-আচ্ছা, এই নদীটার নাম কী?
নুড়ি পাথর দিয়ে প্রায় সম্পূর্ণ পরিবৃত একটা ছোট্ট নদী দেখিয়ে জানতে চাইল মাধবী। এই গরমে তির–তির করে সামান্য জল বয়ে যাচ্ছে সেটাতে। সামনের পাহাড় দু’টির মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এসে সেটা ক্রমশ চওড়া হয়ে গেছে ভাটির দিকে। নদীটির দুই তীর পলাশ, কুসুম, মহুল, কেঁদ, ছাতিম, অর্জুন, শিরীষ আর ঘন ঝোপ-ঝাড় দিয়ে ঢাকা।
-জানি না। সজলবাবু বললেন , -এরকম অনেক নদী আছে অযোধ্যা পাহাড়ের কাছে-পিঠে। অনেকদিন আগে হয়তো জানতাম, কিন্তু এখন আর খেয়াল নেই।
-আচ্ছা, এত কম জল। মাধবী অবাক হয়ে বলল, -হিমালয়ের নদীগুলোতে কত জল থাকে সারাবছর। আর কী তার স্রোত!
-কিন্তু এই মালভূমি এলাকার নদীগুলির সৌন্দর্য এদের প্রস্তরাবৃত রিক্ততায়। সজলবাবু কিছুটা আবেগের স্বরে বললেন, -সেই সৌন্দর্য দেখার চোখ থাকা চাই যে!
-হতে পারে নদীটার নিচে হয়তো জলের অদৃশ্য প্রবাহ রয়েছে। মাধবী নাছোড় গলায় বলল, -যেমন পাহাড় থেকে নামার পর হিমালয়ের নদীগুলো তরাই-ডুয়ার্সের সমতলে এসে প্রথমে বালিতে অদৃশ্য হয়, কিছুদূর যাওয়ার পর আবার বালি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে।
-তা নয়। সজলবাবু বুঝিয়ে বললেন, -আসলে আমাদের মানুষদের মতন ওরাও স্বতন্ত্র।
কথাটা যে কত বড় সত্যি, তা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নইলে তো……।
(*)
ট্রেনটি হাওড়া থেকে ছাড়ে বেশ রাত করে। সজলবাবু খাওয়া-দাওয়া সেরে ধীরে-সুস্থে এসে দেখলেন যে ট্রেনটাকে প্ল্যাটফর্মে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ট্রেনের গায়ে লাগানো চার্টে নিজের নামটাকে একবার দেখে নিয়ে উঠে পড়লেন কামরায়। গিয়ে বসলেন নিজের সীটে। তাঁর সীট মাঝের বার্থে। ডানদিকে দেখলেন জানালার ধারের সীটে একটা মেয়েদের হ্যাণ্ড ব্যাগ ও জলের বোতল রাখা। বাঁদিকে প্যাসেজের দিকটায় কেউ বসে নেই। ভাল করে লক্ষ্য করে দেখলেন যে আপার বার্থে একজন শুয়ে পড়েছে, মনে হয় প্যাসেজের দিকের সীটের যাত্রী উপরে উঠে গেছে। বিপরীত দিকের সীটে এক-ই পরিবারের তিনজন বসে আছে বলে মনে হল। তারা খাবার-দাবার সাজাচ্ছে। ট্রেনটাও একটু পরে ছেড়ে দিল। ভাবলেন যে জানালার সিটের যাত্রী এসে তার লাগেজ সরিয়ে নিলে পর মাঝের সীট-এ তিনি নিজের বিছানা করে উঠে যাবেন। তাই তিনি বেশ আয়েশ করে নিজের সীটে জমিয়ে বসলেন।
আরাম করে বসে থাকতে থাকতে সম্ভবত একটু তন্দ্রামতন এসে গেছিল। তা ছাড়া রাতও হয়েছে। বয়সও হচ্ছে। হঠাৎ-ই শুনলেন মহিলা কণ্ঠে কেউ একজন বলছে,
-একটু পা-টা সরাবেন প্লীজ। আমি ভিতরে ঢুকে যাব।
কিছুটা চমকে উঠে তিনি পা দু’টি গুটিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসে আগন্তুকের দিকে ভালো করে তাকিয়েই একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন।
এ যে মাধবী!
পরনে রাতের পোশাক, চেহারার বয়সের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু ওকে চিনতে কি কোনকালে ভুল হবে তাঁর? অসম্ভব! মাধবীর সাথে প্রেম-বিবাহ-বিছেদ, সবকিছুই তাঁর এই যেন সেদিনের ঘটনা, এতই স্পষ্ট। মাধবীও চমকে উঠেছিল তাঁকে দেখে। ক্ষণকাল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ওঁর দিকে। ওর হাতে ধরা প্রসাধনসামগ্রীর ছোট্ট বাক্সটা পড়ে গেল অবশ হাত থেকে। পরক্ষণে সম্বিত ফিরতেই মাধবী নিচু হয়ে বাক্সটা কুড়িয়ে নিয়ে দ্রুতগতিতে হেঁটে নিজের সীটের কাছে এসে সীটের উপর রাখা হ্যণ্ড ব্যাগে বাক্সটা ঢুকিয়ে দিয়ে সেটা ওঁদের মাঝে রেখে দিল। তারপর নিস্পৃহ মুখে বসে পড়ল জানালার ধার ঘেঁষে। সজলবাবু চমকে উঠেছিলেন। নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে প্যাসেজের দিকে মুখ করে তাকালেন।
-আপনাদের টিকিটগুলো দেখাবেন প্লিজ।
সহসা খেয়াল হতে দেখলেন যে টিকিট চেক করতে করতে কালো কোট পরা টি.টি.ই. ভদ্রলোক এসে গেছেন। নিজের টিকিট-টা বের করে দিলেন তিনি। বিপরীতে থাকা পরিবারের কর্তাও টিকিট বের করে এগিয়ে দিলেন। আড়চোখে দেখলেন যে মাধবী তার হ্যাণ্ড ব্যাগ হাতড়াচ্ছে। সবার টিকিট চেক করে চললেন টি.টি.ই.। নিজের সীটে কাঠ হয়ে বসে টিকিট-টা টি.টি.ই.’র দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল মাধবী। কিন্তু সেটা টি.টি.ই.’র হাত পর্যন্ত পৌঁছায়নি, যদিও তিনি যথাসম্ভব হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেটা দেখে মাধবীর হাতে ধরা টিকিটের অন্যদিকটা ধরে সেটাকে টি.টি.ই.’র সামনে পেশ করলেন সজলবাবু। তারপর টিকিট চেক করা হলে পর গম্ভীর মুখে সেটাকে এগিয়ে দিলেন মাধবীর দিকে। কঠিন মুখে সেটাকে হাতে নিয়ে হ্যান্ডব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল মাধবী। একটু পরে সেই পরিবারটির রাতের খাওয়া শেষ হয়ে গেল। তারা বাথরুম থেকে ঘুরে এসে ফ্রেশ হয়ে তিনটি সীট-এ কম্বল-বেড শীট দিয়ে বিছানা তৈরি করে ওঁদের দু’জনের অনুমতি নিয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। অনতিবিলম্বেই তাদের নাসিকা গর্জন শোনা যেতে লাগল।
(*)
শক্ত মুখে দু’জনেই বসে ছিলেন তাঁদের জায়গায়। মাঝে মাঝে আড়চোখে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিলেন। দু-একবার তো আড়চোখের চোখাচোখি হয়ে গেল। সে সময়ে দু’জনেই দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়ে পূর্বেকার ন্যায় নিস্পৃহ মুখে তাকাচ্ছিলেন অন্য দিকে। তবে বলা বাহুল্য যে কৌতূহল তাঁরা কেউ দমন করতে পারছিলেন না। অন্তত সজলবাবু তো নন’ই!
সজলবাবুর মনে পড়ে যাচ্ছিল আজ থেকে দু’দশক আগের সেই দিনটা, যেদিন তাঁরা মধুচন্দ্রিমায় যাচ্ছিলেন শিলং। ট্রেনে গৌহাটি গিয়ে সেখান থেকে গাড়িতে করে যেতে হবে। সেদিন ট্রেনে অনেক রাত জেগে দু’জনে প্রচুর গল্প করে ছিলেন। এখন দু’জনের বয়স হয়েছে। তাছাড়া অনেকদিন হল তাঁদের গতিপথ আলাদা হয়ে গেছে। তাহলে? ক্লান্ত শরীরে এখন ঘুম দরকার। অবশেষে কিন্তু কিন্তু করে মাধবী কে উদ্দেশ্য করে ভাববাচ্যে বলে উঠলেন সজলবাবু,
-এবার শুয়ে পড়া যাক।
কোন উত্তর না দিয়ে নিজের জায়গা থেকে উঠে দাঁড়াল মাধবী। উনি হেলান দেওয়ার সীটটাকে তুলে ধরলেন- প্রথমে প্যাসেজের দিকের চেনটাকে আটকালেন। তারপর মাধবীর দিকে এগিয়ে এলেন ভিতরের দিকের চেনটাকে শোবার সীটে আটকানোর জন্য। সহযাত্রী পরিবারটির অনেক লাগেজ ছিল জানালার ধারে, তাই মাধবীকেও জানালার দিক ছেড়ে খানিক এগিয়ে আসতে হয়েছিল। মাধবীর শরীরের পূর্বের সেই মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে লাগছিল। সেই একই পারফিউম! আচ্ছা, আজ কি মাধবীও তাঁর গন্ধ অনুভব করছে?
সীট-এ চেনটা বাঁধতে গিয়ে বাঁ-হাতের কনুইটা মৃদু ধাক্কা দিয়ে গেল মাধবীর বুকে। অনেকদিন আগে হলে তাঁরা হাসি-ঠাট্টা করতেন ব্যাপারটি নিয়ে। বহুবার মজা করে এমনটা করেছেনও, অথচ ভান করতেন যেন অলক্ষ্যে, অনিচ্ছায় এমনটা হয়ে গেছে। কিন্তু এখন বিচ্ছেদের পর দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেছে।
আজ দু’জনে আইনত ততটাই পর যতটা পর দু’জন অপরিচিত নারী-পুরুষ।
-দুঃখিত।
বলে সরে এসে দ্রুত হাতে মাঝের বার্থে নিজের বিছানা সাজিয়ে ফেললেন সজলবাবু । তারপর টয়লেট থেকে ঘুরে এসে মাঝের সীটে উঠে শুয়ে পড়লেন তিনি। গায়ে অন্য বেড শীট-টা। তাঁকে নিশ্চল হয়ে শুয়ে পড়তে দেখে মাধবীও টয়লেট থেকে ঘুরে এসে বিছানা পাতার উপক্রম করল। মাথার দিকের বিছানাটা টেনে ঠিক করতে গিয়ে সেই পরিবারের ফেলে রাখা একটা লাগেজে পা পড়ে হঠাৎই ব্যালান্স হারিয়ে মাধবীর মাথাটা ঠুকে গেল জানালার পাশে কিছুটা বেরিয়ে থাকা একটা স্ক্রু-তে।
-আহ!
আচম্বিতে আর্তনাদটা বেরিয়ে এল মাধবীর মুখ দিয়ে। তারপর হাত দিয়ে বাঁ দিকের কপাল ঢেকে বসে পড়ল তার সীটে। আচম্বিতে মৃদু আর্তনাদ শুনে সজলবাবু তড়িৎগতিতে মাঝের বার্থ থেকে নেমে আসলেন নিচে। দ্রুত নামতে গিয়ে তিনিও জোরে একটা গোঁত্তা খেলেন লোহার চেনের ভারী স্ক্রু-তে।
-আহ!
