Home / গল্প / নোকরি – নির্মাল্য ঘরামী

নোকরি – নির্মাল্য ঘরামী

নোকরি- নির্মাল্য ঘরামী
শিল্পী- পুণ্যতোয়া

 

কেট থেকে দামী সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে খানিক চেয়ে দেখল সুনু। বেকার জীবন আজই শেষ হচ্ছে। কিন্তু যে বেকার জীবনে বিড়ি না খেয়ে সিগারেট, বিশেষ করে দামী সিগারেটের দিকে অপাঙ্গে চেয়ে দেখত ও, কই আজ চাকরি পেয়ে এই দামী সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে নিয়েও কেন আর সুখটান দিতে ইচ্ছে করছে না?

 

একটা একটা করে সিগারেটগুলো বের করে জুতোর তলা দিয়ে দুমড়ে মুচড়ে নষ্ট করে দিতে দিতে সুনু ভাবছিল ওর জীবন থেকেও একটা সুখ হারিয়ে গেল, চিরদিনের মতন, যেটা ওর আগে জানা ছিল না! প্রাপ্তি থেকেই অপ্রাপ্তির সৃষ্টি। বিনামূল্যে কিছুই পাওয়া যায় না। নদী একদিকে ভাঙে, অন্যদিকে গড়ে। জীবনের সম্পূর্ণ নতুন একটা জগতে পা রেখেছে সে। এবারে সবকিছু নতুন করে দেখবে, জানবে।

 

(২)

-রুবি কেমন আছে, অ্যাঁ? মিল্টন চোখ নাচিয়ে জানতে চাইল।

-ভালই দাদা। চোখটা একটু নামিয়ে জবাব দিল সুনু।

-তাহলে বেশ চুপচাপ নিজের কাজ করে যাচ্ছিস, অ্যাঁ?

-লজ্জা দিচ্ছ দাদা। বলে লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিয়েছিল সুনু।

-কেন, এত লজ্জা কেন, অ্যাঁ? বলে পকেট থেকে বেনসন অ্যান্ড হেজেস-এর প্যাকেট বের করে সেটা থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে মিল্টন বলল, -তোর তো ব্যথাটা আবার অনেকদিনের। সবাই তো জানে…..।

বলে মিল্টন নিজে একটা সিগারেট ঠোঁটে গুঁজে পকেট থেকে দেশলাই বের করে কাঠি জ্বালিয়ে ওর দিকে বাড়িয়ে দিল। বেশ জুল জুল চোখে এতক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে ছিল সুনু। সাধারণত দামী সিগারেট সে খায় না। এই বেকার জীবনে সে প্রশ্নই ওঠে না। মিল্টনদাকে আগুনটা ওর দিকে এগিয়ে দিতে দেখে মুখটা ঈষৎ নিচু করে সামনের দিকে ঝুঁকে সিগারেটটা ধরিয়ে নিয়ে একবুক নিঃশ্বাস ছাড়ল ও। ততক্ষণে মিল্টন নিজের সিগারেটটাও ধরিয়ে নিয়েছে। সঙ্গে ওর চেহারায় যোগ হয়েছে সাফল্যের ছটা। সেদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে নিজের মনেই একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে সুনু বলল,

-কী আর করব দাদা? সেই একরকম চলছে। বলে খানিক থেমে উদাসী গলায় বলল, -দেখি……।

-চাকরিটা হয়ে যাবে। মিল্টন আশ্বাস দিয়ে বলল, -ভালই তো হয়েছে বললি? তাছাড়া অনেকগুলো ভ্যাকান্সি-ও আছে।

-খুব ভালো না। সুনু অনিশ্চিত গলায় বলল, -না আঁচালে বিশ্বাস নেই কিছু।

-হ্যাঁরে, কাকীমার খবর কী? মিল্টন আচম্বিতে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল, -বলি শরীর-টরীর ঠিক আছে, অ্যাঁ?

-ঠিকই আছে। খানিক থেমে সুনু বলল, -আসলে বয়স হচ্ছে। আর আমার জন্য টেনশন। তার উপর পুজো-উপবাস। এইসব নিয়ে মায়ের শরীর খুব একটা ভাল নেই। তবে এবারে ছানির মায়ের অপারেশনটা করিয়ে নেব।

-বয়সের ধর্ম। বলেই কথা পাল্টে সিগারেটে একটা বড় টান দিয়ে মিল্টন জিজ্ঞেস করল, -তুই তো সামনের সপ্তাহে কাকীমাকে নিউ লাইফ নার্সিংহোমে অ্যাডমিট করাচ্ছিস বলে শুনলাম, অ্যাঁ?

