কাজের চাপে মাঝে কিছুদিন বিরতি পড়লেও শীতের হালকা হিমেল হাওয়া আবার করে মনের খিদেটাকে জাগিয়ে দিয়ে গেলো। ডিসেম্বরের কুয়াশা ভেজা এক ভোরে লেপের উষ্ণতা জোর করে দূরে সরিয়ে রেখে বেরিয়ে পড়লাম আমরা কজনে। আধো ঘুমে আচ্ছন্ন মেদিনীপুর শহর ছাড়িয়ে, সূর্যোদয়ের মায়াবী আলো মাখা কংসাবতীকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চললো আমাদের গাড়ি।এবারের গন্তব্য গড় কুরুমবেড়া। আমাদের গন্তব্যে পৌঁছতে হলে যেতে হবে কেশিয়ারি ব্লকের গ্রাম গগনেশ্বর। সেই মতো খড়্গপুর শহর ছাড়িয়ে আরো ২৭ কিলোমিটার যাবার পর প্রবেশ করলাম সেই গ্রামে। পিচের সড়ক ছেড়ে মোরামের পথ ধরে এগোতে লাগলো আমাদের গাড়ি।চোখে পড়লো পথের দুপাশে আর পাঁচটা শস্য-শ্যামল গ্রাম বাংলার মতোই সহজ-সরল গ্রামীণ জীবনের আলেখ্য। মনে মনে ভাবছিলাম এমন একটা সাদামাটা নিরুপদ্রব পল্লীজীবনের সাথে তো ঠিক গড় ব্যাপারটা খাপ খায় না। তাহলে কি আমরা ভুল পথে এলাম? ভাবতে ভাবতেই সামনেপড়লো ছোট্ট একটা গঞ্জ মতো এলাকা, সেটা ছাড়িয়ে গাড়ি ডানদিকে ঘুরতেই আমাদের বহুদিনের পোড় খাওয়া অভ্যস্ত চোখ এক্কেবারে বোকা বনে গেলো। শতাব্দী প্রাচীন বটগাছের ঠিক পেছনেই দেখতে পেলাম বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে প্রাচীর ঘেরা এক বিশাল আলিশান ইমারত। বুঝলাম পৌঁছে গেছি আমাদের গন্তব্য গড় কুরুমবেড়া I চটপট গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম কিন্তু ঘোর কাটেনি তখনও।মোহাবিষ্টের মতো দাঁড়িয়ে আছি। ভাবছি এমন একটা শান্ত-শীতল গ্রামের মাঝে এমন একটা রাজকীয় আভিজাত্যের মিশেলে তৈরী গাম্ভীর্যপূর্ণ সুবিশাল প্রাসাদ এলো কোথা থেকে। তখনও জানিনা একে গড় বলবো না কি অন্য কিছু।
মূল ফটক দিয়ে ঢুকতে যেটুকু স্থাপত্যশৈলী চোখে পড়লো তা সহজেই পুরীর লিঙ্গরাজ মন্দিরের কথা মনে করিয়ে দেয়। ভেতরে ঢুকে যেটুকু দেখলাম তা যেকোনো পর্যটকের কাছে যে বিশেষ পাওনা তা জোর দিয়ে বলতে পারি।ওড়িশি স্থাপত্যকলা ও ইন্দো-পার্সিয়ান স্থাপত্য রীতির যুগলবন্দিতে যে অদ্ভুত শিল্পরস তৈরী হয়েছে তাকে ভাষায় রূপ দেবার বৃথা চেষ্টা আমি করবো না। আমার মতো আনাড়ি লেখকের সেই স্পর্ধাও নেই। বরং বলবো এই সৌন্দর্য এখানে এসে স্বচক্ষে দেখতে , প্রাসাদের অলিন্দে হাঁটতে হাঁটতে অনুভব করতে সেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাকে। এখানে এসে প্রাসাদটির সম্পর্কে খোঁজ খবর করার চেষ্টা করলেও বিশেষ কিছু তথ্য উঠে এলো না স্থানীয়দের সাথে কথা বলে। কিন্তু সেই সাথে এটাও উপলব্ধি করলাম যে এর ইতিবৃত্ত না জানতে পারলে এরকম জায়গার ঘুরতে আসার মজাটাই অর্ধেক মাটি হয়ে যাবে। অগত্যা ফিরে গিয়ে আবার শুরু করলাম অল্প বিস্তর পড়াশোনা। গড় কুরুমবেড়ার অতীত অনেকাংশেই এখনো আঁধারে ঢাকা।এই বিষয়ে তথ্যও তেমন পাওয়া যায় না। তবু যেটুকু তথ্য পেলাম মনে অতৃপ্তি নিয়ে পরিবেশন করলাম সেটুকু।
