Home / কিশোর গল্প /  ছেঁড়া রামধনু – মৌসুমী পাত্র

 ছেঁড়া রামধনু – মৌসুমী পাত্র

আমার মা বেজায় দুষ্টু হয়েছে আজকাল। একটা কথাও শুনতে চায় না। এই তো পরশুদিন, বললাম, মা, আইসক্রিম খাবো। কিনেই দিলো না। উলটে বলল, তোর না গত সপ্তাহে সর্দিজ্বর হয়েছিলো! বোঝো ঠ্যালা! গত সপ্তাহে জ্বর হয়েছিলো বলে এ সপ্তাহেও আইসক্রিম পাবো না! তারপরে এই তো গতকালই, বললাম টফি কিনে দিতে। তাও দিলো না। বলল, “দাঁতের বারোটা বাজাস না, বাবুই।” আমার খুব রাগ হোলো। চেঁচিয়ে মেঁচিয়ে বললাম, “তোমার মতো মা থাকার চাইতে না থাকা ভালো।” শুনে মায়ের মুখটা কিরকম হয়ে গেল। সারা রাস্তা আমার সাথে আর কথাই বলল না। আমি কয়েকবার বললাম, “মা, ও মা, কথা বলছ না কেন?” মা উত্তর দিলো না। সন্ধেবেলা রোজ আমাকে পড়াতে বসায়। কাল তাও বসাল না। নিজের ল্যাপটপটা খুলে কিসব খুটুরখাটুর করতে থাকল। শেষকালে আর না থাকতে পেরে বললাম, “মা, ও মা, আমাকে আজ পড়াতে বসবে না? কাল আমার ক্লাস টেস্ট।” তখন পড়াতে বসল।

আজ সকালে অবশ্য রোজকার মতোই আমাকে চান করিয়ে দিল, খাইয়ে দিল, টিফিন জল গুছিয়ে দিল। তবে সবই শুকনো মুখে। তারপর যখন আমাকে জড়িয়ে ধরে হামি খেয়ে বলল, “পরীক্ষাটা ভালো করে দিস”, আমি আর থাকতে না পেরে বললাম, “মা, ও মা, তোমায় আমি বড্ডো ভালোবাসি। তুমি আমার সোনা মা।”

অমনি মায়ের মুখে একগাল হাসি। মাথার চুলটা ঘেঁটে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে রে, বাবা, ঠিক আছে। পরীক্ষাটা ভালো করে দিস। আর ফিরে খেয়ে নিস। অফিস থেকে ফিরে আজ তোকে একটা নতুন গল্প শোনাব।”

 

এখন আমি ক্লাসঘরে। পরীক্ষার খাতা দিতে শুরু করেছে। রঞ্জনা মিস আমারটা দিয়ে একগাল হাসলেন। উনি আমাকে খুব ভালোবাসেন। আরে, এর সবকটাই তো পারব। প্রত্যেকটাই মা আমাকে অনেকবার করিয়েছে। ঝটপট লিখতে শুরু করলাম। প্রায় যখন শেষ হয়ে এসেছে, হেডমিস দেখি এসে রঞ্জনা মিসকে ফিসফিসিয়ে কিসব বললেন। নিজের নামটা বারদুয়েক যেন শুনতে পেলাম। মিসের মুখটা কিরকম করুণমতো হয়ে গেল আর উনি অমনি সঙ্গে সঙ্গে আমার দিকে চাইলেন আর আমার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়াতে ওঁকে মুখেচোখে কেন আঁচল চাপা দিতে হল কে জানে? যাইহোক, আমি আবার লিখতে শুরু করলাম। আড়চোখে একবার তাকিয়ে দেখলাম, হেডমিস বেরিয়ে যাচ্ছেন আর রঞ্জনামিস মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে আছেন। কী যে ব্যাপার ওঁরাই ভালো বোঝেন! আমি তো কোন গোলমাল করিনি।

খাতা যখন জমা দিতে গেলাম, রঞ্জনা মিস অন্যদিনের মতো হেসে কথা বললেন না। কেমন যেন শূন্যদৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলেন আর জিজ্ঞেস করলেন, “সব লিখেছিস?” গলাটা কেমন যেন ধরা ধরা লাগল। কিন্তু আমার আর তখন সেদিকে ভাবার মত সময় নেই। মা হয়তো গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, আর ফিরে গিয়ে আমাকে একটা একদম নতুন গল্প শোনাবে।

গেটের কাছে দেখি হেডমিস নিজেই দাঁড়িয়ে আছেন। কাঞ্চীর মা, স্বপ্না আন্টির সাথে কিসব কথা বলছেন। আমি আর কাঞ্চী কাছাকাছি যেতেই স্বপ্না আন্টি বললেন, “ম্যাডাম, আমি তাহলে ওদের দুজনকেই নিয়ে যাই?”

হেডমিস ঘাড় নাড়লেন। তাঁরও দেখি মুখচোখ থমথমে। আমি অবাক হয়ে শুধোলাম, “আন্টি, মা যে আসবে বলেছিল?”

