বলি ও মশাই, শুনছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি। ওপারে গিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে আছেন দিব্যি বসে আছেন বুঝতে পারছি। আপনার স্তাবক, সমালোচক, গুণমুগ্ধ, নিন্দুকসহ অন্যান্য যাঁরা যাঁরা আছেন (আর ছাতা মনেও পড়ছে না) সবাইকে নিয়ে নাহয় ওপারে জাঁকিয়েই বসে আছেন, আমরা তো আর দেখতে যাচ্ছি না (মানে ওপর থেকে পারমিশন না এলে যাবোই বা কী করে?)।
তা যেটা বলি, কিছু কি দেখছেন? শুনতে পাচ্ছেন কিচ্ছু? এই যে সকাল থেকে সাড়ম্বর আয়োজন… আপনাকে পেন্নাম ঠুকতে যাবার জন্য গতকাল থেকে ধুতি-পাজামা-পাঞ্জাবি কিংবা শাড়ি-ব্লাউজ-ম্যাচিং কানের দুল-গলার হার সব গুছিয়ে রাখা- বলি চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে স্বর্গ থেকেও তো এসব কিছু দেখতে পারতেন না কি!
আর তা, বলতে গেলে, আপনার তো মশাই দেখাই উচিত। আপনি তো আর ‘তৈলঢালা স্নিগ্ধতনু নিদ্রারসে ভরা’ পাবলিক নন! এই যে কয়েকদিন ধরে রাস্তার মোড়ে চোঙা ফুঁকে আপনার গান বাজিয়ে ‘রবীন্দোজ্জয়ন্তী’র প্র্যাকটিস চলছে, শোনেননি? ওই যে এ বাড়ি সে বাড়ির বাচ্চারা তাতা থৈ থৈ করে সমানে নেচে নেচে পাঁচ ইঞ্চি পুরুত্বের ফ্ল্যাটবাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে কাঁপন ধরিয়ে দিল, তাও বোঝেননি? ওই যে বাচ্চাটা সকাল থেকে প্রাণপণে আবৃত্তি অভ্যেস করে যাচ্ছে ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে’, আর তার মা- বাবা তাড়না করে যাচ্ছে সমানে- ‘তালগাছের’ তাল লাগছে না ঠিকঠাক কিছুতেই- বিকেলে পাড়ার অনুষ্ঠানে পাছে বেইজ্জতি হয়- এসব কি দেখেনও না ছাই?
তাপ্পরে, দাঁড়ান দাঁড়ান- আরও আছে। আপনার সব মূর্তি টুর্তি জলটল ঢেলে পরিষ্কার করা হয়েছে কালকে- নজরেও আসেনি বুঝি সেসব? উফফফ! আপনাকে নিয়ে আর পারা যায় না মশাই, সিম্পলি পারা যায় না! ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসি মোর কাব্যখানি’- এসব ভিজুয়ালাইজ করতে পারেন, আর আসল দেখাগুলোয় ফাঁক? যে লোকটা ওই টঙে উঠে বালতিতে জল-কাপড় এসব নিয়ে আপনার মূর্তি পরিষ্কার করল, দুটো টাকা পাবে বলেই তো, না কি? আর তাপ্পর পাড়ার দাদার সঙ্গে মজুরি নিয়ে টানাটানি- সেসব বুঝি শতবর্ষ আগে ভেবে উঠতে পারেননি?
যাকগে, কী আর করবেন বলুন? আজকে কিন্তু আপনাকে নিয়ে হেব্বি দড়ি টানাটানি! ব্যাপক মজা, নিতে পারলেই হল! আপনি তো বেজায় রসিক মানুষ ছিলেন- বহুত বহুত প্রমাণ রেখে গিয়েছেন আপনার লেখার পাতায় পাতায়- তবু বলি, এই রগড় কিন্তু আপনিও মিস করলেন! পাড়ায় পাড়ায় মোড়ে মোড়ে আজ দাদারা দিদিরা চেঁচিয়ে মেঁচিয়ে গলার শির তুলে কে আপনার কতবড় হকদার, কত বড় অনুরাগী- তার জোর কম্পিটিশন! অফিস ছুটির দিনে লোকজন ফূর্তিতে চিকেনের ঠ্যাং দিয়ে পরিপাটি ভাত খেয়ে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে ফেবুতে ‘রবীন্দোজয়ন্তী’র ছবি সাঁটাবে- সেখানেও কম্পিটিশন! শান্তিনিকেতনী হাটে আজ কিছু রাবীন্দ্রিক জিনিস বেশিই বিকোবে! সকাল থেকেই ফেবুতে ওয়াপে (মানে হোয়াটসঅ্যাপে- আপনার সময়ে এসব ছিল না, তাই হয়তো ঠিক ধরতেও পারবেন না!) কম্পিটিশন জোর- কে আপনার কত ভালো ছবি, কত ভালো বাণী ইত্যাদি ইত্যাদি পাঠাতে পারে!
