Home / ধারাবাহিক / পঞ্চম পর্ব- ভুঁড়েলবাটির ভুঁড়ি চোর- মৌসুমী পাত্র

পঞ্চম পর্ব- ভুঁড়েলবাটির ভুঁড়ি চোর- মৌসুমী পাত্র

পঞ্চম পর্ব

পঞ্চম পর্ব-ভুঁড়েলবাটির ভুঁড়ি চোর
শিল্পী- যামিনী খাঁ

উপর্যুপরি এইসব ঘটনায় গঞ্জে মহা শোরগোল পড়ে গেল। লোকজনের সমবেত চাপা দীর্ঘশ্বাসে প্রায় সারাক্ষণই ছোটখাটো ঝড় বইছে। আশেপাশের দশটা গাঁয়ের লোক যতই মহুলবাটিকে ভুঁড়েলবাটি বলে হাসাহাসি করুক না কেন, মহুলবাটির বাসিন্দারা নিজেদের নিয়ে বরাবরই অত্যন্ত গর্ববোধ করে। ছেলেছোকরারা অন্যান্য গ্রামের লোকজনদের শুনিয়ে শুনিয়ে ছড়া কাটে- এমন ভুঁড়িটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি/ সকল ভুঁড়ির সেরা যে সে ভুঁড়েলবাটির ভুঁড়ি।

শেষমেষ হ্লাদিনী দেবীই উদ্যোগ নিয়ে একটা মিটিং ডাকলেন। তাঁর জ্বালাময়ী ও মর্মস্পর্শী ভাষণে অনেকেরই চোখে জল এসে গেল।

“হে ভাইসব ও বোনসব! ভুঁড়েলবাটিতে গত কয়েকদিনে পরপর যেসব দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে, তাতে আমরা, এই ভুঁড়েলবাটির বাসিন্দারা এক অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের সম্মুখীন। দিনেদুপুরে ডাকাতির কথা শোনা যায়, কিন্তু তাই বলে দিনেদুপুরে ভুঁড়ি চুরি! ভূভারতে কেউ শুনেছে? ভুঁড়ির গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। ভুঁড়ি ইজ মাই বার্থ রাইট অ্যান্ড আই শ্যাল হ্যাভ ইট! ভুঁড়ির আমি,  ভুঁড়ির তুমি, ভুঁড়ি দিয়ে যায় চেনা। এই ভুঁড়ি নিয়েই অন্যান্য গ্রামগঞ্জের লোকেরা আমাদের কি কম ঈর্ষা করে? আড়ালে আবডালে তারা আমাদের যতোই ভুঁড়েলবাটি বলে উপহাস করুক না কেন, আসলে আমরা তো জানি…, কী জানি?”

এই বলে হ্লাদিনী দেবী পাশের দিকে তাকালেন। চিন্তাহরণবাবু ফিসফিস করে বললেন, “নেবারস এনভি, ওনারস প্রাইড!”

হ্লাদিনী দেবী পুনরায় সামনের দিকে মুখ ফেরালেন, “ইয়েস,  নেবারস এনভি, ওনারস প্রাইড! পড়শির ঈর্ষা, ভুঁড়িমালিকের গর্ব! কিন্তু আমাদের এই গর্ব সুপরিকল্পিতভাবে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করে ধুলোয় মিশিয়ে দেবার চেষ্টা চলছে। তার বিরুদ্ধে আমাদের একজোট হতে হবে। শুধু একজোট হওয়াই নয়, সমাধানের রাস্তাও বের করতে হবে।”

ওপরে হ্লাদিনী দেবীর বক্তৃতা চলছে। মাধাই তার দুই মেয়ে নিয়ে এসেছে মিটিং-এ। তারা দুজন খুব মন দিয়ে হ্লাদিনী দেবীর ভাষণ টুকছিল। পরে ‘বড়দিমণি বড়দিমণি’ খেলায় কাজে দেবে। ছোট বোন তার দিদিকে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ রে, দিদি, এর মধ্যে কোন জায়গাগুলো বেশি ইম্পরট্যান্ট রে?” তার দিদি খানকয়েক জায়গা দাগিয়ে দিল।

এদিকে দর্শক-কাম- শ্রোতামণ্ডলীর মধ্যে জোর ফিসফাস শুরু হয়ে গেছে। যাঁদের মোটামুটি বাহারি ভুঁড়ি আছে, তারা যে যার ভুঁড়ি আগলে বসে আছে। ঝিকলু পড়ে ক্লাস ফোরে। সে মাত্র কয়েকদিন আগে মহাভারত পড়েছে। সে তার মাকে শুধোল, “মা, মা, এটা কি বিনাযুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র ভুঁড়ি?”

