Home / নাটক / বাপুর পরশ –   মৌসুমী পাত্র

বাপুর পরশ –   মৌসুমী পাত্র

।। প্রথম দৄশ্য ।।

(পর্দা উঠতে দেখা গেল দুটি বেঞ্চে বসে কয়েকজন ছাত্রছাত্রী বসে আছে। সামনে বইখাতা পেন ইত্যাদি খোলা। মেয়েদুটির নাম আল্পনা ও কলিফা। ছেলেদুজনের নাম কাদের ও রক্তিম। আল্পনাকে দেখা গেল রক্তিমের চুল ধরে টানতে। )

রক্তিম। অ্যাই আল্পনা‍‍, তুই আমার চুল টানলি কেন রে?

আলপনা। (অবাক হবার ভান করে) ওমা! আমি কোথায়? কাদের তো তোর চুল টানল!

কাদের। (প্রতিবাদ করে ওঠে) মিথ্যে বলবি না, আল্পনা। তুই চুল টেনেছিস আমি দেখেছি।

কলিফা। আমিও দেখেছি।

আ। টেনেছি তো টেনেছি। বেশ করেছি। (বলে দুই কানে দুই আঙুল দিয়ে জিভ ভেংচে দেয়।)

রক্তিম। তবে রে! (বলে আল্পনার দিকে তেড়ে যেতে যায়। এমন সময় দিদিমণি ঢোকেন। ‘দিদিমণি আসছেন’ ‘দিদিমণি আসছেন’ একটা রব ওঠে। সকলে যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে যায়। দিদিমণি এসে চেয়ার টেবিলে বসেন।)

দি। বোস্ সবাই। কী রে, এত চেঁচামেচি হচ্ছিল কীসের শুনি?

আ। (তাড়াতাড়ি করে) না দিদিমণি, চেঁচামেচি না। আমরা ওই একটু মজা করছিলাম।

র। না দিদিমণি, আল্পনা আমার চুল ধরে টানছিল।

দি। আল্পনা, তুই ফের গণ্ডগোল করছিস?

ক। দিদিমণি, আপনি না থাকলেই ও খুব জ্বালাতন করে।

কা। হ্যাঁ দিদিমণি, কাল তো স্কুল থেকে ফেরার সময় বৄষ্টি হচ্ছিল। ও আমাকে জলকাদায় ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। জামাকাপড় পুরো কাদা হয়ে গিয়েছিল।

দিদিমণি। (চোখ বড় করে জোর গলায়)ঃ  আল্পনা!

(আল্পনা মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়ায়)

দি। আল্পনা, রোজ রোজ তোর নামে এত নালিশ শুনতে আমার ভালো লাগে না। তুই ঠিকঠাক পড়া করবি না, সবাইকে সবসময় জ্বালাবি, এত কিছু কিন্তু আর আমার সহ্য হচ্ছে না। তুই যে এতকিছু করছিস, তোর বন্ধুরা যদি আজ কেউ তোর সঙ্গে কথা না বলে তাহলে তোর এমন লাগবে?

আল্পনা। (মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে) দিদিমণি ভুল হয়ে গেছে, আর হবে না।

দি। তোর মুশকিলটা কী জানিস? তুই খুব তাড়াতাড়ি নিজের ভুল বুঝতে পারিস, আর তার চেয়েও তাড়াতাড়ি তুই সেটা ভুলে যাস। (একটু থেমে) ঠিক আছে। এ জিনিস যদি চলতে থাকে তাহলে কিন্তু তোর কপালে দুঃখ আছে বলে দিলাম। মনে থাকবে? (সামান্য থেমে) ঠিক আছে, এবার তোদের পড়া শুরু করি।

র। আজ কী পড়াবেন, দিদিমণি?

দি। আজ তোদের শোনাব জাতির জনকের কথা।

ক। দিদিমণি, জাতির জনক কে?

র। আমি জানি। মহাত্মা গান্ধী।

কা। আমিও জানি, দিদিমণি। পুরো নাম মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।

আ। আমিও জানি, দিদিমণি। টাকার নোটে ওঁর ছবি থাকে।

দিদিমণি। (ব্যঙ্গের সুরে) হ্যাঁ, তুমি তো খালি ওই-ই চেনো!

(বাকিরা ফিকফিক হাসতে থাকে।)

দি। যাইহোক, মহাত্মা গান্ধী ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাণপুরুষ। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাটি মূল দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটি হোল সহিংস আন্দোলন। আর অপরটি হোল অহিংস আন্দোলন।

কা। দিদিমণি, অহিংস আন্দোলন কী?

দি। অহিংস আন্দোলন মানে যে আন্দোলনে হিংসার আশ্রয় নেওয়া হয় না। শুধু ভারতে বলে নয় , পুরো পৄথিবীতে এ এক অভিনব জিনিস। গান্ধীজী কর্মসূত্রে কিছুকাল দক্ষিণ আফ্রিকায় ছিলেন। সেখানেও শ্বেতাংগেরা সে সময় কালা আদমি, মানে ওখানকার স্থানীয় লোকজনেদের উপর চরম অত্যাচার করত। গান্ধীজী দেখলেন নিগ্রোরা শুধুমাত্র গায়ের জোরে ইংরেজদের সঙ্গে পেরে উঠবে না। তাই তিনি শুরু করলেন অহিংস আন্দোলন। অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রতিবাদ। সেই  অহিংস আন্দোলন এত এতোই শক্তিশালী ছিল যে বন্দুকের নলও তার সামনে নুয়ে গেছল।

র। দিদিমণি, গান্ধীজী ভারতে আন্দোলন করেননি?

