ওরা ওকে আড়াল-আবডাল থেকে নজরে রেখেছিল। পূর্ণিমা রাত হওয়ার কোন অসুবিধে হল না। এবারে আর চাটনিকে কেউ ছাড়ল না। ও যে ডাইন, তার নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেছে। মঙ্গল–একেশ্বরও কিছু বলতে বা করতে পারল না।
ওদের কথা শুনবেটা কে?
সবাই তখন নিজের নিজের স্বাস্থ্য-সম্পদের রক্ষা করতে মরীয়া! চাটনি যে সিংরাই ওঝার মন্ত্রপূত ভাত খেয়েছে, তা উপস্থিত সকলেই দূর থেকে দেখেছে।
কাছেই পলাশ গাছটায় বাবুই ঘাসের দড়ি দিয়ে চাটনিকে ভাল করে বেঁধে বাঁশ দিয়ে সজোরে মারতে থাকল কারু, সারা দেহে খুঁচিয়ে চলল ভাটু তার বর্শাটা দিয়ে, আর মাঝে মধ্যে বড় বড় পাথর ছুঁড়ে মারতে থাকল ডোমান সহ বাকিরা। অচিরেই পূর্বের ক্লান্ত মৃতপ্রায় প্রাণটি এই লাগামছাড়া অত্যাচার আর সহ্য করতে পারল না। দেহটি এলিয়ে, ঝুঁকে পড়ল বেঁধে রাখা দড়ির উপরে। তাও ওরা রেহাই দিল না।
(*)
-হে ঈশ্বর, একটু দেখো আমাদের।
প্রতিদিনের মতন আজও বিধবা চাটনি খানিক দূর থেকে ঠাকুর থানের উদ্দেশ্যে ভক্তিভরে প্রণাম করে তার মিনতি রেখে বাড়ির পথ ধরল। আজও তার দেরী হয়ে গেছে। অনেক দূরে কুচিয়ার সাপ্তাহিক হাটে সে গেছিল রানীশোলের জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা ছাতু অর্থাৎ মাশরুম বিক্রি করতে। কিছুটা বিক্রি হয়েছে। বাকিটা নিয়ে ফেরার সময় সে একেবারে জামিরা নদীর জলে হাত-পা-মুখ ধুয়ে ঠাকুরের উদ্দেশ্য প্রণাম জানিয়ে ঘরের রাস্তা ধরল। তখন সন্ধ্যা প্রায় নেমে এসেছে দশকহানিয়া গ্রামে।
খানিক দূরে একটি অনুচ্চ বাঁশের মাচায় আর বাবুই ঘাসের দডির খাটিয়ায় গ্রামের জনা তিনেক বয়স্ক লোক মিলে তাদের বৈকালিক আড্ডা দিচ্ছিল। আরেকটু পরে তাদের আড্ডা ভাঙবে। তাদের মধ্যে মাচায় বসা কারু নামের একজন উঠে দাড়িয়ে অপসৃয়মান চাটনির দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে দেখল। তারপর খাটিয়ায় বসা বাকি আড্ডাধারীদের মধ্যে ভাটুকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-মেয়েটার ভাবগতিক কিন্তু সুবিধার নয় হে। আমার তো ভয় লাগে তোর জন্য। বলে বিজ্ঞের মত মাথা নাড়িয়ে আবার মাচার উপর বসে পড়ল।
-কেন? কিছু ক্ষতি করল নাকি? উদ্বিগ্ন গলায় বাবুই ঘাসের দড়ির খাটিয়ায় বসা ভাটু জিজ্ঞেস করল।
-আমার সে রকম মনে হচ্ছে গো। ওর হাব ভাব তো সুবিধার ঠেকে না।
-একটু খুলেই বলনা ভাই? ভাটু অনুরোধের সুরে বলল, – সাবধান না হলে আবার ক্ষতি না হয়ে যায়। ভাই, তুই একটু দিশা দেখা।
-যদি আমার কথা শুনিস তো তোর গরুটা বিকেলের আগে খোঁটা থেকে খুলে নিয়ে গোয়ালে রেখে আসিস।
অনুচ্চ টিলাটার খানিক নিচে বয়ে চলেছে জামিরা নদী। এই গ্রীষ্মে তাতে জল খুব কমে এসেছে। প্রায় সর্বত্রই বালি আর পাথরের সমাহার। তার মধ্যেই তির তির করে বয়ে চলেছে জামিরার সংকীর্ণ প্রবাহ। হেঁটেই পার হয় লোকে। আর নদীর বাম তীর থেকে থেকে হঠাৎই জেগে ওঠা টিলাটার ঠিক উপরেই পূজার থান। তার একটু নিচে টিলাটা থেকে খানিকটা দূরে বাঁশের ঝাড়। খানিকটা ঘাসের জঙ্গলও আছে সেইদিকটায়। তার থেকে খানিক দূরে কুটুস লতার বেড়া দাওয়া ভাটুর বাড়ি। তার বাড়ির পাশ থেকেই দশকহানিয়া গ্রামের বাকি বাড়িগুলো শুরু হয়েছে। উপস্থিত লোকেদের বাড়ি এই গ্রামেই।
-তুই কী বলতে চাস? ও কি চুরি করবে? বলে হাতের মুঠো পাকাল ভাটু। বলল সে, -মাথা ভেঙে দেব না।
-ওর চুরি করার সাহস হবে না। তবে কিনা…
বলতে বলতে বাক্য উহ্য রেখেই কথা শেষ করল কারু। কিছু কিছু কথা উহ্য থাকলেই তার গুরুত্ব বেশি থাকে। সেটা সে ভালো করেই জানে।
-তবে? তার মানে? চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল ভাটু। কিন্তু কারু’র তরফ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে সে প্রায় মিনতির সুরে বলল, -একটু খোলসা করে বল না কারু।