ওড়িয়া ভাষায় লিখিত শিলালিপি থেকে জানা যায় ১৪৩৮ থেকে ১৪৬৯ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে উড়িষ্যার সূর্য্য বংশীয় রাজা গজপতি কপিলেন্দ্রদেব সমগ্র ইমারতটির নির্মাণ সম্পন্ন করেন। আরো জানা যায় যে প্রথমে এটি ছিল একটি শিব মন্দির। মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গ পরিচিত ছিল প্রতিষ্ঠাতার নামানুসারে কপিলেশ্বর শিব নামে। প্রথমে শুধু দেবালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় দেবালয়ের চারপাশে গড়ে ওঠে ভক্তবৃন্দের আশ্রয়স্থল। বর্তমানে দালানের মধ্যস্থলে মন্দিরটির ভিত্তিভূমিটুকুর অবশিষ্টাংশই শুধু দেখা যায়। বিদগ্ধ ঐতিহাসিক তারাপদ সাঁতরাও মধ্যিখানে পড়ে থাকা পাথরের ভগ্নাবশেষটিকে মন্দিরের অংশ বলে চিহ্নিত করেছেন। যোগেশ্বর কুন্ড এবং গড়ের পরবতীকালের অভিভাবক দত্ত পরিবারের অন্যতম সদস্য প্রসাদ কুমার দত্ত সহমত পোষণ করে বলেছেন মধ্যিখানের পাথর ঘেরা আয়তাকার ক্ষেত্রটি ছিল মন্দিরের মূল ভিত। মন্দিরের শিবলিঙ্গকে যখন স্নান করানো হতো তখন সেই তরল বা জল ভিত্তিভূমির উত্তরদিকে খনন করা একটি নালার মাধ্যমে বেরিয়ে যেত।ভগ্নাবশেষটি পরীক্ষা করে প্রত্নতাত্বিকরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে মন্দিরটি ছিল পশ্চিমমুখী, জগমোহনসহ ওড়িশার সপ্তরথশিখর দেউল বিশিষ্ট স্থাপত্য সম্বলিত। আবার অপর একদল পন্ডিতব্যক্তি মনে করেছেন বর্তমানে যেখানে ডোমশোভিত মসজিদটি আছে সেখানেই ছিল মন্দিরটি। মোটের ওপর অনুমান করা যায় এখানেই ছিল বহু শতাব্দী আগের রাজা গজপতি কপিলেন্দ্র দেবের আরাধ্য শিব মন্দির।
১৫৬৮ সালে অভিবক্ত বাংলা ও বিহারের আফগান অধিপতি ওড়িশা আক্রমণ করেন ও নিজ দখলে আনেন। সেই সময় ওড়িশা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল এই মেদিনীপুর জেলা।এরপর ১৫৭৫ সালে তুকারোই এর যুদ্ধে আফগানদের পরাজিত করে মুঘল শক্তি নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করে এই অঞ্চলে। মোঘল শাসনাধীনে সমগ্র উড়িষ্যা রাজ্য উড়িষ্যা সুবা হিসেবে পরিগণিত হয়। ভারতের অন্যান্য মোঘল সাম্রাজ্যভুক্ত অঞ্চলের মতো মুঘলদের আঞ্চলিক শাসন পরিকাঠামো অনুযায়ী এই উড়িষ্যা সুবা আবার ৫টি সরকারে বিভক্ত হয়। আমাদের আলোচ্য স্থানটি জলেশ্বর সরকারের অন্তর্ভুক্ত হয়।
