Home / গল্প / ফয়সালা – নির্মাল্য ঘরামী

ফয়সালা – নির্মাল্য ঘরামী

ফয়সালা
শিল্পী- পুণ্যতোয়া ধর

 

-দেখুন স্যার।

বলে সিকিউরিটি গার্ডটি বিজয়ীর দৃষ্টিতে মহাকুলসাহেবের দিকে তাকালো। তার হাতে ধরা ব্যাগটির ভিতরে তাকালেন উনি। খানিকটা চাল, দু’টি আলু ও একটি পেঁয়াজ উঁকি মারছে সেখান থেকে। মুখ সরিয়ে মালতীর দিকে তাকালেন তিনি। লজ্জায় তার মুখ তখন নিচু হয়ে গেছে। কপালে যে আর কত দুর্ভোগ আছে, সেটা মনে হয় এখন থেকেই হিসেব করতে শুরু করে দিয়েছে সে।

 

কাজের মেয়েটি যে ইদানীং চুরি করছে, সে বিষয়ে তিনি একরকম নিশ্চিত ছিলেন। কিন্তু নিজে থেকে তো আর তাকে সার্চ করা যায় না। পরিবার এলে তবে হয়তো সেটা ঠেকানো যাবে, অন্তত কমানো যাবে। তাই তিনি এই গভর্নমেন্ট হাউজিং কমপ্লেক্সের সিকিউরিটি-কে বলে রেখেছিলেন যে খুব সন্দেহজনক মনে হলে একদিন মেয়েটির ব্যাগ সার্চ করতে। আর আজ ফল ফলল একেবারে হাতেনাতে।

 

আজ সকালের ঘটনা। কয়েকদিন হল অফিসে নতুন বড় সাহেব এসেছেন। এমনিতে লোক মন্দ নন। তবে সবদিক কড়া নজর তাঁর। তার উপর অফিসে অনেক ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসিয়েছেন। ফলে উপরি-টুপরি একটু সাবধানেই নিতে হয়। বেশ অনেকদিন ধরে কাজ করে-টরে প্রমোশন পেয়ে অফিসার র‍্যাংক-এ পৌঁছেছেন উনি। মাস কয়েক হল প্রমোশন নিয়ে বদলি হয়ে এখানে এসেছেন। জায়গাটার সুযোগ-সুবিধে মন্দ নয়। এখানেই একটা ফ্ল্যাট বা বাড়ি দেখে সেটল করে গেলে খারাপ হয় না। ইনকামও বেশ হচ্ছে। কিন্তু আরেকটু হলেই আজ বিপত্তি হতে বসেছিল। কিন্তু ‘মা’ ঠিক বাঁচিয়ে দিয়েছেন। সেটা স্মরণ করে ভক্তিভরে কপালে হাত ঠেকালেন উনি।

 

সাধারণত “ওরা” ওঁর বাড়িতেই আসে। তবে সেদিন সাপ্লায়ার মধুবাবুর একটু তাড়া ছিল। বিকেলে ধানবাদ যাবেন। এদিকে সই দিয়ে দেওয়ার পর পাওনা গন্ডা বুঝে পেতে প্রায়শই অসুবিধে হয়। তাই সেদিন রিস্ক নিয়ে অফিসেই কাজটা সারতে চেয়েছিলেন। সবে খানিকটা এগিয়েছেন, এমন সময় ওঁর আর্দালি রাজু দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে বলল,

-স্যার, তাড়াতাড়ি গুটিয়ে নিন।

আচম্বিতে টাকা থেকে দৃষ্টি সরে যেতে উনি হতচকিত হয়ে গেলেন। ফুরফুরে মনটা এতক্ষণ অন্যদিকে ছিল। সেখান থেকে বাস্তব পৃথিবীতে নেমে এলেন উনি। আসতেই হল। এবং বড্ড তাড়াতাড়ি। হতভম্ব মুখে জিজ্ঞেস করলেন,

-কী হল?

-স্যার, বড়সাহেব করিডোরে বেরিয়েছেন। আপনার ঘরের দিকেই আসছেন। এই এসে গেলেন প্রায়। চললাম।

বলে দরজা দিয়ে যেমনি চকিতে ঢুকেছিল, তেমনিই দ্রুত বেরিয়ে গেল সে। মহাকুলসাহেব তখন একটা বান্ডিল ড্রয়ারে রেখে সবে আরেকটা বান্ডিলে হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু…। বিপদ কি আর বলে কয়ে আসে?

-নাঃ, মাথার উপরে আর যেই থাক, ভগবান নেই।

কপালকে একবার দোষ দিয়ে ঝটিতি বাকি বান্ডিলগুলি চেয়ারের তোয়ালের নিচে গুঁজে দিলেন। কোনরকমে! প্রায় পরক্ষণেই ঘরে ঢুকলেন বড়সাহেব।

-কী ব্যাপার মহাকুলসাহেব?

