“গণেশ! অ্যাই গণেশ! গণশা……গনা……!”
গামছাটায় একটা শক্তমতো গিঁট লেগেছে। গণেশেরও রোখ চেপে গেছে। আজ সে গিঁটটার শেষ দেখেই ছাড়বে।
“গণশা! কখুন থেকে ডেকছি, হাঁদারাম, মোটামাথা! কানের মাথাট খেছিস নাকি?”, ভিখুর গলার স্বর ক্রমশঃ চড়াইয়ের দিকে।
“দ্যাখ শালা, ফাঁকাই রোয়াব দেখাবি না, কয়ে দিলাম”, গণেশ গিঁটসহ গামছাটা হাতে জড়িয়েই নেয় এবারে, “একট মাডার করেই এখেনে এয়েছি, খেয়াল রেখিস।’’
কথাটা খাঁটি। গণেশ দাদাকে খুনের দায়ে জেল খাটছে। ভিখু সুর নরম করে, “চটিস ক্যানে, গনা? সিনাবি চ। তোকে কখন থেকে তলাশ করছি।”
তারপর কানের কাছে মুখ এনে গোপন তথ্য ফাঁস করার ভঙ্গিতে বলে, “আজ দুপরে ভাত মাংস আছে রে, ভাত মাংস! লে, আর দের করিস না। ঝট চ।”
ভাত মাংসের প্রভাবেই হোক, বা তাড়াতাড়ি চান সারার তাগিদে, গণেশ গিঁট খোলার আশা ত্যাগ করে টানটান হয়।
একই থানার প্রায় পাশাপাশি গ্রামে বাড়ি তাদের। গণেশের বাড়ি বাতিকারে আর ভিখুর বাড়ি পাড়ুইয়ে। প্রায় কাছাকাছি সময়ে জেলে আসা। অপরাধের ধরনও অনেকটা কাছাকাছি। ভিখুর গাঁয়ের কোন নেতা তার ইন্দিরা আবাসের টাকা নাকি মেরে দিয়েছে, সেই রাগে ভিখু রাতের বেলা বন্দুক নিয়ে তার বাড়ি চড়াও হয়েছিল। খুন সত্যি সত্যি করার উদ্দেশ্য ছিল কিনা বলা মুশকিল, কিন্তু সে ফেঁসে গেছে। গণেশের মত তারও এখন ঠিকানা সিঊড়ি জেলা সংশোধনাগার। এত মিল থাকার জন্যই হয়তো গণেশের সাথে তার এক অদ্ভুত ধরনের সখ্যতা তৈরি হয়েছে। অপরাধীর প্রতি অপরাধীর টান!
ঝাঊগাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে দুই কয়েদী এবারে ঢিমে তেতালায় চলল চান সারবে বলে।
দুই
সংশোধনাগারের একপ্রান্তে পীরবাবার মাজার, একটা মস্ত জামগাছের ছায়ায়। এখানে এলেই গণেশের সেই ছোটবেলার ছড়াটা মনে পড়ে,
আম কুড়াব, জাম কুড়াব, তেঁতুল কুড়াব গা
কুড়াতে যাব, কুড়াতে যাব, কুড়াতে যাব গা!
ছড়াটা গাইতে গাইতে তারা আম, জাম, তেঁতুল, পেয়ারা কুড়িয়ে বেড়াত। আর কুড়োত তাল। বর্ষার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। তারা। সে আর দাদা। কার্তিক আর গণেশ। কাতু আর গনা।
গণেশের এখনো মনে পড়ে, ছোটবেলায় বর্ষার মুখে একবার তারা রাজনগর গিয়েছিল। তাদের মামাবাড়ি। কাতু আর গনার মামাবাড়ি। দাদা কত কত তাল কুড়িয়ে গাদা করছিল। মামাতো ভাইবোনেরা হাততালি দিচ্ছিল, ‘কাতু পারে! গনাট পারে না!’
গনা পারে না! আজন্মই শুনছে কথাটা। কাতু পারে! গনা পারে না! তবে কী যে সে পারে, প্রমাণ করে দেখিয়েই ছেড়েছে। বরাবরের মত!