দি। আরে, গান্ধীজীর আসল আন্দোলন তো ভারতেই। আমাদের দেশের সমুদ্রের জল ফুটিযে নুন অব্দি বানাতে দিত না তারা।

আ (ধীরে ধীরে)। নুনটুকুও বানাতে দিত না?

(দিদিমণি শান্ত চোখে তাকালেন আল্পনার দিকে।)

দি। এই তো বেশ পড়ায় মন দিযেছিস। তাহলে কেন যে ওরকম করিস?

(আল্পনা মাথা নামিয়ে বসে থাকে।)

দি। শোন আগামী ২রা অক্টোবর গান্ধীজীর জন্মদিন। ওদিন স্কুলে অনুষ্ঠান হবে। তোদের প্রত্যেককেই কিন্তু কিছু না কিছু অনুষ্ঠান করতে হবে।

র। কী মজা!

আ। (ধীরে ধীরে) আমাকেও?

দি। হ্যাঁ, তোকেও। বড়দি বলে দিয়েছেন, ভালো হোক, খারাপ হোক- সব ছেলেমেয়েকেই কিছু না কিছু করতে হবে। এখনো সময় আছে। তোরা সবাই মিলে ঠিক করে নে।

(ঢং ঢং করে ক্লাস শেষের ঘন্টা পড়ে যায়। দিদিমণি বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়ান। পর্দা পড়ে যায়।)

।।দ্বিতীয় দৄশ্য।।

(আল্পনার বাড়ি। একটা চৌকি পাতা। কাছে একটা চেয়ার। আল্পনা বিছানায় পড়তে পড়তে ঢুলছে। )

আ। গান্ধীজী ১৯০৯ সালে ডাণ্ডি মার্চ করেন। ইহা লবণ আইন ভংগ নামে পরিচত। … অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ (আর একটু ঢোলে) ইহা লবণ আইন ভংগ নামে পরিচত। … ১৯০৯ সালে… হ্যাঁ হ্যাঁ … ১৯০৯ সালে… ডাণ্ডি মার্চ…

… মার্চ মাসে ডাণ্ডা নিয়ে… হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ… ১৯১৯ সালে… তারপর গোলটেবিল বৈঠক… চৌকো টেবিল পাওয়া যায়নি বোধহয়… দূর দূর… এটা … আরউইনের সঙ্গে বৈঠক… আরউইন বোধয় ডারউইনের পিসতুতো ভাই… হ্যাঁ হ্যাঁ… আরউইন ডারউইনের মাসতুতো ভাই ছিলেন… দুজনে মিলে অনেক যুদ্ধ করেছিলেন… গান্ধীজী এসে বললেন… হ্যাঁ হ্যাঁ বললেন… মানে বলার চেষ্টা করেছিলেন…

(আল্পনার মা ঘরে ঢোকেন)

মা। যা ভেবেছি তাই… আবার ঢুলছে… আল্পনা… অ্যাই আলো… (কাছে গিয়ে দাঁড়ান)

(আল্পনা ঢুলুঢুলু চোখে তাকায়)

আ। মা, পড়ছি তো।

মা। পড়ছিস না ঢুলছিস?

(মা খাটে পাশে বসেন)

মা। রোজ রোজ তোকে এত বলতে কেন হয় বল তো? তোর বাবা নেই। আমি একার হাতে তোকে অত কষ্ট করে মানুষ করছি। সেসব  তুই কিছু বুঝবি না? একটু ভালো করে পড়াশুনোটা তো করতে পারিস, বাবা।  তবে তো দুঃখটা ঘোচে। এই সেলাই টেলাই করে ক’টাকাই বা পাই বল? জমানো টাকাও তো তেমন নেই। নেহাত বাড়িটা আছে, তাই একটু রক্ষে।

আ। মা আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।

(মা উঠে দাঁড়ান।) ঠিক আছে, তবে ঘুমো। আলোটা নিভিয়ে দিচ্ছি। সকালে ডেকে দেবো। উঠে পড়বি। আমারই পোড়া কপাল! (কপালে হাত দিয়ে ঠুকতে ঠুকতে বেরিয়ে যান।)

আল্পনা শুয়ে পড়ে। (মঞ্চের আলো কমে আসে। হালকা নীল আলো।)

(আল্পনা ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরে শোয়। ব্যাকগ্রাউণ্ডে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। গান্ধীজী ঢোকেন। ধীরে ধীরে আল্পনার বিছানার কাছে গিয়ে মৄদুস্বরে ডাকেন, “আল্পনা! আল্পনা!”)

আ। (ঘুমের ঘোরেই আস্তে আস্তে উঠে বসে) কে তুমি?

গা। আমি বাপু।

আ। তুমি কি আমার বাবা?

গা। বাবাই তো। তোমরা সকলেই আমার সন্তানের মতো।

আ। জানো, আমার মা না খুব কাঁদে, মনখারাপ করে সবসময়। আমারো তাই ভালো লাগে না। স্কু্লে আমার কোন বন্ধু নেই।

গা। তুমি কি তোমার বন্ধুদের ভালোবাসো?

আ। বন্ধুরা তো আমায় কেউ ভালোবাসে না। সবার কী সুন্দর মা আছে, বাবা আছে! ওরা কত ভালো থাকে, ভালো ভালো টিফিন আনে, ছুটিতে মা বাবার সঙ্গে এদিক সেদিক ঘুরতে যায়। পুজোর আগে, ঈদের আগে ক্লাসে এসে দামী দামী জামাকাপড়ের গল্প করে!