হাসি মুখে জিজ্ঞেস করতে করতে ভিতরে এলেন তিনি। ততক্ষণে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন মহাকুলসাহেব। ভাগ্যে সেরকম ঝটকা লাগে নি। তোয়ালের নিচে গুঁজে দেওয়া টাকা গুলো আরেকটু ঝাঁকুনি খেলে ঠিক আত্মপ্রকাশ করে দিত। ভাগ্যে সেরকম কিছু হল না। পাঁচভোমরায় কালীমায়ের মন্দিরে একটা পাঁঠার মানত করে রাখলেন উনি। এই বড়সাহেবের বড় একটা গুণ এই যে কাজের প্রয়োজনে বা এমনিও নিজের অধস্তনদের চেম্বারে মাঝে মধ্যেই যান এবং কখনও তাদের চেয়ারে বসেন না। আজ বসলে যে কী হত? একরকম নিশ্চিত যে টাকাগুলির উপস্থিতি আর লুকোনো যেত না। তবে বড় সাহেব তো! তাই কোনরকমে বাংলা পাঁচের মুখটিকে অনেক কষ্টে হাসিমুখে পরিণত করতে করতে উনি বললেন,

-স্যার আমার চেয়ারে এসে বসুন।

-নাঃ। নাঃ। থ্যাংক ইউ।

বলে ওঁর পাশের একটি গদিওয়ালা চেয়ারে বসলেন উনি। তারপরে শরীরটাকে খানিক পিছনে হেলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

-কী খবর?

-এই চলছে স্যার।

-ফ্যামিলি?

-ছেলেটার পরীক্ষা হয়ে গেলে নিয়ে আসব স্যার।

-ক’বছর আরও চাকরি আছে?

বড়সাহেবের মুখের দিকে ভাল করে তাকালেন উনি। কোন কিছু আন্দাজ করেই কি এখানে এসেছেন? ওঁকে ধরার জন্যই কি ফাঁদ পেতেছেন? খচ্চর মধুটাকেই কি ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করেছেন উনি? দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ লোক মহাকুলসাহেব। জানেন যে লোকের চোখ-মুখ দেখে অনেক কিছুই আন্দাজ করা যায়। তবে বড়সাহেবের মুখে সেরকম কোন অভিব্যক্তি না দেখে একটু সহজ হলেন উনি। মনে হয় না কোন বদ মতলব আছে তাঁর। খানিক আশান্বিত চোখে ওঁর দিকে তাকিয়ে মহাকুলসাহেব বললেন,

-এই বছর দুয়েক স্যার।

-তা কেমন লাগছে জায়গাটা? চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে উনি জানতে চাইলেন।

-ভাল স্যার। তারপরে একটু থেমে বললেন, -আমাদের মতন গ্রামের লোকেদের পক্ষে সুযোগ-সুবিধে পর্যাপ্ত।

-তাহলে তো এখানে সেটল করে যেতে পারেন।

-দেখি স্যার। আমার তো বেশ মনে ধরেছে। এখন গিন্নী কী বলেন, সেটাই দেখার।

-দেখুন। বলে আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে বসলেন উনি। সঙ্গে সঙ্গে মহাকুলসাহেবও সতর্ক হয়ে গেলেন। টান টান হয়ে গেল শরীর। খানিক ঝটকা লাগল চেয়ারে। টাকার বান্ডিলগুলি বেরিয়ে না পড়ে! তাহলে যে কী হবে? নিজেকে সামলে নিতে নিতে ভাবলেন উনি। তবে সেরকম কিছুই হল না।

-আমি একটা মিটিং-এ বেরোব। বড়সাহেব বললেন, -সেখান থেকে বাড়ি চলে যাব। আজ আর ফিরব না।

-আমি থাকছি স্যার। অফিস ছেড়ে কোথাও যাব না। মহাকুলসাহেব আশান্বিত গলায় বললেন।

-দাঁড়ান, এখনও শেষ হয়নি। বেশ কর্তৃত্বভরা গলায় বলতে থাকলেন বড়সাহেব, -আগামীকাল ছুটি নিচ্ছি। শনি-রবি আর এখানে থাকছি না। সোমবারে ফিরব।

তার মানে ওঁকে এখানে থাকতে হবে। এবং কোনমতেই শুক্রবার তো নয়ই, শনি-রবি হেড কোয়ার্টার ছেড়ে কোথাও যেতে পারবেন না। সরকারী চাকরি বিষম জিনিস। লোকে ভাবে যে দারুণ সুখে আছে। এদিকে আধিকারিক স্তরে ছুটি-ছাটা উপভোগ করা যে কী কষ্টকর, সেটা আর কে কাকে বোঝাবে!

-আমি থাকছি স্যার।

-হ্যাঁ। এটা বলতেই এলাম। বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন উনি। সাথে সাথে মহাকুলসাহেবও। বড়সাহেব দরজার দিকে মুখ করে বললেন, -যাইহোক, চলি এবার। অনেকটা রাস্তা যেতে হবে।

দরজা অবধি বড় সাহেবকে এগিয়ে দিতে দিতে ভেবে দেখলেন উনি, একটা বড়োসড়ো ফাঁড়া গেল। ধরা পড়লে যে কী হত?