-আসলে ওকে তো অনেকদিন ধরে দেখছি। গম্ভীর গলায় কারু বলল, -আমার মনে হয় না ও ঠাকুরের উদ্দেশ্যে প্রণাম করে। ওর উদ্দেশ্য আলাদা। বলে চোখ দু’টি বড় বড করে নিজের মনেই মাথা নাড়ল কারু।
-মানে? চিন্তিত মুখে খাটিয়া থেকে নেমে কারুর কাছে চলে এলো ভাটু্ ।
-আসলে ঠাকুরথানের উদ্দেশ্যে প্রণাম করাটা ওর ভণ্ডামি। ও আসলে তোর গরুটাকে বাণ মারছে। ওকে আমি চিনি। ও একটা ডাইন।
কারু যে চাটনিকে চেনে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। চাটনি ওরই সদ্য মারা যাওয়া ভাই কারমু’র বিধবা স্ত্রী। তাই ওর কথার একটা আলাদা দাম আছে। তা ছাড়া পাশের নেড়াবনী গ্রামের সিংরাই ওঝার জিগরি দোস্ত কারু। অপদেবতা সংক্রান্ত কোন সমস্যায় তাকেই আশেপাশের দশ-বিশটা গ্রামের লোক স্মরণ করে, ভক্তি করে। ফলে এই সব ক্ষেত্রে কারুর কথাটা কেউ চট করে উড়িয়ে দিতে পারে না।
–সে রকম হলে চাটনির কপালে দুঃখ আছে। গম্ভীর মুখে জানাল ভাটু্।
-গতকাল সন্ধ্যার পর অঞ্চল অফিস থেকে ফিরছিলাম। বড় বড় চোখ ভয়াল গলায় কারু বলল, -স্পষ্ট দেখলাম চাটনি রানীশোলের জঙ্গলে ঢুকল। চাঁদনি রাতে সন্ধ্যার পর কারা ঢোকে বনে? বলে উপস্থিত লোকেদের দিকেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল সে।
-কথাটা মনে হয় কারু ঠিকই বলেছে। বিজ্ঞের মতন গলায় মাথা নাড়িয়ে ডোমান এতক্ষণে বলল, -বুঝলি, এত সময় ধরে কেউ থানে প্রণাম জানায়? তায় মেয়েমানুষ?
-সিংরাইকেই ডাকিস একদিন। আমি ঠিক বলছি কি বেঠিক, তা সেই প্রমান করে দেবে। গম্ভীর মুখে একথা বলে মাচা থেকে নেমে গেল কারু। সন্ধ্যা নামছে। এবার তাকে বাড়ি ঢুকতে হবে। শেষবারের মতন বলল, -আমার কথাটা ভেবে দেখিস। তোর ভালোর জন্যই বলা।
-মনে হয় তুই ঠিকই বলেছিস। কারুর মুখের দিখে চেয়ে ভাটু বলল, – আজ সকালে দেখি বাড়ির পিছনটায় কে যেন হেগে চলে গেছে।
-এ তো পরিস্কার ডাইনের কাজ। নিশ্চিত গলায় কারু ঘোষণা করল।
-সেরকম বুঝলে আমরা সিংহরাই ওঝাকে ডাকব। তখন দেখা যাবে।
বলে ডোমান আশ্বাস দিল ভাটুকে। তারপর আড্ডার জায়গা ছেড়ে পা বাড়াল বাড়ির দিকে। সাথে কারু। আর তাদের যাত্রাপথের দিকে হতচকিত মুখে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকল ভাটু।
(*)
-আজও সেই চিড়ে? আর জল? এভাবে আর ভালো লাগে না মা।
সন্ধ্যার সময় রাতের খাওয়া সারতে সারতে কিশোরী পিয়ারী তার মা চাটনিকে অনুযোগের সুরে বলল।
-কী করব? বাড়িতে কি অঢেল ট্যাকা আমার। আজ তো ছাতু প্রায় বিক্রিই হয়নি। চোখে দেখতে পাস না? খেতে খেতে মুখ তুলে ওর দিকে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল চাটনি।
-সব দিন কি এক ভাল লাগে? সেই তরশু দিন রাতে ভাত খেয়েছিলাম।
বলে গজগজ করতে করতে একদলা চিড়ে এক জায়গায় মাখিয়ে মণ্ড বানাতে থাকল পিয়ারী।
-তা আমার সাথে একটু তো হাটে গেলে পারিস। দু’জনে মিলে ছাতু, শাক বেচলে লাভ আছে। তা তো আর যাবি না। তোর নাকি লজ্জা লাগে।
চাটনি বিরক্ত মুখে এ কথা বলে খাওয়ায় মন দিল। কয়েক মাস হল টাইফয়েডে ভুগে তার স্বামী কারমু মারা গেছে। মাথা গোঁজার এই বাড়িটা ছাড়া রেখে যাওয়ার মতন সম্পত্তি বলতে বিশেষ কিছু নেই। নদীর দিকে প্রায় বিঘা তিনেকের একটা জমি আছে। মানে ছিল, তবে রাখতে পারব কিনা ও নিশ্চিত জানে না। জমিটা উর্বর। ভাল চাষ হত। তবে তা নিয়ে ভাসুর কারু’র সাথে ওদের টানাটানি চলছে। কারুর কথা যে কারমু’র অসুখের সময় সে ওকে অনেকটা টাকা দিয়েছে। শর্ত ছিল যে দু’ মাসের মধ্যে কারমুর সেরে উঠে সুদে-আসলে পুরোটা শোধ দিয়ে দেবে। কিন্তু কারমু মারা যাওয়ায় তার টাকা মার যেতে বসেছে। তাই তার দাবি যে কড়ায়-গণ্ডায় পাওনা টাকা শোধ না করলে ওই জমি সে চাটনিকে চাষ করতে দেবে না। তবে জমিটা চাটনি ওকে লিখে দিলে সে অবশ্য কিছু টাকা দিতে রাজি। কিন্তু চাটনি’র রোখ চেপে গেছে যে সে ওই জমিটা কিছুতেই বিক্রি করবে না। আর তাই কারু’র বাধায় জমিতে চাষ বন্ধ। ঠিকা শ্রমিকের কাজেও কেউ চট করে ওকে ডাকে না। কিন্তু মেয়ে পিয়ারী সে সব বুঝলে তো!
