তখনও ছটফট করছিল ছাগলটার শরীরটা। চারখানি পা তার এলোমেলো নড়ছিল। যদিও দেহ থেকে মাথাটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, তাও শরীরের স্পন্দন তার থামেনি। পেটটা থেকে থেকেই ওঠা নামা করছিল। কাটা গলাটা থেকে তখনও তাজা রক্ত বেরোচ্ছিল। অনেকটা তাজা রক্ত বেরিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছিল সামনের ঘাস। ক্রমশ রক্ত ছড়িয়ে পড়ছিল আরও দূরে। তবে আগের চেয়ে অনেক ধীরে। রক্ত বেরোনোটা ক্রমশ কমে আসছিল। সাথে কমছিল শরীরের আনিয়ন্ত্রিত ছন্দ। স্থির হয়ে আসছিল দেহটা।
মন্দিরটা টিলার ঠিক পাদদেশে। মা পূর্ণাপাণি মন্দিরের চাতালের চারদিকে গাছের চারপাশে বেদী করে বসবার জায়গা করা হয়েছে পুণ্যার্থীদের জন্য। চাতালের একপাশটায় বলি দেওয়ার হাঁড়িকাঠ। সেখান থেকে একটা নালা গিয়ে মিশেছে পাশের একটা অগভীর ডোবাতে। জাগ্রত দেবীর থানে প্রত্যহ এক বা একাধিক বলি হয় বলে এলাকার চারপাশটায় শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দুর্গন্ধ সবসময় নাকে এসে লাগে। মন্দিরটার পেছনদিকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে ছোট্ট নদীটার বুকে। সেখানে আছে শ্মশানঘাট। চারদিকে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে আছে পোড়া কাঠ, ভাঙ্গা হাঁড়ি, হাড়, ইত্যাদির নমুনা। সবমিলিয়ে গোটা মন্দির চত্বর আর আশপাশের এলাকায় প্রকৃতির মধ্যেও একটা অপ্রাকৃতিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।
এই কিছুক্ষণ আগেও ভিড়টায় উপস্থিত ব্যক্তিরা তিনদিক দিয়ে ঘিরে ছিল বলিদানের জায়গাকে। আর সাথে সাথে তারা জয়ধ্বনি দিচ্ছিল দেবী পূর্ণাপাণির নামে। বড় জাগ্রত এই দেবী পূর্ণাপাণি। আশপাশের গ্রাম-গঞ্জ তো বটেই, দূর-দূরান্ত থেকে লোকেরা আসে এখানে মানত করার জন্য। চতুর্দিকে ভেসে বেড়ায় দেবীর মহিমা। তাই এই লোকগুলিও পাশের গ্রাম থেকে এসেছিল মনস্কামনা পূর্ণ হওয়ায় প্রতিদানের তাগিদে।
বলি হয়ে যাওয়ার পরে জয়ধ্বনি থেমে গেছিল। বদলে লোকজন এসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিল মন্দিরের সামনে গাছের নিচের বেদীগুলিতে। কিছু লোক রাস্তায় জটলা করে দাঁডিয়েছিল। কিছুক্ষণ পরে এখানেই রান্না করে খাওয়া-দাওয়া সেরে তারা ফিরে যাবে তাদের গ্রামে। ওদের মধ্যে জনাকয়েক গেছিল রান্নার তাদারকিতে।
ঠিক এমন সময় ভিড় দেখে সেখানে আবির্ভাব ঘটল রাস্তা দিয়ে যাওয়া এক সাধুজীর। তখন বলি শেষ করার পর লোকটি তার খাঁড়াটি পরিষ্কার করছিল সামনের কলের জলে। বেশ কয়েকবার পাম্প করে জল দিয়ে ভাল করে ধুয়ে নিল খাঁড়াটি, যাতে করে কোন দাগ না লেগে থাকে। রক্তের দাগ যদিও ধুলে যায় না, কিন্তু আপাতদৃশ্য তেমন কিছু আর সত্যিই লেগে ছিল না খাঁড়ার গায়ে। তারপর লোকটা ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে সন্তুষ্ট হয়ে নিষ্পাপ খাঁড়াটি রেখে আসল মন্দিরের ভিতরে।
