকে রুশ বিপ্লবের একটি অনন্য দলিল বলে গণ্য করা হয়। ‘অক্টোবর’ ছবিটি নির্মাণ করতে গিয়ে বহু মানুষকে মিলিতভাবে পরিশ্রম করতে হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আইজেনস্টাইন লিখেছেন – “রাতের পর রাত লেনিনগ্রাদের চার থেকে পাঁচ হাজার শ্রমিক উইন্টার প্যালেস আক্রমণের দৃশ্যটি তুলবার জন্য স্বেচ্ছায় অংশ নিয়েছেন। সরকার আমাদের সৈন্যবাহিনি, অস্ত্রশস্ত্র এবং ইউনিফর্ম দিয়ে সাহায্য করেছিলেন।” এই ছবিটিতে তিনি আঙ্গিক নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। গণ-আন্দোলনের দৃশ্য নিয়ে সাব-টাইটেলসহ এমন ছবি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে দুর্লভ। বিশেষত মানুষ ও বস্তুকে প্রতীকী অর্থে ব্যবহারের জন্য এই ছবিটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
‘অক্টোবর’ নির্মাণের আগেই আইজেনস্টাইন ‘দ্য জেনারেল লাইন’ নামে আরেকটি ছবির কাজ শুরু করেছিলেন। যৌথ কৃষিব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করে তোলা এবং প্রাচীন কৃষি পদ্ধতি পরিত্যাগ করে নতুন যান্ত্রিক কৌশলকে আয়ত্ত করতে অনুপ্রাণিত করাই ছিল এ ছবির উদ্দেশ্য। ১৯২৯ সালে ছবিটি মুক্তি পায়। আইজেনস্টাইন এই ছবিতে প্রথম একজন নায়িকাকে (অর্থাৎ একজন ব্যক্তিকে) মুখ্য চরিত্রে দেখালেন। এই ছবিতে তিনি টাইপেজ ও মন্তাজের প্রয়োগ করেন। সিনেমাটোগ্রাফিতেও এই ছবিনতুনত্বের স্বাক্ষর রাখে। কিন্তু কোনও কোনও সমালোচকের মতে এ ছবিতে অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বুদ্ধিবাদের প্রয়োগ ঘটে। পাশাপাশি বিষয়বস্তুক ছাপিয়ে গিয়েছিল আঙ্গিক সচেতনতা, যার ফলে ছবিটি অনেকের কাছেই দুর্বোধ্য ঠেকে।
১৯২৯ সালে প্যরামাউন্ট পিকচার্স-এর আমন্ত্রণে আইজেনস্টাইন হলিউডে পাড়ি দেন। তাঁর তখন বিশ্বজোড়া খ্যাতি। তাঁর অনেকদিনের পরিকল্পনা ছিল কার্ল মার্কস-এর ‘পুঁজি’ অবলম্বনে চলচ্চিত্র তৈরি করবেন। পুঁজিবাদের ভয়ঙ্কর রূপটিকে দেখানো তাঁর একটা উদ্দেশ্য ছিল। অন্য দিকে চলচ্চিত্র তখন সদ্য নির্বাক থেকে সবাক হয়েছে, সে সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান অর্জনও তাঁর আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল। মাঝপথে কিছু দিন তিনি ইউরোপে কাটান এবং তরুণ চলচ্চিত্র-নির্মাতাদের ক্লাস নেন। কিন্তু হলিউডে গিয়ে তিনি পুঁজিবাদী দুনিয়ার নির্মমতার সম্মুখীন হন। সোভিয়েত দেশে সরকার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের যথার্থ ছবি বানানোর কাজে পৃষ্ঠপোষকতা করে, কিন্তু আমেরিকায় তিনি দেখলেন ব্যবসায়ীরা চলচ্চিত্রে পুঁজি বিনিয়োগ করছে। তিনি বুঝলেন চলচ্চিত্র এখানে শিল্প বা গণমাধ্যম নয়, বরং পুঁজি বিনিয়োগ আর মুনাফার উপকরণ মাত্র।
