Home / কিশোর গল্প / গিনি-পিগের বাসা – নূপুর রায়চৌধুরী            

গিনি-পিগের বাসা – নূপুর রায়চৌধুরী            

                                                            

শিল্পী- পুণ্যতোয়া ধর/ গিনিপিগের বাসা
শিল্পী- পুণ্যতোয়া ধর

 

 

কমনরুমে ঢুকতে ঢুকতেই মিস টিউলিপের কথাটা কানে এল দিয়ার। ইকুয়েডরে নাকি এখন গিনি-পিগ ফেস্টিভ্যালের মরসুম, গিনি-পিগদের ঐতিহ্যগত পেরুভিয়ান পোশাকে সাজিয়েগুজিয়ে খুব মজা করা হয়। শুনেই চমকে ওঠে দিয়া, চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে ওঠে সেদিনের ঘটনা, বহুযুগের চাপা-পড়া ক্ষতে কেউ যেন একটা সুঁই ফুটিয়ে দেয় । সেও তো ঘটেছিল এক ফেস্টিভ্যালেরই দিনে। চিরতরে হারিয়ে গেছিল ওর প্রিয় গিনি-পিগটা।

 

তখন কতই বা বয়স ছিল দিয়ার—বড়োজোর ছয়, তার মানে ওর পিঠোপিঠি ভাইয়ের পাঁচ। সদা দাদার সঙ্গে দুই ভাইবোনে নাচতে নাচতে গিয়েছিল মহামায়াতলার জমজমাটি হাটে । সেখান থেকে ওরা কিনে এনেছিল দুটো গিনি-পিগ –টিউ, আর পিউ। টিউ ছিল সাদা-কালো আর পিউ, সাদা, কালো, বাদামী রঙের মিশেল। দেখতে দুটোই খুব মিষ্টি, কিন্তু পিউ ছোট্টোখাট্টো মেয়ে, একটু বাড়তি সুন্দর, একটু বেশি আদুরে, মেয়েরা যেমন হয় আরকি! আর টিউ ডাকাবুকো, বড়োসড়ো ছেলে ! ওরা আসার পর থেকে দিয়া আর তার প্লাস্টিকের পুতুল নিয়ে খেলে না, খেলবেই বা কেন? এখন তো হাতের কাছেই জ্যান্ত পুতুল!  টিউ-পিউকেই সাধ মিটিয়ে সাজাত সে- পিউয়ের জন্য লাল টুকটুকে সাটিনের জামা, টিউয়ের গায়ে সাদা ভেলভেট–মনে হতো পিউ যেন এক রানী, আর টিউ তার বশংবদ প্রজা ।

 

সারাটা দিন বাগানে ছাড়া থাকত ওরা, ঘুরে ঘুরে কচমচিয়ে সবুজ সবুজ কচি ঘাস-পাতা খেত দুটিতে। সন্ধ্যে হলেই ওদের খড়-বিছানো, কোঁদা- উঁচু কাঠের বাক্সের ঢাকনার লোহার আংটা-টাকে খট খট করে নাড়াত দিয়া, আর অমনি কুঁই কুঁই করতে করতে বাগান ছাড়িয়ে, কলতলা ডিঙিয়ে বাসার মায়ায় ফিরে আসত কর্তা গিন্নি । দিয়া দেখত, কচি ঘাসের সবুজ রস, ওদের চিবুক বেয়ে কেমন গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে, ধবধবে সাদা খুদে খুদে দাঁতগুলো মনে হতো আরো ধারালো,পুঁতির মতো কালো কালো চোখে হাসি যেন চিকচিক করত। দিয়া ইচ্ছেমতো নিত্যি নতুন ঢঙে সাজাত তার দুই পুষ্যিকে । বৌ সাজালে পিউ যেন আহ্লাদে গদগদ হয়ে যেত। টিউ অবশ্য বরের ধড়াচূড়া পড়ে, অনিচ্ছায় মাথা ঝাঁকাত। রগড় দেখে খ্যাঁকখেঁকিয়ে হাসত দিয়ার ভাই।

দেখতে দেখতে পিউ মা হতে চলল, ওর ছটফটে চলন বদলে গিয়ে শান্ত ধীর হয়ে উঠল, টিউ পিউ’র পিছন পিছন খবরদারি করতে করতে দিনশেষে বাসায় ফিরত।

 

দিয়া এক এক করে দিন গুনে চলেছে, না জানি কবে ঘুম থেকে উঠেই দেখবে গিনি-পিগের কাঠের বাসা ভরে গেছে নতুন কচি-কাঁচা ফুটফুটে অতিথিদের আগমনে ।

 

ওহ, বলা হয়নি, দিয়াদের একটা ঝাঁকড়া বাদামী রঙের মেয়ে-কুকুরও ছিল; ওর নাম টমৰা। এ বাড়ির বহু পুরোনো সদস্য সে। এতদিন একা একা আদর যত্ন ভোগ করেছে, টিউ পিউ আসায় তাতে ভাগ বসেছে না? অতএব, প্রথম প্রথম ওদের বিরুদ্ধে টমৰা’র অসন্তোষের ভাবটি কারুর আর বুঝতে বাকি থাকেনি। কিন্তু ধীরে ধীরে ওদের মেনে নিয়েছে টমৰা। সত্যি কথা বলতে কি, এক ধরণের সখ্যতাই গড়ে উঠেছে ওদের তিনজনার চালচলনের মধ্যে দিয়া লক্ষ্য করেছে, বড়ো বড়ো রাক্ষুসে চিলগুলো আশেপাশে থাকলে, টমৰা মোটেই টিউ-পিউদের পাশটি ছাড়ে না। নিশ্চিন্ত হয়েছে দিয়া, টমৰা থাকতে ওদের কেশাগ্র স্পর্শ করার সাহস হবে না কারুর!

