বড় নিঃশব্দে চলে গেল শামশের আনোয়ারের চলে যাওয়ার দিন, ১২ জুন l
১৯৪৪ সালে ৩০ এপ্রিল, ঘড়ির কাঁটা ১২ টার ঘর ছুঁতেই জন্ম হয়েছিল তাঁর মুর্শিদাবাদ জেলার সালার-সংলগ্ন ‘রাজাদের গ্রাম’ তালিবপুরের মাটিতে এক বনেদি পরিবারে l কিন্তু বনেদিয়ানার ফকর তিনি পরিহার করে চলতেন l এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে ভেতরে ভেতরে এক অস্বস্তিকর জ্বালা অনুভব করতেন, বিরক্তি প্রকাশ করতেন l প্রতিভার বরপুত্র ছিলেন শামসের l বিস্ময়কর সে প্রতিভা ! কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কী করে তিনি বিস্মৃতির অতলে চলে গেলেন ভাবতেও কষ্ট হয় !
বড় স্বল্প দৈর্ঘ্যের জীবন তাঁর । ১৯৬৪ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সেই জন্মমৃত্যুকে একসঙ্গেই স্মরণ করেছিলেন শামসের l তাঁর কবিতায়, মাঝে মাঝে, সরীসৃপের মত শিরশিরে অস্বস্তিকর অনুভূতি উঠে আসে । পাঠক বিহ্বলিত হয়, মৃত্যুর হিমশীতল থাবা যেন তরুণ কবির কাঁধ কেটে রক্ত ঝরায়, কী শ্বাপদ অনুভব তাঁর ! “১৯৪৪ সালে কে কার ঘাতক হয়েছিলো কে দিয়েছিলে সময় দুপুর / ১২- টা, ৩০ শে এপ্রিল ? / চৌকাঠ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছি এত দীর্ঘ কাল / …..১৯৪৪ সালে হত্যা করেছিলাম ২০ বছর হয়ে গ্যালো / প্রতীক্ষায় আছি l”
এই কী জন্মদিনের কবিতা ! ‘জন্মদিন’- এ কেন তিনি দেখেছিলেন নিজের মৃত্যুকে ‘ভীতি বিহ্বল দর্পণে’ ? সেই ভয়ংকর মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য কেন ‘চৌকাঠ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে’ আছেন ! কী কৌতুককর নির্মমতা নিজের জন্মপরিচয়ের কবিতায় !
তারুণ্যে প্রবেশের সন্ধিক্ষণে গতানুগতিক কাব্য কাননে এক আকস্মিক বিস্ফোরণ ঘটান তিনি । কিন্তু পাঠক ঠিক বুঝে নেন তাঁর জন্ম ১৯৪৪ সালের শেষ এপ্রিলের দুপুর বেলার অক্তে । দুপুর বেলা কি তাঁর জন্য কোনো আত্মশ্লাঘার মুহূর্ত ছিল ! হয়তো বা । “দুপুর বেলার অক্ত / বৃষ্টি নামে…/ আরে বৃষ্টি কোথায় ! / এ যে বরকতেরই রক্ত !” আল্ মাহমুদের কবিতা তিনি পড়েছিলেন । কারণ ভাষা শহীদ বরকত তো তাঁদের গ্রামের স্কুলের ছাত্র, সম্পর্কে অগ্রজ পড়শী ভাই ।
