না, দূরত্বের অনুভব নিবিড় হয়ে এল না এবারের জন্মদিনে। আসবেই বা কী করে? ছ’ফুটের দূরত্ব বজায় রাখতে হচ্ছে যে! মাস্কের আড়ালে মুখ বাঁচে লুকিয়ে। মহামারীর বীজ বয়ে চলা অগণিত নরদেহ পিপিই কিটের অন্তরালে পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে চিরতরে! প্রিয়জন, পরিজন বিচ্ছিন্ন। হে কবি, কে ভূয়োদর্শী কবি, কষ্টকল্পনাতেও কি ভেবেছিলে এতসব?
হে কবি, তোমার গান, তোমার কবিতাই আমাদের সম্বল- এই দুর্দিনেও! কিন্তু তোমার ভাবনা? তোমার চিন্তার কথা হেথা কেহ তো বলে না কবি। তোমার জন্মদিন আসে- নাচে, গানে, আবৃত্তিতে। বা হয়তো কিছু আলেখ্যে। নেতাদের অগ্নিস্পর্শী ভাষণে। তোমার ভাবনাচিন্তার গভীরে আমরা ঢুকি অনেক কম, কাজে পালন করি আরও কম। তুমিই তো বলেছিলে না, নগরের অরণ্যায়ন করার কথা। আমরা এখন ‘ডেভেলপ’ হওয়া নিয়ে ভীষণ চিন্তিত, হে গুরুদেব! ক্ষমা করো। বিশাল বিশাল ঝকঝকে শপিং মল, ঝাঁ চকচকে রেস্টুরেন্ট- তুমিই বলো না, এসব ছাড়া কি চলে আজকের দিনে? আর তাছাড়া, তোমাকে তো ভুলে যাইনি একেবারে! মাঝেসাঝে শৌখিন হলুদ পাঞ্জাবি পাজামা কিংবা ইয়াব্বড়ো ব্বড়ো পোড়ামাটির গয়না কানে গলায় ঝুলিয়ে সোনাঝুরির হাটে গিয়ে তোমার প্রতি প্রীতির পরাকাষ্ঠা জাহির করি না? তুমিই বলো।
শৈশব শিক্ষা আনন্দময় করে তুলতে চেয়েছিলে না? আমাদের সন্তানাদিকে একবার দেখে যাও কবি। ব্যাগের ভারে, বইয়ের ভারে ন্যুব্জ। ‘তোতাকাহিনী’ লিখেছিলে না তুমি? আমাদের ঘরে ঘরে এখন তোতাকাহিনী। যেন-তেন-প্রকারেণ পুঁথির সারবস্তু জল দিয়ে গেলানোর আপ্রাণ প্রয়াস। আনন্দ নিয়ে হবেটা কি? সে তো আর চাকরি দেবে না! বাংলাভাষার দাম দিনে দিনে কমছে, কবিগুরু! যাকে প্রাণের রসে ফুলে-ফলে সঞ্জীবিত করতে চেয়েছিলে তুমি। আমরা বাংলা বলি কবিগুরু, নেহাত ইংরেজিটা ঠিকঠাক আসে না বলেই।
তোমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কাটাছেঁড়া কত যে বেড়ে গেছে, একবার যদি দেখতে! তুমি ক’বার হাঁচি তুলেছ, ক’বার ঢেঁকুর উদ্গীরণ করেছো, ঠিক কার কার সঙ্গে কেমন কেমন সম্পর্ক ছিল তোমার- এসব খুঁটিনাটি জানতে গিয়ে তোমার রচনাবলী পড়া যদি বাদ থেকেই যায়, ক্ষতি কী? ইংরেজের গোলামিও মানো নি তুমি, আবার বিলিতি কাপড় পোড়ানোতেও সায় ছিল না তোমার- এরকম হলে কি আজকের দিনে চলত, কবি? হয় তুমি এই শিবিরে, নয় ওই শিবিরে- মাঝখানে দাঁড়িয়ে তোমার বিবেকের নির্দেশে চলবে, এ কি আজের দিনে চলে গো?
