একটা মোটা দড়ি থেকে পাশাপাশি ঝোলানো সারি সারি মৃতদেহ। ছাল ছাড়ানো।
গত কদিন ধরেই ব্যস্ততার আর সীমা নেই বুধনের। কোথায় সপ্তগ্রাম, কোথায় পোলবা, কোথায় মগরা, শিয়াখালা, পুইনান- যেখান থেকে পারে মাল জোগাড় করেছে। আজকে বলে একটা বিশেষ দিন! বাবু-বিবিরা সকাল সকাল পতাকা তুলে কুচকাওয়াজ দেখে হাজারো অনুষ্ঠান উপভোগ করে হা-ক্লান্ত হয়ে দুপুরে ভাত-মাংসের জমিয়ে খ্যাঁটন দিয়ে দিনটা পালবে! ঢুকুঢুকুও চলবে দেদার। বুধন তো ঢালবে গলায়। অবশ্য সে সন্ধ্যায়। দিনের বেলা বুধন ওসব ছুঁয়েও দেখে না। অবশ্য সময়ই বা কোথায়?
কেলাস ফোর অব্দি কাপাসডাঙ্গা পেরিয়ে হুই বস্তির পাশের ইস্কুলটায় গিয়েছিল বুধন। কী যেন বুনিয়াদী বিদ্যালয় বলত! পুরা নামটা আর মনে পড়ে না। তবে হেব্বি মজা হত বছরের এই দুটা দিন। সক্কাল সক্কাল চুলটুল আঁচড়ে আগের দিনের কেচে রাখা জামাকাপড় পরে দে- ছুট। কে কত লোকের বাগানের ফুল চুরি করে নিয়ে যেতে পারে স্কুলে- অলিখিত রেষারেষি লেগে যেত যেন! তা বুধনকে কেউ টপকাতে পারেনি কোনকালেই। এর বাড়ির বেড়া টপকে, ওর বাড়ির পাঁচিলে দাঁড়িয়ে ডিঙি মেরে উঁচু গাছের ফুল তোলা- বছরের দুটো দিন অদ্ভুত এক নেশায় যেন পেয়ে বসত তাকে। সবার থেকে বেশি ফুল তুলে বেদীতলায় দেওয়া। বসই ছিল তার প্রাণের বন্ধু। সে বরাবর আনত দুটো বড় লাল গোলাপ। তবে তার বেশিও নয়, কমও নয়। অন্য কোন ফুলও নয়। কোথা থেকে জোগাড় করত সেই জানে! বসইকে অনেকবার শুধিয়েছে সে, হুঁ হাঁ করে সে এড়িয়েই গিয়েছে শুধু! বুধন খালি এটুকুই দেখত, বসই কেমন যেন মনমরা, উদাস হয়ে থাকত গোটা দিন! আনন্দ করত, ফূর্তিতেও মাতত সবার সাথে, কিন্তু থেকে থেকেই তার চোখদুটো কেন যেন বাদলা আকাশের পারা মনখারাপ করে বসে থাকত! কত শুধিয়েছে বুধন, তোর কী হয় রে বচ্ছরকার এই দুটা দিনে?
বসই চুপ থেকেছে। আর তারপর হেসেছে। তার চোখদুটো আর্তনাদ করে উঠেছে। বসই তার সেই অদ্ভুত কান্নামাখা চোখে আর নিষ্পাপ হাসিমুখে বলেছে, – কিছুই লয় রে! কুথায় কী হবে? তরও যেমন! যা মাংসভাত খে গে যা!
বুধন অমনি ছুটত, সব ফেলে। ‘সমাজসেবা’র আয়োজন করত পাড়ার দাদারা। তারই দৌলতে স্বাধীনতার দিনে মাংসভাতের ব্যবস্থা। নজরুল ইসলামের গান বাজত পিছনে- রক্তজমাট শিকল পূজার পাষাণবেদী! আর সেই গান শুনতে শুনতে দুপুরের খাওয়াটা বেজায় জমে যেত বুধনের! বসই, তার আনা দুটো লাল গোলাপ, তার কাঁদতে চাওয়া চোখদুটো- অনেক অনেক পিছনে চলে যেত তখন!