আইজেনস্টাইন হলিউডে গিয়ে ‘গ্লাস হাউস’ নামে একটি কমেডির খসড়া তৈরি করেন। বহিরঙ্গে আছে এমন একটি বাড়ি যেটি পুরোটাই স্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে ঢাকা, ফলে বসবাসের অযোগ্য। অন্তরঙ্গ বিচারে এই ছবিটি আসলে ছিল মার্কিনী জীবনযাত্রার প্রতি তীব্র ব্যঙ্গের প্রকাশ। ফলে আমেরিকার কেউই এই ছবিতে অর্থলগ্নী করেনি। পরবর্তিতে তিনি এক স্কুলশিক্ষকের জীবন নিয়ে ‘স্যাটারস গোল্ড’ নামে একটি ছবি তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যে শিক্ষক ক্যালিফোর্নিয়াতে অনেক বাধা অতিক্রম করে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হলিউডের বোদ্ধাদের মতে এটি অতি বিপ্লবী ছবি, ফলে তা বাতিল হয়। আরও পরে তিনি মেক্সিকো গিয়ে সেখানকার সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ‘কিউ ডিভা মেক্সিকো’ নামে চিত্রনাট্য তৈরি করেন। চার্লি চ্যাপলিনের অনুরোধে এ ছবিতে অর্থলগ্নি করতে রাজি হয়েছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার আপটন সিনক্লেয়ার। কিন্তু এই ছবির বেশিরভাগ কাজ শেষ হওয়ার পর মার্কিনী অভিজাতদের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে সিনক্লেয়ার এই ছবির অর্থায়ন বন্ধ করে দেন, এমনকী ছবির সমস্ত রিলগুলোও তিনি রেখে দেন। পুঁজিবাদী দুনিয়ার কুৎসিত চিত্র প্রত্যক্ষ করে আইজেনস্টাইন ১৯৩২ সালে দেশে ফিরে আসেন এবং মস্কোর ‘ইনস্টিটিউট অব সিনেমাটোগ্রাফি’-তে অধ্যাপনার দায়িত্ব নেন। অধ্যাপনাতেও তিনি পাণ্ডিত্য, মৌলিক কল্পনা ও চিন্তাশক্তির ছাপ রাখেন। পাশাপাশি তিনি নিজের তত্ত্বগত পড়াশোনা ও চলচ্চিত্র নিয়ে গবেষণায় মনোযোগী হন।
আইজেনস্টাইন ১৯৩৫ সালে ইভান তুর্গেনেভের গল্প অবলম্বনে ‘বেজহিন মেডো’ ছবি তৈরির কাজ অনেকটা শেষ করলেও সম্পূর্ণ করতে পারেননি। এর পর তিনি ইতিহাসধর্মী ছবি ‘আলেকজান্ডার নেভস্কি’ নির্মাণে হাত দেন। এটি আইজেনস্টাইনের প্রথম সবাক ছবি (যদিও ‘ঝিঝিন ওগ’ ছবিতে তিনি প্রথম শব্দের ব্যবহার করে, কিন্তু এর নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায় এবং বেশিরভাগ দৃশ্য নষ্ট হয়ে যায়)। স্তালিনের সময় যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও নাৎসি জার্মানির মধ্যে সংকটময় পরিস্থিতি চলছিল তখন ‘আলেকজান্ডার নেভস্কি’ ছবিটি নির্মিত হয়। তখন হিটলারের জার্মানি গোটা দুনিয়াকে হুমকি দিচ্ছিল। সে সময় সাতশো বছর আগের জার্মানি কর্তৃক রাশিয়া আক্রমণ এবং নেভস্কির নেতৃত্বে রাশিয়ার লড়াইয়ের ঘটনা নিয়ে নির্মিত ছবিটি আলোড়ন তুলেছিল। সমালোচকদের মতে এই ছবিতে দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান রাজনৈতিক অবস্থা রূপকের মাধ্যমে চিত্রায়িত হয়। এই চলচ্চিত্রের কাহিনি ও দৃশ্যের বিস্তারে ছিল কয়েকশো বছর আগেকার পটভূমি। নেভস্কি ছিলেন নভোগরদের রাজকুমার। অত বছর আগের এই চরিত্র নিয়ে একটি বাস্তবসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণ করা অত্যন্ত কঠিন। আইজেনস্টাইন সেই দুরূহ কাজটি করেছিলেন। শুধু দৃশ্যাবলির বিশালত্ব ও পরতে পরতে চমকই নয়, এই ছবি আইজেনস্টাইনের সমসাময়িক রাশিয়া থেকে কাহিনিকে যেন অনেক অতীতে নিয়ে গেল। তিনি যেন অতীতের সেই ঘটনাকে বাস্তবে দেখতে পেলেন। বিশেষত এই ছবিতে বরফের উপর যুদ্ধের দৃশ্যটি (‘ব্যাটল অব আইস’) অসাধারণ।
