একটা ঘটনা বলি। রাতের পুরুলিয়া এক্সপ্রেসের সাধারণ কামরায় যাচ্ছি। উল্টোদিকে এক কমবয়সী দম্পতি, সঙ্গে দুই বাচ্চা ছেলে। খড়্গপুরের পর পুরুলিয়া এক্সপ্রেস অনেকটাই ফাঁকা হয়ে যায়। যাত্রীরা হাত পা ছড়িয়ে বসে, ছোট বাচ্চারা একটু হলেও হুটোপাটির সুযোগ পায়। এক যাত্রীর সঙ্গে অন্য যাত্রীর নিশ্চিন্ত মনে আলাপচারিতার সুযোগ ঘটে। কাছাকাছিই একজন অল্পবয়সী পুরুষ যাত্রী ছিলেন। তিনি ভাব জমালেন পরিবারটির সঙ্গে। বড় ছেলেটির পড়াশুনোর কথা উঠল কথায় কথায়। ছোট ছেলেটির স্কুল যাবার বয়স হয়নি। মহিলা বললেন- “ওর সব ভালো। ইংরেজি খুব পড়ে। বাংলায় খালি কম নম্বর পায়। ওকে বললে বলে, বাংলা পড়ে কী হবে?” চাপা গর্ব ঝরে ঝরে পড়ে মহিলার কথায়। একটু পর, বড় ছেলেটি জল খেতে চাইল। মা ধমক দিলেন, “জল কী রে? ‘ওয়াটার’ বলতে পারিস না?” ছেলেটি উত্তর দিল, “মা আমি যদি আজ সব ইংরেজি কথা শিখে যাই, আর সব ইংরেজি বলি, তাহলে তুমি আমার কথা বুঝতে পারবে তো?” নিমেষেই মা অধোবদন।
আমার আশ্চর্য হবার আরও কিছুটা বাকি ছিল। খানিক পরেই উল্টোদিকের সিট পুরো খালি হয়ে গেল। বাচ্চা দুটি জুতো পরিহিত অবস্থায় ‘ও গড’ ‘ও গড’ বলতে বলতে জুতো পরিহিত অবস্থায় সিটের উপর নাচানাচি শুরু করল। মা বা বাবা কেউই একবারের তরেও বারণ করার প্রয়োজন মনে করলেন না। আমিও চুপ রইলাম। অতীতে এরকম আরো দু একটি ক্ষেত্রের তিক্ত অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গেল।
আমাদের স্বাধীনতার প্রকৃত স্বরূপ কী, বুঝতে হলে এরকম ছোটোখাটো দু’ একটি ঘটনাই যথেষ্ট। আমাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা আছে, ফলে আমরা জুতো পুরে বসার জায়গায় নাচানাচি করবো, ইচ্ছেমতো থুতু ফেলবো যেখানে সেখানে, রাস্তাঘাটে ইচ্ছেমতো বিস্কুট চিপসের প্যাকেট ফেলে রাখবো- ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ প্রতিবাদ করলে মারমুখী হয়ে বলে উঠবো, ফেলেছি, বেশ করেছি। আপনার অসুবিধা হয়, অন্য জায়গায় সরে যান। এসব আমরা বলি, করি, কারণ আমরা জানি- আমরা স্বাধীন। একই সঙ্গে আমরা মাখন না বলে ‘বাটার’ বলবো, মশলা না বলে ‘স্পাইস’ বলবো, চিনি না বলে ‘সিগার’ বলবো, বাইরে খাওয়াদাওয়া করাকে ‘হ্যাংগিং আউট’ বলবো। কারণ কথার মাঝে যত ইংরেজির ফুলঝুরি ছোটানো যায়, ততোই সমাজের নব্য কুলীনপদে আসীন হবার কাছাকাছি পোঁছোই আমরা।