শামশেরের কবিতা আত্মজৈবনিক ও আক্রমণাত্মক l খুব কাছের বন্ধু ভাস্কর চক্রবর্তী ‘শামশের আনোয়ারের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ গ্রন্থের ভূমিকায় তাই বলেন — “শামশেরের সঙ্গে বন্ধুত্বটাই ছিলো একটা বাঘের সঙ্গে বন্ধুত্বের মতো ।” তাঁর কবিতাগুলি যেন করাতাকলে কাঁটা ছেঁড়া হৃদয়-নিংড়ে উপস্থাপন করা l যেন বিরামহীন চাপ চাপ রক্ত করতলে চেপে রেখে প্রেমিকার সঙ্গে কথা বলা । সে প্রেমিকা মানবী নয়, কবিতা l তবে অত তাড়াতাড়ি মৃত্যুর কাবিনে স্বাক্ষর করেছিলেন কেন কবি :”তবে কি অনুতপ্ত ঘাতক আমি শবাধার ছুঁয়ে বসে আছি ? আমি তো হৃদয়ের ওপর বিশাল জ্যোৎস্না আড়াআড়ি / আমি তার দেহ ছুঁয়ে বসে আছি l” [জ্যোৎস্না ও শ্যামলীর হাসি]
মাত্র তিনটি কবিতার বই তাঁর । সেই ১৯৭৩ সালে ‘মা কিম্বা প্রেমিকা’, ‘স্মরণে, মাঝে মূর্খ স্বপ্নের গান’ আর তারপর ১৯৯১ – ‘এ শিকল আমার গায়ের গন্ধে’ এবং আর কয়েকটি প্রবন্ধ — সাকুল্যে সংখ্যা খুব বেশি নয় ।
ষাট সত্তরের দশক । তখন কেমন আমাদের কলকাতা, আমাদের বাংলা, আমাদের জঙ্গল মহল ! স্বাধীনতার অত বছর পরও ভীতি আর সন্ত্রাসের ছায়া, চিন ভারত যুদ্ধের রেশ, চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান শ্লোগান, কমিউনিস্ট পার্টির খন্ডিকরণ, নকশাল অন্দোলন, মেধাজীবী বাঙালি মননের অবক্ষয়, একান্ত আলোচনার অসহনীয় অস্বস্তিকর সংলাপ — ‘আমরা জন্ম স্বাধীন, কিন্তু শৃঙ্খলের অধীন’, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, শৃঙ্খল ভাঙার গান — “এই শিকল পরা ছল, মোদের এই শিকল পরা ছল”– সব মিলিয়ে স্বস্তি নেই কোথাও l ঢেউয়ের মত ওপার বাংলা থেকে পিঁপড়ের সারির মত শরণার্থীর দল l যাদের ঘর নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই l
“থকথকে এক বুক পচা কাদার মতো দুর্গন্ধ এক বুক অন্ধকারে / গলা অবধি ডুবিয়ে আমিই শুয়ে থাকি”। [ঘর]
বাদল সরকারের ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ বা মোহিত সরকারের ‘মৃত্যু সংবাদ’ বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতার বাঁধা ছকে যেন শাবলের আঘাত ! প্রচলিত মূল্যবোধ, নন্দনতত্ত্ব, নস্টালজিক ভাবনার মূলে পরশুরামের কুঠারাঘাতের মতই নির্মম । পৌরাণিকে পিতার আদেশে মাতৃমুণ্ডচ্ছেদ, কলিতে নেতার নির্দেশে নরমুণ্ডচ্ছেদ। “আমি পরশুরামের কঠিন কুঠার”, অথচ নজরুলের মত বিদ্রোহী বা বামঘেঁষা নিরামিষাশী পাতি বিদ্রোহী কোনটায় নন শামশের । আবেগের ফেরিওয়ালা কিম্বা ঝাণ্ডা হাতে পথে নামাও বড়ই নাপছন্দ তাঁর । “মূর্খতার গুঁড়ো