নাঃ আর বেশি কিছু ভাবতে পারছেন না। চরম একটা লজ্জার হাত থেকে আজ বেঁচে গেছেন। আরেকটু হল এতদিনের অর্জিত এই চাকরি, সম্মান, পেনশন- সব যেতে বসেছিল। স…অ…ব। নাঃ এই সপ্তাতেই মন্দিরে যেতে হবে। মা তাঁর কথা শুনেছেন।

সিকিউরিটি গার্ডটি হাসিমুখে ওঁর দিকে তাকাল। আজ বড়সাহেব না থাকায় তাড়াতাড়ি অফিস সেরে বেরিয়ে পড়েছিলেন উনি।

-আজ ওর হাতের ব্যাগটা দেখে সন্দেহ হয়েছিল স্যার।

সিকিউরিটি গার্ডের মুখ চোখ তার আত্মগর্বে গরীয়ান হয়ে উঠেছিল। উদ্ভাসিতমুখে ওঁর দিকে তাকিয়ে নিয়ে ব্যাগটি দেখিয়ে বলল,

-তাই একটু আগে যখন চুপি চুপি কাজকর্ম বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন ওকে ডাকলাম। ডেকে জোর করে ওর ব্যাগটা খুললাম। খুলতে কি আর চায় স্যার! এই দেখুন স্যার………।

বলে আঙ্গুল দিয়ে দেখাল ব্যাগের ভিতরে।

 

জিনিসপত্রের দাম তো আর কথা শুনছে না। এদিকে ঢোকার সময় ওকে বলেছিলেন যে কয়েকমাস দেখে নিয়ে তবে মাইনে বাড়াবেন। কিন্তু নিজের মাইনে না বাড়ার কারণ দেখিয়ে ওর মাইনে আর বাড়ান নি তিনি। সাধারণত বদলির চাকরির লোকেদের থেকে কাজের মেয়েরা বেশি টাকা পেয়ে থাকে। স্থানীয় লোকজন তুলনায় মাইনে দেয় অনেক কম, তবে কাজটা প্রায়শই স্থায়ী হয়। ও নিয়েছে সামান্যই। অথচ এই ঘটনার পরে এই হাউজিং কমপ্লেক্সে তো বটেই, ওঁর অফিসের কারুর বাড়িতে যে ও আর কাজে ঢুকতে পারবে না, তা তিনি নিশ্চিত। হবেটা কী ওর? ওরও তো একটা পরিবার আছে। নিজেই তো আজ কপাল জোরে বেঁচে গেলেন! আর উনি যে উপরি নেন, সেটা এরা অনেকেই আন্দাজ করে। কিছু বলার সাহস নেই। তবু…। ওদের চোখে তিনিও কি…? ওদের ভাবনা চিন্তা কি একইরকম……? আর বেশি ভাবতে পারলেন না উনি। বলে উঠলেন,

-আরে ওটা আমিই ওকে দিয়েছিলাম।

কথাটা যেন হঠাৎই ওঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। গার্ডটির চমকে ওঠা মুখ দেখতে দেখতে উনি বলে উঠলেন,

-ও খানিকটা চাল ধার চেয়েছিল। সকালে ওর সঙ্গে ব্যাগ না থাকায় ওকে দিতে পারিনি। বলেছিলাম বিকেলে ব্যাগ এনে নিয়ে যেতে।

এই বলে হতভম্ব মুখে দু’জনকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে উনি হাঁটা দিলেন নিজের কোয়ার্টার্সের দিকে।

 

……০……

Leave a comment

Check Also

স্বীকারোক্তি

স্বীকারোক্তি- ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য্য

    আজই ফোনটা ডেলিভারি দিয়ে গেলো। অনলাইনে একবার দেখেই ভারি পছন্দ হয়ে গেছিল সমীর …

দর্পণে

দর্পণে – নির্মাল্য ঘরামী    

    -চল, আমি জোরের সঙ্গে বললাম, -ওসব একদম ভাবিস না। তোকে এতদিন পরে পাচ্ছি, …

রক্তগোলাপ/ মৌসুমী পাত্র/ পুণ্যতোয়া ধর

রক্তগোলাপ – মৌসুমী পাত্র

  একটা মোটা দড়ি থেকে পাশাপাশি ঝোলানো সারি সারি মৃতদেহ। ছাল ছাড়ানো। গত কদিন ধরেই …

যখন অন্ধকার হাতছানি দিল

যখন অন্ধকার হাতছানি দিল – নির্মাল্য ঘরামী

  আলোটা এবারে দপ করে নিভে গেল। -যাহ! ওর মুখ দিয়ে শব্দটা প্রতিবর্তক্রিয়ার মতন-ই বেরিয়ে …