Home / প্রবন্ধ / রামকিঙ্কর : সৃষ্টিসুখে মগ্ন এক উদাসীন- রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

রামকিঙ্কর : সৃষ্টিসুখে মগ্ন এক উদাসীন- রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

রঞ্জন চক্রবর্ত্তী
রামকিঙ্কর : সৃষ্টিসুখে মগ্ন এক উদাসীন

 

 

আধুনিক ভারতীয় ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্পের অন্যতম পথপ্রদর্শক রামকিঙ্করের জীবন ও সৃষ্টি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সময়ের সঙ্গে তিনি ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্র হয়ে উঠেছেন। তিনি শিল্পের যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন তা পুরোপুরি তাঁর স্বোপার্জিত। দরিদ্র অন্ত্যজ পরিবারের সন্তান এই শিল্পী সহজাত প্রতিভা, আত্মবিশ্বাস ও প্রজ্ঞার সমাহারে বিংশ শতাব্দীর ভারতীয় শিল্পের পুরোধা হয়ে উঠেছিলেন। প্রতিভার স্ফুরণে, শিল্প-সাধনায় ও ব্যক্তিত্বে তাঁর তুল্য দ্বিতীয় কোনও শিল্পীকে খুঁজে পাওয়া যায় না। ভারতীয় শিল্পকলায় আধুনিকতার ক্ষেত্রে নন্দলাল-রামকিঙ্কর-বিনোদবিহারীর অবদান অতুলনীয়।

শিল্পী রামকিঙ্করের শুরু জানতে হলে আসতে হবে বাঁকুড়ার যুগীপাড়ার এক মাটির বাড়িতে। এখানেই ১৯০৬ সালের ২৫ মে (মতান্তরে ২৬ মে) ক্ষৌরকার চণ্ডীচরণ বেইজ ও তাঁর স্ত্রী সম্পূর্ণার ছেলে রামকিঙ্করের জন্ম। এখানেই তাঁর প্রথম ছবি চিনতে শেখা।  দাদা রামপদর কাছে মেঝেয় অক্ষর লেখা শেখার সময় বালকের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকত দেওয়ালে টাঙানো রাধাকৃষ্ণের পটের দিকে। এক সাক্ষাৎকারে রামকিঙ্কর বলেছিলেন, “শেখাচ্ছেন, কিন্তু আমার চোখ দুটো আটকে আছে দেওয়ালে টাঙানো রাধাকৃষ্ণের পটে। কানে হাত পড়তেই চোখ নামাতে হয়। তখন থেকেই ছবি আমার চোখ টেনেছে।”

ছোটবেলা থেকেই শিল্পশিক্ষার প্রথম গুরু কুমোরপাড়ার অনন্ত সূত্রধরকে দেখে রামকিঙ্কর মাটির মূর্তি গড়া শিখেছিলেন। সেই বয়সেই মাটি ছেনে তৈরী করেছেন অনেক দেবদেবীর মূর্তি। শিল্পের প্রতি তাঁর গভীর নিষ্ঠার মনোভাব তখনই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। স্কুল-পড়ুয়া বালক স্থানীয় বারাঙ্গনাদের ভাদুপুজোর মূর্তি গড়ে দিতেন। পরে তিনি স্বদেশি মেলায় জাতীয় কংগ্রেসের পোস্টার এঁকেছেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় নেতাদের ছবি এঁকেছেন। তাঁর বাবা ক্ষৌরকর্ম করতে যেতেন রামানন্দ বন্দোপাধ্যায়ের বাড়ি। চণ্ডী নাপিতের ছেলের আঁকা ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছেন প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক।

১৯২৫ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা না দিয়ে বাঁকুড়ার যুগীপাড়া থেকে রামানন্দ বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে চলে এসেছিলেন রামকিঙ্কর। সঙ্গে একটা টিনের ট্রাঙ্কে কিছু জামাকাপড়, পেনসিল স্কেচ ও জলরঙে আঁকা ছবি। সেখানে কলাভবনে তাঁর কাজের কয়েকটি নমুনা দেখে নন্দলাল বসু প্রথমেই বলেছিলেন, “তুমি তো সব শিখেই এসেছ। তাহলে আবার এখানে কেন?” তারপর কী যেন ভেবে বলেছিলেন, “আচ্ছা, এসেছ যখন দু’-তিন বছর থাক।’’ সেই যে থেকে গেছিলেন রামকিঙ্কর, তার পর থেকে এক টানা সাড়ে-পাঁচ দশক শান্তিনিকেতন ছেড়ে আর যাননি। মৃত্যুর কিছু দিন আগে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “সেই দু’-তিন বছর আমার এখনও শেষ হল না।”

নিজের শিক্ষক সম্পর্কে সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল হলেও রামকিঙ্কর তাঁর কথা সব সময় মেনে চলেননি। কলাভবনের ছাত্রদের মধ্যে তিনিই প্রথম তেল রঙে কাজ করেছেন। মাষ্টারমশাই নন্দলাল প্রথমে সে ব্যাপারে আপত্তি করলেও পরে ছাত্রের যুক্তি মেনে নিয়েছিলেন। রামকিঙ্কর রঁদা, সেজান ও পরবর্তীকালের কিউবিস্ট ঘরানার ছবির সঙ্গেও পরিচিত ছিলেন। তাঁর কাজে কিউবিস্ট প্রভাব পড়েছিল, যা নিয়ে নন্দলালের সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিল। অবশ্য সে বিরোধ পরে মিটেও যায়। মডেল ব্যবহার করার বিষয়েও নন্দলালের স্পষ্ট আপত্তি ছিল। কিন্তু রামকিঙ্কর সেই আপত্তি মানেননি। তিনি পরবর্তীকালে বলেছিলেন, “মাস্টারমশাই শ্রদ্ধেয় নন্দবাবু ছিলেন ভীষণ গোঁড়া। তিনি ছিলেন জ্যান্ত মডেল ব্যবহারের ঘোর বিরোধী। বলতেন ও-সব পশ্চিমে চলে। কিন্তু আমি তার উপদেশ মেনে চলিনি। মডেল ব্যবহার করেছি।”