-মা শুনছ? কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মুখ তুলে প্রশ্ন করে মায়ের সাড়া দেওয়ার অপেক্ষায় চেয়ে থাকল পিয়ারী।
-হাঁ, বল তুই। খাওয়া থেকে মন না সরিয়ে চাটনি বলল।
-রুইয়া বলছিল যে কাল ব্লক অফিস থেকে ও কিছুটা চালের বাবস্থ্যা করে দেবে। বলে মুখ নিচু করে কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করল, -যাবে?
–তোর সাথে ওর আবার দেখা হল কী করে? চাটনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
-ও আজ এদিকে এসেছিল পুরোনো জামা কাপড় বেচতে। আমাদের অবস্থা শুনে বলল যে কাল ও ব্লক অফিস যাবে, আমরাও যেন সকাল সকাল সেখানে চলে যাই। ওর চেনা এক বাবুকে বলে দশ-বারো কিলো সরকারী চালের ব্যবস্থা করে দেবে।
-কাল তো কোথাও হাট নেই। কিছুটা ভেবে চাটনি বলল -চল যাই। তারপরে কিছুটা সংশয়ভারে চাউনি মেলে পিয়ারী’র দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল, -তা সত্যি দেবে? নাকি এতটা পথ হেঁটে গিয়ে ফিরে আসতে হবে খালি হাতে?
–না, না, বলছিল যে সত্যি ব্যবস্থা হয়ে যাবে। পিয়ারী আশ্বাসের সুরে বলল, -সেই বাবু নাকি প্রায়ই ওর থেকে টাকা ধার নেয়, মাইনে পেয়ে শোধ দেয়। ওর কথা ফেলবে না।
-তাহলে চল কাল সকাল সকালই বেরিয়ে পড়ি। চাটনি উৎসাহী গলায় বলল, -যেতে তো প্রায় তিন ঘণ্টা লাগবে। সকাল সকাল রওনা দেওয়াই ভাল।
(*)
-তাহলে কাকি, এখানেই তুমি খানিক বস অন্যদের সাথে। একটু সময় লাগবে। ব্লক অফিসের একপাশে রিলিফের গোডাউনের সামনে একটা সিমেন্টের চাতালমতন জায়গায় সার বেঁধে বসে থাকা প্রায় জনা দশেক প্রায় অথর্ব বুড়ো-বুড়ির লাইনে চাটনিকে বসিয়ে দিয়ে রুইয়া বলল, -তোমার দরখাস্ত লিখে ভিতরের অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছি। কিছু সময় বাদে তোমার নাম ধরে ডেকে একটা স্লিপ দেবে। সেটা হাতে নিয়ে ওই অফিসটাতে যাবে। বলে কিছু দূরে একটা ছোটমতন অফিস দেখিয়ে বলল, -ওখান থেকে ওরা তোমাকে মেপে চাল দিয়ে দেবে। নিয়ে তারপরে ঘরে যেও।
-তা তুমি বাবা কাছেই থাকছ তো? উদ্বিগ্নস্বরে চাটনি বলল, -কোনদিনও তো এদিকে আসিনি। কোথায় যে কী হয়ে যায়?
