হ্যাঁ রে, এত কিছুর পরেও তুই আসবি?
শীতশেষের উড়তে থাকা ধুলো মেখে, খবরের কাগজের নিত্যদিনের খুনজখম- ধর্ষণ-রাহাজানি-দুর্নীতি-ইতরামির পাঁক গায়ে জড়াতে জড়াতে কেন আসিস তুই? প্রতি বছরে? তোকে দেখলেই যেন আহ্লাদী মুখে গলে যেতে হবে, এমন হাবভাব কেন রে তোর?
তুই নিজেও তো জানিস, জঠরে থাকা অবস্থায়- সেই ইরাবতী নদীর ছলাৎ ছল বয়ে চলা স্রোত- কোন অনির্দ্দেশ্য ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বয়ে নিয়ে- সেদিন… কোন্ সুখস্বপ্ন দেখেছিলি তুই?
সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুকে দেখে সবাই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে রে, টলোমলো পায়ের হাঁটতে থাকা শিশুকে দেখে সবাই হাততালি দেয়, কচি কচি গলার দুষ্টু-মিষ্টি পাকা পাকা কথার শিশুকে দেখে প্রাজ্ঞজনেরাও কৌতুকে মাতে। আর তারপর? যতটা ছোট যখন আর থাকে না, ততটা বড়ও যখন হতে ঢের দেরি, তখন? হাততালি দিতে থাকা লোকজনেরা দূর থেকে আড়ে আড়ে চায়, কৌতুকে মেতে থাকা লোকজন মাপতে যায়, মাঝে মাঝে তীক্ষ্ণ হুল বিঁধিয়ে চলে যায়। এই না বড়, না ছোট বয়সে অহর্নিশ যন্ত্রণার কাঁটা এদিক ওদিক থেকে এসে এফোঁড় ওফোঁড় করতে ছুটে আসবেই- জানিস না বুঝি?
তাহলে? তোর এখন যা দশা, সামনে এলেই পাঁচটা লোকে দশ কথা শোনাবেই। তবুও যে কেন মরতে আসিস?
এই তো দেখছিস, চোর-ছ্যাঁচড়-নেতায় লুটেপুটে ফাঁক করে দিচ্ছে, কচি কচি ছেলেমেয়েরা কুলির মত ভারি ব্যাগপত্র পিঠে স্কুলে যাচ্ছে, খাবার দাবার শাক-সবজি ভেজাল, রাসায়নিকে ছয়লাপ! শরীর খারাপ হলে ওষুধ-পত্র-ডাক্তার-বদ্যি-হাসপাতাল-নার্সিংহোম আর তার পিছন পিছন ফেউয়ের মতন লেগে থাকা অগণিত ফিরিস্তি আর দালালচক্রের ফলাও কারবার! ঠকানোর জন্য আর মাথায় হাত বুলিয়ে টু পাইস কামানোর জন্য সবাই বসে আছে রে! গ্রামে যা, রাস্তা ভালো পাবি না, পরিশ্রুত জল পাবি না, রোগ অসুখ হলে কতদূর যে ঠ্যাঙাতে হবে তারও ঠিকঠিকানা নেই। আর রাত হলে আঁধারই আঁধার! আর শহরে যাবি? সেখানে ধুলো ধোঁয়া, ভিড়, আবর্জনা, গাড়ির প্যাঁ পোঁ, গাদা গাদা মানুষের ক্যাচক্যাচানি- কী শান্তি আছে বল? কোথায় আছে বল?