-হ্যাঁ, আর দেরী করা ঠিক হবে না দাদা। পরীক্ষা-টরীক্ষা হয়ে গেছে। এই সময়ে কোন টিউশন নেই। পুরো খালি আছি। এই সুযোগে মায়ের অপারেশনটা করিয়ে নিই।

-তাহলে আমার কাজটা করে দে না ভাই। বলে ওর দিকে তাকিয়ে স্থির দৃষ্টিতে সুনুকে মাপতে মাপতে সিগারেটটা ঠোঁট থেকে নামিয়ে হাতে নিয়ে মিল্টন খানিক মিনতির সুরে বলল, -আমার মায়ের অপারেশনটাও কবে থেকে করিয়ে নেব বলে ভাবছি, কিন্তু দেরী হয়ে যাচ্ছে। ওই নিউ লাইফ নার্সিং হোমেই করাব। আমি প্রথম দিন ভর্তি করে দিয়ে যাব। তারপরে তুই একটু দেখে দিতে পারবি?

-কোন অসুবিধে হবে না দাদা। সুনু মুখ তুলে আশ্বাসের সুরে বলল, -তুমি নিশ্চিত থেকো।

-আসলে তোর বৌদিকে নিয়ে ওই সময়টা একটু ওর বাপের বাড়ি যাব। মিল্টন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, -আমার কাজের চাপে বেচারা অনেকদিন ওর বাড়ি যেতে পারছে না। দিন সাতেক ছুটি পাব। ওকে একটু না নিয়ে গেলেই নয়। তা আমি অ্যাডমিট করিয়ে খরচাপতি সব দিয়ে যাব তোকে, সেদিক থেকে………

 

-তুমি কিচ্ছু চিন্তা কোরো না মিল্টনদা, সুনু  তড়িঘড়ি বলে উঠল, -আমি তো আছিই। দু’জনের ভালই সময় কাটবে।

-কথা দিচ্ছিস তো? মিল্টন খানিক চিন্তার সুরে বলল, -দ্যাখ আবার?

-তুমি কিচ্ছু ভেবো না দাদা। শেষ টান দিয়ে পর সিগারেটের ফিল্টারটা মাটিতে ফেলে জুতো দিয়ে সেটা নিভিয়ে দিয়ে সুনু আশ্বাস দিল, -আমি সব দেখে নেব।

 

(৩)

আজ মিল্টনদা’র চেম্বার থেকে বেরিয়ে মাথাটা ঝিমঝিম করছিল ওর। ঢোকার সময়ে যদিও বেশ ফূর্তিতেই ঢুকেছিল সুনু। সুনু’র মিল্টনদা মোটামুটি পদস্থ অফিসার। শহর থেকে কিছুটা দূরে ওদের অফিস। সুনুদের পাড়াতেই বাড়ি। কিন্তু অফিসের কোয়ার্টারে থাকে। সুনু যে চাকরিটা পেয়েছে, সেটা মিল্টন যে অফিসে কাজ করে, সেখানেই। কিন্তু কিভাবে কী করবে, সেইসব কিছুই ওর জানা ছিল না। পকেটে ছিল ওর অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। তাই ভাবল যে একবার দেখা করে আসি। অন্তত মিষ্টির প্যাকেট দেওয়ার এই ছুতোটা সে হাতছাড়া করতে নারাজ। তাছাড়া অফিসে চেনা জানা পদস্থ মুরুব্বি থাকলে পরে অনেক সুবিধে আছে। অন্তত কিছু সাজেশন তো দিতে পারবে। আজ সন্ধ্যায় বাড়িতে পুজো। কাল থেকে সে কাজে যোগ দেবে।

 

প্রথমেই অবশ্য ও মিল্টনের চেম্বারে ঢুকতে পারেনি। অফিসটায় দু’জন অফিসার পাশাপাশি চেম্বারে বসে থাকেন। তাই আর্দালি ওর থেকে জানতে চেয়েছিল যে সুনু কার সঙ্গে দেখা করতে চায়। ও বলে ফেলেছিল ‘মিল্টনদা’। তাতে ওর দিকে অবাক ও বিরক্তমুখে তাকিয়েছিল সে। পরক্ষণেই অবশ্য ও ভাল নাম বলল, যেটা চেম্বারের বাইরের নেম প্লেটে লেখা ছিল। তা ওকে বসতে বলে ওর নাম জেনে নিয়ে ভিতরে গেল সেই আর্দালি। খানিক বাদে ওর ডাক পড়ল। বেশ স্মার্টলি ও পর্দা ঠেলে ঘরে ঢুকে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। টেবিলের অন্যপাশে বসে মিল্টন ওকে দেখছিল। বেশ আন্তরিক একটা হাসি দিয়ে ইঙ্গিতে ওকে সামনের চেয়ারে বসতে বলে সে জিজ্ঞেস করল,

-কী রে, কী মনে করে, অ্যাঁ?

-একটা ভাল খবর আছে।

চেয়ারে বসতে বসতে সুনু বলে উঠল। সুনু’র পাশের চেয়ারে একজন বসে ছিলেন। মনে হল অফিসের কেউ। তিনি বিরক্ত মুখে ওর দিকে তাকালেন। অবশ্য খুশীর আতিশয্যে ও সেদিকে দেখেও দেখল না।

-বল বল শুনি? মিল্টন অবশ্য বেশ আগ্রহান্বিত মুখেই জানতে চাইল।

-আমার না একটা চাকরি হয়ে গেছে।

-কনগ্র্যাটস! জোর গলায় বলে উঠল মিল্টন, -তা মিষ্টি কই, অ্যাঁ?