শব্দটা প্রতিবর্তক্রিয়ার মতন বেরিয়ে এল তাঁর মুখ দিয়ে। তবে সেটা গ্রাহ্য না করে নিচে নেমে প্রথমে আলো–টা জ্বাললেন। দেখলেন যে মাধবী কপাল হাত দিয়ে ঢেকে বসে।
-দেখি কী হল?
ওঁর গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যাতে মন্ত্রমুগ্ধের মতন মাধবী কপালের কাটা জায়গা থেকে হাত-টা সরাল। উনি দেখলেন যে বাঁ-দিকের ভুরুর একটু উপরে কপালে খানিকটা কেটে গেছে। ভাগ্যে চোখের কোন ক্ষতি হয় নি। বিপদ তো আর বলে কয়ে আসে না। কাটা জায়গাটা থেকে হাল্কা রক্ত বের হচ্ছে। মাধবীর হাতে রক্ত লেগেছে। দ্রুতহাতে নিজের ব্যাগ থেকে অ্যান্টিসেপটিক লোশনটা বের করে তুলোতে মাখিয়ে নিয়ে সেটা চেপে ধরে থাকতে বললেন কপালের কাটা স্থানে। মাধবী তুলোটা নিয়ে চেপে ধরল কাটা জায়গাটাতে। তারপর চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দিল সীটে। এতক্ষণে নিজের দিকে তাকাবার ফুরসুত পেলেন সজলবাবু। নিজের মাথার মাঝখানটা বেশ ব্যথা ব্যথা করছে। ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে তুলোতে করে খানিকটা জল নিয়ে চেপে ধরলেন মাথার মাঝখানে। তারপর শ্রান্ত সজলবাবু আলোটা নিভিয়ে মাথা বেশ নিচু করে বসে পড়লেন মাধবীর পাশে।
(*)
বেশ কিছুটা সময় এইভাবেই কেটে গেল। প্যাসেজের নাইট লাইটের আলোতে একে অপরের উপস্থিতিটা বুঝতে পারছিলেন কেবল। এমন সময় মুখ খুলল মাধবী। উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল,
-তোমার মাথায় কী হল?
ঠিক এমনি করেই আজ থেকে দু’দশক আগে পা-পিছলে চেরাপুঞ্জীর চুনাপাথরের গুহাতে পড়ে গিয়ে একটা পাথরে লেগে কপাল ঈষৎ কেটে গিয়েছিল সজলবাবুর। সেবারে কয়েকটা সেলাই দিতে হয়েছিল। মাধবীর গলায় মনে হল সেই হারানো দিনের পুরোনো উৎকণ্ঠা ফিরে এসেছে। ক্লান্ত গলায় জবাব দিলেন সজলবাবু,
-তেমন কিছু না। মাথাটা একটু ঠুকে গেছে। রক্তারক্তি কিছু হয় নি। তারপর একটু থেমে উদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞেস করলেন, -তোমার রক্ত পড়া বন্ধ হল?
–থেমেছে মনে হচ্ছে। তবে খুব একটা কাটেনি। একটু থেমে বলল মাধবী, -যদিও বেশ ব্যথা রয়েছে।
-আমার কাছে পেন-কিলার আছে, খাবে……? দাঁড়াও বের করছি। বলে সীট থেকে নামলেন সজলবাবু ।
-থাকগে, ছেড়ে দাও……। অনিচ্ছুক গলায় মাধবী আপত্তি জানিয়ে বলল, -এই সামান্য ব্যথার জন্য ওষুধ খাওয়ার কোন মানে হয় না।
তবে ওর গলার স্বরে মনে হল অনিচ্ছার মাত্রাটা কম।
-খেয়ে নাও। সজলবাবু একটু জোরের সঙ্গে বললেন, -চলো দু’জনে একটা করে খেয়ে নিই, তাতে ব্যথা কমবে। আর রাতের ঘুমটা ভাল হবে।
-দাও তাহলে একটা ……। মৃদু স্বরে মাধবী বলল।
উঠে ব্যাগ থেকে ওষুধ বের করে মাধবীর দিকে একটা ট্যাবলেট ও নিজের জলের বোতলটা এগিয়ে দিলেন সজলবাবু। ওঁর হাত স্পর্শ করে ওষুধটা হাতে নিয়ে মুখে ফেলে দিল মাধবী। তারপর বোতলের ছিপি খুলে একঢোক জল খেয়ে নিয়ে বোতলটা ফিরিয়ে দিল। আবার হাতে-হাত ঘষে গেল দু’জনের। একসময় এইরকম ও অন্যরকমভাবে কত হাতে হাত ঘষে গেছে দু’জনের, তবে দিনগুলি অনেক আগের! কত মজা ঠাট্টা করেছেন তা নিয়ে একসময়। অথচ…আজ…। ভাবনা-চিন্তা দূরে সরিয়ে নিজেও একটা ওষুধ খেয়ে নিলেন সজলবাবু।
-তা তুমি যাচ্ছ কোথায়? হুঁশ ফিরল মাধবীর প্রশ্নে। আধো অন্ধকারে ও তাকিয়ে আছে তাঁর দিকেই।
-চান্ডিলে, সেজ-কাকার শ্রাদ্ধে। তারপর একটু থেমে প্রশ্ন করলেন -তুমি?
-আমি যাচ্ছি চক্রধরপুর। তা, তুমি তাহলে তোমাদের আদি বাড়িতে যাচ্ছ?
-হ্যাঁ। বলে কিঞ্চিত থমকালেন সজলবাবু। ওঁদের বিয়েটা দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। তাইত মাধবীকে কোনদিন নিয়ে যেতে পারেন নি নিজেদের গ্রামে। বললেন -ট্রেনটা সকাল সাড়ে সাতটা কি আটটার আগে ঢুকবে না চান্ডিলে। তারপর একটু থেমে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, -এখন একটু ভাল লাগছে?
-অনেকটাই ভাল লাগছে! একটু জোর দিয়েই বলল মাধবী।
-তুমি তাহলে শুয়ে পড়। সজলবাবু বললেন, -সকালে বেশ ঝরঝরে লাগবে।
-ঘুমটা কেটে গেল। তাছাড়া আমার তো শেষ স্টেশন। তাই তাড়া নেই আমার। তারপর একটু বিরাম দিয়ে মাধবী বলল, -তুমি বরং শুয়ে পড়। সকালেই তো তোমাকে নামতে হবে।
-আমার সকালে ওঠার অভ্যাস আছে। সজলবাবু বললেন, -আমারও ঘুমটা কেটে গেল। কিছুক্ষণ সময় লাগবে ঘুম পেতে। ততক্ষণ না হয় একটু বসে থাকি। তারপর একটু প্রগলভ সুরে বললেন, -অবশ্য তোমার অসুবিধে না হলে!
-আমার আর আপত্তির কী আছে? মাধবী বলল, -অনেকদিন পর তোমার সাথে দেখা হল। দু’টো কথা তো হতেই পারে।
-তুমি তা হলে শীলপাড়াতেই আছ? সজলবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
-হ্যাঁ। আর কোথায় যাব? তা তুমি?
–আমিও সাহাপুরে। সেই ভাড়া বাড়িটা বাড়িওয়ালা মারা যাওয়ার পর ওর ডেনমার্কবাসী ছেলের কাছ থেকে কিনে নিয়েছি। একটু হাত-পা ছড়িয়ে থাকব বলে আর ফ্ল্যাটের রাস্তায় হাঁটিনি। বেশ গর্বিত শোনালো সজলবাবু শেষ দিকের কথাগুলো।
-তা বটে। একটু থেমে মাধবী যোগ করল, -তুমি যেরকম আয়েশ করে থাকতে ভালবাসতে, তাতে করে এমনটাই হওয়া উচিত ছিল।
-হয়তো। আসলে নিজেকে চিনতে পারি না আমরা। অন্যকে বা পারিপার্শ্বিকতা দিয়েই নিজেদেরকে চিনতে হয়। একসঙ্গে এতটা বলে সজলবাবু একটু থামলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, -তা তুমি কী তোমার সেই মেম-মাসির কাছে চলেছ?
-তোমার বেশ মনে আছে তো! সপ্রশংস দৃষ্টিতে ওঁর দিকে তাকাল মাধবী। তারপর গর্বিত কণ্ঠে বলল, -ওঁর এমন দুধে-আলতা রং যে, ওখানে অনেকেই ওঁকে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ঘরের মেয়ে বলে ভাবত।
-ভাল! তা এখনও তিনি সুস্থ আছেন দেখে সত্যি ভাল লাগছে।
-বেঁচে আছেন বটে, তবে শরীর খুব দুর্বল। তাছাড়া অ্যালঝাইমার্স ওঁকে ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছে। ভারাক্রান্ত গলায় মাধবী বলল, -মা বাবা চলে গেলেন। মাসি-পিসিরাও এক এক করে পা বাড়াচ্ছেন চির-প্রস্থানের পথে। কাছের লোক বলতে আর ক’জনই বা টিকে আছে আমার?
শেষদিকে ওর গলার স্বরটা আবেগে ধরে এল। খারাপ লাগছিল সজলবাবুর। আর কথা চালিয়ে গেলে মাধবী হয়তো কেঁদেই ফেলবে। সেই ধরনের সীন-ক্রিয়েট তিনি চান না। আবেগ ওর মধ্যে চিরদিনই বেশি। আবেগের বশে ওই তো প্রথম সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল। স্থির স্বরে তিনি বললেন,
-অনেক রাত হয়েছে। চলো শুয়ে পড়া যাক। আর কিছু না হোক, শরীর খারাপ হবে রাত জাগলে।
বলে বিষাদাচ্ছন্ন মাধবীকে একলা রেখে বাথরুম থেকে ফিরে এসে শুয়ে পড়লেন নিজের বার্থে।
(*)
ঘুমটা অন্যদিনের মতন আজও ভোরেই ভেঙেছিল। মোবাইলটা অন করে দেখলেন যে সকাল ছ’টা বাজে। বার্থ ছেড়ে নেমে জলের বোতল, ব্রাশ, পেস্ট নিয়ে গিয়ে দাঁত-মুখ মেজে এলেন সজলবাবু। ফিরে দেখলেন মাধবী তখনও ঘুমোচ্ছে। বিপরীতদিকের সেই তিনজনের পরিবার, আপার বার্থ ও সাইড বার্থের সেই ব্যক্তিরা ট্রেন থেকে নেমে গেছে। সাইড বার্থের একটা সীটে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন তিনি।
বাইরে তখন দৃশ্যপটের প্রভূত পরিবর্তন হয়েছে। অনেকদিনের অভ্যস্ত চোখে দেখা কোলকাতার বা শহরতলীর সমতলভূমি আর দেখা যাচ্ছে না। নেই পূর্বের অগুন্তি জলাশয় বা ঘন জনবসতি। শস্য-শ্যামলা মোটেই বলা যাবে না এই জায়গাগুলিকে। পরিবর্তে চোখে পড়ে সুদীর্ঘ ফাঁকা ফাঁকা মোটা মোটা আল বিশিষ্ট উঁচু-নিচু জমি, মাঝে মাঝেই যা ভেদ করে পাথর বেরিয়ে এসেছে। নজরে পড়া দু-একটি জলাশয়গুলিতে জল খুব কমে এসেছে। জনবসতি সে রকম একটা চোখে ঠেকে না। শস্যবিহীন প্রান্তরের মাঝে ছোট-ছোট খেজুর, তাল আর পলাশের সমারোহ। হঠাৎ হঠাৎ দেখা যায় পলাশের ছোট ছোট জঙ্গল। নেড়া বা বৃক্ষবিরল পাহাড় কাছে–দূরে একা একা নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে। উঁচু-নিচু পিচ ঢালা বা মোরামের রাস্তা সর্পিল গতিতে এঁকে–বেঁকে হারিয়ে গেছে দূরের প্রান্তরে বা কোন অচেনা জনবসতিতে। এই লালমাটির ঢেউখেলানো পাথুরে এলাকাতেই তো তাঁর জন্ম। নিজের এলাকা……। অথচ……। এত পর পর মনে হয় এখন…। এভাবেই তো একদিন মাধবী পর হয়ে হারিয়ে গেছে তাঁর জীবন থেকে। ভাবতে ভাবতে মনটা ক্রমশ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল সজলবাবু।
(*)
ট্রেনের গতি কমে এসেছিল। তাকিয়ে দেখলেন ট্রেনটা প্রবেশ করছে অনুচ্চ টিলার উপরে অবস্থিত একটা ছোট্ট স্টেশনে- নাম তার বাগালিয়া। এরপর আরও ছোট্ট ছোট্ট দু’টি স্টেশন এল- কুস্তাউর ও ছররা। সামান্য কিছু লোক নামল ট্রেন থেকে।
কিছুক্ষণ পর ট্রেনটা পুরুলিয়া স্টেশনে ঢুকল। একরাশ যাত্রী নেমে গেল পুরুলিয়ায়। তারপর সবে ট্রেনটা চলতে শুরু করেছে, এমন সময় ওঁর কাঁধে আলতো করে টোকা পড়ল। ফিরে দেখলেন ঘুমচোখে দাঁড়িয়ে মাধবী। তন্দ্রাছন্ন কণ্ঠে সে জিজ্ঞেস করল,
-কোন স্টেশন গেল?