কাতু সাইকল চালিয়ে সিউড়ি তন্নিক যায়, কাতু একদমে ডুবসাঁতার দিয়ে পুকুরের এদিক ওদিক করে, কাতু তালগাছ বাইতে পারে, কাতু পাঁইপাঁই দৌড়তে পারে খ্যাপা কুকুরের পারা!
আরো একটা জিনিস কাতু পেরেছিল। সে পারেনি। ভরভরন্ত কলাগাছের পারা বৌ ঘরে তুলতে! মংলুকে পেথম দেখে তার দুটা চোখ কে যেন টেনে রেখেছিল! কচি নরম কলাগাছেরই পারা গায়ের বন্ন, কালো কুচকচা কাড়ার পারা মাথার চুল, সিঁথিতে যেন একদলা রক্ত ডগডগ করছে। মুখ থেকে আর নিচের দিকে নামতে যেন ভয়ই করে!
ভয়? ভয়ই পেয়েছিল নাকি সে? নাকি ওই একদলা রক্ত তার রক্তকে চাগিয়ে তুলেছিল? কালিপুজোর রাতে শুকনো শরকাঠি দিয়ে মশাল বানাতো তারা। আর রাশি রাশি কীটপতঙ্গ, মরবে জেনেও যেন, সেই আগুনে ঝাঁপ দিত! গনা বছর বছর দেখেছে আর ভেবেছে। মংলুর আগুনটাতে ঝাঁপ দিয়ে সেও পুড়তেই চেয়েছিল। গনা পারেনি। মংলু পারতে দেয়নি। কাতুর বৌ মংলু পারতে দেয়নি।
বোলপুরের কাছে সাত্তোরে পিসির বাড়ি বাবা একদিন টিভি দেখাতে লিয়ে গেছল। গনার বয়স তখন কত হবে? সাত কি আট! টিভিতে রামায়ণ হচ্ছিল। সীতামায়ের চারপাশে আগুন জ্বলছিল দাউদাউ করে। চারিদিকে দাউদাউ আগুন, মাঝখানে সীতামা।
তবে কিনা, মংলুটা নিজেই জ্বলন্ত মশাল! চোখের চাউনি, ঠোঁটের হাসি, আর… আর…।
কাতু আর গনাকে খাবার বেড়ে দিয়েছিল মংলু। দুই ভাই খাচ্ছিল পাশাপাশি। কাতু আর মংলুর সে কী চোখ ঠারাঠারি আর হাসাহাসি! ভাবের রস যেন জ্বাল দিয়ে উথলে উঠেছে! মংলু কাতুর সামনে দাওয়ার মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে শুধোল, “বলি হ্যাঁ গা, আর কী লেবে?”
কাতুটও তেমন! চোখ মিটকে তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বেশ রসিয়েই বলল, “সে কথাট তুমাকে লয় রাতেই কইব!”
ভঙ্গি দেখে মাথাটা জ্বলেই গেছল গনার। নকল হাসি হাসতে ছাড়েনি, “কী লাগবে আমারেও একদিন শুধিও গা বৌ!”
ব্যস, কী এমন কথাই বা বলেছিল সে? দেওর-বৌদির সম্পক্ক, ওটুকু সে বলতেই পারে! কিন্তু তাতেই কাতুর যেন একখান হাত ছিঁড়ে নিয়েছিল কেউ। থালাটালা ছিটকে ফেলে সিংহের পারা গরগরে গলায় বলেছিল, “দ্যাখ গনা শুয়ার, চামড়া তোর ছিঁড়ে নেব হারামজাদা! আমার বৌরে অমন বললি জিভ টেনে ছিঁড়ে দেবো গা, শুয়ার!”
মারমুখী সিংহের সামনে শিয়াল যেমন লেজ গুটিয়ে পালায়, তেমনই পালিয়েছিল সে। কিন্তু পালাবেই বা কোথায়?