আজও গান বাজছে- রক্তজমাট শিকল পূজার পাষাণবেদী! গানটা যেন রক্তের মধ্যে নেশা চাগিয়ে দিচ্ছে, আর হাতের ছুরি চলছে ঝপাঝপ! মা লক্ষ্মী বাবা লক্ষ্মীদের ভিড় লেগে যাবে একটু পরেই! চোখ চকচক করবে খদ্দেরদের- দুপুরে ভরপেট সাঁটিয়ে স্বাধীনতার নিশ্চিন্তি ঘুম দেবার অদূর সম্ভাবনায়! গানটা বদলে গেল- আমার এই দেশেতেই জন্ম যেন, এই দেশেতেই মরি! তা তো বটেই। এ দেশেতেই জন্ম তার, এই দেশেতেই তো মরবে! ইচ্ছে করলেও বিদেশে গিয়ে মরার পয়সা কোথায়? তবে এই ঝোলানো সারি সারি মৃতদেহ- এই বোকা পাঁঠাগুলো! এরাও জন্মাল আর মরল- স্বাধীনতার খাদ্য হয়ে! যাকগে, এরা আছে বলেই তো দুবেলা দুমুঠো জুটছে তার।
হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর- গান বদলে গেল আবার। ছোটবেলায় কী সব ভুলভালই না ভাবত! তারা জোরে জোরে গান জুড়ত, হও ধর মেতে বীর, হও কর মেতে বীর! একদিন ধমক লাগিয়েছিল বসই তাকে- অমন ভুল গান করুস ক্যানে? ধর মেতে ধীর? কর মেতে বীর? অ্যাঁ? উটা ধর মেতে লয় রে, ধরমেতে। মানে, ধর্মেতে। আর কর মেতেও লয়, করমেতে। মানে কর্মেতে।
তা বসই ধমক দিতেই পারে। অন্য পরীক্ষায় কম পেলেও ইতিহাসে তার বেশি নম্বর বাঁধা। কী যে আনন্দ পায় ঐসব ছাইপাঁশ পাতিহাঁস পড়ে, ওই-ই জানে!
“দাদা! হাত চালান! এই ক’টা পাঁঠা কাটতে এত সময় লাগে? ছুটির দিনটা আপনার দোকানে কেটে যাবে যে!”
আবার কোপ পড়তে থাকে ঝপাঝপ! মাংস কাটা, ওজন করা, খদ্দেরকে গুছিয়ে দেওয়া, দাম হিসেব করে টাকাকড়ি লেনদেন- ফুরসত নেই আর! এদিক থেকে অন্য একটা মাইকে গান শুরু হয়েছে লতা মঙ্গেশকরের। আজকের দিনে তিনি সুপার ডুপার হিট। দিনভর গেয়েই যাবেন একটানা। ‘ওয়াতন কে লোগোঁ’ জড়ো হয়েছে এখন বুধনের দোকানের সামনে। গান বাজছে মাইকে-‘জারা ইয়াদ করো কুরবানি।’ তা সে কুরবানিও চলছে পুরোদমে। শহীদের কুরবানি উদ্যাপিত হচ্ছে… একের পর এক। বুধনের ঘোর লেগে যাচ্ছে…। এত লোক? এতোই লোক? এরা কি সব অভুক্ত ছিল এতকাল? ফিনকি দিয়ে রক্ত উঠে ছিটিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে তার স্যাণ্ডো গেঞ্জি, তার গলা, তার হাত-পা স-অ-অ-ব। আচ্ছা শহীদদের যখন ফাঁসি দিত, এমন ছটফট করতে কি তারাও? সবাই নিশ্চয়ই বলিদান দিতে চাইত না। কেউ কেউ হয়তো বাঁচতেও চেয়েছিল। কাউকে কাউকে হয়তো ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে ফাঁসিয়েও দিয়েছিল কেউ কেউ! হতেই পারে, সবই হতে পারে।
“মাংস কিনতে এসেছি না বনগাঁ লাইনের ট্রেনের টিকিট কাটতে এসেছি, বোঝা দায়!”, আলগা মন্তব্য উড়ে এল।
“ও দাদা, একটা বালিশ হবে? এক ঘুম ঘুমিয়েই নি বরং।”
“চলুন দাদা, একটা সিনেমা দেখে আসি বরং!”