গাছের নিচে বসে থাকা ছোট জটলাটার সামনে উপস্থিত হলেন সাধুজী। কয়েকজন তখন তাকিয়ে দেখছিল ক্রমশ বলির রক্তের ক্রমশঃ শুকিয়ে যাওয়া। ঘন লাল থেকে কালো হয়ে যাচ্ছিল রক্তের শুকনো দাগ। খানিকটা রক্ত একটা ছোট নালা দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল সামনের ক্ষুদ্র ডোবাটার দিকে। পরবে যখন বলি হয় অগুনতি, তখন ওই ক্ষুদ্র নালাটি দিয়ে বলির রক্ত বয়ে গিয়ে ভরিয়ে দেয় ডোবাটাকে।
-আজকে কার, কী মানত ছিল? ভিড়টাকে জিজ্ঞেস করলেন সাধুজী।
-হরেনের ছোট ছেলেটার কঠিন অসুখ হয়েছিল। অনেকদিন ধরে জ্বর, কিছুতেই আর কমছিল না।
ভিড়ের থেকে জনৈক বয়স্ক ব্যক্তি হরেন নামক দূরে বসে থাকা একজনের দিকে আঙুল তুলে দেখাল,
-ও মানত করেছিল, ওর ছেলে সেরে গেলে ছাগল বলি দিয়ে মা’র পুজো দেবে। কিছুদিন হল ওর ছেলে পুরো সুস্থ হয়ে উঠেছে। ডাক্তারেরা বলেছেন ওর আর কোন ভয় নেই।
-যদি ডাক্তারের চিকিৎসাতেই সারবে তাহলে আর মানত কেন? আর যদি দেবীর দয়াতে সেরে উঠবে তো ডাক্তার দেখানোর কী দরকার? ক্ষণিক হেসে সাধুজী প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন।
-ওরকম বলবেন না সাধুজী। ভীত চোখে কপালে হাত ঠেকিয়ে সেই ব্যক্তি বলে উঠলে, -মা বড়ই জাগ্রত। তাঁর ইচ্ছে তো মানুষের হাত দিয়েই ফুটে ওঠে। তাই ডাক্তার দেখানো। মার সাহায্য ছাড়া তাঁর ডাক্তারি বিদ্যে কী কাজ দেবে?
কথা শেষে আর একবার ভক্তিভরে কপালে হাত ঠেকাল সেই ব্যক্তি। লোকটির আন্তরিক ভক্তি দেখে আর কিছু বললেন না সাধুজী। প্রসঙ্গ ইষৎ পাল্টে জিজ্ঞেস করলেন,
-তা এক কোপে কাটতে পেরেছ?
-হ্যাঁ, সাধুজী। নইলে তো পরের বছর দু’টো বলি দিতে হত।
-তা ছাগল কোথায়? একরকম ব্যঙ্গ করে বলে উঠলেন তিনি, -এ তো নিতান্তই ছাগলছানা দেখছি।
-ওর আর সামর্থ্য কত সাধুজী? অন্য একজন পাশ থেকে বলল, -ওর জমিতে বিঘেতে দশ মণ ধানও হয় না। আছে মোটে তিন বিঘে জমি। তাও ছেলের চিকিৎসায় এক বিঘে বন্ধক রেখেছে। তাছাড়া পুজো দেওয়া, লোকেদের যাতায়াতের খরচ, এসবেও অনেকটা টাকা লেগেছে। বড় ছাগলের দাম অনেক।
-তার মানে সব খরচই ও করতে পারে, কিন্তু ভক্তিভরে দেবীর মানত রাখার জন্য ও আর বেশি খরচ করতে রাজী না! কেননা ওর প্রয়োজন মিটে গেছে। তোমরা শেষে দেবীকে ঠকিয়ে দিলে?
শেষটায় মনে হয় নিজেকেই প্রশ্ন করে উঠলেন সাধুজী।
-এরকম করে বলবেন না সাধুজী, সেই ব্যক্তি অনেকটা মিনতির সুরে বললেন, -কথাটা দেবীর কানে গেলে অমঙ্গল হবে আমাদের। সবাই জানে দেবী রেগে গেলে ধ্বংস করে দেবেন সবকিছু। সামর্থ্য থাকলে ও ধুম-ধাম করেই পুজো করত। কিন্তু …………। তাছাড়া এবছর চাষও ভালো হয় নি। ছেলেকে নিয়ে দৌড়-ঝাঁপ করতেই অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে।
-দেবী যদি জাগ্রতই হবেন, তাহলে ব্যাপারটা এতক্ষণে জেনেই গেছেন। আর যদি তা না হয়, তো তোমাদের ভয়টা কোথায়?
