ক্রিঁক……ক্ল্যাং………ক্রিঁক…………ক্ল্যাং…………ক্রিঁক…………ক্রিঁক………..ক্রিঁক………ক্রিঁক………ক্রিঁক….
একটানা এই বিচ্ছিরি আওয়াজটা শুনে ঘুম ভেঙে গেল চন্দ্রমণিজীর। প্রথমে ঘুমের ঘোরে ঠিক বুঝতে পারেন নি, ঘুম ভেঙে গেলেও না, কেননা ঘুমের রেশ তখনো কাটেনি। তন্দ্রালু অবস্থাতেই উঠে বসলেন বিছানায়।
নাহ, শব্দটা অ্যালার্মের নয়।
সেটার আওয়াজ আলাদা। তাছাড়া বাইরে সূর্যের আলো ফোটেনি। জানালা দিয়ে চেয়ে দেখলেন, দূরে দূরপীন পাহাড়ের আলোগুলো জ্বলজ্বল করছে। মনে পড়ল তাঁর অ্যালার্ম বাজার কথা ছ’টার সময়ে। তার মানে এখনও সকাল হয়নি।
ক্রিঁক……..ক্রিঁক…..ক্রিঁক…ক্রিঁক..ক্রিঁক. ক্রিঁক. ক্রিঁক
শুরুতে আওয়াজ দু’টির মধ্যে বেশ গ্যাপ ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বিরাম না দিয়েই শব্দটা বেজে চলেছে। মাথাটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছিল। তন্দ্রার জড়তা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে করতে উনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন এটা ইনভার্টারের শব্দ। তাহলে কী এতক্ষণ কারেন্ট ছিল না? সারাক্ষণ ইনভার্টারেই জ্বলেছে ব্যালকনি, ডাইনিং-এর আলোগুলো? তাও বা কী করে হবে? বাইরের বাগানে ভেপার আলো জ্বলছে। তার মানে বিদ্যুৎ আছে। যাকগে! আগে তো বন্ধ করা যাক এই বিচ্ছিরি শব্দ। মাথাটা পুরো ধরিয়ে দিল।
আস্তে করে বেডরুমের দরজা খুলে ডাইনিং-এ এলেন চন্দ্রমণিজী। আর অবাক হয়ে দেখলেন যে ইনভার্টারের সুইচটা অফ করা। অন করতেই শব্দটা বন্ধ হল। আর পরক্ষণেই গায়ের সব রোম খাড়া হয়ে উঠল।
হলটা কি করে?
তিনি তো অফ করেন নি সুইচটা। প্রশ্নই ওঠে না।
তাহলে?
বেশি আর ভাবতে পারলেন না। দ্রুতপায়ে ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ঘরের আলোগুলো সব জ্বালিয়ে দিলেন।
কে সে? তবে কি জনকলাল? কিন্তু সে ছাড়া আর কেই বা হবে?
তাঁকে সেই যে সে অনুসরণ করে চলেছে, সেই অনুসরণের মনে হয় আর শেষ নেই। গা-টা ছম ছম করে উঠছিল আলোতেও। তবে কি সে ওঁকে উত্যক্ত করে চলেছে? ঠিক সময়েই প্রকাশ পাবে তার অস্তিত্ব? বলা ভাল অপার্থিব অস্তিত্ব। এবং নেবে সে প্রতিশোধ?
সম্ভবত! ভাবতেই শিউরে উঠলেন তিনি। কী দরকার ছিল? তাঁর এত উদ্যোগী হওয়াটা কি খুব জরুরী ছিল? জীবনে টাকাটাই কী সব? আর গুরুত্ব? অথবা দুটোই?
