Home / গল্প / এখন কাজের সময়- নির্মাল্য ঘরামী

এখন কাজের সময়- নির্মাল্য ঘরামী

সুশীলা ওকে অনুরোধটা না করলে, হয়তো কাজটা হাতেই নিত না ভুবন। ফেসবুকে যোগাযোগ আছে ওরে সঙ্গে, যদিও তা অনিয়মিত। বাল্যের সেই টানটা হয়তো নেই, কিন্তু একটা চার্ম কি থেকে যায় না? আর এমনিতে মেয়েটা ওর থেকে কোনদিন কোন সাহায্য চায় নি। ফলে বাস্তববুদ্ধি সম্পন্ন মধ্য যৌবনে পৌঁছে গিয়েও ওকে না করতে পারেনি ভুবন। মেসেঞ্জারে মেসেজ পাঠিয়েছিল সুশীলা,

-কোথায় আছ এখন?

-শিলিগুড়িতেই। তুমি?

-আমি কালিম্পঙয়েই আছি। তা, তুমি কি হিমালয় ট্রিবিউনেই আছ?

-হ্যাঁ। ভুবন লিখল, -একটা লিফট পেয়েছি।

-বাহ।

তারপরে একটু ইতস্তত করছিল সুশীলা। কয়েকবার একটা কিছু লিখে কেটে দিচ্ছিল। সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারছিল ভুবন। একসঙ্গেই ওরা ডেলো পাহাড়ের পাদদেশের বিখ্যাত স্কুল গ্রাহামস হোমস থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে বেরিয়েছিল। তারপরে সুশীলা কালিম্পং কলেজেই ভর্তি হল। এদিকে ভুবন শিলিগুড়ি কলেজে ইংরিজিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়। তারপরে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস কম্যুনিকেশন পাশ করে হিমালয় ট্রিবিউনে ট্রেনি সাংবাদিক হিসেবে ঢোকে। ইতোমধ্যে সুশীলার সঙ্গে যোগাযোগ কেটে গিয়েছিল। মূলত সেটাই কারণ ছিল কালিম্পং ছেড়ে শিলিগুড়ি চলে আসার। এদিকে সুশীলার বাবা তিস্তা ভ্যালির যে চা-বাগানটায় কাজ করত, সেটা বন্ধ হয়ে গেছিল। লোকমুখে শুনেছিল যে তার বাবা অত্যধিক রক্সি মানে দেশী মদ খেয়ে মারাও গেছে। সুশীলা পড়া ছেড়ে দিয়ে একটা হোটেলে কাজ নিয়েছে। পরে ওর সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে পুনরায় যোগাযোগ হওয়ার পরে শুনেছিল যে সেই এখন পরিবারটাকে ধরে রেখেছে। ভুবনের চিন্তাসূত্র ছিন্ন করে একটা মেসেজ ফুটে উঠল মোবাইলের স্ক্রীনে,

-একটা সাহায্য করবে?

-শুনি। বলো…

-আরে সংকোচ হচ্ছে তোমাকে বলতে, কিন্তু এখন আর এমন কেউ নেই যে বলব।

একবার ভাবল যে জিজ্ঞেস করে যে সেই মারোয়াড়ি ছেলেটা কোথায় গেল, যার পাল্লায় পড়ে তুমি আমাকে ছেড়ে দিয়েছিলে। কিন্তু সেসব যে কোন ভদ্রলোকের পক্ষে জিজ্ঞেস করা অসম্ভব। অবশ্যই ওর ভদ্রতায় বাধবে।

-কিছু টাকার দরকার খুব। সুশীলা লিখল, -মায়ের হার্টের অপারেশনটা না করালেই নয়।

-কিন্তু সে তো অনেক টাকা। ভুবন লিখল, -যদি তোমাকে ধারের ব্যবস্থা করে দিই।

-আমিও কিছু জোগাড় করেছি। সুশীলা বলল, -কিন্তু ধার নেওয়ার মতন চাকরি আমি করি না। মায়ের গয়নাও নেই। বাবার ট্রিটমেণ্টের সময়ে সব-ই গেছে।

তারপরে কয়েকবার নিজের কিছু একটা লেখা নিজেই মুছে ফেলে শেষে লিখল,

-কিছু টাকা সাহায্য করতে পার ভুবন। মনে হয় না টাকার অংকটা তোমার পক্ষে খুব কঠিন হবে।