কথার শেষদিকটায় গম্-গম্ করে উঠল সাধুজীর কণ্ঠস্বর। প্রশ্নটা ওদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে জাম-গাছটার তলায় বসলেন সেই সাধুজী।
সেই লোকটি দলের কয়েকজনের সাথে আলোচনা করে খানিকটা হেঁটে তাঁর কাছে এসে অনুনয়ের সুরে বলল,
-সাধুজী আপনি কিন্তু আমাদের সাথে খাওয়া-দাওয়া সেরে তবেই যাবেন। আজ অনেক ভাগ্য, তবে আপনাকে আমরা পেয়েছি। লোকটি তাঁর দিকে তাকিয়ে ভক্তিভরে হাত জোড় করে বলে উঠল, -আপনি অনুগ্রহ করে একটু বসুন, যাবেন না যেন। আমি দেখে আসছি যাতে তাড়াতাড়ি হয়।
কিছুক্ষণ পরে সেখানে আবির্ভাব হল এক সাধিকার। অবাক হয়ে সাধুজীর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন,
-তুমি আজ হঠাৎ এখানে? সেই যে গেলে আর তো এলে না? কতদিন ধরে ভাবছি তুমি ঠিকই আসবে।
-তুমি কেমন আছো, দেখতে চলে এলাম। স্মিত হেসে বললেন সাধুজী, -আমিও একদিন তোমার কথা খুব ভেবেছি। মনে হয়েছে তোমার কাছে যাওয়াটা দরকার। তুমি তো একলাই থাক।
-আগে চল, কিছু খাবারের আয়োজন করি। অনেকদিন পরে এখানে এলে। তোমাকে যে কী খেতে দিই? নিজের মনেই শেষটায় বলে উঠলেন সেই সাধিকা।
-দরকার নেই, ওই দেখ ওরা ইঁট দিয়ে উনুন বানিয়ে রান্নার আয়োজন করছে। ওরাই আমাকে খেতে দেবে, তোমাকেও। বরং চল নদীর দিক থেকে একটু ঘুরে আসি। অনেকদিন পরে এলাম এদিকে।
বলে দূরে রন্ধনরত লোকেদের ইশারা করলেন যে শীঘ্রই ফিরবেন। তারপর সাধিকার সাথে পা বাড়ালেন নদীর দিকে।
বেশ কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে দেখলেন যে ওদের রান্না প্রায় শেষ। তারা এবার সবাইকে বসিয়ে খাওয়াবার আয়োজন করতে চলেছে। দুই সারিতে লোকেরা বসল। কয়েকজন শুধু পরিবেশন করার জন্য রইল। দুই সারিতে বসতে হল ওদেরকে, কেননা বলির প্রসাদ শুধু পুরুষরাই খেতে পায়। মেয়েদের ও বাচ্চাদের তা খাওয়া বারণ। তবে একজন মহিলার ক্ষেত্রে এই বারণ খাটে না। তিনি দেবী পূর্ণাপাণি! অবশ্য তিনি আর কবে নিজের প্রসাদে ভাগ বসিয়েছেন?
খানিকটা দূরে সাধুজী আর সাধিকা, দু’জনেই বসে পড়লেন। সাধুজী ইশারায় পরিবেশনকারীকে সবকিছুই দিতে বললেন। সে তাঁকে সবকিছু দিলেও সাধিকাকে আর দেবীর প্রসাদ পরিবেশন করল না। বলিপ্রদত্ত জীবের মাংস মেয়েদের খেতে নেই। যদিও দেবীর নামে বলি হতে বাধা নেই। তবে দেবী তো আর কোন সাধারণ মেয়ে নন! তাঁর ক্ষেত্রে কোন পার্থিব বাধাই যে খাটে না।
যাইহোক নিয়ম, নিয়ম-ই।
কঠিন হলেও মানতে হবে। তবে সাধিকার সন্মানার্থে সাধুজী আর বলির প্রসাদ খেলেন না। লোকেরা তাঁকে অনেকবার সাধাসাধি করল। কিন্তু তাঁর প্রতিজ্ঞা বড়ই কঠিন। সাধিকাকে না দেওয়া হলে তিনি খাবেন না। কিন্তু কোন প্রাচীন প্রথা ভাঙ্গার ক্ষমতা উপস্থিত ভক্তদের ছিল না। তারা করজোড়ে ভীতবিহ্বল চোখে সাধুজীর কাছে ক্ষমা চাইল। সদাজাগ্রত দেবীর থানে এমনটা করলে ঘোরতর অমঙ্গল হবে!