তুই নিজেই বল্ না সত্যি কথা, এই-ই কি তুই চেয়েছিলি? এইভাবেই কি চেয়েছিলি বড় হয়ে উঠতে? তোর পাড়ায়, তোর আশেপাশে, তোর গ্রামে, তোর শহরে, তোর জেলায়, তোর রাজ্যে, তোর দেশে- চোখেও কি পড়ে না জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাওয়া কিংবা পিটিয়ে লাশ করে দেওয়া সেই সব নেই- মানুষদের, কিংবা একের পর এক দুর্ঘটনায় মরে যাওয়া শবেদের? চিকিৎসা না পেয়ে ধুঁকতে থাকা চোখগুলোকে? অ্যাসিডে পুড়ে যাওয়া কায়াদের? রেলস্টেশনে, শিবকাশীর বাজি কারখানায়, রাস্তার ধারের পাইস হোটেলের লাথি খেতে খেতে ঝুলতে থাকা প্রতিবাদহীন শৈশববগুলোকে? অথবা সাট্টা জুয়ার ঠেকে গুলি বন্দুক নিয়ে মারামারি করা খুনে মস্তানগুলোকে? আর নইলে শ্বশুরবাড়ির হাতে মারধর খেতে খেতে মর্গে খোবলানো শরীর আর কাঁটাতারের নির্জীব হয়ে যাওয়া প্রাগৈতিহাসিক মনগুলোকে?
তোর সেই আধো আধো স্বরে, সেই নিষ্পাপ চোখদুটো দিয়ে এই-ই কি ছুঁতে চেয়েছিলি তুই? আয়নায় শেষ কবে নিজেকে দেখেছিস হিসেবটাও কি রাখিসনি? বারুদে পুড়ে যাওয়া ঝলসানো আধপোড়া পোড়াকাঠের মতন কী চেহারা করেছিস, দেখতে পাস?
তবুও জানিস কি, এত কিছুর পরেও তোকে চুপিচুপি ভালোবাসি। যেভাবে ভালোবাসা যায় সন্তান-সন্ততিকে, যেভাবে ভালোবাসা যায় বন্ধুকে, যেভাবে ভালোবাসা যায় একলা সন্ধ্যাতারাটিকে, যেভাবে ভালোবাসা যায় টুপটাপ শিউলির মনখারাপি ঝরেপড়াকে, যেভাবে ভালোবাসা যায় একলা দুপুরে একলা চলা রিকশার রিনঠিনকে, যেভাবে ভালোবাসা যায় ভোরবেলাকার বাতাসিয়া গন্ধকে- সেভাবেই ভালোবাসি তোকেও।
তোর ওপর এক এক সময় রাগ ওঠে, ভীষণ ভীষণ প্রবল এক রাগ- ভেঙেচুরে তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করে সবকিছু- তবুও… তবুও, এত কিছুর পরেও মনে হয় যেন তুই আসিস বছর বছর! আমাদের এই নিত্যদিনের ক্লিন্ন যাপনকে আশা- ভরসার সোনা-রূপোর জীয়নকাঠি ছুঁইয়ে লহমায় ঝলমলে করে দিতে।
তুই না এলে যে কিছুই থাকবে না রে! কলেজের ইউনিভার্সিটির সামনে হাহা হিহি গুলতানি, চাষীদের নিজের জমিতে নিজের ইচ্ছেমতন ফসলের চাষ, ইচ্ছেমতন রুটিরুজির অধিকার, অফিসে-কাছারিতে-হাটে-বাজারে-ট্রামে-বাসে-ট্রেনে আমাদের অনন্ত স্বাধীন কথা কানাকানি, শেষ বিকেলের মন-কেমন-করা আলোয় প্রেমিক-প্রেমিকার হাত ধরাধরি করে চলে যাওয়া, দাঁতভাঙা শিশুর ফোকলা হাসিতে খুশিয়ালি ঢেউ বাওয়া, উজান গাঙে দিনশেষে মাঝির একলা আনমনা গান গাওয়া, কিংবা এই খেয়ালখুশিতে মনের সাধে বেলাগাম কলম পেষা- সম্বৎসরে তুই না এলে থাকত এতকিছু?
তাই বলি, তুই আয়! বছর বছর আসতেই থাক! আর তোর আসার পথে গুঁড়িয়ে দে যত কালোবাজারি, যত মূল্যবৃদ্ধি, যত গুণ্ডাগিরি, যত লুঠতরাজ- চুরমার করে দে যত নোংরামি আর ইতরামি, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দে মানুষ আর মানুষীদের না-পাওয়ার যন্ত্রণা, বেদনা!
হ্যাঁ রে, পারবি না এটুকু করতে?
তুই যে আমাদের স্বাধীনতার আগেই স্বাধীনতার নাড়িছেঁড়া ধন- প্রজাতন্ত্র দিবস!
……০……