বাপট মরে বেঁচেছিল আগেই। ঘরদোর বাগাতে পারেনি তেমন। বাপ মারা যাবার পর মায়ের নামে একখান ইন্দিরা আবাসের ঘর হয়েছিল। একটাই বড়োপারা ঘর, বিয়ের আগে কাতু তার একপাশে একট মাটির দেয়াল তুলে লিয়েছিল। পাতলা দেয়াল, লড়লে-চড়লে ইধারের কথা উধারকে যায়। এদিকের ঘরে দড়ির খাটে গনা, আর নিচে মেঝেতে কাতু-গনার মা। আর ওধারের ঘরে কার্তিক আর তার কলাবউ। মা ঘুমায়ে পড়ত সাথে সাথেই, আর কলাবনে হাতির দাপাদাপিতে দমবন্ধ হয়ে আসত গনার।
“মরদের মত মরদ বটিস তু! লে, ইবারে ছাড় গা!”
“হঁ, এই যে, ইবারে। তর মরদটকে চিন গা জুত করে!”
তারপরেই মৃদু একটা ঝটপটানি আর তার সাথেই নারীকণ্ঠের খিলখিল রব! শরীরটা অসম্ভব রকম আনচান করে উঠত গনার, আর তার সাথে দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো যেন ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইত।
নিষ্ফল আক্রোশে বিছানায় ছটফট করত সে আর খাটের দড়িগুলো যেন কাঁটা কাঁটা হয়ে ফুটত গোটা গায়ে সারারাত।
তিন
একটা ফাইল নিতে গিয়ে জেলার সাহেবের কম্পিউটারের মাউসটা নড়ে গেল খানিক। আর অমনই কম্পিউটারের আঁধারি কেটে গিয়ে ফুটে উঠল গতবারের পৌষ মেলার দৃশ্য। কয়েকজন বাউল একতারা বাজিয়ে নেচে নেচে গান করছে, বাকিরা বসে আছে। দেখতে দেখতে প্রায় বছর ঘুরে গেল। বীরভূমে আসাও তো কম দিন হল না। তিন বছর হতে চলল। জেলাটাকে নিজের অজান্তে ভালোবেসে ফেলেছেন কখন!
প্রথমে তো অবস্থাটা মোটেও এরকম ছিল না। একরকম মুহ্যমানই হয়ে পড়েছিলেন সিউড়িতে পোস্টিং-র খবরে। উসকানির লোকেরও অভাব ছিল না অবশ্য। শ্বশুরবাড়িতে প্রায় কান্নার রোল পড়ে গিয়েছিল। শাশুড়ি পারলে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসেন! শ্বশুরমশাইয়ের সমানে তাগাদা, “এবারে একটু চ্যানেল ট্যানেল ধরো, অর্ক। এভাবে আর কতদিন চালাবে?”
চ্যানেল ট্যানেল ধরা যে তাঁর কাছে চিরকালই ইংলিশ চ্যানেল পেরোনোর মতো অসাধ্য ব্যাপার, সেটা আর বোঝাতে পারেননি তিনি। গুরুজনের কথায় হুঁ হাঁ করে কাটিয়েছেন। ভায়রাভাই রসিক মানুষ। সে নিজের থেকে ফোন করে বলেছিল, “কী ভায়া, জেলে যাবে, তাও বীরভূমে? একটা ভালো জেলে থাকলে তাও আত্মীয়স্বজনদের বলতে পারতাম, আমার ভায়রাভাই আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে আছে। হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ।”
তবে কিনা, তাঁর স্ত্রীই এহেন ঘোর দুঃসময়ে সাহস যুগিয়েছেন, “যে যা বলে বলুক, তুমি পাত্তা দিও না। বদলির চেষ্টাও কোরো না। এমনিতে তো বেড়াতে টেড়াতে যাওয়া হয়না কোথাও। তোমার এই চাকরির দৌলতে অন্ততঃ যতটুকু পারি ঘুরে বেড়িয়ে নি।”