‘আলেকজান্ডার নেভস্কি’ ছবিটিতে মূল বিষয়বস্তুর উপর জোর দেওয়া হয়েছে এবং দেখানো হয়েছে যে সাধারণ জনগণ রাশিয়াকে বাঁচাতে বদ্ধপরিকর। অন্য দিকে অভিজাত ও বণিক শ্রেণীকে বুর্জোয়া হিসেবে দেখানো হয়েছে যারা জনগণের শত্রু, কারণ তারা জনগণের জন্য কিছুই করছে না। এ ছাড়া আলেকজান্ডারকে একজন লোকবীর হিসেবে দেখানো হয়েছে, যে মঙ্গোলদের চেয়ে ভয়াবহ শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য তাদের সঙ্গে একটি যুদ্ধ পাশ কাটিয়ে যায়। ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন সোভিয়েত ঔপন্যাসিক পিওতর পাভ্লিয়েঙ্কা এবং সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ প্রকোফিয়েভ। এই চলচ্চিত্রের নির্মাণের সঙ্গে আগাগোড়া জড়িয়ে ছিল শব্দের পূর্ণাঙ্গ সমন্বয়। এর কিছু দৃশ্য প্রকোফিয়েভের সঙ্গীতের ভিত্তিতে চিত্রায়িত হয় এবং কিছু সুর রচিত হয় আইজেনস্টাইনের চিত্রায়নের ভিত্তিতে। চলচ্চিত্রটির সম্পাদনাকালে পরিচালক আইজেনস্টাইন ও সঙ্গীতজ্ঞ প্রকোফিয়েভের মধ্যে সুষ্ঠু ও সৃজনশীল সমন্বয় সঙ্গীত ও দৃশ্যের যেভাবে সংযোগ ঘটিয়েছে তা এখনও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য আদর্শ বলে বিবেচিত হয়। ১৯৩৮ সালের ১ ডিসেম্বর মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটি দর্শক ও সমালোচক মহলে সাড়া ফেলে দেয় এবং এর জন্য আইজেনস্টাইনকে রাশিয়ার সর্বোচ্চ সম্মান ‘অর্ডার অব লেনিন’-এ ভূষিত করা হয়। ১৯৩৯ সালের ২৩ আগস্টের পর জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দ্বন্দ্ব পরিহারের লক্ষ্যে মলোতভ-রিবেনট্রপ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে ছবিটির প্রদর্শন বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৪১ সালের ২২ জুন সোভিয়েত ইউনিয়নে জার্মানির আগ্রাসনের ফলে পরিস্থিতি আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেলে ছবিটি পুনরায় সোভিয়েত দেশ ও পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হতে থাকে।
বিংশ শতাব্দীর চারের দশকে আইজেনস্টাইনের বিখ্যাত কাজ ‘ইভান ট্রায়োলজি’। ষোড়শ শতাব্দীর রাশিয়ার জাতীয় ঐক্যের নিয়ন্তা জার ‘ইভান দ্য টেরিবল’-এর জীবনকাহিনি অবলম্বনে তিন পর্বে বিভক্ত বিশাল ছবিটিই তাঁর শেষ কাজ। কিন্তু তিনটি পর্বের দু’টি তোলার পরেই তাঁর মৃত্যু হওয়ায় তৃতীয় পর্বটি আর করতে পারেননি। ‘ইভান দ্য টেরিবল’-এর প্রথম অংশে নিকোলাই-এর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন আরেকজন বিখ্যাত রাশিয়ান পরিচালক পুদভকিন। এই ছবির প্রধান চরিত্র জার ইভান এক জটিল দ্বন্দ্বক্ষুব্ধ মানবচরিত্র। লুস্কোভির রাজপুত্র ইভান মাত্র ১৭ বছর বয়সে রাজা হন। তিনি রাজা হওয়ার পর কাহিনিতে নানা চরিত্র আসে, কখনো তার বিবাহকে কেন্দ্র করে, কখনো গির্জাকে বা কখনো ধর্মকে কেন্দ্র করে। অবশেষে একটা সময়ে বিশ্বাসঘাতকতা এবং পরাজয় ইভানের মধ্যে এক ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই ছবিটির জন্য তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা স্টালিন পুরস্কারে ভূষিত হন।