গা। আল্পনা, তুমি নিজে কি তোমার বন্ধুদের ভালোবাসো? তুমি যদি ওদের ভালোবাসো, ওরাও ঠিক তোমাকে ভালোবাসবে। নিজেকে প্রশ্নটা একবার করে দেখো তো।

আ। (কিছুটা জেদের সুরে) আমি তো ওদের ভালোবাসি। কিন্তু ওরা সেটা বুঝতে চায় না।

গা। তার মানে তোমার ভালোবাসায় নিশ্চয়ই কোন ঘাটতি আছে। ভালোবাসো আল্পনা, সকলকে ভালোবাসো। বহুগুণ ভালোবাসা তুমি ফেরত পাবে। মনে রেখো, ভালোবাসা দিয়ে সব জয় করা যায়।

আ। ওরা ওরকম করে বলে আমিও সুযোগ পেলে ওদের নানারকম জ্বালাতন করি।

গা। খুব ভালো কথা। কিন্তু একটা কথা ভাবো তো দেখি। ওরা খারাপ ব্যবহার করলে যদি তুমি ওদের জ্বালাতন করো, তাহলে কি ওরা আরো দূরে সরে যাবে না?

আ। আমার কিরকম যেন হয়ে যায়। করে ফেলি।

গা। একবার ভাবো তো আল্পনা- চোখের বদলা যদি চোখই হয়, তবে তো পৃথিবীতে একদিন অন্ধ মানুষ ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।

আ। (বিড়বিড় করে) চোখের বদলা চোখ হলে পৃথিবীতে অন্ধ মানুষ ছাড়া আর কেউ থাকবে না!

গা। আমি আসি আল্পনা। সত্যের পথ আর ভালোবাসার পথ কখনো ছেড়ো না।

(গান্ধীজী বেরিয়ে যান। আল্পনা শুয়ে পড়ে। একটু পরেই মোরগের ডাক, পাখির কিচিরমিচির শোনা যায়। আল্পনার মা ঢোকেন।)

মা। আল্পনা, ওঠ। ছটা বাজে। উঠে পড়। পড়তে বোস। কাল রাতে তোর কিছু পড়া হয়নি।

(আল্পনা চোখ মুছতে মুছতে উঠে বসে।)

মা। নে, হাতমুখ ধুয়ে নে। আমি চা বসাচ্ছি। কাল রাতের রুটি আছে, চায়ের সঙ্গে খাবি।

(মা বেরি‍য়ে যান)

(আল্পনা উঠে দাঁড়ায়। এদিক ওদিক পায়চারি করতে করতে নিজের মনেই বলে)

আ। বাপু… গান্ধীজী… সত্যিই কি বাপু কাল এসেছিলেন? নাকি আমি স্বপ্ন দেখলাম? সত্যি না স্বপ্ন? বাপু বলে গেলেন সকলকে ভালোবাসতে। সত্যের পথে থাকতে বলে গেলেন…

(নেপথ্য থেকে  মায়ের গলার ডাক- আল্পনা, মুখ হাত ধুয়ে নে তাড়াতাড়ি।)

আ। (সেদিকে তাকিয়ে জোরে) আসছি মা। (তারপর আবার স্বগতোক্তি করে) কিন্তু… কিন্তু… আমি তো ঘুমোলাম… স্বপ্নে  এত কথা হয়? সত্যি না স্বপ্ন? সত্যি না স্বপ্ন? সত্যি না স্বপ্ন? (বলতে বলতে স্টেজ ছেড়ে চলে যায়।)

।। তৄতীয় দৄশ্য।।

(আল্পনাদের ক্লাসরুম। ছেলেমেয়রা ব্যাগ কাঁধে এক একজন করে ঢুকছে। প্রথমে ঢোকে কলিফা। ব্যাগটা বেঞ্চে রেখে বসতে বসতে বলে)

ক। যাক্‌ বাবা, আল্পনাটা এখনো ঢোকেনি। যত দেরিতে ঢোকে, ততই মংগল। বাবা বাবা, ওর জ্বালায় আর পারিনা। যতক্ষণ না আসে, ততক্ষণ বরং শান্তিতে হাওয়া খাই।

(রক্তিম আর কাদের কথা বলতে বলতে ঢোকে।)

র। নাঃ, আল্পনাকে এবারে একটু টাইট দিতেই হচ্ছে।

কা। (ভয়ের সুরে) দিবি কী করে? আমাকে দেখলেই তো মারতে আসে।

র। (রাগের সুরে) সে তুই ভীতু বলে। শোন্‌, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।

কা। কী আইডিয়া?

ক। আমাকেও বল্‌ ।

র। ঠিক আছে। বলছি।

(ব্যাগগুলো রেখে ওরা তিনজনে একজায়গায় মাথা ঝুঁকিয়ে কিসব ফিসফিস করে বলাবলি করে। তা করতে করতেই আল্পনাকে উইংসের কাছে ক্লাসে ঢুকতে দেখা যায়।)

র। ওই আসছে! আমাদের অ্যাকশন এবার শুরু হবে।

(আল্পনা সোজা কাদেরের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।)

আ। (বলার চেষ্টা করে), কাদের, কাল আমি ঠিক করিনি রে… আমি কাল খুব ভুল কাজ করেছি…

(অমনি রক্তিম লাফিয়ে আল্পনার সামনে এসে)

আড়ি আড়ি আড়ি

ক। কাল যাব বাড়ি।

(সকলে মিলে আল্পনার চারপাশে ঘুরে ঘুরে বলতে থাকে)

কা। পরশু যাব ঘর।

র। হনুমানের লেজ ধরে টানাটানি কর।

ক। এক বালতি জল নিয়ে পা পিছলে পড়।

কা। (কাঁচকলা দেখিয়ে) যা করবি কর।

(বলে সবাই হো হো করে হাসতে থাকে।)

আ। (হতভম্ব হয়ে) তোরা কেউ আর আমার সঙ্গে কথা বলবি না?

