Home / ছোটদের গল্প / ঢোলুরাম আর চুনাবতী -মৌসুমী পাত্র

ঢোলুরাম আর চুনাবতী -মৌসুমী পাত্র

বনের ধারের এক গাঁয়ে বাড়ি ছিল ঢোলুরাম আর চুনাবতীর। ঢোলুরাম ছোট ভাই আর চুনাবতী তার দিদি। ঢোলুরাম একদম ছোট্টবেলা থেকেই খেতে ভালবাসে আর খাওয়াদাওয়া করলেই তার পেটটা ফুলে ঢোলের মত হয়ে যায়। তাই তার নাম ঢোলুরাম। আর তার দিদি ছোটবেলায় চুনের গামলায় পড়ে গিয়েছিল বলে নাম চুনাবতী। চুনাবতীর খুব সাহস আর মুখে মুখে দারুণ ছড়া কাটে।
তা এখন একদিন দুপুরবেলায়, বাড়ির লোকজন সবাই ঘুমোচ্ছে। ঢোলুরাম আর চুনাবতী খেলছিল নিজেদের মতন। খেলতে খেলতে ওরা যে কখন বনের মধ্যে ঢুকে পথ হারিয়ে গেছে, নিজেরাই বুঝতে পারেনি।

যখন বুঝতে পারল, ঢোলুরাম তো প্রথমেই ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। চুনাবতী ভাইকে সাহস দিল-

কাঁদিস না, কাঁদিস না।
আমরা মোটেই হারাবো না।
ভয় পেলে কাঁদিস যদি,
উড়ে উড়ে পালায় বুদ্ধি।

একথা শুনে ঢোলুরাম একটু ভরসা পেল। সে আর কাঁদল না। দিদির হাতটা জোরে চেপে ধরল। চুনাবতী আবার বলল,

বেরোনোর রাস্তা খুঁজি
চল্‌ যাই সোজাসুজি।

সোজাসুজি যে রাস্তাটা পেল, সেটা ধরেই ওরা চলতে শুরু করল। খানিকদূর এগিয়ে ওরা দেখল, সামনে একটা সরু নালা। আর একটা ব্যাঙ সেই নালাটা পেরোনোর চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুতেই পারছে না। বারবার নালার জলে পড়ে যাচ্ছে। তখন চুনাবতী একটা বড় শালপাতা এনে ব্যাঙটার সামনে ধরে বলল,

ব্যাঙ, ব্যাঙ, ব্যাঙ
গ্যাঙর গ্যাঙর গ্যাং।
এই পাতাতে লাফাও যদি
ভাঙবে নাকো ঠ্যাঙ।

এই কথা শুনে ব্যাঙ একলাফে পাতার ওপরে চড়ে বসল, আর এক লাফে নালার ওই পারে পৌঁছে গেল। নালা পেরোতে পেরে ব্যাঙ বেজায় খুশি। সে ঘাড় তুলে বলল,

ডানদিকের পথ ধরে
সোজা চলে যাও।
খাবারদাবার অনেক পাবে
পেট পুরে খাও।

সত্যি সত্যিই ঢোলুরাম আর চুনাবতীর এতক্ষণ ধরে ঘুরে ঘুরে খুব খিদে পেয়েছিল। ওরা তাই ডানদিকের পথ ধরে এগোতে থাকল। কিছুদূর গিয়ে দেখে, একটা গাছের ডালে একটা হনুমান এককাঁদি কলা নিয়ে বসে বসে খাচ্ছে। তাই দেখে চুনাবতী ছড়া কাটল,

কলা! কলা! কলা!
না দিলে পাবি কানমলা।

dholuram-o-chunabati
ছবি : -মৌসুমী পাত্র

কানমলার কথা শুনে হনুমান তো ভয় পেয়েছে বেজায়। সে তাড়াতাড়ি করে কলাগুলো নিচে ফেলে দিল। ঢোলুরাম আর চুনাবতীও কলার কাঁদিটাকে লুফে নিয়ে খেতে শুরু করে দিল। আর সে কলাগুলো যেমন পুরুষ্টু, তেমনই তাদের স্বাদ! ওদের মনে হল, এত দারুণ জিনিস বোধহয় আগে কোনদিন খায়নি।
কলা খেয়ে ওরা আবার যাচ্ছে, যাচ্ছে, যাচ্ছে। যেতে যেতে দেখে, খানিক দূরে একটা বিশাল বড় কাঁঠালগাছ আর একটা ভালুক তার তলায় বসে কাঁঠাল খাচ্ছে। তাই দেখে চুনাবতী বলে উঠল,

