এক যে ছিল গাধা। রোজ সকালে সে গান গাইত- সা রে গা মা পা ধা- গা…ধা… গা…ধা…।
তা অত সাতসকালে হেঁড়ে গলায় গান গাইলে কার না রাগ ধরে? ভোরবেলাটাই তো সবাই একটু আরামে ঘুমোয়। আর ঠিক সেই সময়েই গাধার রোজ গান গাওয়া চাই। যেই না অন্য জন্তু জানোয়ারেরা গান থামানোর জন্য বলতে আসত, অমনি গাধা খুব মেজাজের সঙ্গে জবাব দিত, “তোমরা গানের বোঝটা কী, বাপু? এ তো যে সে গান নয়, এ হল গর্দভ রাগিণীতে গান। বুঝলে?”
তাই শুনে খরগোশ, কচ্ছপ, ভালুক, হাতি বা আর যেই না থাকুক, ঠোঁট বাঁকিয়ে বলত- “হ্যাঁ রে, বাপু, হ্যাঁ। ‘গর্দভ’ মানে তো গাধা। গাধা তো গাধার মতোই গাইবি। তাই নিয়ে অত নাক উঁচু করার কী আছে রে?”
কিন্তু তাদের সে কথা গাধার কানে গেলে তো? সে তো ততক্ষণে ফের গান জুড়েছে- সা রে গা মা পা ধা—গা… ধা… গা… ধা…।
ফলে যে যার মতো গাধার গানের গুঁতো থেকে পালিয়ে বাঁচত।
কিন্তু এভাবেই আর কদিন চলে? না ঘুমিয়ে আর কাঁহাতক পারা যায়? ফলে বনের বাকি পশুরা সকলে মিলে একদিন বসল আলোচনায়। হাতি বলল, “গাধার এই গান থামাতেই হবে।”
সজারু আর হরিণ সাথে সাথে সায় দিল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, থামাতেই হবে।”
শিয়াল সরু চোখে তাকাল, “তা তো ঠিক, কিন্তু থামাবে কী করে?”
ভালুক গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে বলল, “গাধাটা তো কোন কথা শুনতেই চাইছে না।”
হনুমান নিমডাল দিয়ে দাঁত মাজছিল পাশের তেঁতুলগাছে বসে। এতক্ষণে তড়াক করে নেমে এসে বলল, “তা তোমরা সিংহদিদার কাছে গেলেই তো পারো।”
কাঠবেড়ালি বলল, “সেই ভালো। চলো, সিংহদিদার কাছেই যাই।”
সকলে মিলে সিংহদিদার কাছে পৌঁছোল যখন, তিনি তখন গুহার বাইরের রোদে বসে একটা চিরুনি দিয়ে পিঠ
চুলকোচ্ছিলেন। ওদের দেখে ভারি খুশি হয়ে বললেন, “এই যে, বাছারা সব। এত সকাল সকাল কী মনে করে?”
ওরা সবাই মিলে সমস্যার কথা জানাল। শুনেটুনে সিংহদিদা গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ালেন, “যা বলেছিস। গাধাটার হাঁকেডাকে আমারো সকালের ঘুমখানা হচ্ছে না মোটে। তা ঠিক আছে, তোরা আজ বিকেলে গাধাকে এখানে ডাক। বলবি যে, আমি ডাকছি গান শুনতে। আমি ওকে একটু ভালো করে ধমকে দেব। তোরা এখন যা, আমি একটু সিংহনাদটা অভ্যেস করে নি।”
শুনে ছোটহাতি তার মাকে জিজ্ঞেস করল, “মা, সিংহনাদ কী গো?”
মা হাতি উত্তর দিল, “সিংহ যেমন করে গর্জন করে, তাকে বলে সিংহনাদ।”
বিকেলে গুহার সামনে জড়ো হয়েছে সকলে। গাধা খুব সেজেগুজে এসেছে। দুই কানে দুটো গাঁদার মালা ঝুলিয়েছে, গলায় আরো একটা। সিংহদিদা তার গান শুনতে চেয়েছে বলে কথা!
সিংহদিদা যেই না সভার শুরুতে বলেছে, “তাহলে গাধা, আমরা এবার তাহলে সভার কাজ শুরু করি”, অমনি গাধা লাফিয়ে উঠে বিকট সুরে গান ধরল, সা রে গা মা পা ধা- গা… ধা… গা… ধা…।
ব্যস, সভা পুরো চৌপাট। পশুরা তো যে যেখানে পালাল। নেহাত সিংহদিদার আর পালাবার জায়গা নেই, তাই তিনি কোনরকমে গুহার ভিতরে ঢুকেই অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
অনেকক্ষণ ধরে খেলিয়ে খেলিয়ে গান করে গাধা যখন থামল, তখন দেখে, চারদিক ভোঁ ভাঁ। কোত্থাও কেউ নেই। সিংহদিদাকে ডেকে ডেকে সাড়া না পেয়ে বাধ্য হয়ে সেও বাড়ির পথ ধরল।
পরের দিন সকালে আবার আলোচনায় বসল সবাই সিংহদিদার গুহায়। বসে ঠিক হল যে, গাধাকে সেদিন বিকেলে আবার ডাকা হবে আর সবাই কানে তুলো গুঁজে আসবে।
সেইমতো বিকেলে সবাই কানে তুলো গুঁজে বসেছে। সিংহদিদাও বসে আছে। এমন সময় দেখা গেল, গাধা আগের দিনের চেয়েও বেশি সাজগোজ করে আসছে। দু কানে লাল জবাফুলের মালা, গলায় হলুদ কল্কেফুলের মালা, কপালে আবার খানিকটা লালরঙের মাটি টিপের মত করে থাবড়ে নিয়েছে।
গাধা এসে বসলে পরে সিংহদিদা বলল, “গাধা, তোমার গান কাল আমাদের খুব ভালো লেগেছে। খালি ঘরে জরুরী কাজ ছিল বলে পুরো গানটা বসে শুনতে পারিনি।”
যেইনা তার কথা শেষ হয়েছে, অমনি গাধা ঘাড় দুলিয়ে বলল, “ঠিক আছে, আমি এখুনি শোনাচ্ছি।” বলেই তারস্বরে গান ধরল, “সা রে গা মা পা ধা- গা… ধা… গা… ধা…।”
সে এমন বিকট গান যে গানের গুঁতোয় সবার কানের তুলো গেল ছিটকে। পশুরা আগের দিনের মতোই দিগ্বিদিকে পালিয়ে বাঁচল। আর সিংহদিদা কোনমতে গুহায় ঢুকে লেপমুড়ি দিয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকলেন।
পরের দিন সকালে আবার সভা বসল সিংহদিদার গুহায়। আগের দুদিনের অভিজ্ঞতা থেকে ঠেকে শিখেছে সকলে। সিংহদিদা বললেন, “শোনো বাছারা। আমি কাল রাতে অনেক ভেবেছি। ভেবে ভেবে দেখলাম, গাধাকে আর গান শোনাবার সুযোগই দেওয়া যাবে না। আমি একটা উপায় ভেবেছি।”
এ কথায় সবাই নড়েচড়ে বসল, “কী উপায়, সিংহদিদা?”