র। (কাদেরকে এক ঠেলা মেরে) হ্যাঁ রে, আড়ির পর আবার কি কেউ কথা বলে?

ক। যার লজ্জা নেই সে সেধে ভাব করতে আসে।

কা। লাজলজ্জা যাদের নেই, তারাই ভাব করে!

(আল্পনা আর কিছু বলে না। চুপচাপ ব্যাগের উপর মাথা গুঁজে বসে থাকে। বাকিরা তার দিকে তাকিয়ে এ ওকে ইশারা করতে থাকে। দিদিমণি ঢোকেন।)

দি। কী রে, আজ তোরা সবাই এত চুপচাপ! খুব ভালো হয়ে গেছিস মনে হচ্ছে। আল্পনা, তুই তো আজ দিব্যি শান্ত। এমনি ভালো থাকলে কত ভালো লাগে বল।

(আল্পনা কিছু না বলে শূন্য চোখে তাকায়। বাকিরা এ ওকে ঠেলে ইশারায় হাসাহাসি করে।)

দি। (বই খুলে) শোন্‌, কাল কী পড়াচ্ছিলাম তোদের, মনে আছে?

(সবাই মিলে একসঙ্গে উপরের দিকে হাত ছুঁড়ে) গান্ধীজী!

দি। (অল্প হেসে) গুড। এবারে কী জানিস তো? এবছর হোল গান্ধীজীর সার্ধ জন্মশতবার্ষিকী। সার্ধ মানে দেড়। অর্থাৎ এবছর গান্ধীজীর জন্মের দেড়শ বছর। এটা হচ্ছে ২০১৯ সাল। তাহলে গান্ধীজী জন্মেছিলেন কত সালে, চটপট বল্‌ দেখি।

(সবাই হাতে হিসেব করতে ব্যস্ত।)

আ। (হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে) ১৮৬৯ সাল।

দি।(অবাক হয়ে তাকিয়ে প্রশংসার সুরে) বাঃ! বেশ বললি তো। একটু খাটলেই তো তুই খুব ভালো রেজাল্ট করতে পারবি।

(আল্পনা হাসি হাসি মুখে তাকায়। বাকিরা এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।)

দি। গান্ধীজী জন্মেছিলেন ১৮৬৯ সালে, গুজরাটের পোরবন্দরে।  তাঁর  বাবার  নাম ছিল করমচাঁদ গান্ধী। মায়ের নাম ছিল পুতলীবাঈ। ওঁর স্ত্রীর নাম ছিল কস্তুরবা গান্ধী। গান্ধীজী বিলেতে ব্যারিস্টারি পাশ করে ওকালতি করতে আফ্রিকা যান।

ক। দিদিমণি, বিলেত মানে কী?

দি। এখনকার দিনে আমরা যে দেশটাকে ইংল্যাণ্ড বলি, আগেকার দিনে সেটাকেই বিলেত বলা হত। যাইহোক, আফ্রিকা যাওয়ার পরের ঘটনা তোদের কাল কিছু কিছু বলেছি। গান্ধীজীর জীবনের মূলমন্ত্রই ছিল অহিংসা। এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সত্যের প্রতি তাঁর ভালোবাসা। গান্ধীজী আসার আগে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ছিল শুধুমাত্র উচ্চশ্রেণীর ব্যক্তিদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। গান্ধীজী কংগ্রেসে যোগ দেবার পর কংগ্রেস হয়ে উঠল ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে ভারতবাসীর ইংরেজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মঞ্চ। সমাজের যারা অন্ত্যজ শ্রেণী, অস্পৃশ্য- গান্ধীজী তাদের কাছে টেনে নিলেন। বললেন- তারাই হরির আপন জন। তারাই হরিজন।

(আস্তে আস্তে দিদিমণির গলার স্বর কমে আসে।  হাতপা  নাড়া দেখে বোঝা যায় যে দিদিমণি পড়াচ্ছেন। ঢং ঢং করে ক্লাস শেষের ঘন্টা পড়ে যায়। দিদিমণি বই গুটিয়ে উঠে দাঁড়ান। এবারে তাঁর গলা পাওয়া যায়।)

দি। শোন, তোদের আগের দিনও বলেছিলাম, আজকে আবার বলছি আগামী ২ রা অক্টোবর গান্ধীজয়ন্তী। ওদিন সবাইকে গান্ধীজীর ওপর কিছু না কিছু করতে হবে নিজেদের খুশিমত। সে কেউ ছবি আঁকতে পারিস, কেউ কবিতা লিখতে পারিস, কেউ গান গাইতে পারিস, কেউ কিছু বলতে পারিস। কে কী করবি নিজেরা ঠিক করে নিবি। যার যার ভালো হবে, বড়দিমণি তাকেই পুরষ্কার দেবেন বলেছেন। মনে থাকে যেন। আর একটা কথা। প্রত্যেককেই কিন্তু কিছু না কিছু করতেই হবে।

(দিদিমণি বেরিয়ে যান। সবার মধ্যে শোরগোল পড়ে যায়। )

কা। অ্যাই, তুই কী করবি রে, রক্তিম?

র। দাঁড়া, একটু পর বলছি। (ইশারায় আল্পনাকে দেখায়)

(আল্পনা তবু এগিয়ে আসে) এই, বল্‌ না তোরা কে কী করবি?