মনে পড়ে যাচ্ছিল কিছুদিন আগের ঘটনাটি। সেদিন একটা কাজে দার্জিলিং যাচ্ছিলেন। তিস্তাবাজার থেকে উঠে লাভার্স মীট ভিউ পয়েন্ট-কে ডানদিকে রেখে পেশক টী-গার্ডেনকে বাঁদিকে ফেলে লপচু হয়ে লামাহাটা ছাড়িয়ে তাকদা জঙ্গল চিরে এগোলেন। দু’দিকের পাহাড়ি জঙ্গল ক্রমশ ঘন হল। তাকদা ফরেস্ট রেঞ্জের কাঠের ডিপো’র কিছু আগে একটা গাড়ির ড্রাইভার তাঁর গাড়িটাকে ওভারটেক করে একটু আগে তার গাড়ি দাঁড় করিয়ে তাঁকে হাত দেখিয়ে থামতে বলল। অগত্যা তিনি ব্রেক চাপলেন। সেই ড্রাইভার ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে এলে তাঁর দিকে। জানালার কাঁচ নামিয়ে দিয়ে জানালার বাইরে মুখটা বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন চন্দ্রমণিজী,
-কে ভয়ো দাজু?
-আপনার পিছনের সীটে কেউ কি খুব অসুস্থ?
লোকটি তাঁর পিছনের সিটের দিকে তাকাতে তাকাতে জিজ্ঞেস করল, -মনে হল গাড়ির পিছনের সীটের কেউ একজন ছটফট করছে।
-তা কী করে হবে? অবাক হয়ে চন্দ্রমণিজী বললেন, -আমি একাই দার্জিলিং যাচ্ছি।
লোকটি পিছনের সীটের দিকে তাকাতে তাকাতে বলল, -ক্ষমা করবেন, কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখলাম যে কেউ একজন দু’হাতে নিজের গলা ধরে ছটফট করছে। মনে হল সে খুব অসুস্থ বা মারা যাচ্ছে।
-ভুল দেখেছেন আপনি। চন্দ্রমণিজী কথা গুটিয়ে নিতে নিতে বললেন, -এই হাল্কা আলোয় আপনি হয়তো কাঁচে গাছপালার প্রতিফলন দেখে থাকবেন। আর গাড়ি চলছে বলে সেগুলোও চলন্ত। ফলে দৃষ্টিবিভ্রম ঘটে থাকবে।
-না……তা কী করে হয়……নাহ……স্পষ্ট দেখলাম………বেশ দাঁড়ি-গোঁফ আছে বলে মনে হল তাঁর। অবশ্য একঝলক দেখেছি মোটে…………
বলতে বলতে লোকটি মাথা নাড়াতে নাড়াতে তার গাড়ির দিকে এগোল। চন্দ্রমণিজী পিছন থেকে জিজ্ঞেস করলেন,
-তপায়েরো ঘর কাঁহা হো দাজু?
-জোড়বাংলো দাজু। পিছন ঘুরে বলল সে, -ব্যবসার কাজে রম্ফু গেছিলাম।
আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করলেন না চন্দ্রমণিজী। স্টার্ট দিয়ে এগোলেন নিজের রাস্তায়। তবে মনটা যে কিছুটা খচ খচ করেনি, তা নয়। রাতে তাই আর তাকদা’র জঙ্গল দিয়ে ফেরার রিস্ক নেননি। দার্জিলিংয়েই একটা গেস্ট হাউসে থেকে গিয়েছিলেন।
এই ঘটনাটি গতকালের। কিন্তু এখনও একেবারে টাটকা। সামালবং থেকে একটা নিমন্ত্রণ সেরে ফিরছিলেন। পালা আর রেলী নদী দু’টির মাঝের জায়গায় রাস্তা সর্বত্র ভালো নয়। এমনই একটা স্থানে টার্নিং-এ সবে গাড়িটাকে ঘুরিয়ে নিচে নামাবেন, চোখ চলে গেল রাস্তার দিকে। লাইটের আলোতে স্পষ্ট দেখলেন রাস্তার মাঝে একটি লোক বসে। হর্ন দিতে সে উঠে ঘুরে দাঁড়াল তাঁর দিকে।
“জনকলাল!”
