আমার অনেকদিনের শখ আজ পূরণ হলো।
ব্যাপারটা এরকম। আজ অফিস থেকে বেরোনোর সময় আমার অফিসতুতো দাদাটি রীতিমতো চমকে দিয়ে হাতে একটি মিষ্টির বাক্স ধরিয়ে বললেন-খুলে দেখো , বাবরসা আছে। খোদ জায়গা থেকে আনা মিষ্টি। শুনেই এক্কেবারে দিলখুশ হয়ে গেল।মনে পড়লো মাস দুয়েক আগে আমিই চন্দ্রকোনা যাবার সময় বলেছিলাম আসার পথে ওখানের এই বিখ্যাত মিষ্টিটি খেয়েও দেখবো আর সঙ্গে করে নিয়েও আসবো। কিন্তু সে যাত্রা নানা কাজে কর্মে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাওয়ায় আর কেনা হয়ে ওঠেনি।তারপর সে ভাবে এ কদিনে ওদিকে যাবার সুযোগও হয়নি।তাই ইচ্ছেটা রয়েই গেছিলো মনে মনে। আজ দাদা অনেককিছুর মতো এই ইচ্ছেটাও পিতৃস্নেহে পূরণ করে দিলেন। ভাগ্গিস এমন একটি দাদা পেয়েছিলাম।লজ্জার মাথা খেয়ে বললাম -পুরোটাই আমার তো ? তারপর আরেকটু ভেবে বললাম -তুমি খাবে না? যেন জিজ্ঞেস করতে হয় তাই করা আর কি।জানতাম দাদার রক্তে চিনি আছে।মনে মনে ভাবছি শুধু না করার অপেক্ষা। দাদা অভিজ্ঞ চোখে আমাকে একবার দেখে নিয়েই বললেন-না,তুমিই নিয়ে যাও। ব্যাস ধেইধেই করে বাক্সটি বগলদাবা করে চলে এলাম।বাড়ি এসে দাদার পরামর্শ মতো হালকা চিনির সিরা ঝটপট বানিয়ে তাতে চুবিয়ে দিলাম বাবরসা। এরপর তো শুধু খাবার অপেক্ষা। একেকটা টুকরো মুখে দেওয়া মাত্র মিলিয়ে যেতে লাগলো পেঁজা তুলোর মতো। আহা ! এ স্বাদের সত্যি ভাগ হয় না।
মেদিনীপুরের ক্ষীরপাই বাবরসার জন্মভূমি। নামটা শুনে মনে হলেও এই মিষ্টির আবিষ্কারের পেছনে মুঘল সম্রাট বাবর বা অন্য কোনো মুঘল সম্রাটের কোনো অবদান নেই। বরং এক সাহেব কিছুটা এর কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন।
অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে বাংলার ভাগ্যাকাশে কালো মেঘের মতো উদয় হয়েছিল বর্গিবাহিনী। তাদের নিষ্ঠুর আক্রমণ আর লুণ্ঠনে ছারখার হয়ে যেতে বসেছিল সোনার বাংলা। বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের মতো মেদিনীপুর জেলার ক্ষীরপাইতেও এইসময় ক্রমাগত বর্গীহানায় ব্যতিব্যস্ত গ্রামবাসীরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকেন।খবর পেয়ে রুখে দাঁড়ান মেদিনীপুরের রেসিডেন্ট এডওয়ার্ড বাবরশ। প্রতিহত হয় বর্গী আক্রমণ। শান্তি ফিরে আসে গ্রামে। সাহেবের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ পরান আটা নামে স্থানীয় এক মোদক ময়দা,দুধ আর ঘি দিয়ে স্বর্গীয় স্বাদের এক বিশেষ মিষ্টান্ন তৈরী করে উপহার দেন তাঁকে। নাম রাখেন সাহেবেরই নামে -বাবরসা।সেই শুরু।তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। লোকের রসনা তৃপ্তির প্রয়োজনে সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে এর চাহিদা।
আক্ষেপ একটাই। প্রচারের অভাব থাকায় সে ভাবে আজও হয়তো অনেকে এই মিষ্টিটির কথা শোনেননি বা জানেননা। কলকাতায় আমার চেনা-জানা কোনো দোকানেই এমন কোনো মিষ্টির হদিশ পাইনি। কোনো অনুষ্ঠানে বা পঙক্তি ভোজনে কখনো পাতে পড়েনি এই দেবভোগ্য বস্তুটি| অথচ বাংলার রসগোল্লার মতো এটিও নিজগুনে স্বতন্ত্রতার দাবি রাখে। সঠিক প্রচার বা বিপণন হলে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা এই শিল্পেও লাগবে প্রাণের জোয়ার। আজ এই বিশ্বায়নের যুগে শুধু ক্ষীরপাইয়ের মধ্যে এমন একটি অসামান্য জিনিস আটকে থাকার কোনো মানে হয় না। কলকাতার রসগোল্লা, কৃষ্ণনগরের সরপুরিয়া-সরভাজা, জয়নগরের মোয়া, শক্তিগড়ের ল্যাংচা, বেলডাঙা ও জনাইয়ের মনোহরা, শান্তিপুরের খাসামোয়া, রাজহাটির মোহনমোয়া বা নারায়ণগড়ের ঘিয়ে মুড়কির মতো ক্ষীরপাইয়ের বাবরসাও সগৌরবে অধিষ্ঠান করুক মিষ্টি মানচিত্রে।
এখনকার মত থামলাম এখানেই| প্লেটে গরমাগরম গোলগাল রস চুপচুপে শেষ বাবরসাটি আমার জন্য অনেকক্ষন হল হা পিত্যেশ করে বসে আছে| এবার তার মানভঞ্জনের পালা|