তা আশি বছরের জীবনে করলেন তো এতকিছু- ফলটা হল কী? এই যে এত এত গাদা গুচ্ছের লিখলেন, গান বাঁধলেন, সুর দিলেন, নাটক করলেন, ছবি আঁকলেন, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করলেন…ও হ্যাঁ, তারই ফাঁকে পুট করে নোবেলটাও পেলেন ইত্যাদি ইত্যাদি- তা এত কিছু করে হলটা কী? সেইটে ভেবেছেন?
বলি, খবরের কাগজ টাগজ পড়েন আজকাল? পড়েন না, ওই তো ! পড়লেই বুঝতেন, বাঙালি কিরকম গোল্লায় যাচ্ছে দিনে দিনে! আপনি মশাই বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ করলেন, রাখীবন্ধন করলেন, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নাইট উপাধি পর্যন্ত ত্যাগ করলেন, আবার সেই আপনিই ‘ঘরে বাইরে’ লিখলেন- তা লাভটা হল কী শেষতক? কিংবা ধরুন, ওই যে লিখলেন আপনার অচলায়তন- তা ‘ওঁ তট তট তোতয় তোতয়’ বুলি ছাড়া আর ইস্কুল- কলেজের রইলটা কী? ভেবে দেখেছেন? কিংবা আপনার ওই ‘তোতা কাহিনী’র কথাই ধরুন না! পিঠে আট-দশ কিলোর বোঝা নিয়ে সকালবেলায় তোতারা ইস্কুলে যায়, দিনান্তে পুঁথির পাতা তাদের মাথার ভেতর খসখস গজগজ করতে থাকে- সে আওয়াজটা কি পান? আপনার ‘রাজর্ষি’র তাতা-হাসিরা এখন আর রক্ত দেখে চমকায় না, জানেন? ও তাদের গা সওয়া হয়ে গেছে।
আপনি মোবাইল দেখেননি, কম্পিউটার- ইন্টারনেটের কথাও শোনেননি সেসময়! বাংলার ছেলেমেয়েরা আপনার বই পড়তে, আপনার উপন্যাস, প্রবন্ধ চিঠি পড়তে হোঁচট খাচ্ছে- কিছুদিন পরে আপনার লেখার সোনার জলেও হয়তো দাগ পড়বে না, খুলবে না কেউ পাতা। অ-স্বাদিত মধু যেমন, যূথী অনাঘ্রাতা- ওই যে আপনি লিখে গিয়েছিলেন, তাই-ই হতে চলেছে।
আর কে জানে, আজও হয়তো একটা দুটো বাড়ির বৌ হয়তো মরবে! বিয়ের পর, শ্বশুরবাড়িতে! হাসপাতালের লোকজন, থানার লোকজন, প্রশাসনের লোকজন খবরটা জানবে। ‘দেনাপাওনা’ তো লিখেছিলেন- হিসেবটা মিলছে কি? মেলেনি, মিলবেও না। আপনার নিজের জীবনেও মেলেনি।
তাই বলছি মশাই, আপনার ভাগ্যটাও জেনে রাখুন এই ফাঁকে। আপনার লেখা আমরাই পড়ছি না, আর আমাদের পরের প্রজন্ম? আপনার মৃত্যুর পর আপনার দাড়ি ছিঁড়েছিল যারা- তারা কিন্তু এই বাংলারই ‘সংস্কৃত’ লোকজন- বাইরের কেউ নয়!
ফলে আপনার জন্মজয়ন্তীতে আপনার মূর্তির ধুলো ময়লা ইত্যাদি ঝাড়া হচ্ছে, একটু আধটু নাচ-গান-বাজনা-আবৃত্তি হচ্ছে, আপাততঃ ওই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকুন! দাদা-দিদিদের ভাষণ যা পাচ্ছেন, সেই ফাউয়ের পাওনাটুকুও মাথায় তুলে রাখুন!
যাইহোক, ঢের বলে ফেলেছি। আপনার আবার বিকেলে বহু নেমন্তন্ন! খেয়েদেয়ে তৈরি হয়ে ফটোর মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে হবে চটপট।
তাই বলছি, ফটোয় সেঁধিয়ে যাবার আগে কথাগুলো একটু ভেবে দেখবেন। আপাততঃ এই ফুলমালা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকুন! কাল থেকে আবার আপনাকে ভুলে যাবো। চলি, টা টা, বাই বাই!
ও হ্যাঁ, একটা পেন্নামও ঠুকে দি’ বরং এই তালে!
……০……