-পুরুলিয়া। তুমি হাত- মুখ ধুয়ে নাও। তারপর কিছু খেয়ে নেওয়া যাবে।
একটু পরেই হাত মুখ ধুয়ে চলে এল মাধবী। ততক্ষণে উনি তাঁর মাঝের বার্থ-টি গুটিয়ে ভাল করে বসার জায়গা করে নিয়েছেন। এবার সজলবাবু ব্যাগ থেকে দু’টি কেক বের করলেন। মাধবী বের করল কিছু বিস্কুট আর চিপস। তাঁদের খাওয়ার মাঝপথেই ট্রেনটা এসে থামল একটা ছোট্ট স্টেশনে। খানিক পরে তাঁরা খাওয়া দাওয়া শেষ করলেন। কিন্তু সজলবাবু অবাক হয়ে দেখলেন যে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে। এগোচ্ছে না মোটেই! হয়তো সিগন্যাল পায় নি। কিন্তু এভাবে আরো আধ ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। তাঁদের কামরার এক যাত্রী সম্ভবত ট্রেন থেকে নেমে খোঁজখবর করতে গিয়েছিলেন। তিনি আসতে আসতে প্যাসেজের দিকে থাকা সজলবাবুর দিকে চেয়ে বললেন,
-এর পরের কাঁটাডি স্টেশনে ঢোকার মুখে আক্সিডেণ্ট করে উল্টোদিক থেকে আসা একটা মালগাড়ির কয়েকটা কামরা লাইনচ্যুত হয়ে গেছে। আপ-ডাউন, দু’টো লাইনেই ট্রেন চলা-চল বন্ধ করে দিয়েছে। এই ট্রেন-টা কখন এই টামনা স্টেশন থেকে ছাড়বে, ঠিক নেই। বলে তিনি এগিয়ে গেলেন তাঁর সীটের দিকে।
দেখতে দেখতে আরও কিছুক্ষণ এভাবে কেটে গেল। এমন সময় দেখলেন যে তাঁদের পাশ দিয়ে সেই যাত্রী ও আরও কয়েকজন তাঁদের কিছুটা ভারী মালপত্র নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন দরজার দিকে। সজলবাবুরা অবাক হয়ে তাকাতেই সেই ভদ্র লোক উপযাচক হয়ে বললেন,
-চললাম দাদা। হাইওয়ে থেকে বাসে বা ভাড়া গাড়িতে চলে যাব। এই ট্রেন তো বিকেলের আগে আর ছাড়বে না।
-ঠিক মতন খোঁজ-খবর নিয়েছেন তো দাদা? সজলবাবু জিজ্ঞেস করলেন, -ট্রেনটাকে পিছিয়ে নিয়ে পুরুলিয়া-মুরি-সুইসা-চাণ্ডিল রুট দিয়েও তো নিয়ে যেতে পারে।
-আপনি হাসালেন দাদা। মৃদু হেসে সেই ভদ্রলোক বললেন, -এই ট্রেনটার প্রায় সব যাত্রীই নেমে গিয়েছে। পুরুলিয়া-আদ্রার যাত্রীরাই মূলত ভিড় জমায় এই ট্রেনে। কাদের কথা ভেবে রেল অতটা ত্যাগ স্বীকার করবে? তাছাড়া আমি যাব বলরামপুর। কী দরকার এতক্ষণ অপেক্ষা করে? আপনারাও চলুন আমাদের সাথে, হাইওয়ের উপর থেকে বাস বা কোন গাড়ি ধরিয়ে দেব। বিকেলের আগে আর এটা ছাড়ার পরিস্থিতিতে নেই।
-চক্রধরপুর যাওয়ায় বাস পাওয়া যাবে এদিক থেকে? পাশ থেকে মাধবী জানতে চাইল।
-না দিদি। তবে চাণ্ডিল বা টাটা যাওয়ার বাস পেয়ে যাবেন। সেখান থেকে চক্রধরপুর চলে যেতে পারবেন। তবে তার আগে পুরুলিয়া বাস স্ট্যান্ডে আপনাদের যাওয়া দরকার। এতটা পথ। ওখান থেকে সীট পেয়ে ভালভাবে বসে যেতে পারবেন। আমাদের তো সামান্যই পথ।
-ঠিক আছে দাদা, ধন্যবাদ। আপনারা এগোন, আমরা একটু আলোচনা করে নিই। বলে সজলবাবু কথায় ইতি টানলেন।
দু’জনে মিলে খানিক আলোচনা করে নিলেন। ততক্ষণে জানালা দিয়ে তাঁরা দেখতে পাচ্ছিলেন যে প্যাসেঞ্জারেরা ক্রমশ এই ট্রেনটা ছেড়ে বাস রাস্তার দিকে এগিয়ে চলেছে। বিকেল বা সন্ধ্যা পর্যন্ত এই ট্রেনটাতে বসে থাকার কোন মানে হয় না। ঠিক হল, বাথরুম সেরে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়বেন দু’জনে। সজলবাবুর সাথে চাণ্ডিল গিয়ে সেখান থেকে চক্রধরপুর যাওয়ার বাস বা ট্রেন ধরবে মাধবী- শেষমেশ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন দু’জনে। মনে পড়ল সজলবাবুর, বিয়ের পর মাধবীকে বলেছিলেন যে চাণ্ডিলের সুবর্ণরেখা বা পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় ঘুরিয়ে দেখাবেন সময় করে। কিন্তু……। ভাবনা মনেই রেখে লাগেজ গুছিয়ে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন তিনি। মাধবী তাঁকে অনুসরণ করল।
(*)
ট্রেন থেকে স্টেশনে নেমে আপ-এর প্লাটফর্ম ছেড়ে ডাউন-এর প্লাটফর্মে চলে এলেন দু’জনে। দূরে, পশ্চিমে দেখা যাচ্ছিল উল্টানো শঙ্কু আকৃতির একটা পাহাডের চূড়া আর সন্নিহিত পাহাড়সারি।
-অযোধ্যা পাহাড়!
সেদিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে বললেন সজলবাবু। দু’জনে খানিকক্ষণ হেঁটে চলে এলেন বত্রিশ নং জাতীয় সড়কের উপরে। সময়টা মে মাস। সূর্য ভালই উত্তপ্ত করছিল বিশ্ব চরাচর। পুরুলিয়া শহরের দিকে মুখ করে দাঁড়াতেই একটা ফাঁকা গাড়ি পেয়ে গেলেন। ড্রাইভার দু’জনের থেকে মোট একশ’ টাকা ভাড়া চাইল পুরুলিয়া বাস স্ট্যান্ড নিয়ে যাওয়ার জন্য। গাড়িতে উঠতে উঠতেই তাঁরা দেখছিলেন যে দলে দলে লোক চলেছে সাইকেলে, বাইকে এমনকি কেউ পায়ে হেঁটে। অনেকেই আদিবাসী অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত। কারুর গলায় ঝুলছে ঢাক।
-ওরা চলেছে অযোধ্যা পাহাড়ে, শিকার উৎসবে।
বুঝিয়ে বললেন সজলবাবু, বৈশাখি পূর্ণিমার দিন অযোধ্য পাহাড়ে শিকার উৎসব হয়। সাথে চলে পুজো-আচ্চা। শুধু সাঁওতাল সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরাই নয়, আশ-পাশ থেকে অনান্য আদিবাসী আর অ-আদিবাসী লোকেরও ভিড় করে আসে শিকার উৎসবে সামিল হতে। এমনিতে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকেরা অহেতুক পশুহত্যা করে না। তবে আজকের দিনটি ব্যতিক্রম। এইদিন শুধু পশিমবঙ্গ নয়, ঝাড়খণ্ড-বিহার-উড়িষ্যা থেকেও লোকেরা শিকার উৎসবে অংশ নেওয়ার জন্যে আসে। তবে শিকার আজকাল আর বিশেষ পাওয়া যায় না। উৎসব উপলক্ষে জমিয়ে খাওয়া-দাওয়া, আনন্দ-ফুর্তি হয়। অনেকের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ, যোগাযোগ হয়। তাই দূর-দূরান্ত থেকেও লোকেরা আসে উৎসবে যোগদান করতে ।
-এক কাজ করলে হয় না? মাধবী অনুরোধের ভঙ্গীতে বলল, -আমি আবার কবে এদিকে আসব, আদৌ আসব কিনা জানি না। অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল অযোধ্যা পাহাড়ে যাব। চলো না, আজকে সারাটা দিন কাটিয়ে আসি অযোধ্যা পাহাড়ে। এরকম একটা উৎসবের দিন একটু উপভোগ করে নি। বয়স হচ্ছে……শরীরও আর ভাল থাকে না সবসময়। কবে যে কী হয়?
-কিন্তু তুমি চক্রধরপুর যাবে কী করে? উদ্বিগ্ন গলায় সজলবাবু জানতে চাইলেন, -এটা না পেলে সন্ধ্যার আগে আর ট্রেন নেই চক্রধরপুর যাওয়ার।
-ফিরে এসে এই ট্রেনটাই ধরার চেষ্টা করব। না পেলে রাতের অন্য কোন ট্রেন ধরব। কোন অসুবিধে নেই আমার। তারপর একটু থেমে ওঁর চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল, -তোমার?