রামকিঙ্করের বেইজ পদবী নিয়ে অনেকে ঠাট্টা করত। তাই গোড়ার দিকে প্রবাসীতে রঙিন ছবি পাঠাতেন ‘রামপ্রসাদ দাস’ নামে। পরে ক্ষিতিমোহন সেন রামকিঙ্করকে পদবীর উৎপত্তি বুঝিয়েছিলেন — বৈদ্য থেকে বৈজ হয়ে বেইজ। রামকিঙ্কর প্রায়ই নিজেকে ‘ভুঁইফোড়’ বলতেন। শহুরে ‘স্বশিক্ষিত’ শব্দটির চেয়ে মাটির গন্ধ-লাগা এই শব্দটিই তাঁর পছন্দের ছিল। পরবর্তীকালে রামকিঙ্কর একবার প্রসঙ্গক্রমে সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে  বলেছিলেন, ‘ভদ্রলোকদের অনেক সময় বুঝতে পারি না। ওখানে সুর খুব কম। অনেকে আলাপ করতে আসে। ঢং ঢাং দেখি। কেউ পণ্ডিত সাজে, কেউ কবি আর্টিস্ট, কেউ ভালমানুষ, কেউ বা দাতাকর্ণ। যাত্রাদলের সঙ সব, মনে মনে হেসে মরি!’ এই সব লোকেরা তাঁকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে। কলকাতায় এক প্রদর্শনীর উদ্বোধন করতে এসেছেন, সেই প্রদর্শনীর পুস্তিকায় এক লেখক রামকিঙ্করকে সাঁওতাল বলে পরিচয় দিয়েছেন। রামকিঙ্কর এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘যাঁরা লেখেন, তাঁরা কি একটু খোঁজখবর নেওয়াও দরকার মনে করেন না?’ আসলে বাঙালি ভদ্রলোকেরা চিরকালই রামকিঙ্করকে নিয়ে নিজেদের পছন্দসই অলীক সত্য তৈরি করেছে!  তিনি জীবনযাপনে কতটা বোহেমিয়ান ছিলেন এ নিয়ে যত গল্প তৈরি করেছে, তাঁর কাজ নিয়ে ততটা হয়নি। ফলে তাঁর জীবন ও কর্মের অন্তর্নিহিত শিল্প-দর্শন আলোচনার বাইরে থেকে গেছে।

রং-তুলি আর বালি-কাঁকরে কাজ শিখতে শিখতে এক সময় রামকিঙ্করের কলাভবনে ছাত্রত্বের কাল শেষ হয়েছিল। তারপর তিনি নিজের মত করে স্বাধীনভাবে শিল্প-চর্চা শুরু করেন। কিন্তু সারা জীবন তিনি মনে রেখেছিলেন মাস্টারমশাই নন্দলালের উপদেশ, ‘‘রাতের স্বপ্নগুলোকে মনে রেখো কিঙ্কর। ভুলে যেও না। তেমন হলে, স্বপ্ন ভেঙে গেলে, উঠে স্বপ্নের কথা লিখে রাখবে। কোনও স্বপ্নই ভুলে যেও না। স্বপ্নে ছবি আসে কিঙ্কর, প্রতিমা আসে। স্বপ্ন আঁকবে!’’ রামকিঙ্কর স্বপ্ন থেকে আসা সৃষ্টিসুখের উল্লাসের সঙ্গে নিজের হৃদয়ের গোপন উচ্ছ্বাস মিশিয়ে দিয়েছিলেন। রামকিঙ্কর একই সঙ্গে প্রবলভাবে স্বাপ্নিক এবং প্রান্তিক জীবনের সার্থক রূপকার। তাঁর সৃষ্টিকর্মে প্রকৃতি ও প্রান্তিক মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি।

শিল্পের প্রথাগত শিক্ষার বাইরে থেকে এবং সব প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে রামকিঙ্কর সারা জীবন আপন সৃষ্টিকর্মে মগ্ন থেকেছেন। প্রখর রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে তিনি ভাস্কর্য তৈরি করতেন। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নয়, বিভিন্ন কোণ থেকে কাজটা বার-বার দেখতেন। নিজের উপলব্ধি থেকে তিনি বলেছিলেন, ‘স্কাল্পচারে খোদাইয়ের কাজে ছেনির প্রত্যেক ঘাকে মিনিংফুল হতে হয়। মুছে ফেলে আরম্ভ করবে, উটি হবে না হে। মেটিরিয়ালের সঙ্গে লড়াইয়ে দারুণ স্ট্রেন। ভুল করেছো কি কাজটাই নষ্ট।’ বিশ্বভারতীতে তখন ব্রোঞ্জ-ঢালাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান নেই। রামকিঙ্কর মাথা খাটিয়ে বার করেছিলেন কংক্রিট আর স্টোন চিপসের মেটিরিয়াল দিয়ে ভাস্কর্য গড়ার কৌশল। তাঁর শিল্পসাধনা বরাবরই আর সকলের থেকে আলাদা। যেমন ‘কলের বাঁশি’। বাতাসের বিপরীতে ছুটছে দুই সাঁওতাল যুবতী, উড়ছে আঁচল, পায়ে পায়ে ধুলো। পিছনে একটি ছেলে ছুটতে ছুটতে হাতের বাঁশিটা দিয়ে উড়ন্ত আঁচলটা ধরার চেষ্টা করছে। রামকিঙ্কর বলতেন, ‘ওই যে উড়ন্ত শাড়ির ফোল্ডগুলি, ভার জানো? ওর মধ্যে কতটা লোহা আর কংক্রিট ভাবো দেখি। ছবিতে এই সব ঝামেলা নেই। যখন নাস্তানাবুদ, দিলাম ছেলেটাকে অ্যাড করে। ওটাই সাপোর্ট।’ নিজের কাজ দিয়ে চিত্রকলা আর ভাস্কর্যের তফাত বুঝিয়ে দেওয়ার মতো এমন শিল্পী ক’জন আছেন।