–আরে কাকি ভয়ের কিছু নেই। রুইয়া আশ্বাস দিয়ে বলল, -আমারও তো ব্যবসা আছে। সবসময় হয় তো দেখতে পাবে না। তবে আমি ধারে কাছেই থাকব। বলে লাইনে দাঁড়ানো বাকিদের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, -ওরা সব তোমার মতই চাল নিতে এসেছে। তুমি একলা নও। ঘাবড়িও না। আর লাইন ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেও না, তা হলে চাল পাবে না।
এ কথা বলে ধীরে ধীরে পা চালিয়ে ব্লক অফিসের জনারণ্যে মিশে গেল রুইয়া। সেদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে মেয়ে পিয়ারী বলল,
-মা তুমি একটু বস। আমি ওদিক থেকে একটু ঘুরে আসি। বলে আঙ্গুল দিয়ে কিছুটা দূরে ব্লক অফিসের পাঁচিলের গায়ে শ্যাওড়া গাছের তলায় একটা জটলা দেখিয়ে পিয়ারী বলল, -আসার সময় দেখলাম ওদিকে একটা লোক হরেক রকমের জড়িবুটি বিক্রি করছে। দেখে আসি। সে রকম বুঝলে আমিও জঙ্গল থেকে ওসব তুলে বিক্রি করব।
-তাড়াতাড়ি চলে আসিস কিন্তু। চাটনি সাবধানী গলায় বলল, -এদিকে তো আগে কোনদিন আসিনি। কেমন যেন ডর লাগছে।
-তুমি কিছু চিন্তা কোরো না মা। পিয়ারী আশ্বাস দিয়ে বলল, -আমিও কি আর সেই ছোট আছি? একটু ঘুরে-টুরে দেখে নিয়ে ঠিক সময়ে চলে আসব। কিচ্ছু ভেব না।
বলে নিরুদ্বিগ্ন মুখে জটলার দিকে পা বাড়াল পিয়ারী। আর ওর যাত্রাপথের দিক থেকে চোখ সরিয়ে পিছনের দেওয়ালে পিঠ হেলিয়ে ঠেস দিয়ে আরাম করে বসল চাটনি।
(*)
ওদিকে বেলা একটু গড়াতেই দশকহানিয়া গ্রামে ভাটুর বাড়িতে হই-হই শুরু হয়ে গেল। আশেপাশের প্রতিবেশীরাও নিজের নিজের কাজ ভুলে ভিড় জমাল ভাটুর বাড়িতে। ভাটুর দুধেল গরুটা সকাল থেকে কিছু খাছেনা। ভাটু আর তার বাড়ির লোকেরা মিলে অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। গরুটা শক্তভাবে মুখ বন্ধ করে বসে আছে। মুখে কুটোটি নাড়ছে না। অনেক কষ্টে মুখ খুলে কিছুটা তাজা ঘাস দিয়েছিল ভাটু। কিন্তু কাজ তো হয় নি উল্টে গরুটা দ্রুত মুখ বন্ধ করতে গিয়ে ভাটুর ডান হাতের কড়ে আঙ্গুলটাকে চোয়ালে পিষে দিয়েছে। ফলে রক্তারক্তি কাণ্ড বেঁধেছে। কেউই আর ভাটুর গরুটাকে কিছু খাওয়াতে সাহস করছে না।
বেলা বেশ বাড়তে বেগতিক দেখে কারুর পরামর্শে ভাটুর ছেলেটা গিয়ে পাশের নেডাবনী গ্রাম থেকে সিংরাই ওঝাকে ডেকে নিয়ে এল। সিংরাই এলে পর একধারে ডেকে নিয়ে গিয়ে তাকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল কারু। কিছু পরে সিংরাই ফিরে এসে গম্ভীরমুখে গরুটাকে দেখতে লাগল। আর মাঝে মাঝে অস্পট সুরে নানান মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকল। দেখতে দেখতে সিংরাইয়ের মুখে কালবৈশাখীর আঁধার ঘনিয়ে এল। স্পষ্ট বোঝা গেল যে সাংঘাতিক কোন কিছুর হদিস সে পেয়েছে। ভয়ে ভয়ে ভাটুই এগিয়ে এসে জানতে চাইল,
-কিছু বুঝলে খুড়ো?
-এ সহজ ব্যাপার নয় রে। মাথা নেড়ে জানাল সিংরাই।
-কেন খুড়ো? কি বুঝলে? কারু এগিয়ে এসে জানতে চাইল।
-ভাটুর গরুটাকে কোন ডাইনে বাণ মেরেছে। আগে সেই বাণ কাটাতে হবে। নইলে এই দুধেল গরুটা না খেতে পেয়ে মারা যাবে।
-বল কী গো খুড়ো! বলে একটু থামল ভাটু। তারপর উত্তেজিত স্বরে বলল, -কোন শয়তান ডাইন করল এটা?
–সেটা তো পরীক্ষা করে দেখতে হবে। সময় লাগবে। আগে থেকে কী করে বলব?
–তাহলে খুড়ো পরীক্ষা করে দেখ না কে করেছে। জানতে পারলে দেব মেরে তাকে। ক্ষুদ্ধ স্বরে ভাটু বলল।
-দাঁড়া, দাঁড়া! অ্যাত রেগে যাস না। খুড়োকে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে দে। কারু মোড়লি চালে বলল, -যা, যা জানতে চায়, সোজা-সাপটা উত্তর দিয়ে দিস। তাহলে ডাইনটাকে খুঁজে বের করা যাবে। তাই শুধু না, গাঁ-সুদ্দু আমরাও তার হাত থেকে বাঁচব।
-তোর কার কার উপরে সন্দেহ হয়? সিংরাই সরাসরি ভাটুকে জিজ্ঞেস করল, -গ্রামের কারুর হাবে-ভাবে কথা-বার্তায় কোন কিছুর আভাস পেয়েছিলি গত ক’দিনে?
–কাল তো চাটনিকে দেখলাম দূর থেকে ঠাকুর থানকে প্রণাম জানাতে। ভাটু একটু ভেবে বলল, -আর আমার গরুটাও তখন কাছাকাছি ছিল। তা ছাড়া কাল সকালে দেখি বাড়ির পিছনটায় কে যেন পায়খানা করে চলে গেছে।
–আর আমি পরশু চাঁদনি রাত্রে সন্ধ্যার কিছু পরে চাটনিকে দেখেছি রানীশোলের জঙ্গলে ঢুকতে। কারু শক্ত মুখে বলল, -তা ছাড়া আমার ভাই কারমুর হঠাৎ জ্বরে ভুগে মরে যাওয়াটা মোটেও স্বাভাবিক নয়। চাটনি যে কী দেখভাল করল ওর?
