Home / কিশোর গল্প / ফুল-পাখি কথা – মৌসুমী পাত্র

ফুল-পাখি কথা – মৌসুমী পাত্র

শিল্পী- গুঞ্জা
শিল্পী- গুঞ্জা

সে ছিল এক গভীর বন। আর সেই বনের ঠিক মধ্যিখানে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় ছিল এক ফুলগাছ। আশ্চর্যের কথা, আশেপাশে আর কোথাও কোন ফুলগাছ ছিল না। একটাই ফুল ধরে আছে গাছে। অদ্ভুত এক নরম আলো ছড়িয়ে আছে তাকে ঘিরে, আর তার মনমাতানো সুবাস ঘিরে রাখে সারা বন। মৌমাছিরা গুনগুন করে তাকে ঘিরে, কিন্তু তাতে মন ভরে না ফুলের। সে যে একা, বড্ডো একা। দুটো মনের কথা বলবার কোনো সঙ্গীই তার নেই।

তারপর একদিন শীত যখন সবে তার লেপের তলা থেকে হামাগুড়ি দিতে শুরু করেছে, সেই সময় সেই বনে কোত্থেকে এল নাম না জানা একটা ছোট্ট পাখি। বনে ঢুকতেই সেই আশ্চর্য ফুলের প্রাণকাড়া সৌরভ তার নাকে এল। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে তার নজরে এল, বনের ঠিক মধ্যিখান আলো করে ফুটে আছে এক অপরূপ সুন্দর ফুল। ছোট্ট পাখি তার ছোট দুটি ডানায় জলতরঙ্গের কাঁপন তুলে উড়ে এসে বসল পাশের গাছের ডালে।

আর ফুল তখন মন খারাপ করে আপনমনে তাকিয়েছিল অনেক দূরে, যেখানে মাটির বুকে জেগে থাকা ঝোপঝাড়ের উপর একফালি সূর্যকিরণ এসে পড়েছিল। এতোই মন ভার হয়েছিল তার যে মুখ তুলে আকাশপানে চাইবার ইচ্ছেটুকুও তার মরে গিয়েছিল।

ছোট্ট পাখি এসে ফুলগাছের বুকে বসতেই ফুলের বুকে লাগল দোলা। ফুলের মনে হল, তার মনপ্রাণ যেন জুড়িয়ে গেল। অবাক বিস্ময়ে মুখখানি সামান্য তুলতেই তার চোখে পড়ল ছোট্ট পাখিকে। ফুলের মনে হল, এত অপূর্ব পাখি সে বুঝি দেখেনি কখনো!

বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে প্রথম কথা কইল ফুলই, “অচিন পাখি, কোথা থেকে এলে তুমি?”

অচিন পাখি বলল, “আমি আসছি সেই বহুদূরের দেশ থেকে। আমাদের দেশে সারা বছরই ঠাণ্ডা থাকে। কিন্তু এই শীতের সময় সেখানে এত ঠাণ্ডা পড়ে যে আমরা ওখানে আর টিকতেই পারি না। তাই চলে আসি তোমাদের দেশে। গতবছরও এসেছিলাম এখানে। তখন তুমি ছিলে না।”

পাখির কথায় ছোট্ট একটি দীর্ঘশ্বাস পড়ল ফুলের। সে নিজেই জানে না, কোথা থেকে কখন কিভাবে এখানে এসেছে।  তার বড্ডো জানতে ইচ্ছে করে কোথা থেকে এল সে।

ফুলকে চুপ থাকতে দেখে পাখি জিজ্ঞেস করল, “কী হল, ফুল? তোমার মন খারাপ বুঝি!”

এতোই নরম সুরে শুধোল সে যে ফুলের চোখের কোল বেয়ে দু’ ফোঁটা জল ঝরে পড়ল মাটিতে। পাখি অতশত খেয়াল করেনি। সে ভেবেছে, শিশিরের জল বুঝিবা। কচি কচি পাপড়ি দিয়ে চোখের জল মুছে ফুল উত্তর দিল, “না গো, পাখি। মন খারাপ কিসের? এই তো তুমি এসেছো, তোমার সাথে কতো কথা বলা, গল্প করা যাবে।”

আনন্দে পাখি নেচেই নিল একপাক ফুলকে ঘিরে। ফুল বলল, ‘‘পাখি, তুমি আমাকে একটা গান শোনাবে?”