র। (বাজে করে হেসে) আড়ি আড়ি আড়ি।

ক। কাল যাব বাড়ি।

(সকলে মিলে আল্পনার চারপাশে ঘুরে ঘুরে বলতে থাকে)

কা। পরশু যাব ঘর।

র। হনুমানের লেজ ধরে টানাটানি কর।

ক। এক বালতি জল নিয়ে পা পিছলে পড়।

কা। (কাঁচকলা দেখিয়ে) যা করবি কর।

(আল্পনাকে দেখা যায় চোখে হাত চাপা দিয়ে ব্যাগ কাঁধে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে)

।। চতুর্থ দৃশ্য।।

(আল্পনার বাড়ি। আল্পনা তার খাটে বসে আছে। তার হাতে একটা বই খোলা। সে কিন্তু বইয়ের দিকে তাকিয়ে নেই। সে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে।)

আ। (স্বগতোক্তি) আমি কী করব! আমি নাচ পারি না, গান পারি না, আঁকতে পারিনা, কবিতা বলতেও পারিনা। ক্লাসেও সবাই আমার সঙ্গে আড়ি করে দিয়েছে। স্কুলে গিয়েও বা কী করব? কেউ আমার সঙ্গে একটাও কথা বলছে না। কাল কলিফাকে বলতে গেলাম, আর কোনদিন আমি আর ওদের বিরক্ত করব না। ও বলল, আমি নাকি ঢং করছি। আমি কী করব এখন? আমি কী করব? আমি স্কুলে আর যাবো না। (মাথা নিচু করে ফোঁপাতে থাকে।)

(আল্পনার মা ঢোকেন। আল্পনা তাড়াতাড়ি চোখ মুছে তাকায়।)

মা। আলো, তোর পড়ার আওয়াজ পাচ্ছি না যে? এত ফাঁকি দিলে চলবে কী করে বল? ক’দিন পরেই পুজোর ছুটি। তখন তো তোর আরোই পড়া হবে না। কাল সকালে তো গান্ধীজয়ন্তী। স্কুলে যাবি বলেছিলি। তাড়াতাড়ি করে খানিকটা পড়া করে নিয়ে শুয়ে পড়। আমি যাই। কয়েকটা সেলাইয়ের কাজ বাকি আছে। মুড়ির বাটিটা নিয়ে যাই।

(চেয়ারে রাখা মুড়ির বাটিটা নিয়ে আল্পনার মা বেরিয়ে যান।)

আ। আমি পড়বো না। স্কুলই যখন ছেড়ে দেবো, তখন আর পড়ে কী লাভ? কাল সকালে স্কুলেও যাবোনা। যাবো না, যাবো না। আমাকে কেউ ভালোবাসে না। (একটুখানি ফোঁপায়। বইটা জোরে বন্ধ করে শব্দ করে চেয়ারে রাখে।)  ভালো লাগছে না। কিচ্ছু ভালো লাগছে না।

(লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ে আল্পনা। ব্যাকগ্রাউণ্ডে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শোনা যায়। তার পর শেয়ালের ডাক।)

(গান্ধীজী ঢোকেন ধীরে ধীরে। ধীরে ধীরে আল্পনার বিছানার কাছে গিয়ে মৄদুস্বরে ডাকেন, “আল্পনা! আল্পনা!”)

(আল্পনা আস্তে আস্তে উঠে বসে।)

আ। (অবাক বিস্ময়ে) বাপু!!

(আল্পনা ঢুলুঢুলু চোখে হাত বাড়িয়ে চেয়ার থেকে বইটা সরিয়ে মাথার কাছে রাখে। বাপু চেয়ারে বসেন।)

গা। হ্যাঁ আমি। আল্পনা, এত সহজে ভেঙে পড়লে চলে? তুমি নাকি স্কুল ছেড়ে দেবে?

আ। বাপু, আমাকে যে কেউ ভালোবাসে না।

গা। কে বলল ভালোবাসে না? আমি তোমায় ভালোবাসি বলেই তো এলাম আল্পনা। তোমার মা তোমায় ভালোবাসেন, তোমার দিদিমণি ভালোবাসেন, এমনকি বন্ধুরাও তোমাকে ভালোবাসে।

আ। (মাথা নাড়তে নাড়তে) না, কেউ আমাকে ভালোবাসে না। মা খালি বকে, দিদিমণিও বকেন¸বন্ধুরা আমার সঙ্গে আড়ি করে দিয়েছে। আমি এখন কোথায় যাবো?

গা। তুমি কোত্থাও যাবে না। তুমি এখানেই থাকবে। মনে রেখো, ভালোবাসার চেয়ে বড়ো শক্তি আর কিছু নেই। বন্ধুরা কিন্তু তোমার সঙ্গে আড়ি করেনি।

আ। (অবাক হয়ে ) তাহলে?

গা। আড়ি করেছে তোমার খারাপ আচরণের সঙ্গে। আমি যেটাকে অসহযোগ বলেছিলাম, ওরা সেটাই করেছে।

আ। (ধীরে ধীরে) আমি সত্যি সত্যিই ওদের সঙ্গে আগে খুব বাজে ব্যবহার করেছি। এখন আমি ভালো হয়ে গেছি, কিন্তু ওরা মানতে চাইছে না।

গা। মানবে। তুমি যেমন তোমার ভুল বুঝেছ, ওরাও ঠিক ওদের ভুল বুঝতে পারবে। তুমি নিজের ওপর ভরসা রাখো। বন্ধুদের ভালোবাসো। দেখবে, ওরাও ভালোবাসবে তোমায়। আর মা, দিদিমণি- এঁরা সবসময়ই বাচ্চাদের ভালোবাসেন। এই যে তোমার মা সারাদিন এত পরিশ্রম করেন, সে তো তোমারই জন্য, আল্পনা।

আ। তুমি তবে আমাকে কী করতে বলো, বাপু?