আতংকে চেঁচিয়েই উঠেছিলেন উনি। ঘন দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলের উপর থেকে উপচে এসেছে কালো চোখ দু’টির শীতল দৃষ্টি। চেনা, পুরানো অথচ সজীব সেই দৃষ্টি। দেখলেই মনে পড়ে যায় আগেকার দিনের সেই আন্দোলনের সময়টা। শুধু ওর গলার কাছে একটা ক্ষত, যেটা পরবর্তী সময়ের ঘটনা। সেটাতে এখনও কালচে রক্তের দাগ স্পষ্ট, যে দাগ নিয়ে তার বিকৃত, অর্ধগলিত দেহ একদিন আবিষ্কৃত হয়েছিল কোলবং ফরেস্টের গহীনে, একটা ছোট্ট গুহাতে। এবং যেটার কারণ উনি! যদিও কম লোক জানে সেকথা। তবে অনেকদিনের আগেকার ঘটনা। হিসেব করলে তাও প্রায় পঁচিশ বছর। কিন্তু সেসব তো চুকে বুকে গেছে। তা সত্ত্বেও জনকলাল কি এখনও তাঁকে অনুসরণ করে চলেছে?
কতক্ষণ ওইভাবে ছিলেন, জানেন না। তবে মনে হয় না খুব বেশিক্ষণ। কেননা তাহলে একসময় অজান্তে ব্রেকের উপর থেকে পা ঢিলে হয়ে গিয়ে গাড়ি গড়িয়ে পড়ত সামনের খাদে। সম্বিৎ ফিরতে শুনলেন পিছনে একটা গাড়ি জোরে জোরে হর্ন দিচ্ছে। সামলে নিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলেন যে রাস্তা ফাঁকা। কেউ নেই। লোকটি মানে জনকলাল যেন হাওয়ায় মিশে গেছে। তবে সেটাই তো স্বাভাবিক। ভাবতে ভাবতেই দেখলেন পিছনের গাড়িটা থেকে একজন নেমে এগিয়ে আসছে ওঁর দিকে। জানালার কাঁচটা আংশিক নামানোই ছিল। তিনি জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিলেন বাইরে।
-কী ব্যাপার দাদা? সে জিজ্ঞেস করল, -গাড়ি বিগড়েকো?
-না, না, ঠিক আছে। চন্দ্রমণিজী নিজেকে সামলে নিয়ে তড়িঘড়ি বলে উঠলেন, -মনে হল জ্যাকেটের মধ্যে একটা পোকা ঢুকেছে। তাই নেড়ে-চেড়ে দেখছিলাম। ঠিক আছে, এগোচ্ছি।
তারপর একটু থেমে জিজ্ঞেস করলেন,
-তা আপনারা কোথা থেকে আসছেন?
-শিনজী গেছিলাম সপরিবারে। বলল সেই লোকটি, -সঙ্গে ফ্যামিলির লোকজন আছে। উপর থেকে লাইটের হালকা আলোতে একঝলক দেখে মনে হল সামনে একজন লোককে দেখে আপনার গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে। কোন সমস্যা হয়েছে?
-হোইন! কুনে প্রবলেম ছই ন। থ্যাংকস দাজু।
লোকটিকে ধন্যবাদ দিয়ে আর বেশি কথা না বাড়িয়ে উনি গাড়ি স্টার্ট দিলেন। তবে কালিম্পং টাউনে ঢোকার আগে আর সেই গাড়িটাকে পিছুছাড়া করলেন না। সামঞ্জস্য রেখে নিজের গাড়িটাকে চালিয়ে নিয়ে এলেন। সারাটা রাস্তা মনটা খচ খচ করছিল। মনে হয় সেদিন তাকদা’র জঙ্গলে এই জনকলালকেই পিছন থেকে দেখেছিল জোড়বাংলোর সেই লোকটি।
নাহ, আর কোন সন্দেহ নেই। সেদিনের লোকটি জনকলালই ছিল। শোধ তুলতে সে এখন বদ্ধপরিকর। স্পষ্ট বোঝাই যাচ্ছে।