-আমার কিন্তু চাটনির মেয়ে পিয়ারীটাকে ভাল মনে হয় না। ডোমান মাথা নেড়ে বলল, -ওই হাতিরপাল গ্রামের রুইয়ার সাথে দেখা হলেই কী যে গুজ-গুজ ফুস-ফুস করে, আমার তো ওকেই ডাইন বলে সন্দেহ লাগে।
-আর কেউ? সিংরাই জিজ্ঞাসা করল, -আর কারুর উপর সন্দেহ হয়?
-না, সন্দেহ করার মতন আর কেউ নেই গ্রামে। কারু নিশ্চিত স্বরে জানলো। তারপর ভিড়ের দিকে ফিরে বলল, -আছে কেউ? আমার তো মনে হয় না।
-সন্দেহ করার আর কেউ নেই গ্রামে। ডোমান কারুকে সমর্থন করে বলল, -আর সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত।
গ্রামের বাকিরা ওদের সুরে সুর মেলাল। ওদের মধ্যে মতৈক্য হতে দেখে সিংরাই এগিয়ে এসে বলল, তা হলে তোরা আমাকে আগে পরীক্ষা করে দেখতে দে- ওদের মধ্যে কে ডাইন, না কি দু’জনেই? তারপর ভাটুর দিকে ফিরে বলল,
-যা গিয়ে তোর বাড়ির ভিতর থেকে দু’টে কাপড়ের টুকরো আর খানিকটা চালের গুঁড়ো নিয়ে আয় তো।
ভাটু নিজেই বাড়ির দিকে গেল ওগুলো নিয়ে আসতে। সেদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে সিংরাই কারুকে জিজ্ঞেস করল,
-ধারে কাছে কোন উইয়ের ঢিবি আছে?
-ওই খেজুর গাছটার কাছে আছে। বলে খানিক দূরের ডাঙ্গা জমির দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাল কারু।
-চল কারু, দেখি কেমন বটে। বলে কারুকে নিয়ে সেদিকে পা বাড়াল সিংরাই। যেতে গিয়ে একটু থেমে বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলল, -তোরা থাক। আমি এখনি ফিরছি।
কিছুক্ষণ পরে সিংরাই কারুকে নিয়ে ফিরে এল। ততক্ষণে ভাটু চালের গুঁড়ো আর দু’ টুকরো কাপড় নিয়ে ফিরে এসেছে। প্রথমে কাপড় দু’টির উপরে কিছুটা করে চালের গুঁড়ো রেখে দিল সিংরাই। তারপর সাথের ঝোলা থেকে একটা কাগজের টুকরো বের করে সেটাকে দু’ টুকরো করে টুকরো দু’টোতে চাটনি আর পিয়ারী নাম লিখে কাগজের টুকরো দু’টো কাপড় দু’টিতে রাখা চালের গুঁড়োর পাশে রেখে দিল সে। তারপর সাবধানে কাপড়ের সেই টুকরো দু’টো নিয়ে এগিয়ে চলল উইঢিপিটার দিকে। উইঢিপিটার একটা দিকে খানিকটা গর্ত করে সাবধানে কাপড়ের টুকরো দু’টোকে রেখে দিল সেই গর্তে। তারপর বাকিদের দিকে চেয়ে বলল,
-কিছুক্ষণ দেখি। তারপর বোঝা যাবে ডাইনটা কে!
বলে সদল বলে এসে বসল কাছেই একটা অর্জুন গাছের নিচে। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কেটে গেল পর সে একবার উঠে গেল উইঢিপিটাতে রাখা চালের গুঁড়ো উইয়ে খেল কিনা দেখতে। পিছন-পিছন বাকিরা। কাপড়ের টুকরো দু’টোতে একঝলক চোখ বুলিয়েই সে উল্লসিত গলায় বলল,
-পেয়েছি, দুটোই ডাইন। এই দ্যাখ তোরা, উই বেরিয়ে এসে দু’টো কাপড়ের চালেই মুখ দিয়েছে।
বলে ধীরে ধীরে চালের গুঁড়ো সহ কাপড়ের টুকরো দু’টো এক এক করে বের করে এনে মাটির উপর রেখে দিল সে বাকিদের দেখার জন্য। দেখা গেল টুকরো দু’টোতেই উই ঘুরে বেড়াচেছ।
-আর পরীক্ষা করার দরকার নেই। বলে নিদান দিল সিংরাই, -ও দু’টোই ডাইন। ওরা টিকে থাকলে কপালে অনেক দুঃখ আছে তোদের। দ্যাখ, এবার তোরা যা ভাল বুঝিস।
-কিন্তু খুড়ো, আরেকটু পরীক্ষা করে দেখে নিলে ভাল হত না? ভিড়ের মধ্যে থেকে চেঁচিয়ে উঠে মঙ্গল বলল, -আরেকটা যে কোন পরীক্ষা নাও। তাহলে নিশ্চিত চেনা যেত ডাইনটাকে।
মঙ্গলের বাবা বেঁচে থাকতে তাদের সঙ্গে কারমুর বাড়ির লোকেদের সম্পর্ক ভাল ছিল। ইদানিং কারমুর মৃত্যুর পর সেই সম্পর্কে টান পড়েছে। কিন্তু মঙ্গলের সাথে কারমুর ভাই কারুর সম্পর্ক মোটেও ভাল নয়। তবে তাজা যুবক মঙ্গলের গ্রামে ভাল প্রভাব আছে। ফলে কারু তাকে সমঝে চলে।
-কেন রে? কারু জিজ্ঞেস করল, -এত ভাল ভাবে চেনা গেল ডাইনটাকে, এবার তুই বলছিস অন্য পরীক্ষা করতে।
-বেওয়া মেয়ে খুড়ো। দেখলে মায়া হয়। বলে সিংরাই ওঝার দিকে তাকিয়ে মঙ্গল বলল, -তুমি আরেকটা পরীক্ষা করে দেখ খুড়ো। তা হলে নিশ্চিত হওয়া যায়।
-মঙ্গল ঠিক বলেছে খুড়ো। পাশ থেকে মঙ্গলের বন্ধু একেশ্বর বলল, -তুমি আরেকটা পরীক্ষা করে নিশ্চিত প্রমাণ দাও আমাদের।
-আরে ডাইন পাওয়া গেছে, এবারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। আর তোরা বাধা দিচ্ছিস? উত্তেজিত স্বরে কারু বলল, -এভাবে চললে আজ ভাটুর সর্বনাশ হয়েছে। কাল অন্য কারুর সর্বনাশ হবে।
-ওটার মাথা ন্যাড়া করে গাছের সাথে বেঁধে না পেটালে আমি শান্তি পাব না। রাগত স্বরে ভাটু বলল, -মাগীটা আমার এ কি সর্বনাশ করে ছাড়ল বল দেখি!