‘ইভান দ্য টেরিবল’-এর প্রথম পর্বের কাহিনি যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকেই দ্বিতীয় পর্বের কাহিনির শুরু, যার শেষ একজন স্বৈরতন্ত্রীর স্বরূপ উদঘাটনের মধ্য দিয়ে। এই দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে অনেক বিতর্কের জন্ম হয়। এটির মুক্তি আইজেনস্টাইন তাঁর জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারেননি। এই ছবিটির নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার পরেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় রাশিয়ার সরকার ‘ইভান দ্য টেরিবল’-এর মুক্তি বন্ধ করে দেয়। তাদের বক্তব্য ছিল এ ছবিতে অনেক ঐতিহাসিক চরিত্রের ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনি সুস্থ হওয়ার পর স্টালিন তাঁকে ডেকে পাঠান। ১৯৪৭-এর ফেব্রুয়ারিতে আইজেনস্টাইন এবং চেরকাসভ স্টালিনের সঙ্গে দেখা করতে যান। আলোচ্য ছবিটি নিয়ে এবং অন্যান্য কিছু বিষয়ে তাঁদের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয়। স্টালিন যেমন এই ছবিটি ও অভিনেতাদের কিছু দুর্বলতা সম্পর্কে বলেন, আবার তেমনই অনেক কাজের প্রশংসাও করেন। আইজেনস্টাইন বলেন তিনি ছবিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী নিয়ে আসবেন।
আইজেনস্টাইন ‘ইভান দ্য টেরিবল’-এর দ্বিতীয় পর্ব নতুন করে তৈরি ও তৃতীয় পর্ব শুরু করার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু তাঁর অসুস্থ শরীর এই পরিকল্পনায় কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। তাছাড়া তখন তিনি প্রচুর পড়াশোনা করছিলেন এবং ছাত্রদের বক্তৃতা দেওয়ার কাজেও তাঁর বেশ পরিশ্রম হচ্ছিল। তাঁর বিখ্যাত বই ‘ফিল্ম সেন্স’ এই সময় প্রকাশিত হয়। ১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারিতে তিনি ‘রঙিন ছবির তত্ত্ব’ নামে একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লেখায় হাত দেন। ১০ ফেব্রুয়ারি ওই প্রবন্ধ লেখাকালীনই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ১৯৪৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গেই বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। সারা জীবন তিনি একটি সুন্দর, মানবিক, চিন্তাশীল পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য কাজ করেছিলেন। অক্টোবর বিপ্লবের চেতনা দেশের জনগণের কাছে তথা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন। এটা সহজেই অনুমান করা যায় কেন তিনি আমেরিকার হলিউডে গেলে সেখানকার সিনেমার জগতের হর্তা-কর্তারা তাঁকে বিদায় করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন।