মেখে নিই প্রত্যহ সন্ধ্যায় / তোমাদের মুখ হতে মূর্খতার গুঁড়ো চেটে খাই”–[ তুমিই আমার বুক, শাবল ও কঠিন আঁধার l], যাঁর যাপনে অস্বস্তি, অস্বস্তি যাঁর সর্বাঙ্গে, শাবল দিয়ে মাটি খনন, বৃক্ষচারা রোপণ নিমিত্তে নয় l কারণ একটা অদ্ভুত গাছের পাতা হাতে গান শুধাল : / কী গাছের পাতা বলো তো /।” আমি গানকে বুঝি না, মুখের কাছে ধরা পাতাটি / মনে হলো আরো দুর্বোধ্য ।”
খুব সাধারণ এক পাঠক তাঁর কবিতায় দুর্বোধ্যতার অভিযোগ এনেছিলেন । কিন্তু শামসের তো ছিলেন শব্দ শিল্পি । ছেনি হাতুড়ির বদলে তুলে নিয়েছিলেন রাম দা । কেননা “গোবি মরুভূমির ওপারে চেঙ্গিসের ধূসর হাড়/ সেই নিঃসঙ্গ জ্যোৎস্নায় পড়ে থাকে / দুঃস্বপ্নের মতো রক্তাক্ত অভিস্পায় নেচে ওঠে আগুনের শিখা /” [মরুভূমি ও মায়াবী জ্যোৎস্না]
তবু মেধার কষ্টি পাথরে উত্তীর্ণ শামশের । তাঁর কবিতা পড়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চমকিত– “শামশের আনোয়ার বিশুদ্ধ শব্দ নির্মাণের কবি। … কোন কোন কবিকেই সম্পূর্ণভাবে চেনা যায় না । মানুষ হিসেবে, কবি হিসেবে । প্রত্যেক প্রকৃত কবিই আস্তে আস্তে নিজের চারপাশে একটি অস্বচ্ছ বৃত্ত তৈরি করে নেন, স্বেচ্ছায় কখনো তার থেকে বেরিয়ে আসেন, আবার অনেক সময় অগোচর থাকতেই পছন্দ করেন । কখনো কখনো বৃত্তে সংঘর্ষও লাগে ।”
সংঘর্ষ সৃষ্টির নিয়মে হয় । হন্তা ও হন্তারক পরস্পরের ছায়া দেখে কেঁপে ওঠে । “জিভ ধূমকেতু ; ব্যর্থ নক্ষত্র কুকুর ছুটে যাবো কোথা ! / গর্ভ থেকে অর্থহীন গর্ভের আঁধারে ?” [ছাই]
কৃত্তিবাস তখন খ্যাতির শিখরে l নিবিড় আলিঙ্গনে শামশেরকে বাঁধতে এগিয়ে আসে l তাঁর মাথায় তুলে দেয় ‘কৃত্তিবাস পুরস্কার’ – এর শিরোপা l বলা হয় শামশের অনেক উপরে উঠবেন l যেন যুদ্ধে নামানোর আগে বিউগল বেজে ওঠে l কেঁপে ওঠেন শামশের l এরপর কি করবেন — খেই হারিয়ে ফেলেন l “তোমার মুখের ওপর স্থাপিত হাজার মুখ / অন্তরীক্ষে হয়তো কোথাও রয়েছে একটি মুখ যা স্থির ও পূর্ব নির্ধারিত l [মূঢ়, ভুল প্রার্থনা]
এরপর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ডাইরি পাতাগুলি- লোডশেডিং – এ বন্ধ ফ্যানের সুইচ অন হতেই উড়তে থাকে থাকে …., হঠাৎ চোখে পড়ে যায় –“আজ সকাল ৮ টায় শামশের আনোয়ার শামশেরকে মেরে ফেলল । আত্মহত্যার কথা থাকে, অনেকেই করে না। প্রয়োজনও থাকে না ।” কিন্তু শামশেরের প্রয়োজন হল কেন !