মনে পড়ে যাচ্ছিল বছর তিরিশ আগের সেই রক্তক্ষয়ী দিনগুলির কথা। পরিষ্কার মনে হল আলাদা রাজ্যের দাবী নিয়ে সমতলী লোক ভর্তি দলগুলির কোন হেল-দোল নেই। তাই তিন দিনের সামগ্রিক পাহাড় বনধের ডাক দিলেন তাঁরা। পরে সেটার মেয়াদ বাড়ল। উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ গুলি চালাল। একাধিক আন্দোলনকারীর মৃত্যু হল। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন রূপান্তরিত হল হিংসাশ্রয়ী আন্দোলনে। পাশাপাশি থেকে কাঁধে-কাঁধ ঠেকিয়ে আন্দোলন চালিয়েছিলেন তাঁরা- তিনি, জনকলাল এবং আরো অনেকে।
কী সব দিনই না ছিল! পুলিশ-প্যারামিলিটারির ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ান। ধরা পড়লেই থানা বা টাউন হল বা কোন গোপন গেস্ট হাউসে নিয়ে গিয়ে শুরু হবে অকথ্য অত্যাচার। বাড়ি আসতেন ন’মাসে-ছ’মাসে। সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করার সেই যে এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা পেয়ে বসেছিল, সরকারের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার আগে আর সেই নেশা কাটেনি। শেষে একদিন চুক্তি হল। সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে সব কেস তুলে নিল। তাঁরাও বাড়ি ফিরলেন। এতদিনে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এবারে পাহাড়ে তাঁদের দলই সদ্য সদ্য ক্ষমতা হাতে পেয়েছে। শুরু হল নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারার বোঝাপড়া। ইতোমধ্যে কেটেও গেল কয়েকটা বছর। নিজেকে ক্রমশ রিক্ত, বঞ্চিত ভাবতে শুরু করেছিলেন উনি। শেষে একদিন বিষ্ণুপ্রসাদজী ওঁকে ডেকে বোঝালেন।
-সব-টা ও একাই খেয়ে নিচ্ছে। গম্ভীরস্বরে বললেন তিনি, -আমরা আমাদের ন্যায্য ভাগ কিন্তু পাচ্ছি না। অন্তত আমি তো না।
কথাটা সত্যি। আন্দোলনের সময়ে যে লোকটি নিজে না খেয়েও বা কম খেয়ে অন্যের সঙ্গে তার খাবার ভাগ করে নিয়েছে, দলের লোকেদেরকে সামনে থেকে রক্ষা করেছে, নিজে থেকে যেচে অনেক ঝুঁকি নিয়েছে, সেই লোকটিই কেমন যেন পালটে যাচ্ছিল। দলের রাশ কিছুতেই নিজের হাত থেকে ছাড়ছিল না। দলের স্থানীয় ট্রেজারিও নিজেই দেখভাল করত। ব্যবসায়ী বা দোকানদারদের থেকে আদায়, হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিকদের থেকে তোলা, কনট্রাকটরদের থেকে হিস্যা- সব নিজেই সামলাত। উপরে সামান্য কিছু পাঠিয়ে বেশিটা পার্টির খরচ দেখিয়ে নিজেই ঝেপে দিত। ফলে ভিতরে ভিতরে একটা চোরা ক্ষোভ তৈরী হচ্ছিল।
-আমিও বিশেষ কিছুই পাই না। সরাসরি বলে দিলেন চন্দ্রমণিজী।
-সেন্ট্রাল কমিটির মেম্বার সুখিয়াপোখরির টিকারামজী বলছিলেন, বিষ্ণুপ্রসাদজী বলে চললেন, -এভাবে চললে পার্টি থাকবে না। সবাইকে নিয়েই তবে পার্টি। পার্টির স্বার্থে, পাহাড়ী জনতার স্বার্থে আপনাদের বিষয়টি নিয়ে ভাবা উচিত।
-চলুন, আজ আমার বাড়িতেই বসা যাক। আলোচনা করব। চন্দ্রমণিজী বললেন, -তবে একথা পাঁচকান করবেন না কিন্তু।
-সে আর বলতে। তবে আমি রাত আটটার আগে আসতে পারব না কিন্তু।
-ঠিক আছে। ডিনার সেরে যাবেন কিন্তু তাহলে।
-ওকে!