উড়িষ্যা রাজ্য এর পরেও বহুবার সাম্রাজ্যলোভী মোঘলসেনার ভুলুন্ঠিত হয়। তবে তারমধ্যে সবথেকে মারাত্মক আঘাত আসে মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের শাসনকালে।উচ্চাকাঙ্খী ঔরংজেব সাম্রাজ্য বিস্তার এবং রাজকীয় কোষাগার স্ফীত করার উদ্দেশ্যে নির্মম আঘাত হানেন জগন্নাথ দেবের মন্দিরসহ উড়িষ্যার বিভিন্ন মন্দিরের উপর। সেই সকল দেবালয়ে সঞ্চিত রত্নরাশি নির্বিচারে লুন্ঠিত হয় মোঘল সেনাবাহিনীর হাতে। উড়িষ্যা সুবা ভুক্ত মেদিনীপুরের বিভিন্ন স্থানও এই ধ্বংসাত্বক তান্ডবের হাত থেকে রক্ষা পায় নি। সেই সময়ই এরকম কোনো এক শান্ত দিনে হঠাৎই কেঁপে উঠেছিল কুরুমবেড়া দুর্গ ও দুর্গ সংলগ্ন অঞ্চল মুঘল অশ্বারোহী বাহিনীর রণহুঙ্কারে। চুরমার হয়ে গিয়েছিলো রাজা কপিলেন্দ্র দেবের সাধের কুরুমবেড়া গড় ও গড়ের অন্তস্থলে সুসজ্জিত মন্দির। সেই ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়েই বিজয়োৎসবে মেতে উঠেছিল মুঘল সেনাবাহিনী। যুদ্ধ থামলে আবার বাদশাহ ঔরংজেবের সময়েই (১৬৯১ সালে) তাঁর বিশ্বস্ত সেনানায়ক মহম্মদ তাহিরের উদ্যোগে যুদ্ধবিধ্বস্ত দুর্গের মধ্যে ইন্দো-পার্সিয়ান শিল্প রীতিতে গড়ে ওঠে তিনটি ডোম-সজ্জিত মসজিদ।এই সময় এই ইমারতের পুনর্বিন্যাস কালে মহম্মদ তাহির আরো কিছু অংশএতে সংযোজন করেন।এইভাবেই ভিন্ন সময়কালের আঙ্গিকে ভারতীয় ও পারসী শিল্পকলার এক অদ্ভুত মেলবন্ধনের মধ্যে দিয়ে স্বকীয় বৈশিষ্টে ভাস্বর এই গড় কুরুমবেড়া।স্থানীয় কারিগরদের হাত ধরে তার সাথে যুক্ত হয়েছে সপ্তদশ শতকের বাংলার চালারীতির গঠন বৈচিত্র্য যার প্রতিফল দেখা যায় উত্তর ও পূর্ব দিকের খিলানগুলির মধ্যে।
মোঘল সাম্রাজ্যের সূর্য যখন অস্তাচলগামী তখন ভাস্কর রাও হোলকার এবং রঘুজী ভোঁসলের দৃঢ় নেতৃত্বে মেদিনীপুরসহ উড়িষ্যার বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুঘলশক্তিকে পরাস্ত করে মারাঠাদের দখলীকৃত হলেও গড় কুরুমবেড়ার তৎকালীন কাঠামো অবিকৃত থেকে যায়। এই সময়ের বহু পরে কেশিয়ারির হাশিমপুরের দত্ত পরিবার গড় কুরুমবেড়ার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ত্ব প্রাপ্ত হন যদিও তাদের কাছে এই স্থাপত্যের ইতিহাস বিষয়ক তেমন কোনো নথি বা তথ্য পাওয়া যায় নি। ২০১১ সালে Archaeological Survey of India অধিগ্রহণ করেন গড় কুরুমবেড়া।
স্থানীয় ভাষায় কুরুম কথার অর্থ পাথর। বেড়া কথার অর্থ তো সব বাঙালিরই জানা। সুতরাং সেই থেকে মনে করা যায় কুরুমবেড়া কথার অর্থ পাথরে ঘেরা স্থান। আর সত্যিই তো তাই।সম্পূর্ণ নির্মানটি ১২ ফুট উঁচু ,৩ ফুট চওড়া মাকড়া বা লাল ল্যাটেরাইট পাথরের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা।প্রায় ৬৭৫০০ বর্গফুল অঞ্চল জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে সমগ্র গড়টি।খিলানযুক্ত ৮ ফুট চওড়া অলিন্দে মাকরা পাথরের সারিবদ্ধ স্থম্ভগুলির গঠনগত সমতা ও স্তম্ভের শীর্ষদেশে ছাদের গায়ে পাথর কেটে যে নকশাযুক্ত পদ্মফুলের প্রতিকৃতি প্রতীয়মান হয় তার মধ্যে দিয়ে শিল্পীগণের শিল্পনিষ্ঠা,দক্ষতা ও রসবোধের পরিচয় পাওয়া যায়।