গা। আমি কিছুই বলছি না, আল্পনা। নিজের পথ তুমি নিজেই চিনে নিতে পারবে। সে ক্ষমতা তোমার রয়েছে। কাল থেকে তোমার নতুন দিন শুরু। তুমি সকালে নতুন মন নিয়ে স্কুলে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করো। দেখবে কোনকিছুই তোমার আটকাবে না। আমার আশীর্বাদ রইল।

আ। (চোখ বন্ধ করে হাতজোড় করে) তাই যেন হয় বাপু।

(গান্ধীজী ধীরে ধীরে বেরিয়ে যান। আল্পনা শুয়ে পড়ে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক জোরালো হয়ে উঠে আস্তে আস্তে হালকা হয়ে থেমে যায়। মোরগের ডাক, পাখির কিচিরমিচির শোনা যায়। আল্পনা চোখ মুছতে মুছতে উঠে পড়ে।)

আ। (চারপাশে তাকিয়ে) ইসস! সকাল হয়ে গেছে। স্কুলে যাবো। কাল রাতে… কাল রাতে… বাপু…বাপু কি সত্যিই এসেছিলেন? বাপু বলে গেলেন… আজ থেকে নতুন দিন… (হঠাৎ করে মাথার পাশে রাখা বইয়ের দিকে নজর যায়) এ কী! এই বইটা এখানে রাখলো কে? (বইটা হাতে নিয়ে) এ বইটা এখানে রাখলো কে?? আমি তো কাল রাতে ওটাকে চেয়ারে রেখেছিলাম। তবে কি… তবে কি… (পর্দা পড়ে যায়)

।। পঞ্চম দৃশ্য ।।

(আল্পনাদের ক্লাসরুম। কিছুটা সাজানো হয়েছে। টেবিলের ওপর গান্ধীজীর ছবি। ছবিতে মালা পরানো। সামনে আরো কিছু মালা, ফুল ইত্যাদি রাখা। চেয়ারটা টেবিলের পাশে। বেঞ্চগুলো সামান্য ধারে করে রাখা। দিদিমণি ঢোকেন। পেছন পেছন ছেলেমেয়েরা।)

দি। (সামনের দিকে তাকিয়ে) ওই তো, প্রচুর লোকজন জড়ো হয়ে গেছে দেখছি। তোরা সবাই ঠিক ঠিক করে বসে পড়। আমি বড়দিমণিকে ডেকে আনি।

(দিদিমণি বেরিয়ে যান।)

(কাদেরের হাতে একটা আঁকা ছবি। রক্তিম সেই দিকে তাকিয়ে)

র। কাদের, তোর হাতে ওটা কী?

কা। আমি গান্ধীজীর একটা ছবি এঁকেছি। এই দ্যাখ।

ক। দারুণ এঁকেছিস তো!

আ। সত্যিই খুব ভালো হয়েছে, কাদের।

র। নাহ্‌, কাদের আজ প্রাইজটা তুই-ই পাবি মনে হচ্ছে।

(বড়দিমণিকে নিয়ে দিদিমণি ঢোকেন।)

ব। অনেক লোকজন এসে গেছে দেখছি। অনুষ্ঠান শুরু করে দাও।

দি। (সামনের দিকে তাকিয়ে) নমস্কার। আমরা আজের অনুষ্ঠান শুরু করতে চলেছি। আমাদের বড়দিমণি উপস্থিত আছেন। আমি তাঁকে অনুরোধ করবো, গান্ধীজীর ছবিতে মাল্যদান করে আজকের অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করতে।

(বড়দিমণি গিয়ে গান্ধীজীর ছবিতে মালা পরিয়ে প্রণাম জানান। তারপর পাশের চেয়ারে গিয়ে বসেন।)

দি। এরপর আমাদের স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা গান্ধীজীকে পুষ্পার্ঘ নিবেদন করবে।

(ছেলেমেয়েরা পরপর গিয়ে গান্ধীজীর ছবির কাছে কিছু কুচো ফুল ছড়িয়ে দেয়। আল্পনা সামান্য বেশিক্ষণ প্রণাম জানায়।)

দি। এরপর আমি আমাদের বড়দিমণি, শ্রীমতী আলোছায়া বিশ্বাসকে অনুরোধ করব কিছু বলার জন্য।

ব। নমস্কার। আপনারা সকলেই জানেন, আজ ২রা অক্টোবর। গান্ধীজয়ন্তী। মহাত্মা গান্ধীকে বলা হয় জাতির জনক। আজ আমরা যে এই স্বাধীন ভারতে বসবাস করছি, তার পেছনে যে মানুষগুলির অবদান সোনার অক্ষরে চিরদিন লেখা থাকবে, তাঁদের অন্যতম ব্যক্তি মহাত্মা গান্ধী। শুধু স্বাধীনতা আন্দোলনই নয়, গান্ধীজী গড়ে তুলেছিলেন এক সামাজিক আন্দোলনও। তাঁর স্বপ্নের ভারতে উচ্চবর্ণ- নিম্নবর্ণের তফাত ছিল না, ধর্মে ধর্মে ছিল না কোন প্রভেদ। তিনি বলেছিলেন অহিংসার কথা। তিনি বলেছিলেন ভালোবাসার কথা। আমাদের সমাজজীবন থেকে ভালোবাসা ক্রমশঃ হারিয়ে যাচ্ছে। জটিলতা, কুটিলতায় আচ্ছন্ন হচ্ছে মানুষের দিনযাপন। ভোগবাদ আমাদের ঠেলে দিচ্ছে এক যান্ত্রিক জীবনের দিকে। এই পরিস্থিতিতে গান্ধীজীই পারেন আমাদের আলো দেখাতে। গান্ধীজীই পারেন আমাদের দিশা দেখাতে। আসুন, আমরা সকলে মহাত্মার দেখানো পথে চলি। তাঁর জীবনাদর্শ মেনে নতুন জীবনের ব্রতে ব্রতী হই আমরা। এই বলে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি। নমস্কার।

