কফিতে খানিকটা চিনি মিশিয়ে স্টিক দিয়ে ভালো করে নাড়াতে নাড়াতে মধু জিজ্ঞেস করল,
-তারপর?
-আর কী? হাসল সুমন, -সান রে কোম্পানীটায় পোষাল না। যেভাবে খাটাচ্ছে, সেভাবে কমপেনসেট করছে না। এদিকে এই সরকারী চাকরিটা পেয়ে গেলাম। ছেড়ে দিয়ে মালদা থেকে সোজা এখানে।
-কাজের চাপ কেমন? কৌতূহলী মুখে মধু কফির কাপ থেকে মুখ তুলে তাকাল ওর দিকে।
-মন্দ না, বিশেষত এই বর্ষায়। টেবিলের উপরে থাকা মোবাইলটা হাতে তুলে নিয়ে সেটা দেখিয়ে সুমন বলল, -ডাক পড়লেই বেরোতে হবে। এবং যে কোন সময়েই ডাক পড়তে পারে।
কফি ক্লাবের বারান্দা থেকে অনেক নিচে দেখা যায় তিস্তা নদী। তবে এই বর্ষার সীজনে প্রায়ই ঘন, সাদা মেঘে ঢাকা থাকে তা। মেঘ না থাকলে চোখে পড়ে তার সবুজ বনানী অথবা ধস নেমে ধূসর হয়ে যাওয়া খাড়াই পাহাড়ি এলাকা। আর পিছনে সিকিম পাহাড়ের সারি। হাল্কা-হাল্কা সাদা মেঘে ছাওয়া সিকিম পাহাড় বাদ দিয়ে এখন যদিও সবই মোটামুটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে তিস্তার কিনারায় বসতি, দশ নং জাতীয় সড়ক ধরে চলে যাওয়া গাড়ির স্রোত, তবে তা আকারে খুবই ক্ষুদ্র, যেন লিলিপুটদের একটা দেশ আছে নিচে।
-আরো কতদিন থাকবি?
ওর চিন্তা ভাবনায় ছেদ টেনে মধু জানতে চাইল। চোখের কোণ দিয়ে সুমন চেয়ে দেখল বেশ আগ্রহভরে মধু তাকিয়ে আছে ওর দিকে। শুধু যদি এই তাকানোটা কয়েক বছর আগে হত!
একবুক বিষাদের নিশ্বাস বেরিয়ে এল এই সুন্দর রোদ-ঝলমলে দিনেও। কতবার হ্যাঁ করতে করতেও হ্যাঁ বলেনি মধু। বোঝে ও, বেকার ছেলের সঙ্গে নিজের ভবিষ্যৎ জড়াতে ইতস্তত করছে সে। কিন্তু সবটা তো আর সুমনের হাতে নেই। ফলে দোলাচলেই দিন কাটছিল ওদের, মূলত মধুর।
-তা যদি না আমি ছাড়তে চাই, তাহলে বেশ কয়েক বছর থাকতে হতে পারে। হাসল সুমন, -এদিকে টেকনিক্যালি কোয়ালিফায়েড লোকজন বিশেষ কেউ আসতে চায় না। এলেই কিছুদিন থেকে ট্রান্সফারের চেষ্টা করে। আর মনে মনে বলল, “তবে আমার এদিকে থাকার ইচ্ছেটা এখন বেশ চাগিয়ে উঠেছে।”
-তাহলে তোকে এদিকে বেশ কিছুদিন থাকতে হতে পারে, কী বলিস?
চাপা খুশীর গলায় জানতে চাইল মধু। ওর গলায় সত্যি মধু ঢালা। পাগল করে দেওয়া এই গলা বহু দূর থেকেও, বা ভিড়ের মধ্যে শুনলেও অথবা বহুদিন পরে শুনলেও নিমেষে চিনে নিতে এতটুকু ভাবতে হবে না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেই গলা নিজেকে পরিবর্তন করতে শেখেনি। সেই বাচ্চা, খুশী-খুশী গলাটা একইরকম আছে।
-সেটাই আশা করছি। হাসিমুখে বলল সুমন, -এদিকে কেউ আসতে চায় না। অন্তত বেশিদিন থাকতে চায় না।
-এটাই আমাদের নিয়তি না? আচম্বিতে গম্ভীর হয়ে গেল মধু।
-মানে? মধুকে গম্ভীর হয়ে যেতে দেখে কেমন যেন ভড়কে গেল সুমন, গ্রেফ-এর স্মার্ট জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার সুমন মহন্ত। হেলান দেওয়া চেয়ারে ঠিক করে নিজেকে সাজিয়ে নিতে নিতে জানতে চাইল সে, -কিসের নিয়তি?
-লোকে পাহাড়ে বেড়াতে আসতে চাইলেও পোস্টিং নিয়ে বেশিদিন থাকতে চায় না। কিছুটা উত্তেজিত গলায় সে বলে চলল, -বেড়াতে ঘুরতে আসতে বল, সবাই এক পায়ে খাড়া। কিন্তু থাকতে বল, কেউ বেশিদিনের জন্য থাকতে রাজি নয়, যদি না তাকে বাধ্য করা হয়। এই ক’বছরে কত বাঙালি পরিবার এল, চলেও গেল। যাদের নেহাত পেটের তাগিদে থাকতে হয়, তাদের কথা বাদ দিলে আর কেউ স্বেচ্ছায় থাকতে রাজি নয়।
এই সেই মধু! ভাবছিল সুমন, সেই অল্পে রেগে যাওয়া মেয়েটি। রেগে গিয়ে দু’কথা শুনিয়ে দেওয়া বাচ্চা মেয়ের মতন হাবভাব তার এখনও বেশ বজায় আছে। মিষ্টি, নুন, লংকা মাখান আদুরে আদুরে রাগ তার। যাই হোক না কেন ওর উপরে বেশিক্ষণ রেগে থাকা যায় না।
ঠিক এই মধুকেই সে চাইত। ন্যাকামি, ন্যাকামি প্রেম নয়, বেশ বন্ধুত্বমূলক প্রেম ছিল। ছিল একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং। যেমনটা সে চাইত, মনে হয় তেমনটাই। শুধু নিজের কেরীয়ারটা যদি ঠিক সময়ে সুমন গুছিয়ে নিতে পারত! কিন্তু আর আক্ষেপ করে লাভ কী?
-তা তোর কেমন কাটছে?
আচম্বিতে সুমনের থেকে এমন একটা প্রশ্ন শুনতে হবে বলে মনে হয় মধু তৈরী ছিল না। বিনা কোন প্রয়োজনেই কামিজটা একটু ঠিক করে নিয়ে মুখটা নামিয়ে টেবিলের রেখে বলল,
-খারাপ না। তারপর মুখ তুলে নিরাসক্তভাবে বলল, -ওই সংসার যেমন চলে আর কি। থোড়-বড়ি-খাড়া।
ও মধুকে বিয়ে করলেও কি এমনটা হত? নাহ! একেবারেই না। মধুকে ও ছোটবেলা থেকেই জানে। একই পাড়াতে বড় হয়েছে। ও নিশ্চয়ই মধুকে “স্পেস” দিত, যেটা স্বাধীনচেতা মধুর দরকার। ওকে কিছুতেই গোমড়ামুখে থাকতে দিত না। নাকি সবার ক্ষেত্রেই এমনটা হয়? সাংসারিক জীবনে প্রেমের অপমৃত্যুর কথা চিন্তা করে শিউরে উঠল ও।
-তুই তাহলে এখানেই সেটলড? প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে সুমন নিজের মানসিক চিন্তা-ভাবনাকে অন্য খাতে আনার চেষ্টা করল।
-মেয়েদের আর গতি কী? দুধ-চিনি বিহীন কফি গেলার মতন তিক্ত মুখ করে মধু বলল, -যখন বিয়ে দেওয়া হয়েছে, তখন যার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গেই সেটল করতে হবে, বিশেষত সে যখন চাইবে, যেখানে চাইবে।
নাহ! এতটা দুঃখী মধু হত না ওকে বিয়ে করলে। ও নিশ্চিত। মধুর মতামতের দাম অবশ্যই দিত ও। গলাটা বাচ্চাদের মতন হলেও চিন্তাভাবনায় মধু ওর থেকে এগিয়ে। ঢের এগিয়ে, অন্তত মানসিক পরিণতিতে। আচ্ছা, সব মেয়েই কি তাই? তাদের দৈহিক পরিণতির সঙ্গে সঙ্গে মানসিক পরিণতিও কি ছেলেদের আগেই আসে? জানে না ও। তবে এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে মধু মোটেই খুশী নয়। আচ্ছা, সব বিয়ের ক্ষেত্রেই কি তাই হয়?
না, ওর সঙ্গে মধুর বিয়ে হলে এমনটা হত না। কোন মতেই না। তার প্রাপ্য সম্মান সে অবশ্যই পেত। মধুর দুঃখটা অন্তত বোঝার চেষ্টা করত সুমন। এবং প্রতিকারের চেষ্টা সে করতই। সময়ে চাকরী পাওয়া ছাড়া মানুষে পারে না, এমন জিনিস নেই, অন্তত ইচ্ছে থাকলে। মধুর বরের সেই ইচ্ছে মনে হয় একেবারেই নেই। তা, মধুকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখাই যাক না ওর মনের ইচ্ছেটা কী। মনে মনে একথা ভেবে নিয়ে সুমন জিজ্ঞেস করল,
-তুই কি এখানে থাকতে চাস না?
-বেশিদিন কি আর ভালো লাগে? তাই যখনই শুনতাম যে পরিচিত বাঙালী লোকজন চলে যাচ্ছে এই ছোট্ট পাহাড়ী শহরটা ছেড়ে, আরো একা হয়ে যাচ্ছি আমি, খারাপ লাগত খুব শুরুর দিকে। তবে, বলে ওর দিকে অপলক তাকিয়ে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে দ্রুত কিছু চিন্তা ভাবনা করে চলল সে। কপালে হাল্কা রেখার ছাপ ফুটে উঠল। মধু ঈষৎ রিক্ত বলল, -এখন অবশ্য গা সয়ে গেছে। মানুষ তো নিয়তির সঙ্গে সমঝোতা করে নেয়, কি বল?
-ঠিক।
কেমন একটা প্রতিবর্তক্রিয়ার মতন ওর গলা দিয়ে উত্তরটা বেরিয়ে এল, অস্ফুট উচ্চারণে। একটু আশার শিখা ক্ষণিকের জন্য জ্বলে উঠেছিল, কিন্তু সেটা নিভতে সময় নিল না। সমঝোতা ছাড়া জীবন যে অচল। এই যেমন ও নিজের সঙ্গে সমঝোতা করে নিয়েছে। এখনি আবার করল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমঝোতার সমষ্টির নামই জীবন।
ওর দিকে একটু ঝুঁকে আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করল মধু,
-কেমন চলছে অফিসে?
-ভালই। সুমন বলল, -আমার বস মেজর ভাণ্ডারী কাজের লোক। সদ্য এসেছেন, আমিও নতুন। বেশ একটা হৃদ্যতার সম্পর্ক আছে। রাস্তার কাজ দেখতে দেখতে লাভা আর ফাফেরখেতির মাঝে তাঁবু খাটিয়ে দু’জনে কত আড্ডাই না দিয়েছি।
-বাহ! ভালো তো। খুশীমুখে বলল মধু, -তুই তো মহা ওস্তাদ ছেলে। তারপরে প্রশ্ন করল, -বাড়ি কোথায় রে ওনার?