কেন ? — প্রশ্ন থেকে গেল l জবাব দিতে পারতেন যে প্রিয় সহচর, সেই নড়াইলের জমিদার বাড়ির ছেলে, যাঁর দৃষ্টি একেবারে অন্তর্ভেদী, এক্সরে’ র মত ছবি তোলা, সেই তুষার রায় শামশেরের মৃত্যুর ৩ বছর পর, মাত্র ৪২ বছরে চলে গিয়েছিলেন l কী অদ্ভুত মিল দু’জনের ! ভাস্কর চক্রবর্তী যখন বলেন, শামশেরের সঙ্গে বন্ধুত্বটাই ছিলো একটা বাঘের সঙ্গে বন্ধুত্বের মতো”, তখন তুষার রায় লেখেন, “আমারো ইচ্ছা হয় ছুঁয়ে যাই, গুহার ভেতরে গিয়ে/ বাঘিনীর রোমশ শরীর মেখে শুই l” [হনিমুনে বাঘ ডাকে]
ভাষায়, ভাবে তুষার শামশেরের সঙ্গে এতোই একাত্ম– যেন তিনি কবিতা লেখেন না, শামশেরকে আঁকেন– “একাকী কৃষ্ণচূড়া ঝলকে ঝলকে রক্ত বমি করে, / তাই ওই শিমুল শিরীষ পানে তাকাতে পারি না / স্ট্রেপটোমাইসিন দিন ওদের, ডাক্তার…. সিস্টার সিস্টার, আমাকে একটু প্লিজ…” l
অভিন্ন হৃদয় বন্ধু, বয়সে মাত্র আড়াই মাসের বড়, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত একমাস ধরে হাসপাতালে গিয়ে আত্মধ্বংসী বন্ধুর বেডের পাশে নীরবে বসে থাকেন l যেন একটা কাঠের গুঁড়ির পাশে বসে আছেন ! এতটাই অচেতন, মরণঘুমে শামশের !
”ইন্ডিয়া টাইমস’ – এর পাতায়, ২০১৭ সালের তাঁর সাক্ষাৎকারের বয়ান না পেলে শামশের সম্পর্কে অনেকটাই অজানা থেকে যেত l বোঝা যেত না শামশের ছিলেন তাঁর হৃদমাঝারে l
২০১৩ সালে তিনি (বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত) ‘আনোয়ার কি আজিব কিসসা’ নামে একটি ছবি রিলিজ করেন। নাম ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য বেছে নেন নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীকে l বাংলায়ও ছবিটি করার ইচ্ছা ছিল তাঁর । কিন্তু শামশেরের চরিত্রে অভিনয় করার মত বাংলার কোন হিরো তাঁর চোখে পড়েনি । শামশের কী এতই মহার্ঘ ছিলেন বরেণ্য চলচিত্রনির্মাতার কাছে ?
বুদ্ধদেব মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলেন অকালে বন্ধুকে হারিয়ে l বলেছিলেন–“আমরা তো একসঙ্গেই লিখতে শুরু করেছিলাম l” কিন্ত কে তাঁকে আফিং খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছিল ক্রমশঃ l সৃজনশীলতা লোপ পাচ্ছিল l ডিপ্রেশন থেকে ডিপ ডিপ্রেশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন শামশের l বুদ্ধদেববাবু হাজার চেষ্টা করেও শামসেরকে ফেরাতে পারেনি l কিন্তু শামশের আনোয়ার নামটিই তাঁর এত প্রিয় ছিল যে ‘আনোয়ার’ শুনলেই চকিতে হৃদয় উতলা হয়ে যেত l ভেতরের অনুভূতিতে শিহরন উঠত l গত বছর ভেতরের অস্বস্তি- অসুস্থতার সময় হয়ত তাঁর মনে হয়েছিল শামশেরের যাওয়ার দিন ১২ জুলাই তিনি যাবেন l কিন্তু মাত্র দু’দিন আগে ১০ তারিখেই তাঁকে চলে যেতে হল অথচ বাংলার ঘুণধরা-মস্তিষ্কজিবীদের কলম থেকে দু চার কথা বেরিয়ে এল না… আশ্চর্য !
শামশের মানে অস্ত্র l ভাস্কর চক্রবর্তীর ভাষায় (শামশেরের মত এমন) সশস্ত্র এক আধুনিক কবি, সত্যিই খুঁজে পাওয়া ভার l
______________________________________