তা যাই হোক, এই তিন বছরে জেলাটা কম চেনা হল না অর্কপ্রভের। দুবরাজপুরে বক্রেশ্বরের উষ্ণ প্রস্রবণ, মামাভাগ্নে পাহাড়, ইলামবাজারে জয়দেব-কেন্দুলির মন্দির, বোলপুর-শান্তিনিকেতন, তারাপিঠ-বীরচন্দ্রপুর নিত্যানন্দ আশ্রম, ম্যাসাঞ্জোর-গুণে শেষ করা যাবে না।
শীত জাঁকিয়ে পড়ার সাথে সাথে জেলাজুড়ে হাজারো মেলার ধুম লেগে গেছে। শীতকাল এলেই বীরভূম যেন মেলাভূম হয়ে যায়। নানা মেজো ছোট, সরকারি-বেসরকারি মেলার পর শীত যেমন জাঁকিয়ে বসতে শুরু করে, ঠাণ্ডার সাথে তাল মিলিয়ে তেমনই বড়ো মেলারাও মাঠে নেমে পড়ে। ৭ই পৌষ থেকে শান্তিনিকেতনের বিখ্যাত পৌষমেলা। তারপর সংক্রান্তিতে জয়দেব-কেন্দুলির মেলা। এর মাঝখানে টুক করে বক্রেশ্বর থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের মেলাটাও হয়ে যায়। পাথরচাপুড়ির মেলাও বা কম যায় কিসে? একদিকে হরেক রকম ভিখারির মেলা আর অন্যদিকে পীরবাবার ভক্তদের দানধ্যান। কোথায় যেন বেশ একবার শুনেছিলেন, পাথরচাপুড়ির মেলায় ভক্তদের ছোঁড়া টাকার পরিমাণ নাকি কয়েক কোটি টাকা। লাভপুরে তারাশঙ্করের জন্মভিটের কাছেই ফুল্লরা মেলা…
“স্যার, কী এত ভাবছেন?”
মগ্নচৈতন্যের ঘোর কাটতে একটু দেরিই হল বুঝিবা। অর্কপ্রভ কিঞ্চিৎ বিব্রত, “সেরকম কিছু না। পরশু থেকে পৌষমেলা। ভাবছিলাম একবার ঘুরে আসব।”
“ঘুরে আসুন স্যার। বড়দিনেই যান বরং। ছুটি আছে।”, ওয়েলফেয়ার অফিসারের গলায় আশ্বস্ততার ছোঁয়া।
“দেখি। তাই ভাবছি। আচ্ছা, এ ক’দিনের মধ্যে আর কেউ প্যারোলে যাবার আছে নাকি?”
“সেটাই বলতে এলাম স্যার। শাকিল শেখ আর গণেশ লেট। ওদের আজই ছাড়ার কথা। সকাল থেকেই দু’জনে ঘ্যানঘ্যান লাগিয়েছে।”
“গণেশ? কোন গণেশ? সেই দাদাকে মার্ডার করা?”
“হ্যাঁ স্যার।“”
“ইয়েস। ইয়েস। ওর তো পারমিশান এলো পরশু। ও তো এর আগেও একবার প্যারোলে গিয়েছিল, না?”
“হ্যাঁ স্যার।”
চেয়ারে মাথাটা এবারে হেলিয়ে দিলেন অর্কপ্রভ। জেলখাটা এদের নিতান্ত কমদিন হল না। লোকাল থানার রিপোর্টও এসে গেছে। সাতদিনের প্যারোলে যাচ্ছে দুজনেই। প্যারোল অর্থাৎ শর্তাধীন ছুটি, বিভিন্ন কারণে যা সাজাপ্রাপ্ত বন্দীদের মঞ্জুর করা হয়।
“বেশ। কাগজপত্রগুলো রেডি করে নিয়ে আসুন”, ভাবনা ঝেড়ে ফেলে কেজো সুর এবারে অর্কপ্রভের গলায়।
“ঠিক আছে স্যার”, চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বলেন ওয়েলফেয়ার অফিসার।
“আরে, দাঁড়ান। দু’ মিনিট পরেই যাবেন। চা আনাই”, বলেই টুংটুং করে ঘন্টি বাজান অর্কপ্রভ।
ওয়েলফেয়ার অফিসার আবার ধপ করে চেয়ারে বসে পড়েন।
চার
বাসটায় দমবন্ধ করা ভিড়। কোনমতে জানলার ধারে একটা জায়গা পেয়েছে গণেশ। আচ্ছা, এই যে বাসে এতগুলান লোক, এরা যদি জানতে পারে যে সে খুনের আসামী, তাহলে কী প্রতিক্রিয়া হবে তাদের?
