বড়, উন্নত শহর মানেই পেল্লাই সব বাড়ি। যেমন বই এর তাকে বই রাখা থাকে, তেমনই থরে থরে মানুষ সাজানো থাকে। কেউ পনেরো তলা, কেউ আঠারো তলা, মাটি থেকে কয়েকশো ফুট ওপরে পায়রার খুপরিতে সুখ-সারির বাসা। একরত্তি ব্যালকনিতে শুকোতে দেওয়া জামাকাপড় দেখে, বাসিন্দাদের সংখ্যা ও বয়স কিছুটা আন্দাজ করা যায়। প্রতিবেশী “কেমন আছেন” বলেই পাশ কাটিয়ে লিফটে ঢুকে পড়ে। সত্যিই কে কেমন আছে জানার আগ্ৰহ বা সময় কারোরই নেই। এক দেওয়ালের দুপাশে দুরকম বাস্তুতন্ত্র। চাপা গলায় মাপা কথা। হাসিও মুচকি।
আগেকার দিন ছিল, এ বাড়ির খুড়ো ঢেকুর তুললে ওবাড়ির দিদিমা পান সেজে নিয়ে আসতো। ভোলার ঠাকুমার বাতের ব্যথা উঠলে তৎক্ষণাৎ রাজুর পিসি হাজির হতো গরম তেল নিয়ে। সেবার নৃপেন বাবুর বড়মেয়ের বিয়েতে পাড়ার ছেলে-ছোকরারা কোমরে গামছা বেঁধে পরিবেশন করলো। নিজেরাই দায়িত্ব নিল, কেউ ডাকতে যায়নি। মেয়ের বিদায়ের দিন, গোটা পাড়ার চোখে জল। ওদিকে মনকলা খাওয়া মুখচোরা একটা ছেলে, পেছনের গলিতে ঢুকে দু ঢোক বাংলা খেয়ে এলো!
মিত্র বাবুর ছোট মেয়ে গান শিখছে। সকাল-বিকাল রেওয়াজের তোড়ে গোটা পাড়া অস্থির! অমনি কুন্ডুদের বেঁটে বাবলু তবলা ধরলো! পূজার সময় নাটক হলেই মোটা তোতনের দারোগা আর রোগা নান্টুর চোর বা চাকরের রোল ছিল বাঁধা। পাড়ার নিতাই মাষ্টার বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছেলে ঠেঙিয়ে পড়াতো। সন্ধ্যে হলেই সাধন বাবু গান শেখাতে হাজির হতেন গালে দু-খিলি পান দিয়ে।
লোডশেডিং হলেই গোটা পাড়া রাস্তায়। হইহই আড্ডা। হাসির ফোয়ারা। এর বাড়ি থেকে চা আসছে তো ওর বাড়ি থেকে চানাচুর। ক্লাবের ফুটবল টিমের দুঁদে স্ট্রাইকার বঙ্কু, সবার নজর এড়িয়ে চিঠি গুঁজে দিয়ে গেল বরেন বাবুর মেয়ে ঝুমার হাতে। চিঠি পাওয়া ইস্তক ঝুমা কোণা খুঁজে বেড়াচ্ছে! বুক ধড়ফড়! নিশ্বাস ঘনঘন! পত্রপাঠের আগেই না হার্টফেল করে মরে যায়!
জীবন অনেক সহজ ছিল তখন। মানুষ বেঁচে থাকাটাই উদযাপন করতো, ওটাই একটা উৎসব। আজকের মতো চার দেওয়াল আর ছাদের কফিনে বন্দী আধমরা জীবন নয়। এখন তো বেঁচে থাকা ক্লান্তিকর। তাইতো মানুষ অসুস্থ আনন্দ খোঁজে। ইন্দ্রিয়ের আমোদ চায়। জটিল জীবন থেকে ক্ষণিকের জন্য মুখ ফিরিয়ে থাকতে চায়। হঠাৎ সময় পাল্টে গেল। কখন যে বাজিধরা রেসের ঘোড়া হয়ে গেলাম জানি না। তখন অভাব ছিল তবু ভাব ছিল, প্রাচুর্য বিচ্ছিন্ন করে দিল !!
……০……