-আমারও কোন অসুবিধে নেই। সজলবাবু একঝলক ভেবে বললেন, -চাণ্ডিল যাওয়ার একগাদা ট্রেন-বাস আছে।
এই গাড়িওয়ালাই রাজি হল অযোধ্যা নিয়ে যেতে। তবে টাকা একটু বেশিই চাইল বলে মনে হল সজলবাবুর। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে শিকার উৎসব উপলক্ষে গাড়ির চাহিদা তুঙ্গে। তা ছাড়া উগ্রবাদীরা একটু স্তিমিত হয়ে পড়াতে এই সময়ে অনেকেই বেড়াতে আসে অযোধ্যা পাহাড়ে।
অগত্যা……।
ততক্ষণে কাঁসাই ব্রিজ পেরিয়ে পুরুলিয়া শহরের উপকণ্ঠে চলে এসেছিল গাড়িটা। গতিপথ উল্টে কাঁসাই নদীর ব্রিজ আবার অতিক্রম করে টামনা মোড় হয়ে জাতীয় সড়ক ছেড়ে ডানদিকের রাজ্য সড়কে ঢুকল গাড়িটা। উঁচু-নিচু অথচ মসৃণ পিচ ঢালা রাস্তা পেরিয়ে বেশ অনেকক্ষণ চলার পর সিরকাবাদ এল গাড়িটা। এরপর কিছুক্ষণ দু’পাশে আখের খেত। সেটা পেরিয়ে শুরু হল পাহাড়ি পথে উত্তরণ।
(*)
ধীরে ধীরে পাহাড়ি পথ বেয়ে গাড়িটা উঠছিল উপরে। সারাটা পথ শিকার উৎসবে যোগদানকারীদের ভিড়ে ভর্তি। রাস্তা মোটামুটি ভাল, কয়েকটা জায়গা ছাড়া। কিছু স্থানে রাস্তা বিশেষ প্রশস্ত নয়। বিপরীত দিক থেকে আসা একটা বাসকে জায়গা দিতে খানিকটা পিছিয়ে আসতে হল ওদের গাড়িটাকে। তবে মুগ্ধ চোখে চেয়ে ছিলেন তাঁরা বাইরের দৃশ্যাবলীর দিকে। ছোট-বড়, মাঝারি- চারদিকে শুধু অরণ্যাবৃত পাহাড় আর পাহাড়! ছাতিম, অশোক, শিমুল, কেঁদ, অর্জুন, পাকুড়, নিম, বয়ড়া গাছে ছেয়ে আছে গোটা পাহাড়। তবে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে পলাশ। ছোট-মাঝারি-বড় নানান আকারের পলাশ গাছ সারাটা এলাকা জুড়ে। আর সাথে কুটুস ও ধুতুরার ঝোপ গজিয়ে উঠেছে সর্বত্র। মাঝে মাঝে ছোট-খাট ঝরনা। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর জনবসতি শুরু হল। ওঁরা এসে পৌঁছলেন সমতল মতন একটা জায়গায়।
-একে বলে হিল টপ, সজলবাবু বললেন। বেশ খানিকটা এরকম আধা-সমতল থাকবে। তারপরে শুরু হবে উতরাই। আসলে অযোধ্যা পাহাড় মালভূমি বিশেষ, ঝাড়খণ্ডের দলমা পাহাড়ের একটা অংশ। উল্টোনো বাটির মতন দেখতে এই মালভূমি।
-বেশ বই পড়া বিদ্যে দিচ্ছ আজকে? ইষৎ হাসির সুরে মাধবী বললে।
-আরে, এ তো আমাদের নিজেদের দেশ। সজলবাবু হাসতে হাসতে বললেন, -বইয়ের চেয়ে ভাল জানি আমরা এসব এলাকা। চলো আজকে তোমাকে এই পাহাড়-টা ভাল করে ঘুরিয়ে দেখাই। আমার যদিও দীর্ঘদিন আসা হয় নি এদিকে। তবে মনে আছে কিছু কিছু।
(*)
পিঠে বা হাতে তীর–ধনুক, বর্শা, ভল্ল, কুঠার, কোঁচ, তরোয়াল নিয়ে হেঁটে, সাইকেলে বা ছোট গাড়িতে করে চলেছে নানা বয়সের শিকারিরা। কেউ প্রৌঢ়, কেউবা যুবক আবার কাউকে দেখে মনে হচ্ছে যে সে স্কুলে পড়ে। হিলটপ গ্রাউন্ড বলে প্রশস্ত ফাঁকা মাঠটির অদূরে একটা খাবার দোকানে ঢুকলেন দু’জনে। ড্রাইভারও এসে ওঁদের সাথে বসল- বলা ভাল ওঁরাই ডেকে নিলেন।
-এখন কোথায় যাওয়া ভাল হবে ভাই? সজলবাবু জানতে চাইলেন, -সরাসরি উৎসবের মাঠে?
-যেখানে বলবেন দাদা, ড্রাইভার দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলল, -ঝরনাগুলো দেখে নিয়ে পরে উৎসবের মাঠে যেতে পারেন। এখন তো গরমের সময়। বেশী দেরী করলে বাইরের রোদে ঘোরাঘুরি করা কষ্টকর হয়ে যাবে।
-তাহলে চলুন। খানিক দূরের বামনি ঝরনাটা দেখে আসি। সজলবাবু মাধবীর দিকে তাকিয়ে বললেন, -অসুবিধে নেই তো?
–কি যে বলো? অনেকদিন পাহাড়ে বেড়াতে যাইনি। মাধবী বলল -আজ দারুণ লাগছে।
খাওয়া দাওয়া করে নিয়ে কয়েকটা জলের বোতল কিনে দু’জনে গাড়িতে উঠে পড়লেন। শিকার উৎসবে আসা লোকেদের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে জায়গা করে নিয়ে উঁচু-নিচু পিচ ঢালা রাস্তা দিয়ে ওঁদের গাড়ি এগিয়ে চলল। খানিক পর দেখা গেল লোক-জন পিচ রাস্তা ছেড়ে বাঁ দিকে মাটির একটা রাস্তায় ঢুকছে। আর সামনের পিচ রাস্তাটা প্রায় ফাঁকা।
-লোক জন সব যাচ্ছে কোথায় যাচ্ছে ওদিকে? মাধবী জিজ্ঞেস করল, -ওদিকে কি মেলা বসেছে?
–হ্যাঁ, ওরা যাচ্ছে সুতানতান্ডির মাঠে। মেলা ওদিকেই। ওই মোড় থেকে খানিকটা যেতে হয়। সেখানে একটি আদিবাসী বসতি আছে। আর পাশেই জঙ্গল। সজলবাবু হাত নেড়ে বোঝাতে বোঝাতে বললেন, -শিকার উৎসব নিমিত্ত মাত্র। এই উপলক্ষে নানান জায়গা থেকে লোকজন এদিকে এসে মিলিত হয়। আদিবাসী বা অ-আদিবাসী বলে কোন ভেদা-ভেদ থাকে না। স্নান, পিকনিক, হই-হুল্লোড়, ভ্রমণ- এইসবে কোথা দিয়ে যে দিনটা কেটে যায়, কেউ বুঝতেই পারে না। শেষে একরাশ স্মৃতি নিয়ে ঘরে ফেরে।
-তাহলে দেরী করব না। মাধবী উৎসাহী গলায় বললেন, -চলো তাড়াতাড়ি ঝরনা-টা দেখে আসি। এরপর মেলায় গিয়ে ঘুরব।
-আগে কিন্তু মেয়েদের মেলায় আসার অনুমতি ছিলনা। এখনও আদিবাসী মেয়েরা সাধারণত এই মেলায় আসে না, তবে দিনকাল বদলাচ্ছে। ইদানীং অনেক মেয়ে ট্যুরিস্ট হিসাবে মেলায় ঘুরতে আসে। কথাটা বলেই সজলবাবু তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন –তুমি আবার নারী–বৈষম্য নিয়ে তর্ক শুরু কোরো না যেন। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে এইসব আদিবাসী সমাজে নারীরা অনেক খোলামেলা, অনেক স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠে।
-আজ ঘুরতে এসেছি। মাধবী একটু প্রগলভ গলায় বললে, -অন্য কোনদিন না হয় তোমার সাথে এই সব আলোচনা করা যাবে। অনেকদিন পর মজাসে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বৃথা তর্কে সময়টা নষ্ট করতে রাজি নই।
(*)
লোকালয় ছেড়ে গাড়িটা উঁচু-নিচু পথ দিয়ে এগিয়ে চলছিল। সর্বত্র রাস্তা ভাল নয়। অনেক জায়গাতেই পিচ উঠে গেছে। তবে মালভূমি অঞ্চল বলে রাস্তার পাশে খাদ সাধারণত নেই। তাই বিপদ কম। রাস্তার পাশে নিচু জায়গাতে অনেক সময় ঝোরা থেকে জল এসে জমেছে। কোথাও কোথাও সেই জলে ধান, ভুট্টা চাষ হচ্ছে। মাঝে মাঝে ফাঁকা টাঁড় অঞ্চল- গাছ-পালা, ঝোপ-ঝাড় কিছুই নেই। প্রায়শই রাস্তার পাশে মাটি ভেদ করে ছোট-বড় পাথর বেরিয়ে এসেছে। কোথাও কোথাও বিস্তীর্ণ কালচে–সাদা পাথরের চাটান। আর যেখানেই গাছ-পালা আছে, পলাশ গাছের আধিক্য বড়ই চোখে পড়ে।
-পাথুরে, শুকনো মাটিতে পলাশ গাছ ভাল হয়। সজলবাবু বললেন, -পশ্চিম বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, দুর্গাপুর-আসানসোল, গিরিডি, হাজারিবাগ, রামগড়, সিংভুম, সরাইকেলা-খারসোয়ান, বোকারো, ধানবাদ, রাঁচি জুড়ে এই পলাশের বিস্তার। মার্চে যখন লালচে-কমলা ফুলে ভরে উঠে এই গাছ, তখন অপরূপ লাগে। পলাশ তার সব পাতা ঝরিয়ে দিয়ে শুধু মাত্র ফুলের মালা পরে মেতে ওঠে বসন্তের আহ্বানে। সারাটা এলাকা তখন লালে লাল হয়ে যায়। সে দৃশ্যে কোন ভাষায় কোন বর্ণনা করা যায় না। এই পলাশ তাই এখানকার জাতীয় গাছ বলতে পার। আর মকর-সংক্রান্তি এখানকার জাতীয় উৎসব।
-সত্যি দারুণ জায়গা। মাধবী সখেদে বলল –চিরটাকাল কোলকাতায় কাটল। হাতের কাছে এত সুন্দর জায়গা আছে, অথচ আমরা এড়িয়ে যাই। গাদা টাকা খরচা করে এদিক-ওদিক ঘুরি, একরাশ ছবি তুলি- শুধু মাত্র টুইটার–ফেসবুকে সেগুলো অন্যদেরকে দেখাবো বলে।
চরাই–উৎরাই ভেঙে গাড়িটা এগিয়ে চলছিল। এভাবে বেশ খানিকক্ষণ চলার পর ড্রাইভার একজায়গায় গাড়ি থামাল। তারপর হাত দিয়ে বাঁ দিকের জঙ্গলাবৃত জায়গাটাকে দেখিয়ে বলল,
-এখানে নিচে আছে বামনি ঝরনা। আমি গাড়ি ঘুরিয়ে রাখছি। আপনারা দেখে আসুন।
দু’জনে গাড়ি থেকে নামলেন। তারপর সাবধানে রাস্তা থেকে একটু নেমে একটা পাথরের উপরে চলে আসলেন সজলবাবু। মাধবীর হাত ধরে তাকে টেনে আনলেন সেই পাথরটায়। সামনে তির তির করে বয়ে চলেছে একটি ঝোরার নির্জন স্রোত। জলে পা দিয়ে মাধবী উচ্ছল গলায় বলল,
-কী ঠাণ্ডা দেখ! বাইরে এত গরম। অথচ মন জুড়িয়ে যাচ্ছে এই জলে পা দিয়ে।
-এটাই বামনি ঝরনার জল। সজলবাবু বললেন, -ঝরনাটা নিচে। কিছুটা নিচে ওই জঙ্গল ভেদ করে নামতে পারলে পর ঝরনাটির কাছে পৌঁছনো যায়। কিন্তু আমাদের পক্ষে কাজটা কঠিন।
-থাক দরকার নেই।
-নামা-টা কঠিন নয়। সজলবাবু বললেন, -তবে উঠে আসা কষ্টকর।
-দরকার নেই। চলো কিছুক্ষণ বসে থাকি এই জলে পা-ডুবিয়ে। তুমিও জুতো খুলে এই জলে পা–ডুবিয়ে দাও। দেখো মনের সব ভার লাঘব হয়ে যাবে।
অনেকক্ষণ জলে পা–ডুবিয়ে দু’জনে পাশাপাশি বসে থাকলেন। মাধবীর দিকে চেয়ে দেখলেন সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জলের দিকে, একমনে। পাহাড়ের কোন এক অংশ দিয়ে বেরিয়ে আসছে এই শীতল জল। রুক্ষ পাথুরে মাটি, এই ভরা গ্রীষ্ম, অথচ জল এত ঠাণ্ডা! মনে মনে ভাবছিলেন সজলবাবু-
“মানুষের কঠিন মনেও ফল্গুধারার মতন একটা সুশীতল প্রবাহ বয়ে যায়। শুধু উপযুক্ত সময়ে তা আত্মপ্রকাশ করে। আজ মাধবীর সাথে এখানে বেড়াতে এসে কত ভালই না লাগছে। পুরনো স্মৃতি ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করছে। অথচ একটা সময় …….”