তারপরে যে অ্যামাউন্টটা সে লিখল, সেটা জোগাড় করে দেওয়া ওর পক্ষে খুব একটা অসম্ভব নয় বলেই মনে হল। একটা স্পেশ্যাল আর্টিকেল সে লিখছে, যেটা লেখার জন্য তাকে সম্পাদক মশাই বেশ চাপ দিচ্ছেন কিছুদিন ধরে, চাইলে যেটা বাবদ ও কিছু অ্যাডভান্সও নিতে পারবে। সেটার সঙ্গে নিজের পকেট থেকে কিছু যোগ করে সুশীলার টাকাটা সে জোগাড় করে দিতে পারবে।

-ঠিক আছে, আমাকে কিছুদিন সময় দাও। ভুবন লিখল, -আমি চেষ্টা করছি।

-টাকাটা তুমি ধার হিসেবেই দাও। সুশীলা লিখল, -আমি ঠিক শোধ করে দেব।

-সে দেখা যাবে।

সংক্ষেপে জানিয়েছিল ভুবন। তারপরে আর কিছুক্ষণ এটা-সেটা চ্যাট করার পরে ও “বাই” লিখে কাজে মন দিল।

 

(২)

-আরে সুশীলা?

কাউন্টারে একটা চকোলেট কফি ও কিছু কুকীজের অর্ডার দিতে গিয়ে সুশীলাকে ও দেখতে পেল। সবে মানি ব্যাগ থেকে কার্ড বের করে এগিয়ে দিচ্ছে কাউন্টারের দিকে, এমন সময় সুশীলাকে কাউন্টারের সামনে আসতে দেখল। প্রথমে একটা চমক, একটা অজানা বিস্ময়, আর তারপরেই খুশীর জ্যোৎস্না ফুটে উঠল সুশীলার সুন্দর, গোল মুখটিতে।

-কখন এলে? সুশীলা জিজ্ঞেস করল।

-কাল।

ভুবন তার কাজের ব্যাপারে বাইরের কাউকে কিছু বলে না। এমনকি নিজের বাড়িতেও না।

-হঠাৎ? সুশীলা বিস্মিত মুখে বলল, -আরে একটা খবর তো দিতে পারতে।

-আসলে স্কুল থেকে আমার একটা পুরানো সার্টিফিকেট তুলতে এসেছি। পাসপোর্ট বানাবার জন্য বার্থ সার্টিফিকেট পেলাম না। ভুবন বলে চলল, -ওরা বলল যে স্কুল থেকে সার্টিফিকেট আনলেও করে দেবে।

-তা বেশ, বেশ। সুশীলা ইতস্তত করে জানতে চাইল, -তোমার কাজ কি হয়ে গেছে?

-এই যাব। হেড-মাস্টার মশাইকে ফোনে বলে রেখেছি। খুব বেশি সময় লাগবে না। ভুবন বলল, -ভাবলাম যে একটু কফি খেয়ে যাই।

-চলো আমিই খাওয়াব। সুশীলা আন্তরিকতার সঙ্গে বলল, -আজ তুমি আমার গেস্ট।

-ছাড় তো। ভুবন জোর দিয়ে বলল, -কালিম্পং আমারও হোম টাউন। নেহাত এখন আর আমি থাকি না। আমার পেমেন্ট-টা প্রায় করেই ফেলেছিলাম। দাঁড়াও, তোমার জন্য আরেকটা কফির অর্ডার দিয়ে দিই।

 

কালিম্পঙয়ে নতুন একটা “কাফে হোম কফি” খুলেছে। আর্টিকেলটা লেখার জন্য ওকে কিছু ইন্টারভিউ নিতে হবে। তার মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য সেখানেই একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করা হয়েছে। সব-ই করেছে ওর অফিস থেকে। ও নিজে স্থানীয় নেপালী সম্প্রদায়ের হওয়ায় ওকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। তাতে ভাষা সমস্যার হাত থেকে বেঁচে খবর বের করতে সুবিধে হবে।

 

স্টিক দিয়ে ভালো করে ঘেঁটে নিয়ে কফি খেতে খেতে ভুবনের দৃষ্টি চলে গেল রেলী নদীর দিকে। পাহাড় থেকে বেরিয়ে এসে বাঁক নিয়ে আবার পাহাড়ের বাঁকে হারিয়ে গেছে। কিছুটা শুকনো নদী। কিন্তু সারাটা বছর হাল্কা একটা স্রোত নিয়ে বয়ে যায় সে। ঠিক যেন সুশীলার প্রতি ওর আবেগের ফল্গুধারার মতন। এত কাছে…অথচ…ওদের রাস্তা দূরে সরে গেছে। ক্রমাগত…।

-কি এত ভাবছ? সুশীলা জিজ্ঞেস করল।

-এই আর কি।

ভুবন বুঝতে পারছিল না যে কী বলবে। ওর আবেগ, ওর আনন্দ এত কাছে থেকেও যথেষ্ট দূরে। সুশীলার সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছিল যে ভালো বন্ধু ছাড়া আর কিছু হিসেবে ওকে ভাবতে সে রাজি নয়।

-আরেকটু সুগার মিশিয়ে নাও। সুশীলা বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে বলল, -দ্যাখ, ভালো লাগবে।

-নাহ, এই ঠিক আছে। সুগার, সল্ট আমি কম করেই খাই।

-তোমার ডেস্ক জব। সুশীলা কৌতুকপূর্ণ গলায় বলল, -সমতলে থেকে থেকে একেবারে বেঙ্গলী বাবু হয়ে গেছ।

-তুমি সেই স্মার্ট মেয়েটিই আছ।

হাল্কা আমেজে কথাবার্তা চালালেও ভিতরে ভিতরে ভুবন অস্থির হয়ে উঠেছিল। একটা কাজে সে এসেছে। এবারে সুশীলাকে বিদায় দিয়ে তাকে কাজে নামতে হবে। মনে হয় সুশীলা বুঝল ওর কথা। তাছাড়া সুশীলাকেও তার কাজের জায়গাতে ফিরতে হবে। ওকে আর আটকানো ঠিক হবে না। বিদায় নিয়ে সুশীলাই আগে উঠল। আবার ওর সঙ্গে দেখা হবে, এই প্রমিস দিয়ে সে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

 

অনেক দেরী হয়ে গেছে। মনে মনে সেকথা ভেবে নিয়ে দ্রুত পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে অফিস থেকে দেওয়া নম্বরটায় ফোন করল ভুবন। যার সঙ্গে তার দেখা হওয়ার কথা, সে যদি আর না আসে, তাহলে মুশকিল। গল্পে গল্পে বেশ কিছুটা সময় নষ্ট হয়েছে।  এখন কাজের সময়। পাহাড়ে মোবাইল টাওয়ার চট করে কাজ করে না। ভাগ্যে এক্ষেত্রে এক চান্সেই পেয়ে গেল।

আরে………একী……নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না ভুবন।

দরজার বাইরে যেতে যেতে সুশীলা দ্রুত তার মোবাইল বের করে উত্তর দিল,

-হ্যালো, জেনি বলছি………।

বজ্রাহতের মতন ফোন ধরে বসে থাকল ভুবন। তার আর উত্তর দেওয়া হল না। খেয়াল হল যখন দেখল যে দরজা দিয়ে সুশীলা আবার ভিতরে ঢুকছে। তবে চোরের মতন!

দ্রুত ফোনটা কেটে দিল ভুবন। সুশীলাকে আর ডাকল না সে। পাহাড়ে ফ্লেশ ট্রেডের একটা বৃত্ত তার সামনেই সম্পূর্ণতা পেল। বাকিটা আন্দাজে লিখে দিলে ক্ষতি কী?

এত এত আর্টিকেল লিখছে!

……০……

Leave a comment

Check Also

স্বীকারোক্তি

স্বীকারোক্তি- ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য্য

    আজই ফোনটা ডেলিভারি দিয়ে গেলো। অনলাইনে একবার দেখেই ভারি পছন্দ হয়ে গেছিল সমীর …

দর্পণে

দর্পণে – নির্মাল্য ঘরামী    

    -চল, আমি জোরের সঙ্গে বললাম, -ওসব একদম ভাবিস না। তোকে এতদিন পরে পাচ্ছি, …

ফয়সালা

ফয়সালা – নির্মাল্য ঘরামী

  -দেখুন স্যার। বলে সিকিউরিটি গার্ডটি বিজয়ীর দৃষ্টিতে মহাকুলসাহেবের দিকে তাকালো। তার হাতে ধরা ব্যাগটির …

রক্তগোলাপ/ মৌসুমী পাত্র/ পুণ্যতোয়া ধর

রক্তগোলাপ – মৌসুমী পাত্র

  একটা মোটা দড়ি থেকে পাশাপাশি ঝোলানো সারি সারি মৃতদেহ। ছাল ছাড়ানো। গত কদিন ধরেই …