একের পর এক মন্তব্য ছুঁড়ে আসছে স্বাধীন ভারতের স্বাধীন বুভুক্ষু নরনারীদের থেকে। গুলিয়ে যাচ্ছে বুধনের, সব গুলিয়ে যাচ্ছে। কার মাথা কাটতে যাচ্ছে সে? এ কে? এ সেই ষোল বছরের দামাল শহীদ না- যার কথা সে শুনছিল বসইয়ের কাছে? এত রক্ত? এত রক্ত? একটা শহীদের শরীরে কত রক্ত থাকতে পারে? নাকি এ রক্তের ঢল… এই অজস্র সারিসারি ঝোলানো লাশ- ওগুলো কাদের? অবোলা প্রাণীদের? না না… এত রক্ত হয় নাকি? এত বছর ধরে পাঁঠা কাটছে। সে জানে না?
বসই কেমন যেন পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল পরের দিকে… খালি বিড়বিড় করত কিসব আর তাকে পেলেই বলত… অত শহীদের রক্ত… ব্যর্থ হবে না বুঝলি… ওরা ফিরে আসবে… আসবেই… অত রক্ত…অত রক্ত…
পুরো শরীর রক্তে ভিজে গেছে বুধনের… কপালের থেকে, চোখের থেকে রক্তের ধারা গড়াচ্ছে। চোখে ভালো দেখতে না পাওয়ার জন্যই হবে, কোপটা ঠিকঠাক পড়ল না পাঁঠাটার গায়ে। রক্তভেজা হাতে ঠিকঠাক চেপে ধরতেও পারেনি সে। পাঁঠাটা কিভাবে যেন ছুট দিল তার হাত ফসকে।
অদ্ভুত ব্যাপার, উপস্থিত এতগুলো মানুষের কেউই ধরতে পারল না পাঁঠাটাকে। পাঁঠা নাকি অন্য কিছু? বুধন দৌড়োচ্ছে, কিন্তু পায়ে জোর পাচ্ছে না কেন আজ? নাকি এতক্ষণ বসে থেকে থেকে পায়ে খিল ধরে গেছে? অর্ধেক কোপ খাওয়া পাঁঠাটা ছুটছে ছুটছে- ওরা তো বোঝে না কোনদিন। আজ বুঝল কী করে?
কোথায় দৌড়োচ্ছে পাঁঠাটা? ওদিকেই বসইদের সেই পুরনো ঝুপড়িটা ছিল না? তার ওপারের ওদিকটায় ঘাসজমি, ঝোপঝাড়। পাঁঠাটা উধাও হয়ে গেল কোন্দিকে- ঠাহর করতে পারল না সে। কিন্তু ঝোপঝাড়ের ফাঁকে আচমকাই একটা জিনিসে চোখ আটকে গেল তার। একটা ফলক- মৃতদেহের কবরের ওপর যেমন থাকে। একটাই শব্দ কষ্ট করে পড়তে পারল সে- ‘শহীদ…’।
আর হ্যাঁ, ফলকটার ঠিক সামনের বুনোগোলাপের গাছটাতেই গজিয়ে আছে দুটো টকটকে লাল গোলাপ!
……০……
অংকনঃ পুণ্যতোয়া ধর