 

কিন্তু ঈশান কোণে কখন থেকে যেন একটু একটু করে ভয়াল এক মেঘ জমতে শুরু করেছিল। পাশের নার্সিং-হোমের ডাক্তার-বাবুর কালো রোমশ ষণ্ডা বুলডগ কালু ইদানিং টমৰার বন্ধু হয়েছে । টমৰার সাথে দেখা করতে প্রায়ই এ বাড়িতে ঢুঁ মারছে সে। টিউ-পিউদের দেখলেই কালুর চোখেমুখে কেমন একধরনের ক্রূর হাসির যেন ছায়া ফুটে ওঠে । দিয়া’র একদম ভালো লাগে না কালুর এই আসা-যাওয়া। কিন্তু কালু এলেই টমৰা এক্কেবারে নেকুপুষু হয়ে যায়। দিয়া অনুভব করেছে, কালুকে কিছু বললে কষ্ট পাবে টমৰা, তাই সে সামনাসামনি কিছু করতে পারে না, কিন্তু টমৰা একটু এদিক ওদিক হলেই দূর দূর করে খেদিয়ে দেয় কালুকে।

 

তারপর এল সেই উৎসবের দিন–কালী পূজা । ঘর-ভর্তি লোকজন পুজোর তদারকিতে দারুণ ব্যস্ত, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত শুরু হয়ে গেছে, টিউ পিউ সেদিনের পেটচুক্তি খাওয়া সেরে, বাসার পথে রওয়ানা হয়েছে, বাগান পেরিয়ে, কলতলা ডিঙিয়ে বাসার একদম কাছে এসে গেছে দুটিতে। হঠাৎই একটা তীব্র আর্ত-চিৎকার খান খান করে ভেঙে দেয় আনন্দের বাতাবরণ । ঠাকুরের ফুলের সাজ বানাচ্ছিল দিয়া, জান্তব আর্তনাদটা শুনেই ওর বুকটা ধক করে উঠল, পড়ি কি মরি করে ছুটে বাইরে বেরিয়ে আসে সে।

এ কী দেখছে? কালুর মুখে কামড়ে ধরা ওর অতি আদরের নরম তুলতুলে বৌ-রানী পিউয়ের নিস্পন্দ শরীর; পাশে দাঁড়িয়ে ফ্যালফেলে-চোখে টমৰা। মাথাটা বনবন করে ঘুরছে দিয়ার। ডুকরে কেঁদে উঠে, প্রবল আক্রোশে কালুর দিকে তেড়ে যায় সে। বিপদ বুঝেই মুখের শিকার ফেলে দিয়ে পিঠটান দেয় কালু। দিয়া কালুর পিছন পিছন ধাওয়া করে, কিন্তু বজ্জাতটা  এক লাফে পাঁচিল টপকে দে দৌড়। হতাশ হয়ে পায়ে পায়ে ফিরে আসে দিয়া অভিশপ্ত জায়গাটাতে, দেখে, পিউয়ের নিথর দেহটাকে আলতো করে স্পর্শ করে, নতমুখে দাঁড়িয়ে আছে টমৰা, যেন কালুর পাপের জন্য পিউয়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছে সে।  টমৰা’র চোখ দুটো এই মুহূর্তে যেন অসহনীয় করুণ, আর বড়ো বেশি লাল!

অবাক হয়ে জলভরা চোখে স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে থাকে দিয়া শোকের সেই পবিত্র দৃশ্যপটে। কতক্ষণ কেটে গিয়েছে কে জানে? এবার ওর খেয়াল হয়-টিউ কোথায়! ওকে তো দেখতে পেল না আশেপাশে। একবুক শঙ্কা নিয়ে ওদের বাসার সামনে, হাজির হয় দিয়া। ভিতরপানে উঁকি মারতেই দেখে, থম মেরে একা একা সেখানে বসে আছে টিউ। গভীর যন্ত্রণায় সে যেন পাথর; বুঝি বা নিজেকে শতছিন্ন করছে! কেন, কেন সে আজ বেভুলে একাই এগিয়ে গিয়েছিল বাসার দিকে? খেয়ালই করেনি, ভারী শরীরে কখন পিছিয়ে পড়েছিল পিউ, পালাতে পারেনি; গিনি-পিগের বাসা তখনও যে অনেক অনেক দূরে!

 

……০……

 

Leave a comment

Check Also

 ছেঁড়া রামধনু – মৌসুমী পাত্র

আমার মা বেজায় দুষ্টু হয়েছে আজকাল। একটা কথাও শুনতে চায় না। এই তো পরশুদিন, বললাম, …

chitrogupter-computer-mp

চিত্রগুপ্তের কম্পিউটার- মৌসুমী পাত্র

“যত্ত সব আদ্যিকালের জিনিস নিয়ে কাজকারবার! আর পারা যায় না বাপু!”, নিজের মনেই গজগজ করতে …

শিল্পী- গুঞ্জা

ফুল-পাখি কথা – মৌসুমী পাত্র

সে ছিল এক গভীর বন। আর সেই বনের ঠিক মধ্যিখানে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় ছিল এক …

রসেবশে রামায়ণ- মৌসুমী পাত্র

রামায়ণের গল্প আমরা সবাই জানি। কিন্তু গল্পেরও কিছু ভেতরকার কথা থাকে। যাকে বলে, পেটের কথা। …