ওর দিকে জিজ্ঞাসু মুখে তাকিয়ে থাকল মধু।
-উনি গাড়োয়ালি, সুমন বলল, -আসল বাড়ি দেরাদুনে। তবে শিলিগুড়িতেই সেটল করবেন বলে শুনছি।
-আচ্ছা, বলে নিজের মনেই কিছু একটা হিসেব করে নিল মধু। পরক্ষণেই আগ্রহভরা গলায় জিজ্ঞেস করল, -কেমন লোক রে? পটে তোর সঙ্গে?
-উনি দারুণ লোক। খুব হেল্পফুল।
-তোর উপরে বেশ নির্ভর করেন, না?
“তোর উপরে আমার নির্ভরতার মতন না হলেও মন্দ নয়।” মনে মনে বলল সুমন। তাই মধু ডাকতেই সে চলে এসেছে। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিল যে সে লাভাতে এসেছে। বেশ কিছুদিন এদিকেই থাকতে হবে। সেটা দেখেই খোঁজ-খবর করেছিল মধু। যখন জানল যে আলগাড়া-লাভা-ডামডিম রাস্তার কাজ দেখতে সুমন এসেছে, তাকে বলেছিল কালিম্পংয়ে এলে ওকে বলতে। আজ একটা মিটিং-এ কালিম্পঙয়ে তাকে আসতে হল। মিটিং শেষ করে যথা সময়ে সে চলে এসেছিল কফি ক্লাবে। শহরের মধ্যেই অথচ ঠিক যেন প্রকৃতির কোলে। জায়গাটা মধুই আগে থেকে বেছে ওকে বলে রেখেছিল। মনে হল ওর, গাছ-গাছালির ছাওয়ায় ঢাকা আবছা রোদের পরশ মাখানো এই জায়গাটায় এলেই যেন মনের মধ্যে বসন্তের ছোঁয়া লাগবে, ন্যাড়া পলাশ গাছে রাঙা পলাশ ফুল ফুটে ওঠার মতন।
-বলতে পারিস আমাকে ছাড়া ওঁর চলে না।
গর্বের আভা ফুটে উঠেছিল ওর চোখে-মুখে। ওরও যে অবদান আছে, গুরুত্ব আছে এই কর্মমুখর সমাজে, সেটা দেরীতে হলেও লোকে জানছে দেখে ওর বুক ক্রমশ ফুলে উঠছিল। আর এ তো যে সে লোক নয়, খাস মধু। ওর স্বপ্নের মেয়েটি!
-একটা কাজ করে দিবি?
উৎকণ্ঠিত গলায় ওর দিকে আগ্রহভরা চোখে তাকিয়ে মধু বলে চলল, -আমার বরের একটা পেমেন্ট অনেকদিন থেকে ওঁর অফিসে আটকে আছে। আগের জনের সঙ্গে ডীল হয়েছিল, কিন্তু তিনি আচমকা চলে যাওয়ায় সব বন্দোবস্ত জলে গেল। ভাণ্ডারীসাহেবকে একটু বলে দিবি?
বলতে বলতে ওর দিকে উৎসুক চোখে ঝুঁকে এল মধু। কামিজটা একটু উপরের দিকে টেনে নিলে হয়তো ভালো হত। অবশ্য সেদিকে তার তখন কোন খেয়াল ছিল না। আর মধুকে অবাক দৃষ্টিতে ফ্যাল ফ্যাল করে দেখতে দেখতে সুমন বিরস বদনে শুধু বলতে পারল,
-সে কিছু একটা হয়ে যাবেখন।
তবে গলাটা তার কড়া কফির কারণে তেতো হয়ে গেছিল কিনা, ঠিক বোঝা গেল না।
………0………