একদঙ্গল ছেলেমেয়ে ভলান্টিয়ারগিরি শুরু করে দিয়েছে। যে বা যারাই ঢুকছে, তাদের চেতাবনি দিচ্ছে, “সাবধান! ভুঁড়ি সামলে! ভুঁড়ি আগলে রাখুন!”, “ভুঁড়ির দায়িত্ব ভুঁড়ি মালিকের”, “এখানে ভুঁড়ি চুরি গেলে উদ্যোক্তারা কোনভাবেই দায়ী থাকিবেন না” ইত্যাদি ইত্যাদি।

এর মাঝখানেই জগত্তারণবাবুর সাথে টিনুবৌদির একতাল লেগে গেল। জগত্তারণবাবু আক্ষেপের সাথে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “এটা কি একটা কথা হল, বৌমা? ভুঁড়ি কি আর চুরি-ডাকাতি হয়? এই তো আমারই, যৌবনকালে মাথাভর্তি চুল ছিল। আর এখন মাথাভর্তি টাক। তাই বলে কি আমি কাউকে বলতে গেছি যে আমার চুল সব চুরি গেছে? না, তাই নিয়ে মিটিং করতে বসেছি?”

টিনুবৌদি রাগরাগ মুখে নিজের ভুঁড়িটা গোছাতে গোছাতে বললেন, “তা বললে তো হয়না, জগুকাকা। মাথায় টাক পড়া এক জিনিস আর এতগুলো মানুষের এতগুলো জলজ্যান্ত ভুঁড়ি গায়েব হওয়া আর এক জিনিস।”

জগত্তারণবাবু শুকনো মুখে বললেন, “দ্যাখো গে, নিজেরাই হয়তো মনের ভুলে কোথাও ফেলেটেলে এসেছে।”

টিনুবৌদি প্রবলবেগে ভুঁড়ি দুলিয়ে বললেন, “তা হয় না, কাকাবাবু। এতোগুলো ভুঁড়ি-অন্ত-প্রাণ মানুষ একসঙ্গে ভুঁড়ি অঞ্জলি দিয়ে আসবেন, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।”

ওদিকে তখন মঞ্চে হ্লাদিনীদেবীর বক্তৃতা সবে শেষ হয়েছে। বয়স্করা অনেকেই চোখের জল মুছছেন।

চিন্তাহরণবাবু, পুলিন, পয়মন্ত একে একে সবাই বক্তব্য রাখল। যাদের মনে সামান্যতমও দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল, তারাও ঘাড় দোলাতে শুরু করেছে। বিশেষ করে খোদ পয়মন্ত আর পুলিনের ভুঁড়ি চুরি!

চিন্তাহরণবাবু নাহয় দিলদরিয়া মানুষ, কাউকে ভালোবেসে দিয়ে থাকতেও পারেন। কিন্তু বাকী দুজন? নাহ!

কিন্তু সত্যিসত্যিই যদি চুরি হয়ে থাকে, তাহলে চুরি করছে কে বা কারা? চুরির মোটিভই বা কী? বা আদৌ যে চুরি হচ্ছে, তাই বা নিশ্চিত করে কে বলতে পারে?

এইসব প্রশ্নে যখন সবাই জেরবার, তখন হাল ধরল পুলিন। রীতিমত পুলিশি ঢং-এ মাথার ওপর দুই হাত তুলে নাটকীয় ভঙ্গীতে সে বলতে শুরু করল, “বন্ধুগণ ও বান্ধবীগণ, সাইলেন্স প্লিজ। মানে অনুগ্রহ করে শান্ত হন। পয়মন্ত আপনাদের কিছু বলতে চায়।”

পুলিনের কথায় ম্যাজিকের মত কাজ হয়। “চুপ, চুপ, পয়মন্ত বলছে…”, এরকম একটা সমবেত স্বর ভাসতে থাকে এলোমেলো হাওয়ায়।

“সমবেত বন্ধুগণ ও বান্ধবীগণ, পয়মন্ত ভাষণ শুরু করে, “দাদাগণ ও বৌদিগণ, দিদিগণ ও জামাইবাবুগণ, ভাইগণ ও তৃবধূগণ, ভগ্নীগণ ও ভগ্নীপতিগণ, দাদুগণ ও দিদিমাগণ, ঠাকুর্দাগণ ও ঠাকুমাগণ, পিসিগণ ও পিসেমশাইগণ…”

সম্বোধন প্রক্রিয়া আরো কতক্ষণ চলত বলা মুশকিল, কিন্তু একটা জোরালো স্বর ছুটে গেল পয়মন্তের দিকে, “বুঝতে পারছি, সবই গন কেস। আগে বাঢ়ো।”

পয়মন্ত এদিক ওদিক তাকায়। কিন্তু সমবেত জটলার মাঝ থেকে কে যে কথাটা তার দিকে ছুঁড়ে দিল, ঠাহরই করতে পারল না। যাই হোক, একটু থেমে সে পুনরায় শুরু করে, “হ্যাঁ, ইয়ে মানে, তা যা বলছিলাম, আমাদের ভুঁড়েলবাটি থেকে নিত্য নৈমিত্তিক এই ভুঁড়ি চুরি বরদাস্ত করা যায় না। আমাদের ভুঁড়েলবাটির ভুঁড়ি, এ কি যে সে ভুঁড়ি? কত সাধনা করে পাওয়া। আমাদের পাশের গাঁ গোঁফপলসার লোকজন আমার কাছে কতবার ভুঁড়ি বাগাবার জন্য পায়ে হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেছে, কিন্তু আমি কি তাদের কখনো ভুঁড়ি তৈরির সুলুক সন্ধান বলেছি? বলিনি। অতএব, হে জোয়ান, হও আগুয়ান, করিতে নিজ নিজ ভুড়ি রক্ষা।”