হঠাৎ কী মনে হতে মাধবীর দিকে চেয়ে দেখলেন কেমন এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে।
-কিছু বলবে? নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন তিনি। আর পরক্ষণেই অবাক হয়ে ভাবলেন, কত দিন পর মাধবীর সাথে এমন সুন্দর কথোপকথন হচ্ছে।
-নাহ, এমনি। ভাবছিলাম। মাধবী বলল।
-কী সেটা?
কৌতূহল মুখে জিজ্ঞেস করলেন সজলবাবু। তবে কিছু একটা অবশ্যই আন্দাজ করে নিয়েছিলেন। সেজন্য জ্যোতিষী হওয়ার কোন প্রয়োজন হয় না!
-থাক, পরে শুনো! বলে উঠে দাঁড়াল মাধবী। বলল, -চলো, ওই পাথরের ওপাশে ওয়াচ টাওয়ার-টায় গিয়ে উঠি। আশে-পাশের পাহাড়গুলো কে ভাল করে দেখি।
-চলো।
বলে উঠে পড়লেন সজলবাবু। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলেন উঁচু পাথরটার দিকে। তারপর হাত ধরে মাধবীকে টেনে নিলেন উপরে। এরকম শেষ অভিজ্ঞতা হয়েছিল বহু দিন আগে, গঙ্গোত্রী বেড়াতে গিয়ে। সে কি আজকের কথা? অথচ সম্পর্কটা আজ……।
টাওয়ারের সিঁড়ি বেশ সংকীর্ণ। দু’জনে পাশাপাশি ওঠা যায় না। প্রথমে সজলবাবু এগোলেন। পিছু পিছু মাধবী। ধীরে ধীরে টাওয়ারের মাথায় উঠলেন দু’জনে। মাথাটা কিছুটা প্রশস্ত। তারপর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলেন বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগের দিকে। সামনে পাহাড়ের পর পাহাড়। তার পিছনে আরও, আরও পাহাড়। পাহাড় থেকে বেশ কিছুটা নিচে অরণ্যাবৃত সমতলভূমি চোখে পড়ল। মাঝে মাঝে টিলা বা ছোট ছোট পাহাড়।
–ওটা বাঘমুণ্ডি ব্লকের সমতল ভূমি। সজলবাবু বললেন, -আরও কিছুটা দূরে ঝাড়খণ্ডের ইচাগড়ের পাহাড়-বনভূমি, আগে যা অবিভক্ত মানভূম জেলায় ছিল। এই জায়গাগুলো বা চান্ডিলও মানভূমে ছিল।
-তোমাদের আদি বাড়ি ওদিকেই। মাধবী বললে, -তা, এত সুন্দর জায়গা থাকতে কিসের প্রয়োজনে তোমরা কোলকাতায় পড়ে থাক?
–পেটের! সজলবাবু সখেদে বললেন, -এদিকে নেই উপযুক্ত অন্ন সংস্থানের সুযোগ। টাটা, বোকারো বা রাঁচি ছাড়া ভাল চিকিৎসা পরিষেবা নেই। শেষ বয়সে কোথায় থাকব বলো? তাই কলকাতাতেই ভরসা রেখেছি।
-আর দূরে ওই যে লেকটা? মাধবী কিছুটা নিচে একটা পাহাড় ঘেরা বিস্তৃত জলাশয় দেখিয়ে জানতে চাইল।
-ওটা একটা কৃত্রিম জলাশয়। নাম আপার ড্যাম। রাতে যখন বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকে, তখন নিচের লোয়ার ড্যাম থেকে জল পাম্প করে উপরে তোলা হয়। আর বিকেল-সন্ধ্যায় যখন বিদ্যুতের চাহিদা বেশি থাকে, তখন ওই জল লোয়ার ড্যামে ফেলে দেওয়া হয় টারবাইনের মধ্যে দিয়ে। ফলে বিদ্যুত তৈরি হয়।
-থাক ওই কচকচানি। মাধবী মুগ্ধ গলায় বলল, -বরং চারিদিকের এই শোভা দেখতে থাকি। এমন সুযোগ তো চট করে হয় না।
(*)
কতক্ষণ এমনভাবে কেটে গেছিল, জানেন না সজলবাবু। হুঁশ ফিরল ড্রাইভারের ডাকে। দূরে তাকিয়ে দেখলেন রাস্তা থেকে একটু নেমে এসে সে হাঁক পাড়ছে ওঁদের দিকে।
-দাদা, এবার চলুন পাহাড়ের যেখান থেকে পাথর কেটে নিয়ে ড্যাম দুটো বানানো হয়েছে, জায়গাটা দেখিয়ে দিই। রোদ উঠে গেছে বেশ। সে বলল, -এরপর কষ্ট হবে।
-কিসের কষ্ট ? মাধবী বললে, -এই তো দিব্য ছিলাম এখানে। পাহাড় তো এমন কিছু গরম হয় নি এখনও।
-তা হোক। সজলবাবু বললেন, -চলো আরও একটু ঘুরে নিই।
দু’জনে নিচে নেমে সাবধানে সামনের বড় পাথরটায় উঠলেন। এরপর খানিকটা এগিয়ে এসে শ্যাওলা ধরা পাথরে পাথরে পা ফেলে ঝরনাটা অতিক্রম করতে হবে। সজলবাবু আগে পার হয়ে গেলেন। এবার মাধবীর পালা। ও মনে হয় একটু নার্ভাস হয়ে গেছিল। দোষ নেই! বয়সও তো হল বেশ। শেষ পাথরটায় পা দিতেই টলোমলো হয়ে ব্যালান্স হারিয়ে পড়ে গেল সে। লাগত ভালই, যদি না দু’হাত বাড়িয়ে সজলবাবু ওকে ধরে নিতেন। সজলবাবুর বাড়ানো হাতে এরকম এলিয়ে ওঁর বুকে এসে পড়ল মাধবীর দেহ। দু’দশক আগে হলে হয়তো এসব ক্ষেত্রে সংকোচ হত না। কিন্তু এতদিনে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। সংকোচে সজলবাবু কিছুটা কুঁকড়ে গেলেন। মাধবী অবশ্য নিঃসঙ্কোচ রইল। নিজেকে সামলে কাপড়টা একটু টেনে নিয়ে খানিক তফাতে গিয়ে দাঁড়াল। কিছু একটা দ্যুতি খেলা করছিল ওর মুখে। হয়তো না বলা কোন কথা। তবে তা একটুক্ষণের জন্য। পরক্ষণেই ওঁকে হাতের ইশারায় পিছু পিছু আসতে আহ্বান করে মাধবী এগিয়ে চলল গাড়ির দিকে।
(*)
ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে রেখেছিল। এবার যে পথে এসেছিল, সেই পথে খানিক এগিয়ে গেল। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর গাড়ি ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। তারপর কিছুটা এগিয়ে এসে গাড়ি থামাল যে জায়গায়, সেখানে রাস্তার ধারে শক্ত করে বেড়া দেওয়া। সামনে গভীর খাদ, জল ভর্তি। আর খাদের পাশ থেকে উঠে এসেছে ক্ষত-বিক্ষত একটি পাহাড়। এগুলো দেখিয়ে ড্রাইভার বলল,
-ওই পাহাড় আর তার নিচের পাথর কেটেই আপার আর লোয়ার ড্যাম দু’টি তৈরি করা হয়েছে।
দু’জনে গাড়ি থেকে নামলেন। দেখলেন সামনে একটা আহত পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। তার উপরিভাগে বা দু’ পাশে সুন্দর বনভূমি দৃশ্যমান। তবে ওঁদের সম্মুখের দিকটা থেকে পাহাড় কেটে পাথর বের করে নেওয়ায় ভয়ংকর লাগছে। যেন পাহাড়-টা যন্ত্রণায়, আতংকে কাতরাচ্ছে।
পাহাড় তো নয়, যেন পাহাড়ের কংকাল!
সাদা বা ধূসর পাথর বেরিয়ে আছে তার গায়ে। মানব দেহে ত্বক-মেদ অপসারিত হলে এমন বীভৎস কংকাল দৃশমান হয়। এবং পাহাড়ও তার ব্যতিক্রম নয়।
পাহাড়টির অনেকটা নিচ থেকে পাথর কেটে তুলে নেওয়ায় খাদে গভীর এক জলাশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। মাধবী একটু এগিয়ে গিয়েছিল বেড়াটার দিকে। যদি বেড়াটা পলকা হয়? বেড়াটায় ও আবার না ভর দিয়ে ফেলে! আশংকা করে ওর হাত ধরে ফেললেন সজলবাবু।
-আর যেও না। মিষ্টি, আর্দ্র গলায় উনি বললেন, -কোথায় যে কী হয়ে যাবে বেড়াতে এসে?