রামকিঙ্কর একাধিক বার বলেছেন, “পোর্ট্রেট আঁকতে গেলে মুখটাকে ভাল ভাবে স্টাডি করতে হয়। মুখের অ্যানাটমির নকল নয়, ক্যারেক্টারকে ফুটিয়ে তোলা।” কিন্তু কীভাবে ক্যারেক্টারকে ফুটিয়েছেন তিনি? দীনবন্ধু অ্যাণ্ড্রুজের স্মরণসভার জন্য লেখায় ব্যস্ত রবীন্দ্রনাথ শর্ত দিয়েছিলেন তাঁকে কোনওভাবেই বিরক্ত করা যাবে না। কবি তখন অসুস্থ, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। রামকিঙ্কর বলেছিলেন, “আমি তাঁকেই ধরার চেষ্টা করেছি হে। সিরিয়াস রবীন্দ্রনাথ। বাজারের মিষ্টি মোলায়েম কবিগুরু নয়। সারা জীবন লোকটা কী করে গেল নিজের হাতে, শিলাইদহে, এখানে শান্তিনিকেতনে . . . সারা জীবন এমন হাড়ভাঙা খাটুনিই বা কজন খেটেছে আমাদের দেশে।” এই মূর্তিটি তৈরীর সময় রবীন্দ্রনাথের মুখের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য তাঁর চোখে ধরা দেয়, সেটি হল নাক। রামকিঙ্করের কথায়, “ওঁর মুখে নাক একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রোফাইলে সেটা আজও স্পষ্ট ধরা পড়ে। খাঁড়ার মতো।” হাঙ্গেরির বালাতোন হ্রদের ধারে তাঁর সেই ‘রবীন্দ্রনাথ’ নিয়ে কম ঝড় ওঠেনি! শিল্পবোধহীন ব্যক্তিরাও নানা মন্তব্য করেছেন তখন। সে সব শুনে রামকিঙ্কর মনে মনে হেসেছেন কেবল — “আর্টিস্টের কপাল দেখো। আমাদের বাঁকুড়ায় থিয়েটারের দলের একটা ঘর ছিল। সেখানে একটা ঢোল থাকত। দেখতাম যে যখন পাচ্ছে, এক বার করে পিটিয়ে দিচ্ছে।”

একদিন রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছিলেন, ‘বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়বি কাজে। শেষ করে আর ফিরে তাকাবি না। ছেড়ে দিবি। আবার ঝাঁপ দিবি অন্য কাজে।’ এটাই রামকিঙ্কর শিল্পীজীবনের বীজমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে — শিল্পের একটি ফর্মে চূড়ান্ত সিদ্ধিতে পৌঁছানোর সেই সিদ্ধি অবহেলায় ঠেলে ফেলে দিয়ে আবার নতুনের সন্ধানে যাত্রা। অন্তর থেকে আসা সৃষ্টির প্রেরণায় একটার পর একটা মূর্তি গড়েছেন রামকিঙ্কর, পছন্দ না হলে ভেঙেছেন, আবার নতুন করে গড়েছেন। প্রথমে বাঁশের ফ্রেমে খড় দিয়ে মোটা করে সিমেন্ট লেপে তৈরি করেছিলেন ‘সাঁওতাল পরিবার’। ভার কাঁধে মাঝি, ভারের এক দিকে মালপত্র আর অন্য দিকে ছোট ছেলে, পাশে ঝুড়ি মাথায় মেঝেন। কিন্তু বাঁশের ফ্রেমে সিমেন্ট টেঁকে না, ভেঙে পড়েছিলল। তার পর তৈরি করিয়েছিলেন লোহার আর্মেচার। তখনও শান্তিনিকেতনে বিদ্যুৎ নেই, সন্ধ্যার পর তাঁবু ফেলে মূর্তির সামনে বসে থাকতেন শিল্পী। ক্ষুধাতৃষ্ণার বোধ নেই, কখনও নিজের কাজ ভাঙতেন, কখনও বাড়তি কংক্রিট চেঁছে দিতেন। নিজেই বলেছেন, ‘উপোসটুপোসও মনে থাকে না কাজের মধ্যে ঢুকে পড়লে। ওটাই কেল্লা হে। কেউ ছুঁতে পারবে না তোমাকে এই কেল্লায় একবার সেঁধিয়ে পড়তে যদি পারো। যতই চেল্লাক, কানে যাবে না কিছু। ওখানে শুধু কাজ আছে আর তুমি আছো।’