খুনের আসামী! বটেই তো। নিজের হাতে নিজের দাদাকে খুন করেছে সে। উপায়ই বা কী ছিল? কীই বা করতে পারত সে? দিনের পর দিন মুখ বুজে সহ্য করে যাওয়া?
মা মারা যাবার পর অশান্তি আরো বেড়েছিল। একেই দাউদাউ আগুন রাতদিন চোখের সামনে ঘুরছে, ফিরছে, সোহাগে ঢলঢল করছে। রাত হলেই পাশের ঘরটা যেন তাকে গিলতে আসে।
একখানা বিয়েই সারবে ভাবছিল সে। এমন সময়েই একদিন রাতে পাশের ঘর থেকে আরো আরো সব আওয়াজের সাথে ভেসে এল তার নাম। চুপিসাড়ে দাদার ঘরের পাশে গিয়েই কান পাতল সে। মংলুর গলা ভেসে এল, “গনার বিয়াট দিয়াই দাও। ব্যাটাছেলে ঘরে একা থাকা ভাল লয়।”
“বিয়া? উর? কোন মাইয়ালোককে উ সুখ দিতে পেরবে, আমি তোরে যেমন দি?”
মৃদু একটা সুখের ঘষটানির সাথে ভেসে এসেছিল মংলুর গলা, “তা বটে। তোর পারা আরাম কোন ব্যাটাছেলা দিতে পেরবে নাই গা। মরদের মত মরদ তুই আমার। আর উটাকে তো দেখলেই বুঝা যায় আসল কাজে ভেড়া!”
কান-মাথা সব গরম হয়ে গিয়েছিল তার। কী বলল? কী বলল মুংলি? সে ভেড়া? ভেড়া না সিংহ, মুংলিকে সে প্রমাণ দিয়েই ছাড়বে।
সুযোগটা এসেও গেল পরের দিন সকালেই। পঞ্চায়েত মেম্বর কালুকাকা কাতুকে ডেকে নিয়ে গেল। বলক অফিসে কিসের না কিসের মিটিং আছে। গনা তক্কে তক্কেই ছিল। কার্তিক বেরিয়ে গেলে মুংলি রাতের এঁটো থালাবাসন নিয়ে পাশের ডোবায় গেল মাজতে। এই ডোবাটা বেশি কেউ ব্যবহার করে না। জায়গাটা বেশ নির্জন। বাঁশঝাড় আর নানারকম আগাছায় ভর্তি। গনা সেখানে গিয়েই মুংলিকে ধরল।
“মুংলি, ই জায়গাট বেশ ভাল বটে, লয়? চ, তোরে আজ লতুন খেল দেখাই।“”
আগুন তার আগুনঝরা চোখ নিয়ে তাকায়, “বটে? কী খেল দিখাবি?”
“আমি ভেড়া না সিংহ, তোরে আজ পেরমানট দি। কাতুর বাড়া সিংহ যে আরো আছে, সেইট দেখবি নাই?”
জ্বলন্ত চিতা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে, “কী? কী বললি? পেরমান দিবি? তু ত ভেড়াই। কুন কাজে তুই কাতুর পারা বটিস?”