কাঁঠাল, কাঁঠাল, কাঁঠাল
না দিলে পাবি আঁটাল।

এখন আঁটাল বলে তো কিছু হয়না, কিন্তু সে কথা কি আর ভালুক জানে? সে ভাবল, আঁটাল বুঝি কোন বিষম বস্তু। তাই সে ভয়ের চোটে কাঁঠাল ফেলে দিয়ে দৌড়ে পালাল।
তাই দেখে ঢোলুরাম আর চুনাবতী তো হেসেই কুটোপাটি। বেশ খানিক হেসে নিয়ে ওরা বসল কাঁঠাল খেতে। যেমন সুন্দর গন্ধ সেই কাঁঠালের, তেমনই অপূর্ব খেতে। ওরা যে যত পারল খেল। চুনাবতীর কাছে একটা রুমাল ছিল, তাইতে সে আবার খানকয়েক কাঁঠালের কোয়া বেঁধেও নিল।
তারপর যেতে যেতে যেতে যেতে ওরা যখন আর একেবারেই হাঁটতে পারছে না, তখন ওদের চোখে পড়ল, একটা গাছের কোটরে এক প্যাঁচা আরামে ঘুমোচ্ছে আর তার নাক ডাকছে- ঘড়রর ঘোঁ… ঘড়ড়ড়ড় ঘোঁ…।
গাছটা দেখে চুনাবতীর মনে হল, এই গাছে ওরা দুজন দিব্যি আরামে খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে পারবে। তাই বলে উঠল,

ঘুড়ুত ঘুড়ুত ঘোঁ
পুড়ুত পুড়ুত পোঁ
উড়ে যা রে এখান থেকে
করিস না ট্যাঁ ফোঁ।

তাই শুনে প্যাঁচাটা ভয় খেয়ে উড়ে চলে গেল। ঢোলুরাম আর চুনাবতীও গাছে চড়ে বসে আরাম করে ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুম যখন ভাঙল ওদের, তখন সন্ধে হব হব। চুনাবতী আর ঢোলুরাম নীচের দিকে তাকিয়ে দেখে, একটা বাঘ চলেফিরে বেড়াচ্ছে। ঢোলুরাম তো তাই দেখে ভয়ে দিদিকে আঁকড়ে ধরল। চুনাবতী একটুও না ঘাবড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলে উঠল-

বাঘ রে বাঘ!
ভাগ তুই ভাগ।
ঢোলু-চুনা আসছে এবার
বানাতে তোকে ছাগ।

‘ঢোলু-চুনা’-র কথা বাঘ এর আগে কখনো শোনেনি। সে ভাবল, ঢোলু- চুনা বোধহয় বিকট কোন জানোয়ারই হবে, আর এলেই তাকে বাঘ থেকে ছাগল বানিয়ে দেবে। তাই সে ল্যাজ গুটিয়ে সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে পালাল।
‘ঢোলু-চুনা’ মানে ঢোলুরাম আর চুনাবতীও নামল গাছ থেকে। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে, ওরা কোনমতে এগোচ্ছে। এমন সময় ওদের কানে এল অনেক লোকজনের গলা, তাদের মধ্যে ওদের মা বাবার গলাও শুনতে পেল। আর চোখে পড়ল গাছপালার ফাঁকে লণ্ঠনের আলোর রেখা। তাড়াতাড়ি করে ওরা সেদিকে দৌড়ে গিয়ে মা বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
ওদের দেখে সবাই হইহই করে উঠল। সকলেই জানতে চায়, এতক্ষণ ধরে বনে ওরা কিরকম ভাবে ছিল। ঢোলুরামকে জড়িয়ে ধরে চুনাবতী বলল,

অনেক কিছু গল্প আছে
শুনতে যদি চাও-
ঘরে গিয়ে ভালোমন্দ
খাবারদাবার দাও।

তারপর গাঁয়ে ফিরে গিয়ে ভালো করে খেয়েদেয়ে ঢোলুরাম আর চুনাবতী শুরু করল তাদের বনের গল্প…

Leave a comment

Check Also

শিল্পী- রিমিল জানা

পরীক্ষা দিলেন বাঘু- মৌসুমী পাত্র

(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা দিয়েছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ গল্পে। …

ওযোধ্যা পাহাড়ে বাঘু

অযোধ্যা পাহাড়ে বাঘু – মৌসুমী পাত্র

(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা দিয়েছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ গল্পে। …

শিয়ালনী কুপোকাত

শিয়ালনী কুপোকাত- মৌসুমী পাত্র

বর্ষা বিদায় নিয়েছে। আকাশে সোনা সোনা রঙের রোদ্দুর। সাদা সাদা মেঘ নীল আকাশে হামাগুড়ি দিয়ে …

বাঘু হলেন মনিটর

বাঘু হলেন মনিটর- মৌসুমী পাত্র

  পাঠশালার পোড়োগুলো বড্ডো ঝামেলা পাকাচ্ছে ক’দিন ধরেই। শিয়ালনী ক্লাস থেকে একটু উঠলেই চিৎকার, চেঁচামেচি, …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *