প্রশ্নের সঠিক উত্তরটা এই মুহূর্তেও আমি জানি না। পুরোনো বন্ধুত্ব, অন্তরঙ্গতা, ভাবাবেগ- সবই ঠিক আছে। কিন্তু আমি এখনও পরিষ্কার করে বুঝে উঠতে পারছি না কিটু আমাকে ভালোবাসে কিনা। আচ্ছা, এটা জানার কী খুব দরকার আছে? কিন্তু ভাবনা বাস্তবের সীমানা ছাড়িয়ে কল্পলোকে পাখনা মেলে দেয়। কৌতূহল চরিতার্থ করার ইচ্ছে বড়ই প্রকট হয়ে ওঠে।
(২)
অনেকদিন আগে হঠাৎই সেদিন হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজ এসেছিল, -আপনি বিনীত?
অবাক হয়ে গেছিলাম। নম্বরটা অচেনা। চট করে এমন মেসেজ আসে না।
“হ্যাঁ, কিন্তু আপনি?”
বলে মেসেজ পাঠাতেই তার প্রোফাইলের ছবিটা দেখতে পেলাম।
একজন মহিলা!
অচিরেই সেটা পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠল। জীন্স-শার্ট পরা, কপালে সিঁদুরের ফোঁটাওয়ালা হাসি-খুশী ঈষৎ গোল মুখের আংশিক পৃথুলা মেয়েটি ব্র্যান্ডেড টি-শার্ট পরা স্বামীর গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা আইল্যাণ্ড রিসর্টের দরজার সামনে (মধ্যবিত্ত বাঙালী মেয়েরা ক্যামেরার সামনে যার-তার গায়ে এরকমভাবে অন্তরঙ্গভাবে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় না)। পুরোনো স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভাসতে ভাসতে দ্রুত স্থির হয়ে এল।
মেয়েটি কিটু!
বিচ্ছেদ বহুভাবেই হয়। ভুল বোঝাবুঝি হয় বেশি। ইগো জিনিসটা যে ভালো নয়, সেটা বুঝতে সময় লাগে। কিন্তু ততদিনে ক্ষতি যা হওয়ার, তা হয়ে যায়। তাই সেসব স্মৃতি আর রোমন্থন করতে চাই না। যদিও ভাবনাগুলো ঘুরে ঘুরে আমাকে ডেকে যাচ্ছিল। সেদিন আমি বসে বসে কফি টেবিল থেকে মেনু কার্ড-টা তুলে নিয়ে তার তলার লেখাগুলো পড়ছিলাম। লেখায় চোখটা আটকে গেছিল-
“সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরানো বন্ধু নতুন হয়ে ওঠে, বাস্তবে ডানা মেলে দেয় কল্পনা।”
আমি আলতো ভাবে কফি ও স্যাণ্ডউইচ খেতে খেতে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। চেনা এই পাহাড়ী শহরের দৃশ্যগুলো অচেনা কিন্তু রোমাঞ্চকর লাগছিল, অনেকদিন পরে। সামনের এই পথ দিয়েই কিটুর আসার কথা। ওই যে রাস্তাটা দিয়ে খুনসুটি করতে করতে একজোড়া কলেজে পড়া ছেলে-মেয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা ছেলেটাকে আলগোছে একটা থাপ্পড় দিল। ছেলেটা হা, হা করে হাসছে। সেন্ট অ্যান্ড্রুজ স্কুলের ছুটি হয়ে গেল। হই-হই করতে করতে একদঙ্গল ছেলে-মেয়ে বাড়ির পথ ধরলো। কিছুটা মেঘ এসে আবছা করে দিল ছিরিং পালদেন রোডের বাড়িঘর, দোকানপাট। দূরে শিবদাড়ার ঝরনাটা কিছুদিন হল বৃষ্টির জল পেয়ে মেতে উঠেছে। আমার ভাবনাগুলো অগোছালো হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎই কাঁধে একটা থাপ্পড় এসে পড়ল। চমকে উঠে তাকাতেই বুঝতে পারলাম কিটু এসে গেছে।
ঠিক সেই ছবিটার মতন দেখতে।
ছোটবেলার চুলগুলো এখন খানিক বেশি কোঁকড়ানো, গালে-হাতে কিছুটা বাড়তি মেদের আভা, চোখ হয়তো আর অতটা সজীব নেই। কিন্তু কিটু কিটুই………….ওর কোন বিকল্প হয় না। অন্তত আমার কাছে।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। প্রায় জড়িয়েই ধরল কিটু আমাকে। অতটা সজীব হয়তো নেই সেই বন্ধন, কিন্তু আন্তরিকতা এখনও আছে, সেটা স্পষ্ট বুঝলাম। সমতল হলে লোকজন কাজকর্ম ফেলে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকত। আমিই সংকুচিত হয়ে উঠলাম। ও আমার সংকোচ বুঝতে পেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল।
-কিরে, আমার উল্টোদিকে বসতে বসতে টেবিলের দিকে তাকিয়ে সে বলল, -কি রাক্ষস রে বাবা! সব শেষ করে দিলি?
-চল আবার প্রথম থেকে শুরু করি।
কথাটা প্রতিবর্তক্রিয়ার মতন গলা দিয়ে বেরিয়ে এল। চোখ নামিয়ে নিল কিটু।
অপরাধবোধে?
এই কফিশপটার ভালো জিনিস হল কেউ এসে আপনাকে অর্ডারের জন্য বিরক্ত করবে না। অনেকক্ষণ বসে থাকলেও না। অর্ডারটা আপনাকেই উঠে গিয়ে দিয়ে আসতে হবে। আমি উঠে গিয়ে দু’জনের জন্য হ্যাণ্ড মেড কফি, পেস্ট্রী ও ক্রীম মাখানো বাদামের অর্ডার দিয়ে এলাম। তারপরে আরামদায়ক সোফাতে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলাম,
-আর কী খবর?
-এখানে আমার এক দিদি থাকে, মিঠুদি। হাত দু’টো থুতনির কাছে নিয়ে এসে বলল ও, -তুই তো চিনিস ওর বরকে, ডঃ বর্মণ।
-হ্যাঁ, তুই বলেছিলি বটে। আমি বললাম, -শহরের যে সব ছেলে মেয়েরা জয়েন্ট এন্ট্রান্সের কোচিং নিচ্ছে, তাদের অধিকাংশই তাঁর কাছে ব্যাচে ব্যাচে পড়ে।
-রেজাল্ট কেমন হয়?
কৌতূহলী হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে এল কিটু। ওর টাইট শার্টটা বুকের কাছে আরো টাইট বলে মনে হল।
-অনেকেই চান্স পায়, বিশেষ করে বেসরকারী কলেজে। আমি অবাধ্য চোখটাকে সরিয়ে নিতে নিতে বললাম, -তবে এদিকে অংকের ভালো টিচার পাওয়া শক্ত। তাঁর মার্কেট অটুট আছে। তারপরে প্রসঙ্গ পালটে জিজ্ঞেস করলাম, -তাহলে গতকাল এসেছিস?
-হ্যাঁ।
শ্রাগ করল কিটু। এমন সময় ওকে দেখতে বেশ লাগে। পুরোনো দিনের সেই মেয়েটির মতন, নিজের যৌবন সম্পর্কে যে ছিল যত্নসহকারে অগোছালো।
-অনেকদিন মিঠুদির সঙ্গে দেখা হচ্ছে না। এই ফাঁকে চলে এলাম। চোখ মটকে বলল কিটু, -ভাবলাম তোর সঙ্গেও দেখা হয়ে যাবে।
-তাহলে থেকেই যা কিছুদিন। কফি এসে গিয়েছিল। আমি গুছিয়ে নিতে নিতে বললাম, -বেশ ঘোরাও যাবে।
-খুব আদিখ্যেতা না। কড়া গলায়, অথচ মজা করে বলল কিটু, -এত সাহস আগে কোনদিন দেখাস নি কেন রে?
-সুযোগ আর দিলি কই?
আমিও মজা করেই বললাম। যে স্বর শুনে কথাটা কেউ সিরিয়াসলি নিলেও নিতে পারে, যদিও তার দায় আমার নয়, ঠিক সেইরকম গলাতেই কথাটা জাস্ট ছুঁড়ে দিলাম।
-দিলে নিতে পারতিস? হালকা হাসল ও। অনেকটা টেনে টেনে বলল, -পারবি এখন, যদি দিতে চাই? আছে সে সাহস?
কিটু ক্রমশ সিরিয়াস থেকে সিরিয়াসতর হয়ে যাচ্ছিল। এবং বড় দ্রুত। কিন্তু মনে হচ্ছে যে ও মজাই করছে। হাজার হোক বাংলার বধূ বলে কথা। বুকভরা মধু থাকলেও দায় থাকে অনেক। ওর সঙ্গে পুনরায় কথা শুরু হওয়ার পরে হোয়াটসঅ্যাপে
অনেক চ্যাট করলেও এমন ধরনের কথা কোনদিনই বলেনি ও। বড় জোর কিছু নির্বিষ অ্যাডাল্ট জোক শেয়ার করেছে সে।
কিন্তু এখন?
আমিও ঝুঁকে এলাম ওর দিকে। চাপা স্বরে বললাম, -আমার সাহসের নমুনা আগে দেখতে চেয়েছিলি?
-তুই আমাকে কিন্তু চ্যালেঞ্জ করছিস!
মুখটা নামিয়ে নিতে নিতে সিরিয়াসলি কথাটা বলেছিল ও। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। তবে খানিক পরে গুমোট ভাব সজীব হয়ে গেলে পর অনেক কথা হয়েছিল। ওরা আগে থাকত আমেদাবাদে। এখন হায়দ্রাবাদে থাকে। দাক্ষিণাত্যে তাও প্রায় বছর দশেক হয়ে গেল। বরের কাজের চাপ বলে এবারের পুজোতে সে আসেনি। নিঃসন্তান কিটু তাই একাই এসেছে। কয়েকদিন পরে ফিরে যাবে।
(৩)
আমার সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। গত তিনদিন ধরে বারে বারে একাধিকবার এটাই ঘটেছে। ঘটনার আগে আমরা একে অপরকে সর্বতোভাবে জানতে যতটা আগ্রহী হই, ঘটনাটির পরে একে অন্যের সম্পর্কে ঠিক ততটাই নিরুত্তাপ হয়ে যাই। কিন্তু এবারের, এই এখনকার নিরুত্তাপ একেবারে অসহনীয়। আমার তৃষ্ণার্ত মরুভূমির মরূদ্যান কি মরীচিকা?
খাট থেকে নেমে আমার সেকেণ্ড হ্যাণ্ড কেনা পাইন কাঠের পুরোনো দিনের ড্রেসিং টেবিলটার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিতে নিতে বলল কিটু,
-কাল সকালে বেরিয়ে যাচ্ছি। জীনসের প্যাণ্টটাকে ঠিক করতে থাকল ও। সন্তুষ্ট হয়ে শার্টটাকে ঠিক-ঠাক করে নিয়ে আমার দিকে না ঘুরেই বলল, -দুপুরে বাগডোগরা থেকে ফ্লাইট। পরশু হায়দ্রাবাদ চলে যাচ্ছি।
-তবে যে বলেছিলি কালকের দিনটা থাকবি। আর আজ রাতে আমরা একসাথে ডিনার সারব?
আমার বিস্ময় আর কাটছিল না। এ কোন কিটু? গত দিন তিনেকের এই চূড়ান্ত অন্তরঙ্গতার পরিচয়ের বাইরে আরেকটা কিটু থাকা সম্ভব, সেটা একপ্রকার ভুলেই গেছিলাম।
-নারে! চুলটা ঠিক করতে করতে সে গম্ভীর গলায় বলল, -আজ মিঠুদির ছেলের জন্মদিন। বাড়িতে অনেক কাজ আছে।
কথাটা আজ দুপুর অবধিও আমাকে বলেনি। কিন্তু কেন?
এরপরে ওর সঙ্গে আর বিশেষ কোন যোগাযোগ ছিল না। ও আর পাত্তা দিত না। কেমন সরিয়ে নিয়েছিল নিজেকে। মেসেজ করলে হয়তো মাসখানেক পরে উত্তর পেতাম। অভিমানী আমিও নিজেকে খোলসের মধ্যে গুটিয়ে নিতে থাকলাম। প্রায় বছরখানেক পরে আলগোছে ফেসবুকের বিভিন্ন পোস্টিং স্ক্রল করতে করতে হঠাৎই শিশুসন্তান কোলে ওর একটা ছবি চোখে পড়ে গেল।
আচ্ছা, কিটু কি সত্যিই আমাকে ভালবাসে?