১৯৫৮ সাল নাগাদ চলচ্চিত্র শিল্প হিসেবে অনেক পরিণত। ততদিনে অনেক বিখ্যাত চলচ্চিত্র দর্শকদের সামনে এসেছে, চলচ্চিত্র বিষয়ক অনেক নতুন তত্ত্ব হাজির হয়েছে, কারিগরি দিক থেকেও অনেক নতুন সংযোজন ঘটেছে। এই সময়েই বেলজিয়ামের ব্রাসেলস শহরে বসেছিল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের আসর। বিশ্বের নানান দেশ থেকে আগত চিত্রপরিচালকরা সেখানে সর্বসম্মতভাবে নির্বাচন করেছিলেন সেরা চলচ্চিত্র – ‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বরেণ্য পরিচালক অরসন ওয়েলস, মাইকেল মান, বিলি ওয়াইল্ডার এবং চার্লি চ্যাপলিন ‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’-কে তাঁদের প্রিয় চলচ্চিত্রের তালিকায় রেখেছেন। বস্তুত এই চলচ্চিত্রটি সারা বিশ্বে এতটাই সমাদৃত যে, ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটের মুখপত্র ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ এটিকে পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের তালিকায় স্থান দিয়েছে। কিন্তু কেন আইজেনস্টাইনকে নিয়ে বা তাঁর ছবি ‘ব্যাটলশিপ পটেমকিন’ নিয়ে এত আলোচনা? এর কারণ দ্বিবিধ – এক দিকে আছে তাঁর চলচ্চিত্র দর্শন, আর অন্য দিকে আছে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে তাঁর তত্ত্বগত অবদান।
সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন নতুন মানুষ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে নতুন রূপে গড়ে তুলতে চেয়েছে। আর এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য যে দর্শনগত চিন্তাকে ভিত্তি করা হয়েছিল তা হল সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা। সাধারণভাবে, বাস্তববাদ হচ্ছে বাস্তবের যথাযথ প্রতিফলন। সমাজে যা ঘটছে তাকে যথার্থ রূপে যে শিল্পে বা সাহিত্যে ফুটিয়ে তোলা হয় তা-ই হচ্ছে বাস্তববাদী বা রিয়েলিস্টিক শিল্প-সাহিত্য। সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতায় শিল্প-সাহিত্যের কেন্দ্রে রয়েছে মানুষ। সেখানে শিল্প-সাহিত্যের কাজ হল দ্বন্দ্বের মাধ্যমে মানুষের চিন্তার ক্রমবিকাশ ঘটানো। আইজেনস্টাইনের দর্শন দাঁড়িয়ে ছিল সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার ভিত্তির উপর। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন – “সদাসর্বদায় অভিজ্ঞতার সব থেকে বড় ঐশ্বর্যময় উৎস হচ্ছে মানুষ নিজেই। তার আচরণকে বোঝা, বিশেষত তার বাস্তবকে উপলব্ধির এবং বাস্তবের ভাবমূর্তি তৈরির পদ্ধতি বোঝার ব্যাপারটাই আমাদের (শিল্প-সাহিত্যের) নির্ধারক বিষয়।”
আইজেনস্টাইনকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আলোচকরা প্রধানত তাঁর শিল্পকলা বা প্রায়োগিক কৌশলের উপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু চলচ্চিত্র সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বা তাঁর কাজের সামাজিক তাৎপর্য নিয়ে ততটা আলোচনা হয়নি। চলচ্চিত্রের প্রায়োগিক দিক নিয়ে তিনি যে গবেষণা করেছেন তার মাধ্যমেও নিজের দর্শন ও অবস্থান দেখিয়েছেন। কবির প্রাথমিক হাতিয়ার যদি হয় শব্দ, চিত্রকরের রেখা, তাহলে চলচ্চিত্রকরের শট। শট-এর পর শট জোড়া লাগিয়ে তৈরি হয় চলচ্চিত্র। এই শট নিয়ে তিনি গভীরভাবে ভেবেছেন বলেই বলতে পেরেছেন – “The unity of the visible form of an object and of its imagist