“শোনো। তোমরা গিয়ে গাধাকে বলবে, গত দুদিন তোমার গান শুনে সিংহদিদা বেজায় খুশি হয়েছেন। আজ তোমাকে উনি প্রাইজ দেবেন ঠিক করেছেন। কিন্তু তোমার আজ আগে গান গাইলে চলবে না। তোমার গান আসলে ওঁর এত ভালো লাগে যে, প্রাইজ দেবার কথা ভুলেই যান। তাই তুমি কিন্তু একদম গাইবে না। গাইলে আর প্রাইজ পাবে না।” শুনে এককথায় সবাই বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। সে খুব ভালো প্রস্তাব।”
বিকেলে আরো একবার সবাই জড়ো হয়েছে সিংহদিদার গুহার সামনে। গাধা আজ আরো বেশি সেজে এসেছে। দুকানে ধুতুরা ফুলের মালা, কপালে লাল রঙের তিলকমাটি। আবার একটা নীল রঙের ছেঁড়া কাপড় জোগাড় করে সেটাকে গলায় রুমালের মত বেঁধেছে।
সিংহদিদা আজ সরাসরি কথা পাড়লেন, “শোনো গাধা। আজ আমি তোমাকে পুরষ্কার দেব। কিন্তু তার আগে একটা কথা আছে। আমি ভেবে দেখলাম, তুমি এত ভালো গান করো, তোমার জন্য আলাদা একটা গানের ঘর বানিয়ে দেওয়া দরকার আমার। বনের পশুপাখিদের জ্বালাতনে নিশ্চয়ই তোমার ভালো গান করা হয়না।”
গাধা সায় দিল এ কথায়, “ঠিক কথা, সিংহদিদা । এই হনুমানটা আর কয়েকটা পাখি রোজ বড্ডো জ্বালায় গানের সময়।”
এ কথা শুনে হনুমান বিকট একটা ভেংচি কাটল গাধাকে। কপাল ভালো, গাধা দেখতে পায়নি।
সিংহদিদা আবার শুরু করলেন, “শোনো, ওই দক্ষিণ দিকে নদীর ধারে একটা কুঁড়েঘর আছে আমার। তুমি কাল থেকে ওখানেই গানের চর্চা কোরো। নিরিবিলি আছে, তোমার সুবিধা হবে।”
এ কথায়, গাধা মহা খুশি। বাকিরাও খুশি ভালোয় ভালোয় ব্যাপারটা মিটে গেল বলে। সবাই বেরিয়ে যাবে, এমন সময় গাধা বলল, “আর আমার প্রাইজটা?”
এইরে! প্রাইজের কথা তো সবাই বেমালুম ভুলেই গেছে। কিছু তো আনা হয়নি। তাড়াতাড়ি করে সিংহদিদা তাঁর গলার মাফলারটাই ঝুলিয়ে দিলেন গাধার গলায়, “এই নাও, তোমাকে উত্তরীয় দিলাম আমি। আর আজ থেকে তোমার নাম হল, গর্দভরত্ন।”
ভালুক সর্দি হয়েছে বলে এক বোতল মধু খাচ্ছিল। হাতি তাড়াতাড়ি সেই মধুটা এনে সিংহদিদার হাতে দিল। সিংহদিদা বললেন, “গর্দভরত্ন, এই মধু তোমার।”
মধুর শোকে ভালুকও হনুমানের হাতে থাকা একডজন কলা কেড়ে নিয়ে এল। সেগুলোও গাধাকে দেওয়া হল।
গাধা খুব খুশি। বলল, “আমি তাহলে এবারে একটা গান শোনাই?”
সিংহদিদা আঁতকে উঠে কোনরকমে বললেন, “গর্দভরত্ন, এখন ভরসন্ধেয় গান গেও না। গলা খারাপ হবে। তার চেয়ে বরং তোমার উপহার নিয়ে বাড়ি যাও।”
তারপর থেকে বনের পশুপাখিরা শান্তিতেই আছে। খালি সিংহদিদার মাফলারটা না থাকায় তিনি মাঝেমাঝে একটু দুঃখে করেন। বাকি পশুপাখিরা বলেছে, পরের শীতে চাঁদা তুলে তাঁকে একটা নতুন মাফলার কিনে দেবে সবাই।