-এইত!

বলে হাতের ব্যাগটা থেকে একটা মাঝারি সাইজের মিষ্টির প্যাকেট বের করে হাসি হাসি মুখে ওর দিকে চেয়ে সেটা টেবিলের উপরে রাখল সুনু।

-বেশ বেশ। মিল্টন ওর দিকে একঝলক ভাল করে তাকিয়ে বলে উঠল, -তা জামার পকেটে ওটা কী উঁকি দিচ্ছে, অ্যাঁ?

-ফাইভ ফিফটি ফাইভ দাদা। সুনু খুশীভরা গলায় বলে উঠল, -আজ আনন্দের চোটে এক প্যাকেট কিনেই ফেললাম।

তারপরে জামার পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে মিল্টনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

-আজ তুমিই শুরু কর দাদা।

-ভাল। ভাল। মিল্টন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, -এই উন্নতি শুরু হল। এবারে গড়গড়িয়ে রথ এগিয়ে যাবে।

সিগারেটটা হাতে নিয়ে দেশলাই দিয়ে সেটা ধরিয়ে একটা সুখটান দিল মিল্টন। সুনুর পাশে বসা সেই ভদ্রলোকও একটা নিলেন। তারপরে ওর দিকে ঘুরে বসে জিজ্ঞেস করলেন,

-তা ভাই কোন অফিসে আপনার চাকরিটা হল?

-এই আপনাদেরই অফিসে দাদা।

-মানে?

উনি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালেন। মিল্টনও আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল।

-মানে এখানেই গ্রুপ-ডি হিসেবে নিয়োগপত্র পেয়েছি। হাসি হাসি মুখে সুনু বলল, -আজ পুজো দিয়ে আগামীকাল কাজে যোগ দেব।

-অ……বুঝলাম। সেই ভদ্রলোক এবারে মিল্টনের দিকে ঘুরে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণ দিয়ে একটা বাঁকা হাসি হেসে বললেন, -আমরা একজন আর্দালি পেলাম। আমি কালকেই জেলা সদরের অফিসে খবরটা শুনেছিলাম যে শিগগিরি আমাদের এখানে একজন আর্দালি জয়েন করবে। আগে তো একজনই ছিল। তাকে নিয়েই আমি-আপনি দড়ি টানাটানি করতাম। এবারে একটা হিল্লে হল। তারপর সুনু’র দিকে ঘুরে গলাটা একটু শক্ত করে বললেন, -তুমি কিন্তু ভাই কাল সকালেই জয়েন করে যাও। আর হ্যাঁ, বলে হাতের সদ্য ধরান সিগারেটটা নিভিয়ে অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে মিল্টনকে দেখিয়ে বললেন, -ওঁকে স্যার বলে ডাকবে। দাদা কথাটা কিন্তু অফিসে চলে না, অন্তত ওঁকে তো নয়ই। তারপরে খানিক থেমে ক্রমশ অবাক হতে থাকা সুনুর মুখের ভাবভঙ্গী দেখতে দেখতে কড়া গলায় উনি বললেন, -আর কথায় কথায় ওঁর সামনে পকেট থেকে সিগারেট না বের করলেই কি নয়?

অবাক হয়ে ভদ্রলোককে দেখতে দেখতে সহসা চোখের কোণ দিয়ে সুনু তার মিল্টনদা’র দিকে তাকিয়ে দেখল। মিল্টনও তখন তার সদ্য ধরানো সিগারেটটা নিভিয়ে অ্যাশট্রে-তে গুঁজে দিচ্ছিল!

 

……0……

অংকনঃ পুণ্যতোয়া

Leave a comment

Check Also

স্বীকারোক্তি

স্বীকারোক্তি- ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য্য

    আজই ফোনটা ডেলিভারি দিয়ে গেলো। অনলাইনে একবার দেখেই ভারি পছন্দ হয়ে গেছিল সমীর …

দর্পণে

দর্পণে – নির্মাল্য ঘরামী    

    -চল, আমি জোরের সঙ্গে বললাম, -ওসব একদম ভাবিস না। তোকে এতদিন পরে পাচ্ছি, …

ফয়সালা

ফয়সালা – নির্মাল্য ঘরামী

  -দেখুন স্যার। বলে সিকিউরিটি গার্ডটি বিজয়ীর দৃষ্টিতে মহাকুলসাহেবের দিকে তাকালো। তার হাতে ধরা ব্যাগটির …

রক্তগোলাপ/ মৌসুমী পাত্র/ পুণ্যতোয়া ধর

রক্তগোলাপ – মৌসুমী পাত্র

  একটা মোটা দড়ি থেকে পাশাপাশি ঝোলানো সারি সারি মৃতদেহ। ছাল ছাড়ানো। গত কদিন ধরেই …