generalization, achieved by means of composition of the shot, is to us the most important feature of a truly realistic treatment of the shot. We consider that this ensures the emotional impression which the sight of the purely plastic images on the screen can excite.” সাধারণভাবে শিল্প বা সাহিত্যের দু’টি দিক থাকে – একটি তার বিষয়গত দিক (content) এবং অন্যটি আঙ্গিকগত দিক (form)। প্রত্যেকটি শিল্পকর্ম এক একটি বিষয়বস্তুকে অবলম্বন করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, আর সে জন্য আলাদা আলাদা আঙ্গিকের দরকার হয়। কিন্তু বিষয়বস্তুর সঙ্গে আঙ্গিকের সম্পর্কটা হতে হয় দ্বান্দ্বিক। আঙ্গিক যথাযথ না হলে একটা বিষয়বস্তু কখনও শিল্প হয়ে উঠতে পারে না। আইজেনস্টাইন তাঁর বিষয়বস্তুকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করার জন্য আঙ্গিক নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন এবং তা করতে গিয়ে চলচ্চিত্রে অনেক মৌলিকতার জন্ম দিয়েছেন। যেমন তাঁর ‘স্ট্রাইক’ ছবিটির একটি বিশেষ তাৎপর্য হল ‘মন্তাজ অব অ্যাট্রাকশন’-এর সচেতন ব্যবহার। পরবর্তীতে ‘ব্যাটলশিপ পটেমকিন’-এ এর ব্যবহার চলচ্চিত্রের ভাষাকেই বদলে দিয়েছিল।
‘মন্তাজ’ শব্দটির সহজ অর্থ হল জোড়া লাগানো। চলচ্চিত্রে বিভিন্ন শট বা দৃশ্যের যোগফলকে বলা হয় ‘মন্তাজ’। ডি. ডব্লিউ. গ্রিফিথ চলচ্চিত্রে মন্তাজের প্রথম প্রয়োগ করেন। তিনি ও তাঁর পরবর্তী পরিচালকরা ‘মন্তাজ’ বলতে শট বা দৃশ্যের জোড়া লাগানোকেই বুঝেছিলেন। কিন্তু আইজেনস্টাইন ‘মন্তাজ’ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এর অন্তর্গত অর্থটাকেই আমূল বদলে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন একাধিক ছোট ছোট শটকে একসঙ্গে জোড়া লাগিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে বড় পর্দায় একটি লম্বা সময়ের ঘটনাপ্রবাহ ফুটিয়ে তোলা যায়। তাঁর মতে, ‘মন্তাজ’ হচ্ছে দৃশ্যের সঙ্গে দৃশ্যের দ্বন্দ্ব। এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কুলেশভ, পুদভকিন-সহ অনেকের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক হয়। কিন্তু পরে তাঁরা সকলেই আইজেনস্টাইনের চিন্তাকেই সঠিক বলে মনে করেন। আসলে আইজেনস্টাইনের উপলব্ধি কেবলমাত্র একজন পরিচালকের সম্পাদনার টেবিলের কারিগরি দিকের উপর দাঁড়িয়ে নেই। তাঁর লেখা থেকে একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি যা থেকে বোঝা যাবে তাঁর মন্তাজ তত্ত্বের দর্শনগত দিক কতটা গভীর – “It is montage that produces the sense of three-dimensional in the cinema. How plastically flat are the representations of men, objects, settings and landscape shot in one piece, from one angle. And how they come to life all of a sudden, how they become rounded and acquire volume, how they become spatial as soon as you begin juxtaposing in montage their individual aspects shot from different aspects.”
মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক তত্ত্ব থিসিস-অ্যান্টিথিসিস-সিনথেসিসের উপর ভিত্তি করে আইজেনস্টাইনের ‘মন্তাজ’ তত্ত্ব দাঁড়িয়ে আছে। তিনি গোটা বিষয়টাকে মার্কসীয় তত্ত্বের আলোকে বুঝতে চেয়েছিলেন। তাঁর শিল্পভাবনা ও কর্মের প্রধান উৎস হল দু’টি বিরোধী সত্তার মধ্যে সংঘাতের চেতনা। সে বিরোধ বস্তুতে ও বস্তুতে, বস্তুতে ও ভাবে, দৃশ্যে ও শ্রাব্যে, গতির দিক পরিবর্তনে এবং ক্যামেরাতে ধরা শটের সঙ্গে শটের। এক একটি স্বতন্ত্র শটের আলাদা করে কোনও অর্থ থাকে না। কিন্তু আইজেনস্টাইনের মতে ওই দু’টি শটের সংযুক্তিতে ও সংঘাতের ফলে নতুন অর্থ তৈরি হচ্ছে। যেমন ‘অক্টোবর’ ছবির একটি শটে আমরা দেখছি কেরেনস্তি মুকুট নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। কাট, পরের শটেই আমরা দেখছি কারখানার হুইশল বাজছে। এ দু’টি আপাত-বিচ্ছিন্ন শট। কিন্তু দু’টিকে মিলিয়ে দেখলে আমরা বুঝতে পারি কেরেনস্কি জারের মতোই স্বৈরাচারি পথে যাবে, ফলে শ্রমিকশ্রেণীকে প্রস্তুত হতে হবে। ‘অক্টোবর’ ছবিরই আরেকটি শটে আমরা দেখছি প্রতিবিপ্লবী জেনারেল কর্নিলভ ধর্মের নামে বিপ্লবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামছে। কাট, পরের শটে দেখানো হচ্ছে যিশুকে, ডিম্বাকৃতি দেবীকে। এর মাধ্যমে দর্শকের কাছে যুগে যুগে ধর্মের ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আসলে আইজেনস্টাইন শুধুমাত্র দর্শেকর আবেগকে নাড়া দিতে চাননি, তার চিন্তাকেও প্রভাবিত করতে চেয়েছেন। তাই পরের দিকে তিনি ‘মন্তাজ’-এর নাম দিয়েছেন ‘ইন্টেলেকচুয়াল মন্তাজ’, অর্থাৎ তা দর্শকের বুদ্ধিবৃত্তিকে প্রভাবিত করবে। তিনি মনে করেন ইন্টেলেকচুয়াল সিনেমা কেবলমাত্র কাহিনি বা ঘটনার দৃশ্য বর্ণনা করবে না, মানুষের চিন্তাকেও দৃশ্যমান করার উপর তার সার্থকতা নির্ভর করবে। এই ধারণার উপর দাঁড়িয়েই তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘ফিল্ম ফর্ম : এসেজ ইন ফিল্ম থিয়োরি’-তে তিনি লিখেছিলেন – “Now why should the cinema follow the forms of theater and painting rather than the methodology of language, which allows wholly new concepts of ideas to arise from the combination of two concrete denotations of two concrete objects? Language is much closer to film than painting is.”
চলচ্চিত্রে আইজেনস্টাইনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল ‘টাইপেজ’। মানুষের মুখের বা শরীরের অংশ দেখিয়ে বা কোনও বস্তুর বিশেষ অংশ দেখিয়ে তার সম্পর্কে একটি উপলব্ধি তৈরি করাকে ‘টাইপেজ’ বলা হয়। ‘দি জেনারেল লাইন’ ছবিতে আমরা টাইপেজের উল্লেখযোগ্য কাজ দেখি। দৃশ্যায়নের ক্ষেত্রেও তিনি একটি বড় পরিবর্তন আনেন। তিনি ক্যামেরাকে অতীতের ধরাবাঁধা ফ্রেম থেকে মুক্ত করেন এবং বিভিন্ন জ্যামিতিক কোণ থেকে ক্যামেরায় দৃশ্যগ্রহণ করেন। তাঁর এ ধরনের দৃশ্যায়নের ক্ষেত্রে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির এবং জাপানের জ্যামিতিক চিত্রকলার পরোক্ষ প্রভাব ছিল। ‘ব্যাটলশিপ পটেমকিন’-এ কামানের কৌণিক ভঙ্গিমা, টন অ্যাঙ্গেল শটে প্যারাম্বুলেটর গড়িয়ে যাওয়ার দৃশ্য কিংবা বৃদ্ধার চশমার জ্যামিতিক রেখাচিত্র, ডায়াগোনাল অ্যাঙ্গেল শট প্রভৃতি চলচ্চিত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এত সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে হয়ত অনেক সময় বিষয়বস্তু ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটেছিল এবং