এ এক আশ্চর্য স্ববিরোধিতা! একদিকে আমরা নিজেদের স্বাধীন ভাবি বলে যেমন সামাজিক ভদ্রতাগুলোকেও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিই, অপরপক্ষে, ইঙ্গীয় আহার- বিহার, কথন- চলনের উদ্যাপনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সত্যিই যদি আমরা স্বাধীন হই, তাহলে সম্পূর্ণ বিনা প্রয়োজনে ‘জল’কে ‘ওয়াটার’ বলার মতো এই নির্লজ্জ ব্যগ্রতা কিসের? এর মানে একটাই। স্বাধীনতাকে আমরা বহিরঙ্গে যতটা ধারণ করতে পেরেছি, অন্তরের অন্তঃস্থলে তাকে গ্রহণ করতে পারিনি এখনও। অন্য ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি- ইত্যাদির সঙ্গে পরিচিত হবার প্রয়োজন অবশ্যই আছে, কিন্তু যখন তা সম্পূর্ণ দেশজ ভাষা বা সংস্কৃতির বিনিময়ে হয়, তখন তার মূল্য হয়তো বা অনেক বেশিই চোকাতে হয়। ময়ূরপুচ্ছধারী কাকই হোক বা কাকপুচ্ছধারী ময়ূরই হোক- কোনটাই সুস্থ সমাজজীবনের লক্ষ্য হতে পারে না।
ভারতবর্ষ চিরকালই অন্তরের সম্পদকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। বহিরঙ্গের চাকচিক্য কখনোই তার কাছে প্রধান হয়ে দাঁড়ায়নি। হামেশাই পড়া যায়, তপস্বী মুনি ঋষিরা এলে রাজা স্বয়ং তাঁর পা ধুইয়ে দিতেন। অর্থাৎ তাঁর কৃচ্ছ্বসাধনা, তার তপস্যা, তাঁর জ্ঞানকে সম্মান জানানো। কিন্তু এখন অনেক জায়গাতেই বেসরকারি বিদ্যায়তনের বিজ্ঞাপনে দেখি, বড় বড় করে লেখা থাকে ‘এসি ক্লাসরুম’। দেখেই একটা প্রবল ধাক্কা লাগে মনে। বিতর্ক উঠতেই পারে যে ছোট বাচ্চারা যদি একটু আরামে পড়াশুনো করে, ক্ষতি কী? গরমে ঘেমে নেয়ে পড়ায় মনোযোগ দিতে পারলে লাভ কার? কিন্তু আসল কথা সেটা নয়। কথা হচ্ছে, শিশুদের (এবং তাদের বাবামায়েদের) প্রলুব্ধ করা। টোপের মত। ‘জানিস, আমাদের স্কুলে না এসি আছে? কী বললি, তোদের নেই? ছ্যা, ছ্যা।’
এই যে পার্থিব ভোগবিলাসের টোপ ছোট থেকেই শিশুমনে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এর প্রভাব বিপজ্জনক হতে বাধ্য।
স্বাধীনতা মানে যেমন স্ব অধীনতা, তেমনই এর আরেকটা মানে, নিজেকে ভালোবাসা। নিজেকে মানে শুধুমাত্র নিজের ব্যক্তিসত্তাকে নয়। নিজেকে মানে নিজের ভাষা, সংস্কৃতি ও সুস্থ ঐতিহ্যকে ভালোবাসা। কমবেশি নিজেকে ভালোবাসি আমরা সকলেই। আমি খাঁদা হই, বোঁচা হই, কি আমার দাঁত উঁচু ইত্যাদি যাই হোক না কেন, দিনের শেষে আমরা নিজেকেই ভালোবাসি। কিন্তু নিজের ভাষা বা সংস্কৃতির প্রতি সেই অনুরাগ আমাদের কতটুকু? আদৌ আছে কি?
