বৈশাখ মাসে জন্মানো মেয়ের বৈশাখী, শ্রাবণে শ্রাবণী কিংবা ফাল্গুনী বা চিত্রা নামের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় আগেই হয়েছিল। শিশু জন্মানোর পর তার নামকরণের পেছনে নানারকম চিন্তাভাবনা, আবেগ, পছন্দ ইত্যাদি কাজ করে।
শুনেছি, অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের জন্মের পর প্রথমে নাম রাখা হয়েছিল ‘ইনকিলাব’ । পরে সেই নাম বদলে ‘অমিতাভ’ রাখা হয়। বাংলায় অবশ্য ‘স্বাধীন’ বা ‘বিপ্লব’ নাম অনেকেরই আছে।
গোলাপকে যে-নামেই ডাকা হোক সে একই রকমের গন্ধ বিলোবে—একথা ঠিকই, তবে কিনা মানুষের নামকরণের ক্ষেত্রে ‘নামে কী আসে যায়’—এই উপমাটি পুরোপুরি খাটে না। ‘কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন’ এই ভাষ্যের মধ্যেই তো একটা ব্যঙ্গ বা পরিহাসের ইঙ্গিত রয়েছে, যেমন করুণ রসের ছোঁয়া আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সুভা’ গল্পে ( “মেয়েটির নাম যখন সুভাষিণী রাখা হইয়াছিল তখন কে জানিত সে বোবা হইবে।” )।
তাই ব্যক্তির নামকরণের ক্ষেত্রে একটু চিন্তাভাবনা, শিক্ষা, রুচি বা অল্প দূরদর্শিতার ছাপ থাকা বাঞ্ছনীয়। চমক বা অভিনবত্ব আনতে গিয়ে ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত যদি হাসি-মস্করার খোরাক হয়ে দাঁড়ায় এবং সেই মস্করা যদি কখনও সেই বিশেষ নামধারী ব্যক্তি যাকে সারা জীবন সেই নামটি বইতে হবে তার কানে পৌঁছয় তাহলে বিষয়টায় ব্যথা আছে।
ইদানীং কোনও বড়সড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নামের সঙ্গে মিলিয়ে সদ্যোজাত শিশুর নামকরণের বেশ একটা চল হয়েছে। ‘বন্যা’ বা ‘প্লাবন’ নামের মধ্যে একটা রোম্যান্টিকতা ছিল, কিন্তু ‘সুনামি কুণ্ডু’ বা ‘সুনামি গরাই’ নামের মধ্যে চমক যতটা রয়েছে, রোম্যান্টিকতাও কি ততখানি ? কে জানে ? হদ্দ রোম্যান্টিকরা হয়তো এর ব্যাখ্যা করতে পারবেন। ঝড়ের সময় জন্মানো কোনও মেয়ের নাম কি ‘আয়লা আঢ্য’ বা ‘আয়লা কর্মকার’ রাখা হয়েছিল ? হওয়া অসম্ভব নয়, কারণ কাগজে পড়লাম, জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন চলাকালীন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে এক শিশুপুত্রের জন্ম হয়েছে বলে সেই সদ্যোজাতের নাম রাখা হয়েছে ‘আন্দোলন’, আন্দোলন ভুঁইয়া।
একসময় আমাদের স্কুলে ‘ইলেকশন টুডু’ আর ‘নির্বাচন ভুঁইয়া’ নামের দুটি ছেলে পড়ত। তাদের এমন নামকরণও নিশ্চয় বিশেষ ঘটনার অভিঘাতেই ? তাদের অভিভাবকদের সেকথা জিজ্ঞেস করার সুযোগ পাইনি।
আচ্ছা, আন্দোলন চলাকালীন হাসপাতালে ওই মা যদি একটি কন্যা সন্তান প্রসব করতেন, কী নাম রাখতেন মেয়ের, ‘ধর্না ভুঁইয়া’ ? অথবা তাঁর যদি যমজ সন্তান হত এবং তাদের মধ্যে একজন পুত্র আর একজন কন্যা হলে ছেলেটির নাম ‘কর্ম’ ও মেয়েটির নাম কি ‘বিরতি’ রাখতেন ? ব্যাপারটা কিন্তু ভাবাচ্ছে। এই আবহে অন্য কোনও সরকারি হাসপাতালে জন্মানো আর কোনও শিশুপুত্রের নাম ‘বিক্ষোভ’ রাখতে উৎসাহিত হয়েছেন কি কেউ ? ‘বিক্ষোভ মিত্র’ বা ‘বিক্ষোভ মণ্ডল’ ? খবর পেলে জানাবেন।
এমনিতে ব্যাপারগুলো মন্দ নয়। তবে এই পুত্র-কন্যারা বড় হয়ে উঠে তাদের এই অভিনব নামগুলি সমাজে বয়ে বেড়ানোর সময়েই হয়তো বিলক্ষণ বোঝা যাবে, নামে সত্যিই কিছু আসে যায় কিনা ।