ধান ঝাড়া থেকে কলের বাঁশি, রামকিঙ্করের প্রতিটি ভাস্কর্যেই কাজের ছন্দ ধরা পড়েছে। তিনি প্রায়ই বলতেন সাঁওতাল, গাঁ গঞ্জের খেটে-খাওয়া মানুষ তাঁকে সবচেয়ে বেশি টেনেছে। অনেক দিন পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আর্ট বিক্রয়যোগ্য পণ্য নয়… কেউ আমার তুলনায় বেশি পাবলিসিটি পেয়ে যাচ্ছে দেখে চিন্তিত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ছবি আঁকা বা মূর্তি গড়ার পর আমার দায়িত্ব শেষ। অহেতুক কোনও পাবলিসিটির চিন্তা না করলেও চলবে।’ তাৎক্ষণিক খ্যাতির মোহ থেকে বহু দূরে বাহ্যিক চটকের বিপ্রতীপে বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি, এবং তা আক্ষরিক অর্থেই। নন্দলাল বসু এক বার বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, ‘দেখে এসো, কলাভবনের দেওয়ালে কিঙ্কর আঁকছে। কী ডেক্সটিরিটি! দেখলে বুক কেঁপে যায়।’

রামকিঙ্কর আমাদের শিখিয়েছেন মুখের ফোটোগ্রাফ মানেই ভাস্কর্য নয়! ফোটোগ্রাফে রিয়ালিটি যেভাবে ধরা পড়ে তার বাইরে বেরিয়ে শিল্পীকে মানুষের মুখের চরিত্র ধরতে হবে। আলাউদ্দিন খাঁ যখন শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ নন্দলালকে তাঁর মূর্তি গড়তে বলেছিলেন। রামকিঙ্কর যেদিন অতিথিশালায় গিয়েছিলেন আলাউদ্দিন সে দিনই চলে যাবেন। তিনি দ্রুত কাজ করছেন, কিন্তু কিছুতেই তৃপ্তি হচ্ছে না। তার পরই হঠাৎ মনে হল, গত রাতেই তো শুনেছিলেন খাঁ সাহেবের বাজনা। রামকিঙ্করের ভাষায়, ‘সুরের ঢেউ উঠছে আকাশে দমকে দমকে, আর সুরের জালে জড়িয়ে পড়ছে মানুষ, গাছপালা, বাড়িঘর। কানে-শোনা শিল্পীর সেই ঝালা আমার ঘাড়ে চাপল, আর কুড়ি মিনিটেই কাজ শেষ।’

প্রস্তাব পেয়েও কিন্তু রামকিঙ্কর বাঁকুড়ায় তাঁরই পাড়ার রাস্তায় পৃষ্ঠপোষক রামানন্দের মূর্তি গড়েননি। কারণ হিসেবে তিনি এক বার স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, ‘শুন হে, আমি পোর্ট্রেট বানাই না। আমার শিল্প-ভাস্কর্য চিন্তায় রামানন্দের যে মূর্তি উঠে আসত, সে মূর্তি ওরা বুঝত না হে, বলত কিচ্ছু হয় নাই। তাই রামানন্দের মূর্তি বানাতে মন চায় নাই।’ এই যে কথাগুলো — ‘সে মূর্তি ওরা বুঝত না হে’, এটা রামকিঙ্করের মনের ভেতর থেকে এসেছে। আসলে শিল্পজ্ঞানহীন এই সমাজের কাছে তিনি অনেক ধাক্কা খেয়েছেন। স্বাধীনতার পর শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে নেতাজির মূর্তির জন্য প্লাস্টার অব প্যারিসে তৈরি একটি ছোট মূর্তি পাঠিয়েছিলেন। সেটা ঘোড়ায় চাপা নেতাজির মূর্তি, যাতে ঘোড়া আর তার পিঠের সওয়ার একাকার। তাঁর চোখে ঘোড়া আর নেতাজি দু’জনেই যে তেজের প্রতীক! সরকারি কর্তারা সেই মূর্তি ফেরত দিয়েছিলেন।

রামকিঙ্কর মানেই স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সৃষ্টিসুখে মগ্ন এক উদাসীন শিল্পী। এই উদাসীনতা কৃত্রিম সভ্যতাকে হেলায় প্রত্যাখ্যান-করা এক বাউলমনের। এক বার বিড়ি কেনার জন্য দু’টাকার নোট দরকার, কিন্তু সেই টাকাও তাঁর কাছে ছিল না। সোমেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় বিছানার শতরঞ্চি উল্টে দেখতে পেয়েছিলেন, সেখানে পড়ে আছে একটা মোটা অঙ্কের চেক। কবে যে তা তামাদি হয়ে গিয়েছে শিল্পীর সে খেয়াল নেই। খাওয়ার সময় তাঁর পাতেই মুখ দিত বিড়াল, কুকুরেরা। রামকিঙ্কর তাদের তাড়িয়ে দিতেন না, উল্টে সস্নেহ বলতেন, ‘খা, খা, তোদেরও তো বাঁচতে হবে।’

চেনা পথের বিরুদ্ধে চলা রামকিঙ্করের জীবনের ধর্ম। এই বিরুদ্ধতা কেবল ভাস্কর্য আর ক্যানভাসেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ভাস্কর্যের অবয়ব পেরিয়ে, ছবির ফ্রেম ছাপিয়ে তা মিশেছিল তাঁর প্রতিদিনের জীবনযাপনের সঙ্গে। শিল্প নিয়ে নিত্যকার ভাঙা-গড়ার খেলায় মগ্ন রামকিঙ্করের সহজিয়া জীবনচর্যা নিয়ে শান্তিনিকেতনে ক্রমেই সোরগোল উঠেছিল। তাঁর জীবনযাপন নিয়ে প্রচুর বিতর্কের সৃষ্টি হলেও তিনি সে সব নিয়ে কোনও দিনই মাথা ঘামাননি। ঘরে-বাইরে জীবন্ত মানুষের নেশা তখন তাঁকে পেয়ে বসেছে। তাঁর স্থির বিশ্বাস ছিল, “সব কিছুর মধ্যেই যৌনতা আছে। যৌনতা ছাড়া সব কিছুই প্রাণহীন, ঊষর।” একবার দিল্লি যাওয়ার পথে এক আদিবাসী নারীর যৌবনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার সঙ্গে তিনি অজানা স্টেশনে নেমে যান। বেশ কিছু দিন তাঁর খবর নেই, যেন হারিয়ে গেছেন। হঠাৎ এক দিন শান্তিনিকেতনে পৌঁছেছিল একটি টেলিগ্রাম, তাতে কোনও ঠিকানা নেই। শিল্পী শুধু এটুকুই জানিয়েছিলেন, “I lost myself, search myself.”