আঙ্গিকের উপর মাত্রাতিরিক্ত জোর পড়েছিল, চিন্তার উপর প্রাধান্য দিতে গিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো আবেগের জায়গাটা বাদ পড়েছিল। তবে আইজেনস্টাইনের পক্ষে এ কথা বলা যাতে পারে অভিনব কিছু প্রদর্শন করার প্রয়াসে বা দর্শককে তাক লাগিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি এ সব করেননি। বরং চলচ্চিত্র শিল্পটিকে আয়ত্তে আনা এবং শিল্পের অন্তর্নিহিত রহস্য উদঘাটনের জন্যই তিনি নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন। উদাহরণ হিসেবে তাঁর লেখা থেকে একটি অংশ উদ্ধৃত করছি – “The cinema is the only plastic art that resolved all these problems of painting without loss of representation and objectivity and with complete ease. At the same time the cinema is capable of communicating much more: it alone is able to reconstruct the inner movement of phenomenon profoundly and fully. The camera angle reveals the secrets of nature. The juxtaposition of various camera angles reveals the artist’s attitude to the phenomenon. Montage structure unites the objective existence of the phenomenon and the artist’s subjective attitude to it. None of the severe standards modern painting sets for itself is relinquished. At the same time everything preserves the full vitality of the phenomenon.”
চলচ্চিত্রের ইতিহাসে মুষ্টিমেয় যে কয়েকজন প্রতিভা এই যন্ত্র ও বিজ্ঞাননির্ভর মাধ্যমটিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন সের্গেই আইজেনস্টাইন। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর মতো প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য, মৌলিক কল্পনাশক্তি, অসাধারণ বিশ্লেষণীক্ষমতা ও বহুমুখী সৃজনশীলতা নিয়ে আর কোনও পরিচালক আবির্ভূত হননি। পৃথিবীর সর্বত্রই চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মধ্যে তিনি অসংখ্যবার চর্চিত হয়েছেন। সমালোচকরা কেউ বলেন ‘অক্টোবর’ তাঁর যুগান্তকারী সৃষ্টি, কেউ বলেন ‘আলেকজান্ডার নেভস্কি’ তাঁর মহাকাব্যিক নির্মাণ, আবার কেউ ‘ব্যাটলশিপ পটেমকিন’-এর পক্ষে সওয়াল করেন। কিন্তু আইজেনস্টাইনের চিন্তার কতটুকুই বা আমাদের উপলব্ধিতে এসেছে! মাত্র পঞ্চাশ বছরের জীবৎকালে তাঁর চিন্তা ও কাজ শতবর্ষকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তিনিই প্রথম চলচ্চিত্রকার যিনি দেখিয়েছিলেন যে চলচ্চিত্রও পঠনের বিষয়, শেখার বিষয় হতে পারে। তাঁর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান বোধহয় ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতাদর্শ ও চলচ্চিত্রের নির্মাণ-কৌশলের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করতে পারা। সিনেমাটোগ্রাফির ব্যবহার, পরিচালনায় তত্ত্বের সার্থক প্রয়োগ, কুশলী সম্পাদনা এবং সংগীতের যথাযথ ব্যবহারে তিনি রাজনৈতিক বার্তাযুক্ত সিনেমাকেও কালজয়ী করে তুলেছেন। সর্বোপরি তিনি চলচ্চিত্রের এমন একজন পদ্ধতিগত তাত্ত্বিক, যিনি চলচ্চিত্রকে নানা আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করতে শিখিয়েছেন। উপসংহারে আইজেনস্টাইনকে উদ্ধৃত করছি – “The profession of film director can and should be such a high and precious one; that no man aspiring to it can disregard any knowledge that will make him a better film director or a human being.”
…….o……