সেই শুরু। বিষ্ণুপ্রসাদজীর উপরে দায়িত্ব দেওয়া হল পার্টির মাথাদের বোঝানোর। চন্দ্রমণিজী নিজেই দলের স্থানীয় যুবক সদস্যদের মধ্যে থেকে বেছে নিয়ে কিছুজনের ব্রেন-ওয়াশ করলেন। জুডাস হিসেবে তাদের মধ্যে থেকেই একজনকে পাওয়া গেল। একদিন কোলবং ফরেস্টের দুর্গম এক পাহাড়ে জনকলালের দেহ গুম করে দিলেন। লোকজন বা পুলিশ তাঁদের সন্দেহ করলেও পার্টির উপরের লোকেদের সাহা্য্যে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে নিতে সমর্থ হলেন তাঁরা।
কিন্তু অবস্থা এখন বদলেছে। গেলবারের আন্দোলনের পর থেকে দলের রাশ নিজের হাত থেকে বেরিয়ে গেছে। বলা ভাল দলের মূল অংশটা বেরিয়ে গিয়ে নতুন দল তৈরী করেছে। তাঁদের পুরানো দল এখন পেপার টাইগার ছাড়া আর কিছু না। এদিকে তাঁকে হতোদ্যম দেখে জনকলালের স্ত্রী হাই কোর্টে গিয়ে পুরোনো মামলাটা খুঁচিয়ে সেটাকে সি আই ডি দিয়ে তদন্ত করানোর অর্ডার বের করে ফেলেছে। এতদিন ভয়ে আর ছেলের ভবিষ্যত ভেবে চুপচাপ ছিল। ফলে কিছুদিন আগে ইন্সপেক্টর সফল রাই এসে তাঁকে এক রাউণ্ড জিজ্ঞাসাবাদ করে গেছেন। সবকিছু ছবির মতন ফুটে উঠছিল চোখের সামনে। ক্লান্ত দেহে হাতে তুলে নিলেন খাতাটা। গতকাল রাতে যা লিখেছিলেন, তার পরে সংক্ষেপে আরো কিছু যোগ করলেন। নোটবুকটা ড্রয়ারে রেখে সবে বাথরুমে ঢুকবেন, চোখ চলে গেল জানালার দিকে। আরররররে………
একটা অবয়ব ফুটে উঠল কাঁচের জানালায়। সেই পূর্বে দেখা দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলভরা একটি যুবক মুখ! একসময়ের অতি পরিচিত ক্লান্ত সেই মুখ। কিন্তু…………। কিন্তু অতি সজীব। আরো জীবন্ত ঘাড়ের সেই কাটা জায়গাটি।
জনক!
চিৎকার করে কেঁপে উঠেছিলেন উনি।
সে এখানে? কিভাবে? আর, জানালার ওপারেই যে সে…………। তাহলে এবারে……
দোতলার জানালার ওপারে সে কিভাবে এল? কিভাবে এটা সম্ভব? তবে কী জনকলাল প্রতিশোধ নিতে নিজেই চলে এসেছে অন্যলোক থেকে? কারুর উপরে সে ভরসা রাখতে পারেনি?
আতংকে শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত ওঠা নামা করছিল তাঁর। বুকটা বড়ই জোরে জোরে ধুক-পুক ধুক-পুক করছিল। কী যে করেন…..কী যে করবেন…কিছুই বুঝতে পারছেন না…আর এই শীতল দৃষ্টি বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারবেন না। কোথায় যে যান! কী যে হবে…
বয়স হয়ে এসেছে। শরীর এত উত্তেজনা নিতে পারল না। অচিরেই বুক চেপে চিন্তামণিজী বসে পড়লেন বিছানায়। কাতরাতে কাতরাতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন।
(২)
ইন্সপেক্টর সুফল রাই বললেন, -কেসটা আমাদের হয়তো ক্লোজ করে দিতে হবে?
-কেন সাহেব?