রামকিঙ্করের জীবনে অনেক নারী-ই এসেছে। তিনি কোনওদিন সে কথা গোপন করেননি। বরং অকপটে বলেছেন, “জীবনে অনেক মেয়ে এসেছে, এটা সত্যি। কেউ এসেছে দেহ নিয়ে, কেউ এসেছে মানসিক তীব্র আকর্ষণ নিয়ে। কিন্তু ছাড়িনি কাউকে। ধরেছি, আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছি। হজম করে ছিবড়ে করে ছেড়েছি। হজম করার মানে জানো? ও মন্ত্রটা আমার গুরুদেবের কাছে শেখা। তাঁর থেকে জন্ম নিয়েছে আমার অনেক ছবি, মূর্তি, অনেক কল্পনা, আর অনুভব।” নিজের সম্বন্ধে নির্দ্বিধায় এমন সত্য-কথন আর কোনও শিল্পীর মুখেই শোনা যায় না। মডেলদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে নানা কথা হাওয়ায় রটেছে। এ বিষয়ে রামকিঙ্কর সরাসরি বলেছেন, “আমার মডেলরা আমার বহু স্কেচে, ছবিতে, মূর্তিতে বেঁচে আছে। মডেলরা তো এভাবেই বেঁচে থাকে।” এ হল নিজের সম্পর্কে শিল্পীর সত্য-দর্শন।

রামকিঙ্করের জীবনে বহু নারীর আনাগোনা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। সে সবের প্রসঙ্গে উঠলে তিনি কখনও এড়িয়ে যাননি, সরাসরি উত্তর দিয়েছেন। তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি, “প্রেম এসেছে জীবনে। সেক্সুয়াল রিলেশনও হয়েছে। কিন্তু একটা জিনিস, কখনও লেপ্টে থাকিনি।”   তাঁর মডেল বিনোদিনীর সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, “বিনোদ, মানে বিনোদিনী? সে আমার ছাত্রী, মণিপুরী মেয়ে। একটু একটু করে শরীরের বাঁক, উপবাঁকের ভুবন চিনিয়েছিল ও-ই। আলো-অন্ধকারে ওকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এঁকেছিলাম অনেক। এক দিন চলে গেল। মণিপুরী ভাষায় একটি নাটকও লিখেছে আমাকে নিয়ে।” অসমের মেয়ে নীলিমা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “নীলিমা বড়ুয়া। নষ্ট হয়ে গেল ওর পোর্ট্রেট। আঁকতে আঁকতে কত বার যে রঙ লেগেছে শরীর থেকে শরীরে . . . সে সব কোথায় গেল! ভুল করেছি, তখন টাকার অভাবে ভাল রঙ কাজে লাগাতে পারিনি।” নিজের জীবনকে নিয়ে এত ভাঙাচোরা, এত সম্ভোগের পরও রামকিঙ্কর বলতেন, ‘‘রিয়ালিটির সবটাই কপি করতে নেই।’’

জীবনে যে নারীরা এসেছিল তাদের কাউকেই ভোলেননি রামকিঙ্কর। এসথার জয়ন্তী আপ্পাস্বামীর প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “মনে থাকবে না কেন? সে তো দক্ষিণী ছাত্রী জয়া। খুব ছিপছিপে ছিল। জয়া নামটা আমারই দেওয়া। সুজাতা করেছিলাম ওকে মডেল করে।” ভুবনডাঙার খাঁদু-র স্মৃতিও তাঁর মনে জীবন্ত ছিল, “দীর্ঘাঙ্গী খাঁদু ফিরে ফিরে এসেছে আমার ভাঙা ঘরে। সুন্দর ছিল ওর ফিগার। প্রায়ই দুপুর দুপুর আমার একলা ঘরে এসে দাঁড়িয়ে থাকত দরজার চৌকাঠ ধরে। এক কাঁখে থাকত ছেলে। সে দুধ খেত মায়ের বুকের। যে ভাবেই দাঁড়াত শরীরে নৃত্যের ভঙ্গী। অজস্র স্কেচ করেছি ওর।” রাধারানির সম্পর্কে রামকিঙ্কর বলেছেন, “ওই তো রইল শেষ পর্যন্ত আমার কাছে। ওর সঙ্গে মেলামেশা নিয়ে অনেকে আপত্তি করেছিল। ডেকে পাঠিয়েছিলেন বিশ্বভারতীর কর্তারাও। তাও ওকে ছাড়িনি। ও ছাড়েনি আমাকেও। আসলে রাধারানীর সঙ্গে আমার জড়ামড়ি সম্পর্ক।”