–আরে খুড়ো, মঙ্গল সিংরাই ওঝাকে দেখিয়ে ডোমানকে বলল, -খরচাপাতি না হয় আমি দেব। কিন্তু আরেকটা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যাক। তারপর সিংরাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, -খুড়ো, তুমি আগে গরুটার ওষুধ পত্রের ব্যবস্থা কর দেখি। অত ভাল দুধেল গরু সারা গ্রামে একটিও নেই।
পরিস্তিতি কিছুটা ঘুরে যেতে দেখে সিংরাই সতর্ক হয়ে গেল। সে কাপড়ের টুকরো দু’টো থেকে চাল ঝেড়ে কাগজের টুকরো দু’টো হাতে নিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বলল,
-আমি এই টুকরো দু’টো কাঠের টুকরোয় আটকে ওই শাল গাছটার ডালে বেঁধে দিচ্ছি। কাল সকালে যারটা ঝরে যাবে সেই ডাইন। তারপর ভাটুর দিকে তাকিয়ে বলল,
-তোর ছেলেটাকে পাঠিয়ে দিস আমার সাথে। আমি মন্ত্রঃপূত ওষুধ দিয়ে দেব, একটা বড় বেগুনের মধ্যে। ওটা কয়েকজন মিলে জোর করে গরুটার মুখ খুলে খাইয়ে দিবি। কাল থেকে ও সেরে যাবে। আর ডাইন কে ঠাণ্ডা করতে তুই চাটনির বাড়ির কাছাকাছি খানিকটা ভাত আর উনুনের ছাই একটা সদ্য কাটা কলাপাতায় করে রেখে দিবি। একটা শিশিতে মন্ত্রপড়া জল দেব, সেটা ওই ভাতে ছড়িয়ে দিবি। মা-মেয়ের মধ্যে যে ওটা খাবে, সেই ডাইন। ওটা খেলে সে কিছুদিন ঠাণ্ডা থাকবে, কারুর ক্ষতি করবে না। এর মধ্যে তোদের ফয়সালা করে নিতে হবে কী চাস- ডাইন রাখবি না ভাগাবি!
বলে কাগজের টুকরো দুটো ঝোলা থেকে বের করে দু’টো কাঠের টুকরোয় আটকে নিয়ে সে এগিয়ে চলল কিছুটা দূরে একটা শাল গাছের দিকে। তারপর সঙ্গের ঝোলা থেকে সুতো বের করে কাগজের টুকরো দু’টোকে সাবধানে বেঁধে দিল শাল গাছটার নিচু হয়ে আসা একটা ডালে। তারপর বিড়-বিড় করে কিছু গুহ্য মন্ত্রোচছারণ করে ফেরার রাস্তা ধরল সে, সাথে বাকিরা।
(*)
প্রায় ঘণ্টা তিনেক ওখানেই বসে ছিল চাটনি। মাঝে একবার উঠে গিয়ে কলটা পাম্প করে খানিকটা জল খেয়ে এল। কিন্তু ওদেরকে কেউ আর ত্রাণের চাল দিতে আসে না। লাইনের কে একজন খোঁজ নিতে গেছিল। সে ফিরে এসে বলল,
-আজ আর চাল দিবেক নাই। বিডিও বাবু শুনলাম জেলা সদরে গেছে, এখনও ফিরে নাই।
–আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকব?
পিছন থেকে অসহিষ্ণু গলায় এক বয়স্ক মহিলা জানতে চাইল। আরও কিছুক্ষণ যাওয়ার পর ওদের বিরক্তি আর ধৈর্য যখন চরম সীমা পৌঁছে গেছে, ওদের কেউ কেউ হাঁক ডাক শুরু করেছে, এমন সময় ব্লক অফিসের এক বাবু এসে ওদের বলল পরদিন আসতে।
-তাহলে আগে বললে না কেন? এতক্ষণ বসে আসি আমরা। মাতব্বর গোছের একজন উত্তেজিত মুখে সেই বাবুকে ঘিরে ধরে বলল।
-আমি কি করব? সাহেব না থাকলে কোন কাজ হয়? বাবুটা নির্বিকার গলায় বলল, -তোরা কাল আয়।
ওদের মধ্যে কয়েকজন কিছুক্ষণ তর্ক করল। কিন্তু বাবুটি নাছোড়। বিডিওসাহেব না এলে কিছু করা যাবে না, তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ার নেই। এতক্ষণ বসে ওরা কাহিল হয়ে গেছিল। শেষটায় ক্লান্ত হয়ে ওরা রণে ভঙ্গে দিল। চাটনি ওর মেয়েকে খুঁজতে থাকল। কিন্তু আশ পাশ ভাল করে খুঁজেও ওর মেয়েকে দেখতে পেল না। বরং দেখা হয়ে গেল ভুঁদুলের সাথে। সে ওদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় হয়। পাশের অঞ্চলের ঘোড়াবাঁধ গ্রামে তার বাড়ি। সে দ্রুত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে সেই বাবুটির দিকেই আসছিল। চাটনিকে দেখে অবাক হয়ে সে জিজ্ঞেস করল,
-তুই এখানে?