কিছুক্ষণ পর এলাকাটা শান্ত হয়ে আসল। দেবীর ভক্তরা সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে একটা ম্যাটাডোরে চেপে চলে গেল। সন্ধ্যা ক্রমশঃ ঘনিয়ে আসছে। সাধুজী আর সাধিকা এসে বসলেন একটা বেদীতে।
-তোমার তো তাহলে ভালই কাটছে। একাকীত্ব নিশ্চয়ই অনুভব হয় না?
সাধুজী সাগ্রহে সাধিকার মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন।
-কী যে বল তুমি? অনুযোগের সুরে বলে উঠলেন সাধিকা, -তোমাকে ছাড়া কোন গতিকে এভাবেই নিজেকে ভুলিয়ে রাখি। এভাবেই নিজের একাকীত্বকে চাপা দিই। ভুলে যাই নিজের হাহাকারকে। তুমি কি ফিরে আসতে পার না সবসময়ের জন্য?
-হয়তো নয়। প্রত্যেকের কিছু কিছু কর্তব্য-কর্ম ঠিক করা আছে। হয়তো তার বাইরে আমরা যেতে পারব না। তুমিও তো যেতে পারছো না। তুমি কী পার না সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে আমার সঙ্গে অনামী একজন হয়ে বেরিয়ে পড়তে?
-কিন্তু এত লোকের সাহচর্য ছেড়ে যাওয়াটাও যে মুশকিল! জানি যে আমি একটা মোহের মধ্যে পড়ে আছি।
-কিন্তু এটা কী তোমার আত্মার অপমান নয়? সাধুজী কঠিন কন্ঠে বলে চললেন, -তোমার নামে সবকিছু! অথচ তুমি নিজেই ব্রাত্য। এসব দেখে-শুনে অপমানিত হয় না কি তোমার সত্তা?
-সে তো হয়ই। কিন্তু এই সন্মান………এই ভক্ত………এই দরদভরা নিবেদন- এসবও কি খুব কম? কোথায়ই বা পাব আমি এসব?
-ভাল করে ভেবে দেখ তুমি, বজ্রকঠিনস্বরে বলে উঠলেন সাধুজী, -একবার এই সন্মান, এই ভক্তি, এই নিবেদনের নির্মোক ভেদ করে তাকিয়ে দেখ, এই পাশবিকতা, এই অমানবিকতা আর কতদিন সহ্য করবে তুমি? এসব দেখে তোমার আত্মা কি হাহাকার করে ওঠে না? তুমি কী শুধুই পাষাণ?
-তুমি আমাকে তোমার সঙ্গে নেবে? বল কখনও ছেড়ে যাবে না? তীব্র আকুতিতে সাধুজীর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন সাধিকা, -বল, আমরা এবার থেকে সবসময় একসাথেই থাকব?
-হ্যাঁ তাই থাকব আমরা। আমরা একসাথে থাকব। থাকব ঘাস হয়ে, বাতাস হয়ে, জল হয়ে পৃথিবীর। এবার তুমি এসব ফেলে আমার সাথে চল। এই নোংরামি, এই ভন্ডামি ছেড়ে একবার মুক্ত পৃথিবীর সংস্পর্শে এস। মিনতির সুরে বলে উঠলেন সাধুজী। তারপর হাত বাড়িয়ে দিলেন সেই সাধিকার দিকে।
সন্ধ্যার মিলিয়ে যাওয়া আলোর মতন তাঁরাও হাত ধরে চলতে চলতে একসময় দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেলেন। আর সন্ধ্যার পর থেকেই তীব্র বৃষ্টিপাতের সাথে সাথে আচম্বিতে বান আসল নদীতে। ধীরে ধীরে নদীর তীব্র স্রোতে ক্ষয় হতে থাকল টিলা, মন্দিরের নিচের মাটি। সেখান থেকে বড় বড় মাটির চাঙড় ভেঙ্গে পড়তে থাকল নদীর তীব্র ঘূর্ণিতে। অবশেষে একসময় সমগ্র মন্দিরটাই ভেঙ্গে পড়ল নদীতে। পরদিন সকালে লোকেরা অবাক হয়ে দেখল যে মন্দির সহ সংলগ্ন এলাকাটা তলিয়ে গেছে নদীগর্ভে!
……0……
অংকনঃ- সোমক সেনগুপ্ত