একই সঙ্গে শুরু হয়েছে দেখনদারিত্বের এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতা। পাশের বাড়িতে হোম থিয়েটার কিনেছে, অতএব আমাকেও কিনতে হবে। আত্মীয়ের বাড়িতে স্প্লিট এসি নিয়েছে, অতএব আমারও একটা না নিলে মান থাকে না। ফেসবুকে আজ যদি একজন পাঁচ রকম রান্নার ছবি দেয়, পরের দিন অবধারিতভাবে আরও একজন দশ রকম রান্নার ছবি দেবে। তোমার যা কিছু দেখানোর, তা আরও দশজনকে দেখাও, দেখাতেই থাকো- যতক্ষণ না তারা ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যায়। জাঁক করাটা আগে অন্ততঃ সামাজিকভাবে লজ্জার বিষয় ছিল, আজ প্রায় পুরো সমাজই নিজের বৈভব, বিত্ত প্রদর্শনে ব্যস্ত। এ আর যাই হোক, কোন সুস্থ সমাজের, সুস্থ মানসিকতার পরিচায়ক হতে পারে না। এ এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা।
স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষদের ‘মানুষ’ হিসেবে মান কি আদৌ উঠেছে, নাকি নেমেছে- এটা কিন্তু যাচাই হওয়া বড়ো প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। একটা দেশ তখনই উন্নতি করতে পারে, যদি তার মানবসম্পদ উন্নত হয়। মানবসম্পদ উন্নত হলে যে কোন মূল্যে সেই দেশের উন্নতি হবে, নইলে হাজার পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও দেশের অবনমন ঘটতে বাধ্য। আর মানুষের মানের অবমূল্যায়ন যে ঘটছে, সেটা খুব স্পষ্ট। বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই, দেশের রাজনীতিকদের দিকে তাকালেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যায়। অবশ্য শুধু রাজনীতিই বা কেন, যে কোন ক্ষেত্রেই, আপাতভাবে দুর্নীতির পাল্লা ক্রমশঃ ভারি হচ্ছে।
তার একটা বড়ো কারণ, আমরা, সাধারণ মানুষেরাই পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত নেই। জলের লাইনে ঠেলাঠেলি করে নিজের বালতি আগে ভরার চেষ্টা করি, রেলের ক্রসিং পড়ে গেলেও তার তলা দিয়ে সাইকেল নিয়ে কিংবা পাশ দিয়ে বাইক নিয়ে পেরিয়ে চলে যাই। জিনিস কেনার সময় দোকানি ভুল করে বেশি টাকা ফেরত দিয়ে ফেললে চুপচাপ পকেটস্থ করি। বাচ্চার স্কুলের দিদিমণিকে বিভিন্ন প্রকারে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করি, যাতে পরীক্ষায় দু’ চার নম্বর বেশি জোটে। আর আমি যদি দোকানদার হই, নির্বিবাদে পচা জিনিস খদ্দেরকে গছিয়ে দিই। উদাহরণ অজস্র। এই যখন সাধারণ চিত্র, তখন সমাজের সর্বস্তরেই যে তা প্রতিফলিত হবে সে আর বিচিত্র কী!
‘দেশ’ একটা বড়ো ব্যাপার। ‘স্বাধীনতা দিবস’ শপথ নেবার দিন বছরের বাকি দিনগুলোর জন্য। স্বাধীনতা দিবস শুধুই একদিনের উদ্যাপন নয়। এই ঘোরতর করোনাকালে বাইরে আনন্দ অবকাশের সুযোগ এমনিতেই কম। স্বাধীনতা দিবসের দিনটিতে নাহয় একটু আত্মচিন্তাই করলাম। যাঁরা বলিদান দিয়েছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য, সরষে ইলিশ খেতে খেতেই নাহয় তাঁদের কথা ভাবলাম। মুখে স্বাদ একটু বিস্বাদই লাগবে, তা লাগুক। সেই মানুষগুলো তো চেয়েছিলেন, আমরা খেয়ে পরে সুখে বেঁচে থাকি। তা একদিন কেন, মাঝেমাঝেই নাহয় স্মরণ করি তাঁদের কথা। সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট দুটো একটা কমিয়ে দিয়েই। নিজের ভাষার প্রতি, সংস্কৃতির প্রতি, ঐতিহ্যের প্রতি, স্বাধীনতা সংগ্রামের অমর বীরদের আত্মাহুতির প্রতি নাহয় আরেকটু যত্নবান হই।
এইটুকু তো করাই যায়, তাই না?
……০……