গড়ের পেছনদিকের অলিন্দের দেওয়ালে একটি পাথরের ফলকে ওড়িয়া হরফে খোদিত প্রায় অবলুপ্ত একটি লেখ চোখে পরে যেটি ভালোভাবে পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি এখনো। উড়িষ্যার বালাসোর জেলার রায়বেনিয়া গড়ের সাথে অনেকে এর স্থাপত্যগত সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছেন। অনেকে মনে করেন মুঘল এবং মারাঠা শক্তি এটিকে পরবর্তী কালে সৈন্যঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ব্রিটিশ আমলের নথিপত্রেও এটির কথা গড় হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে।তবে কোনো স্থাপত্যকে গড় বলে চিহ্নিত করতে গেলে সাধরণত যে জিনিসগুলোর উপস্থিতি আবশ্যক যেমন পরিখা , সুরক্ষিত সদর দরজা, বাইরে বেরোনোর জন্য সুড়ঙ্গ বা গোপন কোনো পথ, আত্মগোপনের স্থান, অস্ত্রাগার ,সৈন্যনিবাস,নজরদারি চালানোর জন্য ওয়াচ টাওয়ার ইত্যাদি কিছুই চোখে পরে না এখানে। বরং অলিন্দে ঘেরা উন্মুক্ত চত্ত্বর মনে করিয়ে দেয় কোনো দরবার বা প্রার্থনা স্থলের কথা।মনে হয় খিলানযুক্ত অলিন্দে হয়তো জমায়েত হতো স্থানীয় মানুষজন বা কোনো বিশেষ শ্রেণীর জনগণ এবং মাঝের খোলা স্থানে কোনো ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সম্পন্ন হতো। যদিও এইরূপ ধারণার স্বপক্ষে এখনো কোনো সেরকম উপযুক্ত প্রমান মেলে নি। তাই প্রাসাদটির ব্যবহারিক দিকটি সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু মন হাতড়ে বেড়ায় আজও ।
মূল ফটক ছেড়ে বাইরে পা রাখতেই চোখে পড়লো মাঝারি আকারের একটি জলাশয়। যেটি স্থানীয় ভাবে পরিচিত যোগেশ্বর কুন্ড নামে। ফিরে আসার পথে বসেছিলাম এক চায়ের দোকানে। পথশ্রমে সকালের খিদেটা চাগার দিয়ে উঠেছিল ভালোই। সেখানেই আলাপ হলো দোকানির ছেলের সাথে। ছেলেই বটে। বয়স ধরুন ১৪ কি ১৫ বছর। কিন্তু হবে ভাবে মনে হচ্ছিলো বোধ হয় দু-কুড়ি ছাড়িয়ে গেছে। গম্ভীর ভাবে সে আমাদের জানালো গড় কুরুমবেড়ার নতুন এক গল্প। যদি সে জানতে পারতো যে আমি তার সেই মনোজ্ঞ বিবরনকে গল্প বলে অবহেলা করছি তাহলে হয়তো খুব রেগে যেত আমার ওপর। কিন্তু কি আর করা। এই অধম সত্যের কাছে দায়বদ্ধ। তাই গল্প হিসেবেই জনশ্রুতিটি বলে রাখি এই বেলা। এই খানে নাকি রাম-সীতা বনবাসে থাকা কালীন পদব্রজে এসেছিলেন।সেই দিন তাঁদের এই অঞ্চলে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য সূর্যোদয়ের পূর্বে এক রাত্রির মধ্যে এই নির্মানটি সম্পূর্ণ করা হয়। যখন তার কাছে জানতে চাইলাম যে এত বড়ো প্রাসাদটি একরাতে কিভাবে কোন জাদু মন্ত্র বলে তৈরী হয়েছিল তখন সে গম্ভীর ভাবে বললে – কেন না করার কি আছে ? এর পর অবশ্য আর প্রশ্ন করার দুঃসাহস দেখাই নি।