রাধারানি ছিলেন স্বামী পরিত্যক্তা এক গ্রাম্য মহিলা। তিনি কাজ করতেন রথীন্দ্রনাথের স্ত্রী প্রতিমা দেবীর কাছে। রামকিঙ্কর তাঁকে বললেন, “খাওয়াদাওয়ার অসুবিধা হয়, আমাকে লোকটি দিতে পারো?” রাধারানিকে মডেল করে ছবি আঁকতে শুরু করেন রামকিঙ্কর। কখনও দিনে, কখনও বা রাতে, সময়ে বা অসময়ে। শান্তিনিকেতন এতে তীব্র আপত্তি তুলেছিল। রামকিঙ্কর বলেছিলেন, ‘আমি সেবাদাসী রেখেছি। তোমাদের আপত্তি কেন?’ কারও কথায় কান দেননি রামকিঙ্কর, রাধারানি তাঁর কাছে শেষ পর্যন্ত থেকে গিয়েছেন। রামকিঙ্কর যখন দেশিকোত্তম পেলেন ছাত্ররা তাঁকে সংবর্ধনা দেবেন বলে ঠিক করলেন। রামকিঙ্কর বলেছিলেন মঞ্চে উপাচার্য এবং তাঁর পাশে সম-মর্যাদায় রাধারানিকে আসন দিলে তবেই তিনি অনুষ্ঠানে যাবেন।

রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে একদা শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন অস্ট্রিয়ার শিল্পতত্ত্ববিদ স্টেলা ক্রামরিশ। তিনি রামকিঙ্করকে মাঝে-মাঝেই পাহাড় ধরতে বলতেন। পরবর্তীকালে পাহাড়ও তিনি ধরেছিলেন। দিল্লিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সামনে আজও দাঁড়িয়ে আছে রামকিঙ্করের তৈরি করা ২১ ফুটের যক্ষ-যক্ষীর মূর্তি। ১৯৫৪ সালে কুলু যাওয়ার পথে রামকিঙ্কর দেখেছিলেন তাঁর পছন্দসই পাহাড়। ভাকড়া-নাঙ্গাল বাঁধের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে তা ব্লাস্ট করিয়ে পাওয়া গেল পাথরের খণ্ড। ন্যারোগেজ লাইনের ট্রেনে সেই পাথর আনার জন্য বদলানো হয়েছিল ওয়াগনের চেহারা। পাঠানকোটে হয়ে ব্রডগেজ ট্রেনে সেই পাথর আনা হল দিল্লিতে। এত ঝঞ্ঝাট করে পাথর আনা হল, কিন্তু কাজ আর এগোয় না। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তাঁকে সতর্ক করে বার্তা পাঠাল, নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। কাজ শেষ করার ডেটলাইনের কথায় রামকিঙ্কর গেলেন রেগে। ডেটলাইন পেশাদার কর্মীর জন্য হতে পারে, সৃজনশীল শিল্পীর নয়। ব্যাঙ্কের কর্তারা কি বুঝবে, কত দিন ঘুম ভেঙে মধ্যরাতে তিনি তাকিয়ে থেকেছেন অসমাপ্ত ভাস্কর্যের দিকে! আগে ধ্যানস্থ হয়ে পরিপার্শ্বিক ও প্রকৃতিকে নিজের ভাবনায় নিতে হবে, তার পরেই তৈরি হবে শিল্পসম্ভাবনা। ১৯৬৭-তে শেষ হল কাজ। রামকিঙ্কর চিঠিতে রাধারানিকে জানালেন, “যক্ষীটা তোমার আদলে। তোমার জন্য অনেকগুলি টাকা পেয়েছি। আমাদের বাড়ি ছেড়ে কখনও যাবে না।”

‘ভুবনডাঙার কিঙ্কর’ শিরোনামে এক স্মৃতিচারণে আবীর মুখোপাধ্যায় ক্ষোভের সঙ্গে লিখেছেন, ‘রামকিঙ্কর বেইজ। খড় কেনার পয়সা নেই, তাই ঘরের ভাঙা চাল ঢাকতেন নিজের তৈরি ক্যানভাসে। তাঁর দরাজ গলার রবীন্দ্রগান ক’জন শুনল? ওঁর মদ্যপ্রীতি, নারীসঙ্গই জানল শুধু!’ রামকিঙ্করকে ভারতীয় শিল্পকলায় আধুনিকতার পুরোধা হিসেবে ধরা হয়। তিনি এমন এক সময় শিল্প নির্মাণ শুরু করেন যখন ভারতীয় শিল্পকলা ক্রমশ আধুনিকতার দিকে ঝুঁকছে। তিনি প্রতীচ্যের শিল্পভাষাকে আত্মস্থ করে নিজের সৃষ্টিকর্মে ব্যবহার করেছিলেন। তাই তাঁর শিল্পকর্ম ভারতীয় শিল্পের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। মানুষের মুখ, সেই মুখের নানা অভিব্যক্তি, শরীরের ভাষা ইত্যাদিকে নাটকীয় ভঙ্গিতে প্রকাশ করায় তাঁর আগ্রহ ছিল। আধুনিক পাশ্চাত্য শিল্পের পাশাপাশি প্রাচীন ও আধুনিক ভারতীয় ধ্রুপদী চিত্রকর্ম তাঁর শিল্পসৃষ্টির কেন্দ্রে ছিল। ভাস্কর্যের বিমূর্ত রূপরীতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাকারী প্রথম ভারতীয় শিল্পী ছিলেন রামকিঙ্কর। তার ভাস্কর্য গতিময় এবং প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। তাঁর কাজ ছান্দিক ও প্রতিসম যার সাথে প্রকৃতির একটি আত্মিক যোগাযোগ খুঁজে পাওয়া যায়।

বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী সাগরময় ঘোষ (দেশ পত্রিকার প্রবাদ-প্রতিম সম্পাদক) লেখায় পাওয়া যায় – ‘‘রবীন্দ্রনাথ রামকিঙ্করকে ডেকে বললেন, শোন, কাছে আয়। তুই তোর মূর্তি আর ভাস্কর্য দিয়ে আমাদের সবখানে ভরে দে। একটা শেষ করবি আর সামনে এগিয়ে যাবি— সামনে।’’ এর পর আর কখনও পিছনে ফিরে দেখেননি রামকিঙ্কর। ভারতীয় ভাস্কর্যের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্মাণে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাঁর ভাস্কর্য ও চিত্রের কোনওটিই সেই সময়ের প্রচলিত ভারতীয় রূপরীতির অনুসারী নয়। সেগুলো তাঁর নিজস্ব শিল্প-ভাবনার ঋদ্ধ প্রকাশ। বিশিষ্ট শিল্পী কে জি সুব্রামনিয়াম তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, “সম্ভবত তিনি প্রথম ভারতীয় ভাস্কর যাঁকে সৃষ্টিশীল ভাস্করের খেতাব দেয়া যায়, তিনি ফরমায়েশকারীর চাহিদা মেটাতে নয় বরং নিজের আনন্দের জন্য ভাস্কর্য নির্মাণ করতেন।”

রামকিঙ্কর নিজের শিল্পকর্মে সাঁওতালদের জীবন ও কর্মের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন এবং তা করেছেন পাশ্চাত্যের প্রকাশবাদী ঢঙে। তিনি প্রায় সারাটা জীবন শান্তিনিকেতনে কাটিয়েছেন। সেখানকার ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষরা তাঁর আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল। তিনি ছবিতে ও ভাস্কর্যে তাদের জীবনকে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘শান্তিনিকেতনের সাঁওতালরা আমায় বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে।… ওরা এত অল্পে তুষ্ট যে বিস্ময় লাগে। সেই বিস্ময়ের আনন্দেই আমি ওদের ছবি করি। মূর্তি গড়ি। যেন মনে হয় ওদের চিনি। ওরাও বোধ হয় আমাকে চেনে। তাই এদের এই চলমান জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তকে আমি আমার ছবি ও মূর্তিতে ধরে রাখার চেষ্টা করেছি।’ তাঁর চারপাশের সচল, প্রাণবন্ত ও মাটির সঙ্গে সংলগ্ন মানুষগুলির এই স্বতঃস্ফূর্ত জীবন-প্রবাহ তাঁকে সর্বক্ষণ টানতো। তার সঙ্গে প্রকৃতির সৌন্দর্য ও তার দুর্দমনীয় শক্তিকে তিনি নিজের শিল্পকর্মে ভিন্ন মাত্রায় তুলে ধরেছেন। সেই জন্যই তাঁর ছবিতে ধানমাড়াইরত গ্রামীণ নারী, সাঁওতাল উৎসব, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা এবং ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। নারী, পুরুষ ও শিশু – এই থিম নিয়ে  তিনি অনেক ছবি এঁকেছেন ও ভাস্কর্য তৈরি করেছেন। এই বিষয়ের প্রতি নিজের আগ্রহের কথা তিনি স্বীকার করেছেন, ‘প্রকৃতিতে আমরা দুটি আকৃতি পাই, পুরুষ আর নারী। তৃতীয়টি হচ্ছে তার প্রজনী – বাচ্চা। এই থিমটি এক অদ্ভুত সুন্দর। এর ওপর কত আনন্দ, কত সৌন্দর্যের খেলা চলেছে।’ শরীরের গড়ন বা রূপরীতির ক্ষেত্রে তিনি প্রকাশবাদী ধারার অনুসারী। সমাজের সুবিধা থেকে বঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাথে ঘনিষ্ঠতায় তাঁর অনুভূতিপ্রবণ মনের ভিত্তি গড়ে উঠেছে। মানুষ, বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষের ভাবনায় তিনি গভীরভাবে মোহাবিষ্ট ছিলেন।

সারা জীবনের সৃষ্টিকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে অনেক সম্মানই পেয়েছেন রামকিঙ্কর – ভারত সরকার প্রদত্ত পদ্মভূষণ, বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম, রবীন্দ্রভারতীর ডি. লিট। দেশে-বিদেশে তাঁর কাজের একাধিক প্রদর্শনী হয়েছে। ‘কিঙ্করদার স্মৃতি’ রচনাটিতে সুশোভন অধিকারী লিখছেন, ‘সব্যসাচী রামকিঙ্কর বেইজ। তাঁর আশ্চর্য জীবনযাপন, অলকসামান্য ছবি আর ভাস্কর্যমালাকে কি কোনো পুরস্কারের নিগড়ে বাঁধা যায়? এর আগেও একাধিক পুরস্কারে ভরে উঠেছে ডালা। তবু একথা স্বীকার করতেই হবে, তাঁর কাজের পাশে এসব পুরস্কারের মালা নেহাতই ম্লান হয়ে এসেছে। আমাদের দেশে রামকিঙ্করই তো সেই শিল্পী — যিনি মন্দিরের দেওয়াল থেকে, পাহাড়ের গা থেকে ছিঁড়ে ভাস্কর্যকলাকে উপড়ে এনেছিলেন — মানুষের মাঝে। প্রোথিত করেছিলেন আমাদের চোখের সামনে প্রকৃতির খোলা দরবারে। প্রতিমা তৈরির শিল্প আর স্কাল্পচারের তফাৎটুকু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের। ভাস্কর্যকে স্টুডিয়োর অন্দর ছেড়ে বাইরে এনে তার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই আলো-বাতাস-মাটি ঘেরা উন্মুক্ত ভুবনে ভাস্কর্যকে দেখসম্পর্কে আমি সব সময়ই উদাসীন। একজন শিল্পী যতক্ষণ সৃষ্টির নেশায় মাতাল হয়ে থাকেন, ততক্ষণ পর্যন্ত বার চোখ, তাকে অনুভব করবার বোধ সযত্নে নির্মাণ করে দিয়েছেন। সে কি একদিনে ঘটেছে? এ অসাধ্য সাধন করতে কত সীমাবদ্ধতা, কত কঠিন চ্যালেঞ্জ, কত দুর্বার হার্ডলের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছিল তাঁকে — তার কতটুকুই বা আমরা জানি?’