সকালের নরম সূর্যের আলোতেই কয়েকবার দোল খেল পাখি। তারপর এসে বসল ফুলের উপরে। ফুলের গা কী নরম! প্রাণমন জুড়িয়ে যায়। পাখি এবারে তার ছোট্ট ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে শুরু করল গান।

এত সুরেলা গান ফুল কখনো শোনেনি। তার মনে হতে লাগল, সে যেন এক স্বপ্নের জগতে পৌঁছে যাচ্ছে অচিন পাখির ডানায় ভর করে।

পাখিও বহুদিন বহু গান গেয়েছে, কিন্তু গান শুনিয়ে তার আর এত ভালো কখনো লাগেনি!

তারপরে সকাল গড়িয়ে দুপুর হল, দুপুর শেষ হয়ে আবার শেষ বিকেলের হালকা হিমেল আলো লুটোপুটি খেতে থাকল বনের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে। ফুল আর পাখির গল্প এদিকে ফুরোতেই চায় না। শেষে যখন সন্ধের ছায়া একটা প্রকাণ্ড কালো আলখাল্লার মতো নেমে আসতে থাকল আকাশ থেকে মাটিতে, তখন দুজনেই বুঝল যে এবার বিদায়ের পালা এসেছে। ছোট্ট ফুলের বুক ব্যথায় টনটন করে উঠল। তার পাপড়িগুলো কাঁপতে থাকল তিরতির করে।

ফুলের বুকের ব্যথার ঢেউ গিয়ে লাগল পাখির বুকেও। পাখি আশ্বাস দিল, “ভেবো না। কাল ভোর হতে না হতেই আমি ঠিক চলে আসব।”

 

পরদিন ভোর থেকেই ফুল আর পাখি দুজনে দুজনকে নিয়ে মেতে রইল। পাখি কাছের নদী থেকে ঠোঁটে করে জল নিয়ে এসে ফুলের পাপড়িগুলো ভিজিয়ে দিল। তার কচি কচি নরম ডানা দিয়ে ফুলের পাপড়িতে লেগে থাকা ধুলো মুছল। ফুলও তার বুকের সঞ্চিত সব মধু উজাড় করে দিল পাখিকে। হাসি-খুশি হুটোপাটি মিলিয়ে বেশ আনন্দে দিন কাটতে থাকল দুজনের।

 

তারপরে একদিন সন্ধ্যাবেলায় পাখি বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছে, এমন সময় শুরু হল বৃষ্টি। আর সে কী বৃষ্টি! কী বৃষ্টি! আকাশ ভেঙে জলের বড় বড় ফোঁটারা নেমে এল মাটিতে, সোঁদা গন্ধে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল বনের আনাচ কানাচ। ছোটো বড় জলের স্রোত বইতে থাকল বনের এদিক সেদিক।

ঠাণ্ডা জোলো হাওয়ায় ফুলের পাপড়িগুলো পুরো কুঁকড়ে গেছে। পাতাগুলো তার কাঁপছে থরথর করে। একে কনকনে শীত, তায় জলের ঝাপটা। বড়ো বড়ো জলের কণা সূচের মত এসে বিঁধছে ফুলের গায়ে। কিন্তু তার মধ্যেও ফুলের মাথায় ঘুরছে একটাই চিন্তা, ছোট্ট পাখির কোন আপদ বিপদ হল না তো? যদি গাছের ডাল ভেঙে পড়ে? যদি বাজ পড়ে গাছে? এই ঝড়জলে ছোট্ট পাখি কিভাবে নিজের প্রাণ বাঁচাবে?

ছোট্ট পাখি ওদিকে গুটিসুটি মেরে ছিল একটা মস্ত বড়ো বটগাছের একটা ছোট কোটরে। ঝড়ের দাপটে আর ঠাণ্ডা জোলো হাওয়ায় তার এইটুকুনি শরীরটা কাঁপছিল তিরতির করে। সেই অবস্থাতেও সে ভাবছিল, “আহা রে! এই ঝড়বৃষ্টিতে ফুলের না জানি কতো কষ্ট হচ্ছে। আমি নাহয় এই কোটরের মধ্যেই নড়েচড়ে বসছি, দরকারে অন্য কোথাও সরেও যেতে পারব! কিন্তু সে বেচারির তো কোথাও নড়ার অব্দি উপায় নেই। তার ইচ্ছে করতে লাগল, এক্ষুণি ফুলগাছের কাছে চলে যেতে! একবার বেরোনোরও চেষ্টা করল সে, কিন্তু সেই মুহুর্তে বিশাল একটা চোখধাঁধানো কানফাটানো বাজ পড়ল খুব কাছেই। পাখি ভাবল, বেরোতে গিয়ে যদি মরেই যাই, তাহলে তো আর আমার ফুলগাছকে কখনো চোখেই দেখতে পাবো না। এই ভেবে সে আর বেরোনোর চেষ্টা করল না বটে, কিন্তু প্রবল উৎকণ্ঠায় ছটফট করতে থাকল সে সর্বক্ষণ। বৃষ্টির জলের ছিটে কোটরের মধ্যেও তার শরীর ভিজিয়ে দিতে থাকল। হাওয়ার দমকে সে কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকল, কিন্তু তার মন পড়ে রইল ফুলের কাছে। সে রাতে আর সে দুচোখের পাতা এক করতে পারল না।