গণেশ ততক্ষণে জাপটে ধরেছে দাউদাউ আগুনকে। সে পুড়বে আর পোড়াবে। মুংলি এদিকে পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে, “কে কুথায় আছ গা, বাঁচাও মোরে। গনাট মেরে ফেলল।”
হিসহিসে গলা গণেশের, “চেঁচা না তু, যত খুশি। চেঁচা। ইদিকে কেউ এসবে না।”
মুংলি নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। আর…সেই সময়েই কাতুর আবির্ভাব। কী একটা কাগজ নিতে ভুলে গিয়েছিল। মুহূর্তের মধ্যে সে বুঝে যায় কী চলছে। হাড় হিম করা গলায় ডাকে, “গনা! আজ তোরে আমি খুন করব।”
নিজের মরদকে দেখে মৃত্যুসীমানায় জীবনের চলকানি দেখতে পায় মুংলি, “হঁ। মারে শেষ কর গনাটরে”, ডুকরে ওঠা কান্নায় মুংলির বাকী কথা চাপা পড়ে যায়।
কার্তিক তেড়ে আসে, ঝাঁকানি দিতে থাকে গণেশকে, মাটিতে ফেলে চেপে ধরে, “আজ তুর একদিন কি আমার একদিন। শেষ করেই ছেড়ব আমি।”
গণেশ আপ্রাণ যুঝতে থাকে কার্তিকের আসুরিক শক্তির সাথে। প্রাণপণ চেষ্টায় এক ঝটকায় কার্তিককে ঠেলে ফেলে দৌড়য় ঘরের দিকে। চালের বাতায় টাঙানো টাঙ্গিটা অবচেতনে ধাক্কা মারছিল ক’দিন ধরেই। এক লাফে নামিয়ে আনে সেটাকে। পিছন ফিরতেই কার্তিককে পেয়ে যায়। ধাওয়া করে এসেছিল পিছু পিছু। টাঙ্গির কোপ নামতে থাকে ঝপাং…ঝপাং…
“কী গা, বাতিকার নেমবে বললে যি? এসে গেছে। নেইমে পড়।“
চিন্তার অতল থেকে ভাড়া মিটিয়ে বিনা বাক্যব্যয়ে নেমে পড়ে গণেশ।
পাঁচ
মন দিয়ে কিছু ফাইল দেখছিলেন অর্কপ্রভ। সামনের সপ্তাহে ডি আই জি প্রিজন সাহেবের আসার কথা। তার প্রস্তুতি আছে। আরো হাজারো কাজ। বেলাশেষের পৌষ ঠাণ্ডা কামড় বসাচ্ছে গায়ে। মাথার মাফলারটা ভালো করে টেনে নেন তিনি। ওয়েলফেয়ার অফিসার হাঁফাতে হাঁফাতে ঢোকেন, “স্যার, তিনটে বাজে। গণেশের তো আজ প্যারোল থেকে ফেরার কথা। এখনো ফেরেনি।”
চমকে অঠেন অর্কপ্রভ। সাধারণতঃ এরকম হয় না। আসামীরা প্যারোলে ছুটি পেলে সময়মতোই ফেরে। কারণ এছাড়া তাদের গতি নেই। পুলিশ ঠিক খুঁজে বের করবে। আর তখন শাস্তির মাত্রা আরো চড়বে।
“লোকাল থানাকে খবর দিন ইমিইডিয়েট”, তৎপরতার সঙ্গে হালকা উদ্বেগের ছায়া তাঁর গলায়।
ওয়েলফেয়ার অফিসার ল্যান্ডলাইন নাম্বার থেকে থানাকে ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অর্কপ্রভ চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে ভাবতে থাকেন। গণেশের কেসটা ভালোই মনে আছে তাঁর। দাদাকে খুন করে জেলে এসেছিল। ওর বৌদি সাক্ষ্য দিয়েছিল। বৌদির সাক্ষ্যের জেরেই যাবজ্জীবন জেল হয়েছে। ব্যবহার ভালো থাকায় প্যারোলে ছাড়া পেল দুবার।