পয়মন্ত একটু থেমে জামার খুঁটে চোখ মোছে। সেই ফাঁকে মাধাইয়ের ছোটমেয়ে তার দিদিকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে দিদি, সামনে আগুয়ান হব কী করে? স্টেজে তো ধাক্কা খেয়ে যাব তাহলে।”

তার দিদি ঠোঁটে আঙুল চাপা দিয়ে ইশারায় বোনকে চুপ করতে বলে। ওদিকে পয়মন্ত আবার শুরু করেছে, “এখন ভুঁড়ি যে চুরি হচ্ছে, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। এতগুলো তাজা তাজা ভুঁড়ির অকালে ঝরে যাওয়াটা কোনমতেই মেনে নেওয়া যায় না।”

সমবেত একটা রব উঠল হাওয়ায়, “যায় না, যাবে না।”

পয়মন্ত তাতে আরো উৎসাহিত হয়ে শুন্যে একটা ঘুঁষি ছুঁড়ে বলল, “এখন আমাদের আশু কর্তব্য হচ্ছে… হচ্ছে… হচ্ছে…কী হচ্ছে?”

পয়মন্ত ভেবেছিল একটা উত্তর ভেসে আসবে আর সে লুফে নেবে। কিন্তু তার প্রশ্নটাই ফিরে এল জটলা থেকে… “কী হচ্ছে?”

পুলিন দেখল গতিক গোলমাল। পয়মন্ত সব ভুলে মেরে দিয়েছে। সে তাড়াতাড়ি মাইকটা পয়মন্তের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বলল, “এখন আমাদের আশু কর্তব্য হচ্ছে, হারানো ভুঁড়িগুলোকে ফেরত আনা।”

হ্লাদিনী দেবী ওপাশ থেকে বললেন “আর অপরাধীকেও ধরতে হবে, সেটা ভুলো না, বাবা।”

চিন্তাহরণবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “এতক্ষণে চিন্তা দূর হল। তাহলে কাজ হচ্ছে, ভুঁড়ি চোরকে ধরা আর চোরাই ভুঁড়ির উদ্ধার।”

এ কথায় বিস্তর হাততালি পড়ল। পুলিন বলে উঠল, “কিন্তু থানায় গিয়ে একবার ডায়রি করা দরকার! বলা নেই, কওয়া নেই, এতগুলো মানুষের ভুঁড়ি চুরি! যে সে চোরের কম্মো নয়। নতুন দারোগাবাবু এসেছেন, তাঁকেই ধরি গিয়ে। ভুঁড়ি চুরির একটা বিহিত করতেই হবে।”

কথাটা সবারই মনঃপূত হল। ঠিক হল যে, একবার সবাই মিলে নতুন দারোগাবাবুর কাছেই যাওয়া হবে একবার।

………০………

ক্রমশঃ……

(পরবর্তী সংখ্যার জন্য চোখ রাখুন www.utolodhara.com  এ পরের শুক্রবারে)

আগের পর্ব গুলি দেখুন – ধারাবাহিক লিঙ্কে 

Leave a comment

Check Also

ষষ্ঠ পর্ব- ভুঁড়েলবাটির ভু্ঁড়ি চোর- মৌসুমী পাত্র

ষষ্ঠ পর্ব নতুন দারোগাবাবু গুছিয়ে বসে নানান ভাবনাচিন্তা করছিলেন একটু আগে। তাঁর পূর্বসূরী খাসা একখানা …

৪র্থ পর্ব- ভুঁড়েলবাটির ভুঁড়ি চোর

চতুর্থ পর্ব – ভুঁড়েলবাটির ভুঁড়ি চোর- মৌসুমী পাত্র

চতুর্থ পর্ব মানময়ী গার্লস স্কুলের প্রাক্তন বড়দিমণি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন বছর চারেক আগে। বিয়ে-থা …

তৃতীয় পর্ব- ভুঁড়েলবাটির ভুঁড়ি চোর- মৌসুমী পাত্র

তৃতীয় পর্ব পয়মন্তর মনটা আজ একটু ভার ভার। উপস্থিত ক’দিন যাবত ভুঁড়েলবাটিতে তেমন কোন ঘটনাই …

vurelbatir-vuri-chor2-mp

দ্বিতীয় পর্ব- ভুঁড়েলবাটির ভুঁড়ি চোর- মৌসুমী পাত্র

দ্বিতীয় পর্ব পুলিশবাবুর আজকাল ঘুম থেকে উঠতে বেশ একটু বেলাই হয়ে যাচ্ছে। সবাই তাঁকে ‘পুলিশবাবু’ …