 

তারপর যখন ভোরের আলো সবে উঁকি দিতে শুরু করেছে, পাখি তখন তার ক্লান্ত ডানায় ভর দিয়ে কোনরকমে গিয়ে পৌঁছোল ফুলগাছের কাছে। কাছে গিয়েই সে চমকে উঠল! এ কী! ফুলগাছ তো পুরো নেতিয়ে পড়েছে! কত পাতা ঝরে গেছে, কাদা বালি লেগে গেছে তার পুরো গায়ে। ছোট্ট পাখির বুক ঠিকরে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইল। সারারাত দুশ্চিন্তায় আর জাগরণে তারো ধকল কম যায়নি। তবু সে তার পালক দিয়ে পাপড়ির, পাতার ধুলো-বালি-কাদা মুছিয়ে দিল, ঠোঁটে করে করে যতটুকু পারে মাটি এনে গাছের গোড়াকার সরে যাওয়া মাটি ভরাট করে দিল। ছোট্ট পাখির সেবা শুশ্রূষায় ধীরে ধীরে ফুল তার পাপড়ি মেলে চাইল। ফুল ধীরে ধীরে বলল, “ছোট্ট পাখি, তোমার অনেক পরিশ্রম গেছে। এবারে একটু বিশ্রাম নাও।”

ছোট্ট পাখি এতোই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল যে কথা কইবার শক্তিটুকুও তার চলে গিয়েছিল। ফুলের কথা শেষ হবামাত্রই সে ফুলের কোলে মুখ গুঁজে ঘুমে ঢলে পড়ল।

 

শীত প্রায় শেষ হয়ে আসছে। ছোট্ট পাখির ডানায় হালকা গরমের রেশ কামড় দিতে শুরু করেছে। ফেলে আসা দেশের জন্য মন খারাপ লাগতে শুরু করেছে তার। এদিকে বলি- বলি করেও ফুলগাছকে সে বলে উঠতে পারছে না। শেষে একদিন ফুলের উপরে বসে সে যখন তার ফেলে আসা দেশের কথা ভাবছে, ফুল তাকে শুধোল, “ছোট্ট পাখি, তোমায় এমন আনমনা দেখছি কেন ক’দিন ধরে?” পাখি বলল, “ফুল, এবারে যে আমায় নিজের দেশে ফিরে যেতে হবে। আমি শীতের দেশের পাখি। গরম যে সহ্য হয় না।”

ফুলের বুক হাহাকার করে উঠল, “ছোট্ট পাখি, তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?”

পাখি দেখল ফুলের পাপড়ির কোণ চিকচিক করছে। কথা বলতে গিয়ে পাখির বুক ব্যথায় ভরে উঠল, “ফুল, এখানে যে গরম পড়তে শুরু করছে। আমি যাই, আবার পরের শীতে আসব।”

বিষাদের রাগিণী বাজতে থাকল ফুলের কণ্ঠে, “থেকেই যাও না, পাখি। গরম তোমার আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে। তুমি চলে গেলে এখানে এই একা বনে আমি কেমন করে থাকব? কার সঙ্গে গল্প করব? আমার যে আর কেউ নেই, ছোট্ট পাখি।”

ফুলের আকুতিতে ছোট্ট পাখির হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে গেল। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাখি বলল, “ঠিক আছে ফুল, তবে তাই হোক। আমি তোমার কাছে এখানেই থেকে যাই।”

শুনে ফুলের আনন্দ আর ধরে না। হাসিতে উপচে পড়ে সে বলল, “পাখি, কত্তো ভালো তুমি। আমি ঠিক জানতাম, তুমি আমাকে ছেড়ে যাবেই না।”

 