“স্যার, মারাত্মক ব্যাপার”, ফোন রাখতে রাখতে বলেন ওয়েলফেয়ার অফিসার, “লোকাল থানার কাছেও খবর পৌঁছেছে। গণেশ কাল রাতে ওর বৌদিকে খুন করে তার পর থেকে ফেরার। বৌদির ওপর তার রাগ ছিলই। আগের বার প্যারোলে গিয়ে সব আটঘাট ভালো করে দেখে এসেছিল। এবারে গিয়ে পুরোনো রাগ মিটিয়েছে।”
“সে কী! ওকে দেখে তো আঁচই পাওয়া যায়নি ভেতরে এতো রাগ এখনো পুষে রেখেছে”, প্রায় আর্তনাদই করে ওঠেন তিনি। ঘটনার আকস্মিকতার চেয়েও বন্দীর মানসিকতা বোঝার অক্ষমতাই তাঁকে এই মুহূর্তে বেশি আলোড়িত করে তোলে।
“স্যার, আমাদের তরফ থেকে সব লেভেলে জানানো দরকার তাড়াতাড়ি”, ওয়েলফেয়ার অফিসার কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেন।
“ঠিক, ঠিক। আমি এখুনি ব্যবস্থা করছি”, বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে দেকে নির্দেশ দেন বড়োবাবুকে ডাকার জন্য।
ছয়
গণেশকে পুলিশ ধরেছে গতকাল সন্ধেবেলা। রামপুরহাট স্টেশনে ওভারব্রিজের ওপর বিক্ষিপ্তভাবে পায়চারি করছিল। রেলপুলিশের সন্দেহ হওয়ায় তারা ধরে নিয়ে এসে রামপুরহাট থানায় খবর দেয়। গণেশের ছবিসহ বিবরণ আগেই পৌঁছে গিয়েছিল জেলার প্রতিটি থানায়। ফলে ফের একবার লৌহকপাটের আড়ালে ঠাঁই হয়েছে গণেশের। আজ বিকেলে পুলিশ এসে হাজতে ভরে দিয়ে গেছে। কাল আদালতে পেশ করা হবে।
“স্যার, শীগগির আসুন”, ওয়েলফেয়ার অফিসারের গলা।
জেল কোয়ার্টাসের বাইরের ঘরে কাজ সারছিলেন অর্কপ্রভ। ডাকাডাকিতে বেরিয়ে এলেন, “কী হয়েছে?”
“স্যার, গণেশ সুইসাইডের চেষ্টা করেছে। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠছে। আমি ওকে জেল হাসপাতালে পাঠিয়ে আপনাকে ডাকতে এলাম।”
“কিন্তু সুইসাইডের চেষ্টা করল কী করে?”, খানিকটা হতবাকই অর্কপ্রভ।
“স্যার, যেটুকু জানলাম, কাল জেলে আসা ইস্তক বেজায় মনমরা হয়ে ছিল গণেশ। এতদিন জেলে থাকার সুবাদে জেনেই গিয়েছিল যে, এবারে তার ফাঁসি অবধারিত। মশা মারার জন্য জেলের ওয়ার্ডগুলোতে রোজ আমরা যে কেরোসিন তেল স্প্রে করি, সেই তেল অন্য কোন বন্দীই হয়তো জমিয়ে রেখেছিল। সবার অলক্ষ্যে সেই তেলই কোনভাবে হাতসাফাই করে গলায় উপুড় করে দিয়েছে সে।”
সোয়েটারের ওপর একটা শাল চাপিয়ে ঘরের পোশাকেই বেরিয়ে পড়লেন অর্কপ্রভ ওয়েলফেয়ার অফিসারের সাথে। ডাক্তারবাবু বেরিয়ে এলেন ওঁদের আসার খবর পেয়ে।
“ডাক্তারবাবু, যেভাবে হোক, গণেশকে বাঁচান। নাহলে কৈফিয়ত দিতে দিতে হয়রান হয়ে যাবো,” একরাশ ব্যাকুলতা ঝরে পড়ল তাঁর গলায়।
পলকের তরে স্তব্ধ হয়ে রইলেন সৌম্য, সুদর্শন ডাক্তারবাবুটি। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “এই দু’মিনিট হল গণেশ চিরকালের মত প্যারোলে চলে গেছে।”