(কথা শেষ করে বড়দিমণি বসেন। সকলে হাততালি দেয়।)

দি। আমাদের বড়দিমণিকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এরপর আমাদের পরবর্তী অনুষ্ঠান আমরা একটু নতুনভাবে সাজিয়েছি। আমাদের ছোট ছোট ছাত্রছাত্রীরা তাদের আঁকা, ছড়া ইত্যাদির মাধ্যমে ওরা নিজেদের মত করে গান্ধীজীকে স্মরণ করবে। আপনাদের কাছে একটাই অনুরোধ, যথাসম্ভব হাততালি দিয়ে ওদের উৎসাহিত করবেন। এজন্য সব্বার প্রথমেই আমরা ডেকে নিচ্ছি কাদেরকে।

(কাদের সামনে এসে দাঁড়ায়।)

দি। কাদের, তুমি কী করতে চাও?

কা। আমি একটি ছবির মাধ্যমে গান্ধীজীকে তুলে ধরেছি। সেই ছবিটি আমি সবাইকে দেখাতে চাই। (এই বলে  ছবিটি তুলে ধরে।)

দি। বাঃ! কাদের একটি খুব সুন্দর ছবি এঁকেছে। কাদেরর জন্য জোরে জোরে হাততালি। এরপর আমি ডেকে নিচ্ছি কলিফাকে। কলিফা, তুমি কী করতে চাও?

ক। আমি গান্ধীজীর প্রিয় ভজন ‘রঘুপতি রাঘব’ গাইতে চাই।

দি। কলিফা গান্ধীজীর প্রিয় ভজন ‘রঘুপতি রাঘব’ গাইবে। (কর্ডলেস মাইকটি কলিফার হাতে তুলে দেন।)

(কলিফা গাইতে থাকে…)

রঘুপতি রাঘব রাজা রাম

পতিত পাবন সীতারাম

সীতারাম সীতারাম,

ভজ প্যারে তু সীতারাম

ঈশ্বর আল্লা তেরো নাম,

সবকো সম্মতি দে ভগবান

রাম রহিম করীম সমান

হাম সব হ্যায় উনকি সন্তান

সব মিলা মাংগে ইয়ে বরদান

হমারা রহে মানব কা জ্ঞান।

দি। খুব সুন্দর, গেয়েছো, কলিফা। কলিফার জন্য জোরে হাততালি।

(কলিফা লজ্জা লজ্জা মুখে নিজের জায়গায় গিয়ে বসে।)

দি। এরপর আমি ডেকে নিচ্ছি রক্তিমকে।

(রক্তিম সামনে এসে দাঁড়ায়।)

দি। রক্তিম, তুমি কী করতে চাও?

র। আমি গান্ধীজীকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছি। সেটি আমি সবাইকে শোনাতে চাই।

দি। রক্তিম ওর স্বরচিত কবিতা আমাদের পাঠ করে শোনাবে। আমরা এবার ওর কবিতা শুনব।

র।       আমি গান্ধীজী সম্পর্কে আমার লেখা একতি কবিতা পড়ে শোনাচ্ছি। কবিতাটির নাম- জাতির জনক।

জাতির জনক তুমি গান্ধীজী

                   তুমি মহাত্মা-

          কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী

                   এক করলে আত্মা।

উঁচুনীচু, ধনী- গরীব

                   এক করলে সবায়-

          অস্পৃশ্য হরিজন

                   নিল তোমায় মাথায়।

          অহিংসা আর অসহযোগ

                   তোমারি যে দান-

          জন্মদিনে জাতির জনক

                   জানাই প্রণাম।।

(রক্তিম নমস্কার জানিয়ে মাইকটা দিদিমণির হাতে দেয়।)

দি। দারুণ সুন্দর একটি ছড়া পাঠ করেছে রক্তিম। ওর জন্য জোরে জোরে হাততালি। (একটু থেমে) এরপর ডেকে নিচ্ছি আল্পনাকে।

(আল্পনা এগিয়ে আসে।)

দি। আল্পনা, তুমি কী করতে চাও?