তারপরে ধরো না, তুমি ‘বিসর্জন’ বা ‘রাজর্ষি’ লিখলে? লাভটা কি হল? ধর্মের নামে পশুহত্যা বন্ধ করতে পেরেছো কি কবি? পারোনি। তারপরে তোমার ‘দেনাপাওনা’র কথাই ধরো না। নিরুপমারা আজো গ্রামবাংলার জ্বলন্ত সত্য। অবশ্য গ্রামবাংলাই বা কেন, শহরাঞ্চলেও তারা আছে। পুলিশের খাতাতে তারা তোমার অসফলতার প্রমাণ হয়ে থেকে যায়।
ব্যর্থ তুমি, কবি। নিদারুণ ব্যর্থ। চেয়েছিলে বাঙালির চেতনার জাগরণ ঘটাতে, রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধে তার জীবন ভরিয়ে তুলতে। পারোনি। রতনকে মনে আছে? সেই যে গো, ‘পোস্টমাস্টারে’র রতন? জানো, রতন এখন ইস্কুলে যায়, মিড ডে মিল খায়। পড়াশুনা কতটা হয় জানি না। খবর কি করে পাবো বলো? পোস্ট অফিসগুলোই তো ধুঁকছে।
কী বলছো, কবি? আরেকটু জোরে বলো। ভালো শুনতে পাচ্ছি না। চারপাশে এত কর্ণবিদারী আওয়াজ, হর্নের শব্দ- শোনা যায় না। এ তো আর তোমার শিলাইদহের পদ্মা নদীর ছলাৎ ছল নয় যে প্রাণভরে মুখোমুখি দুটো মনের কথা কইবো।
ও হ্যাঁ, এবারে শুনতে পেলাম। উতলা প্রাণে, মগ্ন হৃদয়ের গানে তুমি জেগে থাকবে? তাই ভেবেছো বুঝি? অত সস্তা নয়। এখন ব্যাণ্ডের গান বাজে, ধুম তা না না না। তোমার গানেরও কত পরীক্ষা নিরীক্ষা, দলাই মলাই চলে, সে খবর রাখো কি?
ও, তুমি বলছো, তোমার সাধনা- সত্য, শিব, সুন্দরের সাধনা? যা কিছু চিরন্তন, চিরসত্য- তুমি তারই পূজারি? বেশ। ভালো কথা। আর কি বলতে চাও? বুঝলাম, তুমি প্রচারক নও, তুমি পথনির্দেশ করো। শাশ্বত গভীর বাণী তোমার কণ্ঠে। বুঝলাম, করুণাধারার জলে অভিষিক্ত করতে চাও তুমি আমাদের।
তাহলে, চুপিচুপি একটা কথা বলি রবিঠাকুর। আজ সকালে জানালা খুলেই যখন দেখি সজল মেঘের বাদল-ছায়া এই বৈশাখী দিনে, আকাশে দেখি উদভ্রান্ত মেঘের দল, তখন জানো, তোমার গানেরা কেমন যেন মনের ভেতর গুনগুনিয়ে উঠল। জানো এত মহামারীর এত ভয়াল ভ্রূকুটি- বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিলাম ক্ষণিকের তরে। ‘রক্তকরবী’র রাজাকে মনে পড়ল। যত শক্ত, যত কঠিনই হোক না তাঁর প্রতাপ, দিনের শেষে ‘মুক্তধারা’র দেখা তো মিলবেই। সেই মন্ত্রই তো শিখিয়েছ তুমি। অচলায়তনের নিগড় ভেঙে পঞ্চকেরা হই হই উল্লাসে মেতে উঠবে কোনও এক সুন্দর সকালে। আর একটা কথা। দূরত্ব তো শরীরের নয়, মনেরও হয়। সেই মনের দূরত্ব অতিক্রম করতে শিখিয়েছ তুমি। নাহলে এই অতিমারীকে উপেক্ষা করে ঘরে ঘরে তোমার জন্মদিনের পূজার উপচারে নিজেদেরই ভরিয়ে তুলছি কিভাবে, বলো? এও তো একরকম দূরত্বের অনুভব নিবিড় হয়ে আসা।
ভালো থেকো রবিঠাকুর! প্রণাম নিও জন্মদিনের।
……০……
অংকনঃ পুণ্যতোয়া