-কী আর হবে বলো? ওঁর চোখে চোখ রেখে ক্লান্ত স্বরে মাধবী বলল, -মৃত্যু হয়তো নিশ্চিত। হয়তো মৃতদেহটাও পাওয়া যাবে না, এইতো? কার কী যায় আসে, সত্যি করে বলো তো? বেঁচে থাকার ক্লান্তি আর বইতে পারছি না আমি। যে সংস্থায় কাজ করি, তারা ভদ্রতা করে হয়তো দু’মিনিট নীরবতা পালন করবে। তারপর? দুনিয়ার কাছে আস্তে আস্তে আমি এক বোঝায় পরিণত হচ্ছি।
কিছুক্ষণ আগেও মাধবী মুগ্ধনয়নে তাকিয়ে তাকিয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করছিল। রোমান্টিক মন ওর চিরদিনই। সেই মনে সৌন্দর্য ও বিষাদ- একে অপরের পরিপূরক! কিন্তু আজ আর কী-ই বা করতে পারেন তিনি? পথ যে বন্ধ হয়ে গেছে।
-চলো, ফেরা যাক । সজলবাবু ধীর গলায় বললেন, -মেলাটায় অনেক কিছু দেখার আছে।
(*)
দু’জনে মিলে গাড়িতে উঠে বসলেন। ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে রেখেছিল। সে এবার চলল সুতানতান্ডির মেলা মাঠের দিকে। বেশ কিছুটা চলার পর পিচ রাস্তা ছেড়ে গাড়িটা ঢুকে পড়ল মেঠো রাস্তায়। প্রথমে কিছুক্ষণ জনবসতির মধ্যের রাস্তা দিয়ে গাড়িটা এগিয়ে চলল। তারপর ফাঁকা এলাকা শুরু হল। তবে রাস্তায় ভিড় ছিল যথেষ্টই। সামনে তিনটে জলের ট্যাংকার নিয়ে একটা ট্রেলার গজেন্দ্রগমনে চলেছে। তাই দেরী হচ্ছিল। জলের ট্যাংকারগুলির পিছু পিছু চলে এক সময় তাঁরা আসলেন একটা গাছ-গাছালিতে ঢাকা জায়গায়। সেখানে একজায়গায় বড় করে একটা প্যান্ডেল খাটানো। সেটার একদিকে পুলিশকর্মী আর অন্যদিকে স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজন বসে আছে। মাঝে মাঝে মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে সেই প্যান্ডেল থেকে। আগের দেখা গাড়িটা জলের ট্যাংকারগুলি এনে রাখল এই প্যান্ডেলটার কাছে।
-জেলা প্রশাসন থেকে এই গরমে লোকেদের খাওয়ার জলের সরবরাহ করে। সজলবাবু জানালেন। তারপর হাত দিয়ে খানিক দূরে গাছের তলায় জটলা হয়ে থাকা একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন, -ওখানে মারাংবুরুর উপাসনা হচ্ছে।
মাধবী চেয়ে দেখল ওদিকে। আদিবাসী পুরোহিত খালি গায়ে উপাসনা করছে। সাথে কয়েকজন লোক। আর কিছু উপাচার।
-একটু এগোতে পারো। সজলবাবু উপদেশের গলায় বললেন, -তবে বেশি এগিও না। একে তুমি বহিরাগত তায় মহিলা। তার উপর পোশাক মোটেও পূজা-অর্চনার উপযুক্ত নয়। তারপর একটু থেমে বললেন, -চলো বরং সামনের আদিবাসী গ্রামটার মধ্যে দিয়ে মেলার জায়গায় যাই। খানিক ঘোরা ঘুরি করে শেষে কিছু কিনে-টিনে গাছের ছাওয়ায় বসে খাই।
দু’জনে এগিয়ে চললেন উপাসনাস্থলের সামনে দিয়ে। খানিক এগিয়ে যাবার পর হঠাৎই মাধবী সটান জিজ্ঞেস করল,
-আচ্ছা ওরা কেন পুজো দিচ্ছে?
-যাতে ওরা শিকারে সফল হয়। সংক্ষেপে জবাব দিলেন সজলবাবু।
-ওদের এই প্রার্থনা দেবতা পূরণ করেন?
-ওরা তাই বিশ্বাস করে।
-এত নিষ্ঠুর কেন ওরা? মাধবী তিক্ত গলায় বলল, -নিরীহ জন্তু শিকার করবে, তাদের প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে- আর ওরা আশা করে যে ভগবান ওদের সাথে থাকবেন!
-দেখো আদিবাসীরাই জঙ্গল টিকিয়ে রেখেছে। সজলবাবু নির্লিপ্ত গলায় বললেন, -ভারতে মূলত সেই সব অঞ্চলেই জঙ্গল আছে, যেখানে আদিবাসীরা আছে। অন্যত্র অ-আদিবাসীরা জঙ্গল সাফ করে চাষে মেতে উঠেছে। ব্যতিক্রম মনে হয় সুন্দরবন, যদিও আর কতদিন টিকে থাকবে, তা বলা মুশকিল! তারপর একটু থেমে বললেন, -একদিন শিকার উৎসবের নামে সবাই একত্রিত হয়। নিজেদের ঐতিহ্য স্মরণ করে। এটা মূলত মেলা। সামান্যই শিকার পায় ওরা। হয়তো একটা হরিণ, এক-দু’টো বুনো শুয়োর, কিছু পাখি, গোটা কয়েক বেজি- হয়তো বা তাও না। অধিকাংশই খালি হাতে ফেরে। এমনকি অনেকে পোষা মুরগি কিনে এনে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে সেইসব শিকার করে। উৎসব এটা, ফুর্তি হয়, শিকার কম-ই হয়।
আদিবাসী গ্রামটির মধ্যে দিয়ে দু’জনে এগিয়ে অবশেষে মেলায় এসে পৌঁছলেন। এরকম মেলা আগে কখনও দেখেনি মাধবী। চারিদিকে খাদ্যদ্রব্যের ছড়াছড়ি। বিশেষ করে শুয়োর ও মুরগীর মাংস দেদার বিক্রি হচ্ছে চারিদিকে। ছাল ছাড়ান কয়েকটা গোটা শুয়োর দেখতে পেলেন তাঁরা, যেগুলোর মাংস কেটে-কেটে বিক্রি হচ্ছে। সাথে নানান ধরনের চাট –শসা, পিঁয়াজের, ছোলার, ডিমের, মটরের, আরও কত কী। নেশার তরল দ্রব্যও বাদ ছিল না। আবার কিছু কিছু আদিবাসী হস্তদ্রব্যও বিক্রি হচ্ছে এখানে–সেখানে। পাওয়া যাচ্ছে বুনো লতা-পাতার জড়ি বুটি। সজলবাবু একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলেন যে স্বামী-স্ত্রীর পক্ষে উপযুক্ত জড়িবুটি আছে তার কাছে। ওঁকে উদ্দেশ্য করে দোকানি বলল,
-নিয়ে যান। জিনিস ভাল। গ্যারান্টি দিচ্ছি, কাজে দেবে।
শুনে স্মিত হেসে মাধবী মুখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। খানিক এগিয়ে দেখা গেল একজায়গায় একটা ঝোরা জলাশয় মতন মতন সৃষ্টি করেছে। আদিবাসী বা অ–আদিবাসী- সব ধরনের লোকই এই গরমে সেই ঝোরার ঠান্ডা জলে আরাম করে স্নান করছে। অদূরে কিছু কিছু লোক তাদের সাথে আনা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গাছের ছাওয়ায় বসে আছে। কেউ কেউ ইঁট-পাথর জোগাড় করে আগুন জ্বালিয়ে হাঁড়িতে রান্না চাপিয়েছে। আবার কেউবা নেশা করে টং হয়ে আছে। ইউরোপীয় চেহারার কয়েকজনকেও দেখা গেল ইতি-উতি ঘুরে বেড়াতে আর ছবি তুলতে। দু’জনে এইসব দেখে মটর-পেঁয়াজের চাট কিনে এনে বসলেন কিছুটা দূরে ফাঁকা জায়গা দেখে, একটা শাল গাছের তলায়। মাধবী খাচ্ছিল কম। গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে সজলবাবুর দিকে একটু কাত হয়ে আরাম করে বসে তন্ময় হয়ে দেখছিল চারিদিকের দৃশ্য।
(*)
তখন বেলা পড়ে আসছিল। এক-এক দল করে লোক-জন জঙ্গলে ঢুকছে, আর এক দল জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্রাম নিচ্ছে- চান, খাওয়া–দাওয়া সারছে। কোন দলের সাথেই শিকার করা বন্যপ্রাণী নজরে এল না। ওদের কারুর মধ্যেই তাড়া জিনিসটা নেই। তবে ওঁর আছে। ঘড়ি দেখলেন সজলবাবু। এবার ওঠা দরকার। আরও কয়েকটা জায়গা দেখে ফিরতে হবে। ভেবে দেখলেন সিরকাবাদ দিয়ে না নেমে আপার ড্যাম–লোয়ার ড্যাম দেখে অযোধ্যা পাহাড়ের অন্য পাশ অর্থাৎ দক্ষিণ দিক দিয়ে নেমে গিয়ে সোজা বলরামপুরের বরাভূম স্টেশনে চলে যাবেন। যদি ট্রেন যোগাযোগ চালু হয় তো তাঁদের ট্রেনটা ধরে নেবেন। নচেৎ সন্ধ্যায় চক্রধরপুর যাওয়ার অন্য একটা ট্রেন আছে। সেটা ধরবেন। সবগুলি ট্রেন-ই চাণ্ডিল হয়ে যায়। তাঁর যেতে কোন অসুবিধে নেই। মাধবীর দিকে তাকিয়ে দেখলেন সে হেলান দিয়ে বসা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর একটা হাত তাঁর কোলে। অনেকদিন আগে জয়ন্তী ঘুরতে গিয়ে এমনটাই হয়েছিল। ওর নাকি ভাল জায়গার সৌন্দর্য উপভোগ করার সময় আরামে, আয়েশে ঘুম পেয়ে যায়। সত্যি, দু’দশক আগে দিনগুলো কত অন্য রকমের ছিল! ভাবলেন সজলবাবু, কোথা দিয়ে যে ভাল দিনগুলো এত দ্রুত কেটে যায়? সময় কেটে দিয়ে যায় পুরনো সুর, রেখে যায় ভগ্ন হৃদয়।
বেশি ভেবে লাভ কী?
এবার তো উঠতে হবে। অতীতের দেওয়ার ক্ষমতা বড়ই কম। শুধুই হৃদয় নিংড়ে হাহাকার রেখে দিয়ে যায়। মাধবীকে মৃদু ঠেলা দিলেন সজলবাবু। ধড়ফড় করে উঠে বসল মাধবী। একটু লজ্জা পেয়ে গেছিল। সোজা হয়ে বসে পরনের পোশাক একটু ঠিক-ঠাক করে নিয়ে ঝোলা থেকে জলের বোতল বের করে চোখে–মুখে দিল ও।
-সুন্দর একটা ছোট্ট ঘুম দিয়ে নিলাম। মাধবী জিজ্ঞেস করল, -এবার কি করবে?
-থেকে যাওয়ার প্ল্যান নেই আমার। মজা করে সজলবাবু বললেন, এই ভিড়ের সময়ে এইসব জায়গায় দু’টি ঘর পাওয়া মুশকিল।
-হাঃ হাঃ। খানিকক্ষণ হেসে নিল মাধবী। তারপর বলল –সে একটা ঘর পেলেও চলে। আমি দিব্য মেঝেতে শুয়ে যাব।
-সাপের কামড় খাবে। হাসতে হাসতে সজলবাবু বললেন, -অযোধ্যা পাহাড়ে চিতি, গোখরো, কেউটে, চন্দ্রবোড়া- কিছুরই অভাব নেই। বিশেষ করে রাতে ওরা খাবারের সন্ধানে বের হয়।
-এই যে জ্বালায় জ্বলছি এবং জ্বলবো, তাতে কোথায় লাগে সাপের কামড়?