আ। আমি দু’চার কথা বলতে চাই।

দি। (চাপাস্বরে) দ্যাখ বাবা, ডোবাস না। (জোরে) আল্পনা আমাদের গান্ধীজীর সম্পর্কে দু চার কথা শোনাবে।

(আল্পনা মাইক হাতে নেয়।)

আ। নমস্কার। আমি একদমই বলতে পারি না, তাই ভুল হলে আমাকে মাপ করবেন। আমি খুব সাধারণ মেয়ে। আমাদের ক্লাসে যতজন পড়ে, আমি তাদের মধ্যে সবচেয়ে পড়াশুনোয় বাজে। শুধু পড়াশুনোতেই নয়, আমি সবেতেই বাজে। আমার বাবা নেই। বাড়িতে খালি আমি আর মা। আমার মা সেলাই করে অনেক কষ্ট করে আমাকে বড়ো করছেন। মায়ের কষ্ট আমি বুঝি না যে তা নয়, কিন্তু স্কুলে যখন অন্য বন্ধুদের দেখি, তখন আমি মায়ের কষ্টের কথা ভুলে যাই। আমার মনে হয়, ওরা কত ভালো থাকে, ভালো খায়, ভালো পরে। আর আমি কত দুঃখে থাকি। তাই স্কুলের বন্ধুদের ওপর বরাবরই আমার খুব রাগ। আমি ওদের চুল টেনে দি, খামচে দি, মারধোর করি, বইখাতাও ছিঁড়ে দিয়েছি কয়েকবার। ওরা আমার সঙ্গে গায়ের জোরে পেরে ওঠে না। তখন আমার খুব মজা লাগে। মানে লাগত। কয়েকদিন আগে অব্দিও লেগেছে।

তারপর… তারপর আমি একদিন বাপুকে পেলাম…

(মঞ্চের একদিক থেকে গান্ধীজী বেরিয়ে আসেন… বাকি কেউ দেখতে পায় না তাঁকে। তিনি আল্পনার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়েন। আল্পনা হাসি হাসি মুখে তাঁর দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ে। আবার বলতে থাকে…)

গান্ধীজীকে আমি পেলাম বাবার মতো করে… তিনি আমার বাপু… দুঃখে যাঁকে সব কথা বলা যায়… যাঁর ছায়ায় বসে দু’দণ্ড জিরিয়ে নেওয়া যায়… যিনি চলার পথটি চিনে নিতে সাহায্য করেন।

আমার ক্লাসের বন্ধুরা আমার সঙ্গে সবাই আড়ি করেছে… আমার সঙ্গে আজকাল কেউ কথা বলে না… এটা আমার প্রাপ্য ছিল… আমি অনেক অন্যায় করেছি… তার শাস্তি আমাকে পেতেই হবে। তবে আজ এখানে আমার বড়দিমণি আছেন, আমার ক্লাসের দিদিমণি আছেন, আমার বন্ধুরা আছে। সবার সামনে আমি বলতে চাই, বাপুর কাছে আমি শিক্ষা পেয়েছি। আমি এবার থেকে সব্বাইকে ভালোবাসব, নতুন করে বাঁচব, মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করবো। আমার বন্ধুরা আমাকে ছেড়ে গেলেও আমি সবসময় তাদের পাশে থাকব, তাদের ভালোবাসব। গান্ধীজয়ন্তীতে এটাই আমার শপথ।

(আল্পনা মাথা ঝুঁকিয়ে নমস্কার করে মাইকটা দিদিমণির হাতে দেয়। দিদিমণি চোখ মুছে আল্পনাকে জড়িয়ে ধরেন।)

(বড়দিমণি ওঠেন। মাইকটা তাঁর হাতে ধরিয়ে দেয় রক্তিম। ওদিকে কলিফা গিয়ে তখন জড়িয়ে ধরেছে আল্পনাকে।

ক। আমি তোকে ভুল বুঝেছিলাম রে। কত বাজে কথা বলেছি।

আ। সে তো আমিও অনেক খারাপ কাজ করেছি।

(রক্তিম ও কাদের গিয়ে আল্পনার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।)

র। আজ থেকে আমরা আবার বন্ধু।

কা। বন্ধু, বন্ধু।

(মঞ্চের একপাশ থেকে গান্ধীজী আল্পনার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে যান।)

ব। ওরা সবাই আনন্দ- দুঃখ ভাগ করে নিচ্ছে। ওরা নিজেদের মত থাকুক কিছুক্ষণ। আমার দীর্ঘদিনের শিক্ষক জীবনে এ এক বিরল মুহূর্ত। গান্ধীজী যেভাবে সকলকে মিলিয়ে দিলেন এই গান্ধীজয়ন্তীতে- তা আমার সারা শিক্ষক জীবনের পাওনা।

(একটু থেমে) আমি আগেই ছেলেমেয়েদের জানিয়েছিলাম, যার  যার গান ছড়া ইত্যাদি আমার ভালো লাগবে, তাকে তাকে আমি পুরষ্কার দেবো। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে, ছেলেমেয়েদের মধ্যে কোন বিভেদ করা ঠিক নয়। ওরা প্রত্যেকেই খুব ভালো। আমি সব্বাইকেই পুরষ্কার দেবো।

(এই বলে কাঁধের ঝোলা ব্যাগে হাত দেন।) কইরে, আয় তোরা।

(একে একে আসে সকলে। বড়দি প্রত্যেকের হাতে গান্ধীজীর একটি করে ছবি তুলে দেন। ওরা সকলে প্রণাম করে।)

দি। (বড়দির থেকে মাইক নিয়ে) আয়, সবাই মিলে হাত ধরাধরি করে দাঁড়াই। বড়দি, আপনিও আসুন। আল্পনার হাত ধরুন। (সামনের দিকে তাকিয়ে) আসুন, আমরা এই গান্ধীজয়ন্তীতে শপথ নিই নতুন করে বাঁচার, সকলকে নিয়ে চলার, সবাইকে ভালোবাসার। (একটু থেমে) আর আমাদের বড়দির অনুমতি নিয়ে আমাদের আজকের অনুষ্ঠান আমরা এখানেই শেষ করছি। নমস্কার।

(সবাই হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। ব্যাকগ্রাউণ্ডে গান বাজতে থাকে- “এখন আর দেরি নয়/ ধর গো তোরা/ হাতে হাতে ধর গো…)

……০……

Leave a comment