১৯৮০ সালের ২ আগস্ট রামকিঙ্করের মৃত্যু হয়। জীবন ও মৃত্যুর টানাপোড়েনকে তিনি এভাবে দেখতেন, “মৃত্যু তাঁকে কোনও ভাবেই স্পর্শ করতে পারে না।” প্রকাশ দাস সম্পাদিত ‘রামকিঙ্কর: অন্তরে বাহিরে’ বইয়ের ভূমিকায় রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই মূল্যায়ণ করেছেন, “মানুষ রামকিঙ্কর আর শিল্পী রামকিঙ্করে কোথাও ছলনা করেনি। দুয়ে মিলে পূর্ণ রামকিঙ্কর। আমরা তাঁর শিল্প সৃষ্টিকে আর তাঁর নিত্যদিনের জীবনকে আলাদা করে দেখতে চাইলেও সম্ভব নয়।” কিন্তু তথাকথিত ভদ্রলোকের সমাজ তাদের নিজেদের গড়া ডিসকোর্সের দোহাই দিয়ে রামকিঙ্করের মতো মাপের একজন শিল্পীকে, একজন মানুষকে চিরকাল কী নিষ্ঠুরভাবেই না একা করে রেখেছিল!

রামকিঙ্করের জীবন ও সৃষ্টি নিয়ে অনেকেই লিখেছেন। তাঁর এক সময়ের বান্ধবী বিনোদিনী মণিপুরি ভাষায় লিখেছিলেন ‘অশংবা নোংজাবী’ নামে একটি নাটক, যার কেন্দ্রীয় চরিত্র শিল্পী গৌতম অনেকটাই রামকিঙ্করের আদলে নির্মিত। মণীন্দ্র গুপ্ত লিখেছেন ‘রং কাঁকর রামকিঙ্কর’ নামে একটি রচনা। এ ছাড়া শান্তি সিংহ লিখেছেন ‘রামকিঙ্কর’ উপন্যাস। কিন্তু সব থেকে আগে যে রচনাটির নাম করতে হয় নাম করতে হয় সেটি হল সমরেশ বসুর অসমাপ্ত রচনা ‘দেখি নাই ফিরে’। সমরেশ অবশ্যই রামকিঙ্করের জীবনী লিখছিলেন না, আসলে তিনি তৈরি করছিলেন জীবনভিত্তিক উপন্যাস। রামকিঙ্কর যেমন কৃত্রিমতায় ভরা মেকি সভ্যতার কাছে বরাবর অধরা ছিলেন, তাঁর সাহিত্যিক উপস্থাপনাও তেমনই অসমাপ্ত থেকে গেছে।

 

সহায়ক গ্রন্থাবলী ও পত্র-পত্রিকা :

১. দেখি নাই ফিরে — সমরেশ বসু, আনন্দ পাবলিশার্স

২. রামকিঙ্কর অন্তরে বাহিরে — প্রকাশ দাস

৩. বিশ্বভারতী পত্রিকা, রামকিঙ্কর বেইজ সংখ্যা

৪. শিল্পী রামকিঙ্কর আলাপচারি — সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশার্স

৫. রামকিঙ্করের প্রেম : নিদারুণ অকরুণের সাথে —  মোস্তাফিজ কারিগর

৬. শুদ্ধশীল বসুর নেওয়া সাক্ষাৎকার, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা, দেওয়ালি সংখ্যা, ১৯৭২

৭. রামকিঙ্করের রবীন্দ্রনাথ — জয়দীপ মুখোপাধ্যায়

৮. ভুবনডাঙার কিঙ্কর —  আবীর মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ

৯. শিল্প সংক্রান্ত — পূর্ণেন্দু পত্রী

 

 

 

Leave a comment

Check Also

একুশে ফেব্রুয়ারি

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো : একটি গান ও দুই বাংলার মিলনসেতু – বদরুদ্দোজা হারুন

[ভাষা শহীদ আবুল বরকতের ৯৬ তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে লেখা l]   “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো …

মহাশিল্পী রবিশংকর : ভারতের মোৎসার্ট – রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

  বিশ্বের সংগীতপ্রেমীদের কাছে রবিশংকর ও মোৎসার্ট দু’টি নামই সুপরিচিত। উভয়েই বহুশ্রুত হলেও সংগীতের গভীরে …

pablo neruda

পাবলো নেরুদা : জীবন ও কবিতার সংরাগ – রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

।। এক।। দক্ষিণ আমেরিকার তিনজন অসীম প্রতিভাশালী কবি হলেন সোর জুয়ানা ইনেস ডি লা ক্রুজ, …

দু’একটা সত্য কথা – সুদীপ্ত বিশ্বাস

মাত্র ১০০০০ বছর আগে কোনো ধর্মই ছিল না। ছিলনা ধর্ম-ধর্ম করে মানুষের সাথে মানুষের বিভেদ। …