–হ্যাঁ ব্লক অফিসে এসেছিলাম যদি খানিকটা চাল পাওয়া যেত। তা তুই কেন এখানে?
–যদি একটা ধুতি পাওয়া যায়। এটার অবস্থা খারাপ। তা, শেষে শুনলাম বিডিওবাবু নেই। আজ আর হবে না।
-হ্যাঁরে তুই আমার মেয়ে পিয়ারীকে দেখেছিস। চাটনি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে জানতে চাইল, -ও সেই যে জায়গাটা একটু ঘুরে দেখি বলে চলে গেল, আর দেখতে পাচ্ছি না।
-সে কি রে? ভুঁদুল অবাক হয়ে বলল, -অনেকক্ষণ আগেই তো পিয়ারীকে দেখলাম বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে। সাথে একটা চালাক-চতুর ছেলে। কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করতে ছেলেটাই বলল যে পিয়ারী নাকি জেলা সদরে কার বাড়িতে থেকে বাচ্চা দেখাশুনোর কাজ করবে। তোর অমত নেই। মাইনেও ভাল। ভুঁদুল অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল, -তা তুই জানিস না?
-কী রকম দেখতে ছেলেটা? অধীর গলায় জানতে চাইল চাটনি। ওর কি রকম সন্দেহ হছিল এবারে। কেননা দু’ইজনেই ওকে মিথ্যে কথা বলেছে। তারপর রুইয়ার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে জিজ্ঞেস করল, তার মতন দেখতে কিনা।
-একদম তাই। ওই ছিল সাথে। নিশ্চিত গলায় ভুঁদুল বলল, -কথা বলতে বলতে বাস এসে গেল। ওরা হাসতে হাসতে চেপে বসল বাসে। তোর কথা জানতে চাইলে বাসে উঠতে উঠতে পিয়ারীই বলল যে তুই বাড়িতে আছিস। ও মাসখানেক কাজ করে মাইনে নিয়ে একেবারে বাড়ি ফিরবে।
আর ভাবতে পারছিল না চাটনি। স্পষ্ট বুঝতে পারছিল যে ওর মেয়ে ওকে মিথ্যে বলেছে। সম্ভবত রুইয়া’র পরামর্শে। ওরা দুজনে ষট করেই বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু সত্যি কি শহরে গেছে?
নাকি অন্য কোথাও?
আদৌ কি ওর মেয়ে ফিরবে?
রুইয়াকে তো সে বেশিদিন চেনে না। ছেলেটা জিনিসপত্র কেনা-বেচার জন্য মধ্যে মধ্যে গ্রামে আসে। আর গল্প-টল্প করে সবার হাঁড়ির খোঁজ-খবর নেয়। ইদানিং যা সব গল্প শুনতে পায় হাটে বসলে!
ওর একমাত্র মেয়েটার যে কী হবে?
আর যদি না ফেরে কোনদিন?
চাটনির তো জীবনটা কারমু মারা যাওয়ার পর থেকেই বরবাদ হয়ে গেছে। কিন্তু তার আগে সুখে-দুখে একরকম মন্দ কাটেনি। কিন্তু পিয়ারীর জীবনটা মনে হয় শুরুতেই শেষ হয়ে গেল। মা হয়ে ও শুধু দেখেই গেল। কিছু করতে পারল না। ভাবতে ভাবতে চোখে জল এসে গেল চাটনির। ডান হাত দিয়ে চোখ দুটি মুছে অবাক ভুঁদুলের সাথে আর কোন কথা না বলে নীরবে মাথা নেড়ে বাড়ির পথ ধরল সে। অনেকটা পথ হাঁটতে হবে তাকে।
(*)
খুব খিদে পেয়ে গিয়েছিল চাটনির। সেই সকালে তাড়াহুড়ো করে গতকালের বেঁচে যাওয়া ছাতু দিয়ে ঝোল করে খেয়ে বেরিয়েছিল মা-মেয়ে মিলে। মেয়েটা তার ফিরলে হয়……। তারপর সারাদিন আর খাবার জোটেনি। আর এখানেই এসেই যা ধকলটা গেল বটে। ভাবলে এখনও শিউরে ওঠে চাটনি।
বিকেলের দিকে তখন বাড়ির কাছাকাছি এসে সবে দূর থেকে ঠাকুর থানকে প্রণামের উদ্দেশ্যে হাত জোড় করেছে চাটনি, এমন সময় ওকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে তেড়ে এল ভাটু। সাথে কারু আর ডোমান।
-শালা ডাইন মাগী! ভাটুর সেই রণমূর্তি আগে কখনও দেখেনি চাটনি। সে উত্তেজিত গলায় বলল, -আমার গরুটাকে বাণ মেরে তোর শান্তি হয়নি। এবার কি আমাকে সবংশে মেরে ফেলবি?