-কারণ গতকাল রাতে চিন্তামণিজী মারা গেছেন।
-তাই? অবাক হয়ে গেল যুবকটি।
-হ্যাঁ! ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। তবে সেই সঙ্গে আরেকটি কেস ওপেন করতে হবে।
বিস্ময়ে প্রায় চিৎকার করে উঠল সেই ছেলেটি, -সে কী?
-কারণ চিন্তামণিজীর মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়।
-তাই নাকি? কিছুটা অবাক হয়ে সে জিজ্ঞেস করল, -এই যে বললেন ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক।
-করানো হয়েছে।
জোর গলায় একথা বলে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তিনি তাকালেন সামনের যুবকটির দিকে। পড়তে চাইলেন তার মনের ভাব। একটু চমকে উঠলেও সে কিন্তু হাসিমুখে তাকিয়ে ছিল তাঁর দিকে। অবশ্য ভিতরে ভিতরে যে তার টেনশন হচ্ছিল না, তা মনে হয় বলা যাবে না।
-শুনুন, হালকা একটা আওয়াজ দিয়ে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে ইন্সপেক্টর রাই বলতে থাকলেন, -তাকদা ফরেস্টের রাস্তায় আপনি একজন পেটোয়া লোক দিয়ে চিন্তামণিজীকে ভয় দেখান যে তাঁর গাড়িতে তিনি ছাড়াও অন্য কেউ আছে। হয়তো বা অশরীরী কেউ। তাঁর মনে ভয় ঢুকিয়ে দেন। আর সেদিন সামালবং থেকে ফেরার রাস্তায় তাঁর গাড়ির সামনে আপনি নিজেই জনকলাল সেজে দাঁড়িয়ে গেছিলেন।
কেননা তাঁর সঙ্গে আপনার চেহারার বেশ সাদৃশ্য আছে। গতকাল তাঁর বাড়ির ইনভার্টার লাঠি জাতীয় কিছু দিয়ে বাইরে থেকে অফ করে দিয়ে আতংকের পরিবেশ তৈরী করেন। আর তারপরে নিচ থেকে মইয়ের সাহায্যে তাঁর জানালার বাইরে এসে সম্ভবত জনকলাল সেজে ভয় দেখান। চরম ভয় পেয়ে তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়।
-কিন্তু কেন?
-কারণ সুবিনবাবু, আপনার পিতা জনকলালের খুনের বদলা নিতে আপনি আর দেরী করতে চান নি। চিন্তামণিজীর পার্টি দুর্বল হতেই আপনি সুযোগ খুঁজতে থাকেন। সব খবরাখবর নিতে থাকেন। আর তাঁর আরো দুর্বল হার্ট আপনাকে অযাচিতভাবে সাহায্য করে।
-কিন্তু আপনি কি প্রমাণ করতে পারবেন?
খুব একটা টসকায়নি জনকলালের ছেলেটি। বাবার যোগ্য পুত্র! নাহ, দম আছে তার, একথা মানতেই হবে।
-জানি না। রাই সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে ড্রয়িংরুম থেকে বেরোতে বেরোতে বললেন, -ফালতু ফালতু কোর্টে গিয়ে আপনারা আমাদের ডেকে আনলেন। ফলে আমি আর নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারব না। আপাতত চললাম………
সুবিনের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই চোখ চলে গেল কালচে সবুজ পাহাড়ের উপরে তুষারাবৃত কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে। বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মেঘ-কুয়াশার গ্লানি ছাপিয়ে সে ফুটে উঠেছে নিজের খেয়ালে, মুগ্ধতার আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছে চারিদিক। শুধু যদি মানব অন্তরের পাপ-গ্লানি এমনি ভাবে সরে গিয়ে ফুটে উঠত নির্মল মানব হৃদয়!
হবে না কোনওদিন। মনে মনে ভাবলেন তিনি।
মেঘ-কুয়াশার জড়ানো পাহাড়ের মতন মানব হৃদয়ের এই আদিম রিপুগুলি কখনই নিজেদের গুটিয়ে রাখবে না- ঢেকে দেবে, বশীভূত করবে, ছেয়ে ফেলবে মানব জগৎ।
……০……