এমনি করে আরো কিছুদিন গেল। একদিন দুপুরে, ফুল হঠাৎ লক্ষ করল, পাখির ডানায় কেমন কালো কালো ছোপ পড়েছে, সূর্যের গনগনে আঁচে পাখির মুখেও কালো কালো দাগ পড়েছে। ফুলের খুব কষ্ট হল পাখির জন্য। আরো চড়া গরম পড়লে পাখি তাহলে টিকবে কেমন করে? কথাগুলো বলতে ফুলের নরম বুক বেদনায় টনটন করে উঠল, তবুও সে বলল, “পাখি, ও পাখি, তুমি বরং তোমার দেশে চলেই যাও। এখানে আরো গরম পড়বে। তুমি আর থাকতে পারবে না।”

ছোট্ট পাখি রীতিমত ধুঁকছিল গরমে। কিন্তু তাও ফুলকে ছেড়ে যেতে মন সরছিল না তার। কোনমতে চিঁ চিঁ করে সে বলল, “কিন্তু আমি চলে গেলে তোমার যে একলা বড্ডো কষ্ট হবে।”

করুণ হাসল ফুল, “তা হোক। কিন্তু আমার সুখের জন্য তোমাকে দুঃখ দেব না।”

পাখি বলল, “ঠিক আছে, ফুল। তাই হোক। তবে আরো দুটো দিন তোমার কাছে থেকে যাই। তারপরে রওনা দেব। আর পরের শীতের একদম শুরুতেই চলে আসব তোমার কাছে।”

ফুলের চোখের থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল, “তা হয়তো তুমি আসবে। কিন্তু ততোদিন কি আর আমি থাকব? আমি জানিও না আমি কোথা থেকে এসেছি আর কতোদিনই বা থাকব!”

পাখি বলল, “ফুল, তোমাকে থাকতে হবে। আমি যে আসব আবার!”

ফুল আর কিছু বলল না। খালি পাখি যে ডালে বসেছিল, সেই ডালটাকে দোলাতে শুরু করে দিল আপনমনে।

 

এর ঠিক দুদিন পরে, সূর্য ওঠার ঠিক আগে আগে ফুলের থেকে বিদায় নিয়ে ছোট্ট পাখি তার যাত্রা শুরু করল। আর সেই দিনই দুপুরে প্রচণ্ড চড়া রোদ উঠল। রোদে তেতেপুড়ে যেতে যেতেও ফুলের চোখে ভেসে উঠতে থাকল ছোট্ট পাখির দেশের ছবি— উঁচু উঁচু নীল রঙের বরফঢাকা পাহাড় প্রায় আকাশ ছুঁয়েছে, পাহাড়ের কোলে স্বচ্ছ নীল জলের ঝিল। তার মনে হতে থাকল, ছোট্ট পাখি আর কয়েকদিন পরেই পৌঁছে যাবে ওই সুন্দর দেশে- সে ঘুরবে, ফিরবে, আপনমনে খেলা করবে, মাঝেমাঝে ঝিলের জলে ঠোঁট ডুবিয়ে জল খাবে!

ক্রমে সূর্যের তাপ আরো বাড়তে থাকল, আরো তেতে পুড়ে ঝলসে যেতে থাকল তার পুরো শরীর! আস্তে আস্তে তার সব পাতা পুড়ে গেল, পাপড়ি ঝরে গেল…

 

ওদিকে ছোট্ট পাখি তখন মেঘের রাজ্যে উড়তে উড়তে ভাবছে, আবার সামনের বছর আসব, আবার আমার ফুলের সাথে দেখা হবে…

 

……০……

Leave a comment

Check Also

ভুতুম থুম- মৌসুমী পাত্র

পূর্ণিমার চাঁদটা ভেসে আছে বিরাট একটা গোল থালার মতো। একটা শিশুগাছের ডালের কয়েকটা পাতার ছায়া …

 ছেঁড়া রামধনু – মৌসুমী পাত্র

আমার মা বেজায় দুষ্টু হয়েছে আজকাল। একটা কথাও শুনতে চায় না। এই তো পরশুদিন, বললাম, …

chitrogupter-computer-mp

চিত্রগুপ্তের কম্পিউটার- মৌসুমী পাত্র

“যত্ত সব আদ্যিকালের জিনিস নিয়ে কাজকারবার! আর পারা যায় না বাপু!”, নিজের মনেই গজগজ করতে …

রসেবশে রামায়ণ- মৌসুমী পাত্র

রামায়ণের গল্প আমরা সবাই জানি। কিন্তু গল্পেরও কিছু ভেতরকার কথা থাকে। যাকে বলে, পেটের কথা। …