হঠাৎ ঈষৎ তিক্ত গলায় বলে উঠল মাধবী। কথার মোড় যে বিপজ্জনক দিকে ঘুরছে! টের পাচ্ছিলেন সজলবাবু। মাধবী চিরদিনই খেয়ালী। আর্দ্রতা ভরা স্বরে সজলবাবু বললেন,
-চল, এবার আরও এক-দুটো জায়গা দেখে নিই। তারপর যেদিক দিয়ে উঠলাম, তার উল্টোদিক দিয়ে নেমে গিয়ে বরাভূম স্টেশনে চলে যাব। সেখান থেকে ট্রেন ধরতে হবে।
(*)
দু’জনে মিলে গাড়ির কাছে এলেন। ড্রাইভার অদূরে একটা গাছের তলায় বসে ঝিমোচ্ছিল। ওকে ডেকে গাড়িতে উঠে বসলেন দু’জনে। সজলবাবু ড্রাইভারকে বললেন আপার ড্যামের দিকে যেতে। পূর্বের কাঁচা রাস্তা ধরে খানিকক্ষণ চলার পর পিচরাস্তায় উঠে কিছুদূর যাওয়ার পর একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। একটা রাস্তা চলে গেছে বামনি ঝরনার দিকে, অন্যটা আপার-ড্যামের দিকে। ড্রাইভার আপার ড্যামের রাস্তা ধরল। কিছুক্ষণ আগের দেখা দৃশ্যাবলী আবারো চোখে পড়ল। রাস্তার দু’ ধারে সেই পাথরের চাটান। সাথে এখানে ওখানে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পলাশ গাছ দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে দেখা পাওয়া ছাতিম, শিমূল, কেঁদ, বয়ড়া, অর্জুন গাছগুলি পলাশের একাকীত্ব দূর করছে। কখনও আবার বিস্তীর্ণ ফাঁকা টাঁড় অঞ্চল। খানিকক্ষণ চলার পর গাড়ি আসল একটা বড় জলাশয়ের কাছে। একটু এগিয়ে একটা পাহাড়ের কাছে গাড়ি দাঁড় করাল ড্রাইভার। সেখানে আরও এক-দু’টো গাড়ি আগে থেকে দাঁড়িয়ে ছিল। দু-চারজন ট্যুরিস্ট গাড়িগুলো থেকে নেমে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ওঁরাও গাড়ি থেকে নামলেন।
যেখানে ড্রাইভার গাড়ি রেখেছিল, তার একদিকে খাদ, অন্যদিকে রাস্তা। আর রাস্তার ওপারে আপার ড্যাম। হাঁটতে হাঁটতে দু’জনে চলে গেলেন ড্যামের দিকে।
-আচ্ছা ঐ দু’টো কী? জলাশয়ের বুকে জেগে থাকা দু’টি টাওয়ার দেখিয়ে মাধবী জানতে চাইল।
-ওখানে টারবাইন আছে। জল ওই দু’টি টারবাইনের মাধ্যমে সন্ধ্যার দিকে নিচে পড়ার সময় জলবিদ্যুত তৈরী করে। আপার ড্যামে সবচেয়ে বেশি জল থাকে ভোর থেকে দুপুরের মধ্যে। সজলবাবু বলে চললেন, -আর লোয়ার ড্যামের জল সন্ধ্যা থেকে রাত্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি থাকে কারন এই সময়টাতেই সেখানে আপার ড্যামের জল ফেলা হয়।
ওঁরা রেলিং দেওয়া জায়গাটাতে খানিক হেঁটে হেঁটে ঘুরছিলেন। তখনি মাধবীর হ্যান্ডব্যাগে থাকা মোবাইলের রিংটোন শোনা গেল।
-হ্যালো, হ্যাঁ! মাধবী বলছি……হ্যাঁ……যেতে হয়তো বেশ রাত হয়ে যাবে। আসলে ট্রেন লাইনে অ্যাক্সিডেণ্ট হওয়ার ট্রেন লেট আছে বেশ……আসলে এই সুযোগে কাছের অযোধ্যা পাহাড়ে ঘুরতে এসেছি, তাই হয়তো টাওয়ার পাচ্ছিলাম না ……হ্যাঁ…হ্যাঁ, ট্রেন চক্রধরপুরে ঢোকার আগে ফোন করে দেব…… হ্যাঁ, রোহিত স্টেশনে এলেই হবে………না, না, ঘাবড়ানোর কিছু নেই……। বলে ফোন রেখে দিল মাধবী। তারপর মোবাইল দেখে বলল,
-আরে এ তো ঝাড়খণ্ডের টাওয়ার।
-ঠিক। বললেন সজলবাবু, -বিহার বা উড়িষ্যা আমাদের চেয়ে টেলি-পরিষেবায় অনেক এগিয়ে আছে। দীঘাতেও দেখ, বিশেষ করে দক্ষিণ দিকটায়, সবসময় উড়িষ্যার টাওয়ার পাবে। এতে যে বাংলার ট্যুরিজমের কী উন্নতি হয়, উপরওয়ালারাই জানেন। বিহার বা ঝাড়খণ্ড, যে কোন সীমানায় বাংলার নেটওয়ার্ক তুমি পাবেই না।
-আরে তোমার অন্তত খুশী হওয়া উচিত। সজলবাবুকে কনুই দিয়ে হাল্কা একটু গোঁত্তা মেরে মাধবী বলল, -তুমি তো আদতে ঝাড়খণ্ডী বাঙালি। তোমার রাজ্য না হয় কিছু রাজস্ব পেল।
-তা খারাপ বল নি। সজলবাবু হাসতে হাসতে বললেন, -পুরো রাজস্বটা পেলে আরও ভাল হত।
দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছিলেন খাদের ধারে। চারিদিকে গাছ-গাছালিতে ঢাকা পাহাড়। আর নিচে গভীর, ভয়াল খাদ যেন হাঁ করে গিলতে আসছে। বেশ খানিকটা দূরে সমতলভূমি। সেখানে চাষ-আবাদের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। ছোট-বড় সব জমি। কোথাও কোথাও গোরু চরে বেড়াচ্ছে। এত ছোট লাগছে সেইসব দূর থেকে। মাধবী ঝুঁকে দেখতে লাগল নিচটা। একটু ভয় লাগছিল সজলবাবুর। খাদ ঘেঁষে যদিও শক্ত করে বেড়া দেওয়া, তবুও কিছু হয়ে গেলে?
-অত ঝুঁকো না। কোথায় পড়ে যাবে।
বলে ওর হাত ধরে একটু টেনে নিলেন রেলিং থেকে সামান্য দূরে। ওঁর হাতে হাত রাখল মাধবী। হাল্কা চাপ দিল তালুতে। মাধবীর দিকে তাকালেন তিনি। একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ওর চোখের দিকে। মাধবীও চোখ সরাল না। ওর চোখে কিছু একটা বলার আন্তরিক আকূতি ফুটে উঠল।
–কিছু বলবে? মিষ্টি করে জানতে চাইলেন সজলবাবু।
-না, এখন থাক। পরে বলব। ধরা গলায় বলল মাধবী, -চলো আপাতত যাওয়া যাক।
গাড়িতে উঠে পড়লেন দু’জনে। গাড়ি এগিয়ে চলল আপার ড্যামের পাশে পাকা রাস্তা দিয়ে। সামনে একটা চেকপোস্ট। পরীক্ষা না করেই ছেড়ে দিল ওদের গাড়ি। গাড়ি একটু এগোনোর পর মাধবীকে হাত দিয়ে দেখালেন ডানদিকের একটা জায়গা। বড় বড় সুদীর্ঘ কাশে ছেয়ে আছে জায়গাটা।
-শরৎকালে জায়গাটা অদ্ভুত সুন্দর লাগে। সজলবাবু বলে চললেন, -দীর্ঘ লম্বা সাদা কাশে ছেয়ে থাকে সুবিশাল একটা এলাকা। হলফ করে বলতে পারি এমন দৃশ্য কোথাও দেখতে পাবে না।
-কী করে আর দেখব বলো? দুঃখিত গলায় মাধবী বলল, -কে দেখাবে? ইচ্ছে আছে আগামী শরৎকালে এখানে আসার। ট্রেনে বসে না হয় সেই আলোচনা করা যাবে। এখন চলো।
খানিকটা এগোবার পর গাড়ি নামতে থাকল পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে। রীতিমতন গভীর খাদ রাস্তার অন্যদিকে। জঙ্গলে অবশ্য ছেয়ে আছে তা। তাই তার ভয়ালতা ততটা দেখা যায় না, কিছুটা বোঝা যায় মাত্র। তবে রাস্তা খুব ভাল। মাধবী সেকথা বলল সজলবাবুকে।
-হবেই তো! সজলবাবু জোর দিয়ে বললেন, -এগুলো জাপানীরা ওই অযোধ্যা জলবিদ্যুত প্রকল্প তৈরী করার সময় যত্ন করে বানিয়েছিল। তাছাড়া সুন্দর জলনিকাশী ব্যবস্থা আছে রাস্তাটায়। তাই দীর্ঘকাল হয়ে গেলেও এই রাস্তা টিকে আছে।
(*)
অভ্যস্ত হাতে গাড়ি চালিয়ে ড্রাইভার গাড়ি নামিয়ে আনল লোয়ার ড্যামের ধারে। গাড়ি থামাল একটা ফাঁকা জায়গা দেখে। ডানদিকে জলবিদ্যুত কেন্দ্রে প্রবেশ করার রাস্তা। পাশে একটা বড়, উঁচু পাহাড়।
-ওই পাহাড় দেখেছ, বড় পাহাড়টাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে মাধবীকে বললেন সজলবাবু, -ওটার মধ্যেটা ফাঁপা। কয়েক তলা বাড়ি বানান আছে ওর পেটের ভিতরে। এক এক তলায় জলবিদ্যুত প্রকল্পের এক-এক রকম কাজ হয়।
-ওখানে বাতাস পায় কী করে ওরা? মাধবী অবাক হয়ে জানতে চাইল।
-ভিতরে পর্যাপ্ত অক্সিজেন যাওয়ার ব্যবস্থা রাখা আছে। সজলবাবু সংক্ষেপে বললেন।
-তাই? মাধবী বলল, -দক্ষিণ ভারতে অনেক জায়গাতেই একটা গোটা পাহাড় কেটে দীর্ঘ অধ্যবসায়ে মন্দির, উপসনাগৃহ, পুরোহিতদের আবাসস্থল তৈরি করা হয়েছে, এখানেও তাই?
–পার্থক্য আছে মাধবী। সজলবাবু বুঝিয়ে বললেন, -ওরা সেকালে ওসব বানিয়েছিল আদিম যন্ত্রপাতির সাহায্যে পাহাড় কেটে। গায়ে নানান সূক্ষ্ম কারুকার্য করেছিল। কতটা পরিশ্রম সময়সাধ্য, তা বলে বোঝানে যাবে না। আর এখানে আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে পাহাড়টা টিকিয়ে রেখে তার ভিতরের পাথর বের করে বাড়ি তৈরী করা হয়েছে। বাইরে থেকে গাছ-পালায় মোড়া পাহাড়টা দেখে কেউ ভাবতেই পারবে না তার ভিতরে এত কিছু আছে।
মাধবী সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল পাহাড়টার দিকে। এদিকে সন্ধ্যা হতে দেরী নেই খুব একটা। আর দেরী করা ঠিক হবে না। সজলবাবু মাধবীর কনুইয়ে ঠেলা মেরে মৃদু গলায় বললেন,
-চলো এবার যাওয়া যাক।
-এখনই?