–তুই কী বলছিস? বিস্ময়ে হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল চাটনি, -কোনোদিন তোদের কারুর কোন ক্ষতি আমি করি নি।
-তুই মাগী আমার ভাই কারমু কে খেয়েছিস। চিৎকার করে কারু বলল, -নইলে সুস্থ, সবল, জোয়ান লোকটা এক মাস মোটে জ্বরে ভুগে মারা যায়?
-ওরে তোদের পায়ে পড়ি আমি, থাম তোরা। কান্নাভেজা গলায় চাটনি বলল, -আমার স্বামীকে মারব আমি? ওরে সে যাওয়ার সাথে সাথেই যে আমার আশা-ভরসা চলে গেল।
-তুই একটা ক্ষুর নিয়ে আয় তো, ডোমান চিৎকার করে ভাটু কে বলল –মাগীকে নেড়া করে মাথায় পেচ্ছাপ ঢেলে ওই শ্যাওড়া গাছটায় বেঁধে পিটুনি দিলেই সব কবুল করবে। আজ ভাটুর গরুটাকে বাণ মেরেছে। মাগী বেঁচে থাকলে কাল আমাদের দিকে নজর দেবে। গরু-মোষ তো বটেই, গ্রামের লোকেদের জ্বর-জারি আর সারবে না। দাঁড়া তোকে দেখাছি মজাটা!
বলে ঘাড় ধরে সে অবলীলায় চাটনিকে টেনে নিয়ে চলল খানিকটা দূরের শ্যাওড়া গাছটার দিকে।
-ছাড়, আমায় ছাড়। তোর পায়ে পড়ি, ছাড়! হাত-পা ছুঁড়ে মিনতি করে বলল চাটনি – কালই আমি গ্রাম ছেড়ে চলে যাব। ছেড়ে দে আমায়।
-দাঁড়া মাগী, তোকে চিরদিনের মতন ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা করছি। চাটনির এক খানা হাত জোর করে ধরে কারু বলল, -ক্ষুর টুর নয় চল, চল পিটিয়ে মারি ডাইনটাকে।
-ছাড় আমায়, ছাড়! বাঁচাও! বাঁচাও! যথাসম্ভব জোরে চিৎকার করতে করতে সাহায্য চাইতে থাকল চাটনি। ওর চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে আশ-পাশ থেকে ছুটে এল কিছু লোক। কিন্তু ডাইনের তো শেষ রাখতে নেই! তাই কয়েকজনের মনে প্রছন্ন সহানুভূতি থাকলেও চুপ করেই ছিল সবাই। শুধু একেশ্বর জোর গলায় বলল
-খুড়ো, ছাড় এখন তোমরা ওকে। সিংরাই ওঝা যা বলে গেল, তাই করে দেখ। তখন ডাইন প্রমাণ হলে আর আমি তোমাদের বাঁধা দেব না।
কয়েক ঘা চড়-থাপ্পড় মেরে নাক-মুখ দিয়ে রক্ত তুলে, গালে কালশিটে ফেলে, পরনের পুরোনো কাপড়টা ছিঁড়ে ফালা ফালা করে, খামছে কিছুটা চুল টেনে ছিঁড়ে নিয়ে তবেই ওকে ছাড়ল ওরা। তাও একেশ্বর ছিল বলে রক্ষা। নইলে আজ আর রেহাই ছিল না। ওকে আধমরা করে ফেলে গিয়ে চলে গেল ওরা।
(*)
কতক্ষণ ওখানে নিঃসাড়ে পড়ে ছিল, চাটনি জানে না। শুধু যখন হুঁশ হল, তখন রাত হয়েছে। মুখ ফুলে গেছে। নাক আর মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে জমে কালচে হয়ে গেছে। বাঁ পায়ের দুখানা আঙ্গুল মনে হয় ভেঙ্গে গেছে। জ্বর জ্বর ভাব আর সারা গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা।
কোনরকমে কাতরাতে কাতরাতে উঠে পড়ল চাটনি। আর পরক্ষণেই পরিশ্রমে, খিদে-তৃষ্ণায় গায়ের ব্যথায় উল্টে পড়ে গেল মাটির উপরে। খানিকক্ষণ পরে কোনগতিকে আবার উঠে দাঁড়াল। তারপর ক্লান্ত, বিধ্বস্ত শরীরটা নিয়ে এগিয়ে চলল বাড়ির দিকে। কিছুক্ষণ পর ধুঁকতে ধুঁকতে সে এসে বসল বাড়ির দাওয়ায়। আর চাঁদের আলোয় পরক্ষণেই নজরে এল কিছুটা দূরে দাওয়ায় কলাপাতার উপর খানিকটা ভাত রাখা।
মনে হয় কোন সহৃদয় প্রতিবেশী ওর কথা ভেবে গোপনে রেখে গেছে ভাতটা।
আর বেশি কিছু ভাবতে পারল না চাটনি। মৃতপ্রায় শরীরটাকে কোনগতিকে টেনে নিয়ে চলল সেই ভাতের উদ্দেশ্য………। আর গ্রোগ্রাসে গিলতে শুরু করে দিল……।
ক্ষুধা-তৃষ্ণা মানুষ তথা জীব জগতের জৈবনিক ব্যাপার। কিন্তু এই প্রাকতিক, জৈব চাহিদার আড়ালে যে অজৈব ক্ষুধা চিরদিন নিজেকে গোপন করে এসেছে, তার হদিশ হয়তো আমাদের অজানাই থেকে যাবে।
******************************************************
অঙ্কনঃ চিরঞ্জীব বিশ্বাস