মাধবীর গলার সুরে স্পষ্ট যে ওর এখনি যাওয়ার বিশেষ কোন ইচ্ছে নেই। কিন্তু আর দেরী করা অনুচিত। যদি ট্রেন যোগাযোগ চালু হয়ে যায়, তবে ট্রেনটা বরাভূম স্টেশন থেকে ধরার চেষ্টা করতে হবে। টামনা থেকে বরাভূম আসতে কুড়ি-পঁচিশ মিনিট সময় নেবে। যদি ট্রেন না চলে, বাস না পাওয়া যায় তো মোটামুটি ভদ্র-সভ্য হোটেল খুঁজতে হবে বলরামপুরে। তাই আর দেরী করা চলেনা। তা ছাড়া সন্ধ্যার পর পাহাড়তলি্র এইসব এলাকার আইনশৃঙ্খলার অবনতি যে কোন সময়ই হতে পারে। আগে উগ্রবাদীদের নাম করে অনেকেই তোলা তুলত। বিপদ তো বলে কয়ে আসে না! সজলবাবু গাড়ির দিকে এগিয়ে চললেন। অগত্যা মাধবী অনিচ্ছুক পদক্ষেপে তাঁর পিছু নিল।
-দাদা, লহরিয়া শিব মন্দিরটা দেখবেন? ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল।
-না ভাই। সজলবাবু দ্রুত বলে উঠলেন, -অন্য কোন দিনের জন্য তোলা থাকল ওটা।
যদিও এমন দিন হয়তো আর কখনই আসবে না। অবাক হয়ে ড্রাইভারও মাথা নাড়ল। তবে মাধবী যে কী বুঝল, সেই জানে!
(*)
সন্ধ্যা তখন হব হব। অযোধ্য পাহাড়ের সমান্তরালে উঁচু-নিচু পিচ বাঁধানো মসৃণ সড়ক দিয়ে তীব্রগতিতে গাড়িটা এগিয়ে চলছিল পূর্বদিকে। তাকিয়ে দেখছিলেন সজলবাবু শত-শত পাখি তাদের কূজনে চারিদিকে মাতিয়ে ফিরে চলেছে বাসায় অথবা শেষ বেলার আনন্দ মেখে নিচ্ছে ডানায়। মাধবীর দিকে কী মনে হতে তাকিয়ে দেখলেন, গালে হাত দিয়ে গভীর ভাবনায় সে মগ্ন, চোখ তার দূর আকাশে। হাল্কা করে ওর বাহুতে ছুঁয়ে সজলবাবু কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
-কী ভাবছ মৌ?
আর পরক্ষণেই চমকে উঠলেন। দীর্ঘ দিন পরে এমন সম্বোধন! কী করে যে হল? মনটা যে কখন কী করে বসে? একথা ভেবে একটু নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসলেন তিনি। মাধবীও চমকে উঠেছিল দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে এই সম্বোধনে। তার চোখে কোন এক দ্যুতি নিমেষে খেলা করেই যেন মিলিয়ে গেল। ধরা গলায় ও বলল,
-পাখিরা দেখ ওদের সাথীদের সাথে নীড়ে ফিরে যাবে। কিন্তু……।
কথা অসমাপ্ত রেখেই বক্তব্য শেষ করল ও। তবে কথাটার মানে তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ……। আলো-আঁধারিতে দূরে একটা অদ্ভুত দর্শনের পাহাড় দেখিয়ে মাধবী প্রশ্ন করল, -আচ্ছা ওই পাহাড়টাও অযোধ্যার?
-হ্যাঁ, সজলবাবু বললেন, -পুরোটাই অযোধ্য পাহাড়ের শিখরশ্রেণী। ওই নিঃসঙ্গ পাহাড়টার নাম পাখী-পাহাড়।
-পাখিরাও তাহলে সময় সময় নিঃসঙ্গ হয়ে থাকে? আমাদের মতন……? ভাবুক স্বরে বলে উঠল মাধবী।
-সাথীহারা পাখী তো একাকী হবেই! তবে এটা পাহাড়। সজলবাবু সান্ত্বনার সুরে বললেন।
-অথচ চেষ্টা করলে……। উদাসী গলায় মাধবী বলল।
-হয়তো…। হয়তো নয়…। খুব ধীরে বললেন সজলবাবু।
-আচ্ছা? মাধবী জিজ্ঞাসার সুরে কী যেন একটা কথা বলতে গিয়েও থেমে গেল।
-কী? ওর দিকে তাকিয়ে সজলবাবু জানতে চাইলেন, -কিছু বলছ?
–নাহ! সেরকম কিছু না। গলার স্বরে মনে হল মাধবী পাশ কাটাতে চাইছে যদিও ওর ভাব-ভঙ্গীতে সেটা নজরে এল না। সজলবাবুর দিকে একটুক্ষণ তাকিয়েই চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
-থাক, পরে শুনো।
মাধবী আবার জানালা দিয়ে বাঁদিকের অযোধ্যা পাহাড়শ্রেণীর দিকে একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। ওকে চুপ করতে দেখে সজলবাবুও থেমে গেলেন। উনি চোখ ফেরালেন ডানদিকে, খানিক দূরে আঁধারে কালো হয়ে ঝাপসা হয়ে যাওয়া বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমানার নিচু পাহাড়শ্রেণী দিকে। ড্রাইভার তার অভ্যস্ত হাতে ঢেউখেলানো নিখুঁত পিচরাস্তা দিয়ে মসৃণভাবে গাড়িটা নিয়ে এগোচ্ছিল। সেদিকে তাকিয়ে সজলবাবু ভাবছিলেন, শুধু ওঁদের জীবনটাই অমসৃণ, বন্ধুর জীবন উপত্যকার জলবিভাজিকায় পৃথক হয়ে গেল। কখনই যে দু’টি ধারার আর মিলন হবে না!
(*)
বরাভূম স্টেশনে এসে ওঁরা শুনলেন যে ট্রেন যোগাযোগ কিছুক্ষণ হল চালু হয়েছে। তবে ওঁদের ট্রেনটি এখনও টামনা থেকে ছাড়েনি। কপাল ভাল থাকলে হয়তো সেটা ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই এসে যেতে পারে। জিজ্ঞেস করে কোথায় এ.সি. কামরাটা পড়বে, সেটা জেনে নিয়ে কাছাকাছি একটা সিমেন্টের বেঞ্চে এসে বসলেন দু’জনে। ব্যাগ খুলে একটা কেক ও কাজুর প্যাকেট বের করে মাধবীর দিকে এগিয়ে দিলেন সজলবাবু। হয়তো এটাই ওকে দেওয়া তাঁর শেষ বস্তু!
ওঁর নিকটে বসে দূরে অন্ধকারাচ্ছন্ন অযোধ্যা পাহাড়ের দিকে চেয়ে কোন এক গভীর ভাবনায় তলিয়ে গিয়েছিল মাধবী। খুব ধীরে ধীরে খেয়ে চলছিল ও। কথা বলে ওকে আর বিরক্ত করলেন না সজলবাবু। মনে মনে দূরের ওই পাহাড়শ্রেণীকে ধন্যবাদ দিলেন এমন একটা দিন উপহার দেওয়ার জন্য। আজকে কী ভালই না লাগছে। অথচ…। কিন্তু…। উপায় যে নেই…।
বেশ অনেকক্ষণ এভাবেই কেটে গেল। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটা ট্রেন চলে গেল। এমন সময় ওঁদের ট্রেনটার ঘোষণা হল। ট্রেনে কিছুক্ষণ একসাথে থাকার পর দু’জনে পৃথক পথে চলে যাবেন।
আর কখনও কী দেখা হবে?
জানা নেই সজলবাবুর। হয়তো…। হয়তো নয়……। মাধবীও মনে হয় তাই ভাবছিল। কেননা গম্ভীর মুখে বিষণ্ণ চিন্তায় ডুবে থাকতে দেখলেন ওকে।
দূরে ট্রেনের আলো দেখা গেল। ধীরে ধীরে আলোটি বড় হতে থাকল। খানিক পরে আলোটি একটু বেঁকে আবার ওঁদের দিকে এগিয়ে এল। ট্রেনটা মূল লাইন ছেড়ে প্লাটফর্মের লাইনে ঢুকে গেছে। এবার মালপত্র গুছিয়ে নেওয়া দরকার।
-চলো, তৈরী হয়ে নাও।
মাধবীর দিকে না তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললেন তিনি। সীট ছেড়ে উঠে বসল মাধবী। তারপর ওর ব্যাগ নিয়ে তৈরী হয়ে একটু এগিয়ে গেল। ট্রেনটা অচিরেই চলে এল। এ.সি. বগিটা ওঁদের কাছাকাছিই পড়ল। মাধবীর পিছু-পিছু উঠে পড়লেন সজলবাবু। টিকিট চেকার ছাড়া আর কেউ ছিল না কামরাটাতে। দু’জনে গিয়ে বসলেন পাশাপাশি, সেই সীটেই। ঠিক এমন সময় সজলবাবুর মোবাইলটা বেজে উঠল। পকেট থেকে বের করতে করতে রিংটোন-টা অবশ্য কেটে গেল। স্ক্রীন-টা দেখে নিয়ে রেখে দিলেন সজলবাবু।
-দ্যাখো, বলে মাধবী ওঁর মুখের দিকে তাকাল। গলায় তার আত্মপ্রত্যয়ের সুর। কোন একটা সিদ্ধান্তে যে সে উপনীত হয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ওঁর চোখে চোখ রেখে বলল, -আচ্ছা আমরা কি…?
ঠিক এমন সময় সজলবাবুর মোবাইলটা আবারো বেজে উঠল। নিমেষে খানিক ভেবে নিয়ে একবার বিষাদের দৃষ্টিতে মাধবীর দিকে তাকালেন তিনি। তারপরে কিছুটা শক্ত মুখে মোবাইলের কথা বলার সুইচে চাপ দিলেন,
-হ্যাঁ……আসলে ট্রেনটা খুব লেট আছে একটা অ্যাক্সিডেণ্টের কারণে…… পুরোনো এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেল, একটু ঘুরেও নিলাম একসাথে অযোধ্যা পাহাড়…… আসলে পাহাড়ে টাওয়ার থাকে না, তাই তুমি আমায় পাওনি, আমিও তোমায় ফোন করতে পারিনি…না, না, কোন চিন্তা কোরো না……হ্যাঁ, হ্যাঁ তরশু ফিরছি, দেখা হচ্ছে …ভাল থেকো…ঝাড়খণ্ডের টাওয়ার চলে এসেছে… এখন রাখছি….বাই।
কামরাটায় এ.সি. চলছিল পুরোদমে। মাধবীর পাশেই বসে ছিলেন সজলবাবু। তবে শুরুতে দেখা হওয়ার সময়ে যে পরিমাণ দূরত্ব ছিল, অনুভব করলেন হিমেল একটা হাওয়া এসে ক্রমশ সেটা আরও বৃদ্ধি করছে, ওঁদের নৈকট্য ধীরে ধীরে দৃষ্টির অগোচর করে তুলছে। একটা সময় কুয়াশায় ডুবে গেল কামরাটা।
************************************************************