আন্টি যেন থতমত খেয়ে গেলেন। ওঁর ওড়নার খুঁটটাই বা আঙুলে পেঁচাচ্ছেন কেন কে জানে? সেভাবেই বললেন, “না, মানে তোর মায়ের আজ অফিসে কিসব কাজ পড়ে গেছে কিনা। তার জন্য আমাকে বলল, তোকেও নিয়ে যেতে।”

বা! তাহলে তো ভারি মজা! তার মানে আমি এখন কাঞ্চীদের বাড়িতে থাকব আর অনেক হইহই করব! মাঝেমাঝেই এরকম চলে। আন্টি স্কুলে আটকে গেলে তখন কাঞ্চী থাকে আমাদের বাড়ি।

রিক্সা করে পাড়ার মোড়ে এসে নামলাম। এবারে একটু হেঁটে যেতে হবে। আজ এখানে এত লোকের জটলা কেন কে জানে? সবাই কিরকম অদ্ভুত চোখে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে! মা সেদিন ভিনগ্রহের প্রাণীদের গল্প শুনিয়েছিল। ওরা কি আমাদের সেরকম কিছু ঠাউরেছে নাকি? টুকরো টাকরা কথা কানে এল, “এইটুকুনি ছোট্ট মেয়ে, এবারে মা কে ছেড়ে থাকবে কী করে?”, “নিজের ওরকম অ্যাকসিডেন্ট হবার পরও আর একটা মেয়েকে টেনে তুলে টোটো করে হাসপাতালে গেছে”, “শুনলাম যে হাসপাতালে পৌঁছোনোর আধঘন্টার মধ্যেই সব শেষ”।

আমি জিজ্ঞেস করার আগেই কাঞ্চী জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে, মা?” আন্টি আমার হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে বললেন, “কী জানি? জানি না।”

উফফ! এতো জোরে আন্টি হাত চেপে ধরে রেখেছেন বড্ডো লাগছে! আমি কি বাচ্চা যে ওঁর হাত ছাড়িয়ে ছুটব? কিছু বলতেও পারছি না। যাকগে, কাঞ্চীদের বাড়িটা এসে পড়ায় নিষ্কৃতি পেলাম। আন্টি বাড়ির গেট চাবি দিয়ে খুলতে খুলতেই আন্টির মোবাইলে ফোন এল। “হ্যাঁ, আমরা এই ঢুকছি”, “বাবুই আমার কাছেই”, “ঠিকই আছে”, “কথা বলবে?” “আচ্ছা, ঠিক আছে”। আরো খানিকক্ষণ হুঁ হাঁ করে আন্টি ফোনটা রেখে দিল। আমি শুধোলাম, “আন্টি, কার ফোন? মায়ের?”

আন্টি আমার কথার উত্তর না দিয়ে তালা খোলায় ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এবারে কাঞ্চী চেঁচাল, “মা শুনতে পাচ্ছ না, বাবুই কী জিজ্ঞেস করছে?”

আন্টি তাও উত্তর দিল না। আমার খুব রাগ হচ্ছিল। একে ওরকম শক্ত করে ধরে নিয়ে আসা, তার ওপর আবার একটা কিছু জিজ্ঞেস করলে আন্টি উত্তর দেয় না। কাঞ্চীকে বললাম, “কাঞ্চী, আজ তোদের বাড়িতে বেশিক্ষণ বসব না। তোদের বাড়ির ফোন থেকে মা কে ফোন করে বলি, আমাকে নিয়ে যেতে। আজ মা আমাকে একদম নতুন একটা গল্প শোনাবে বলেছে।”

আন্টি অমনি সাথে সাথে কীরকম আর্তনাদের মত করে উঠল, “না, বাবুই না। আমার চোখে সেই পোকাটা ঢুকে গিয়ে খুব জ্বালা করছিল, তাই উত্তর করিনি।”

তা ঠিক। আসার সময় রিক্সায় আন্টি বারবার ওড়না দিয়ে চোখ মুচ্ছিল। জিজ্ঞেস করায় বলেছিল, চোখে পোকা ঢুকে গিয়ে জ্বালা করছে। আচ্ছা বাজে পোকা তো! এতক্ষণেও চোখ জ্বলা কমেনি।

কাঞ্চী বলল, “ফোনটা কে করল সেটা বলবে তো?” আন্টি রান্নাঘরের দিকে ঢুকে গেছে। সেখান থেকেই উত্তর দিল, “বাবুই, তোর বাবা ফোন করেছিল”। আমি একটু দমেই গেলাম। আশা করেছিলাম যে মায়ের ফোন। কিন্তু বাবাই বা আমার সংগে একটা কথাও না বলে ছেড়ে দিল কেন? আমি নাহয় কাল মা কে বাজে কথা বলেছিলাম মানছি, কিন্তু সে তো চুকে গেছে। মা তো আমাকে আবার আদর করেছিল। তাহলে? যাকগে, অত ভেবে লাভ নেই। তার চেয়ে কাঞ্চীদের বসার ঘরে সোফায় আরাম করে বসি!

আন্টি বসার ঘরে ঢুকল। চোখে মুখে প্রচুর জল দিয়েছে দেখছি। ইসস! চোখ পুরো লাল হয়ে গেছে। আন্টিকে বললাম, “কাল একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিও।”

আন্টি হুঁ না কিছুই বলল না। বড়োরা মাঝেমধ্যে এমন এমন অদ্ভুত ব্যবহার করে যে বোঝা দায়! বাড়ি ফিরে মাকে বলব নাকি? উঁহু! মা যদি বকে? যদি বলে বড়োদের ব্যাপারে নাক গলাতে নেই?

টেবিলে খাবার বেড়ে দিয়েছে আন্টি। গরম গরম পরোটা, আলুর দম আর রসগোল্লা। আন্টিও বসল আমাদের সাথে। আমি খেতে খেতেই জিজ্ঞেস করলাম, “আন্টি, মা কখন ফিরবে বলেছে?”

আন্টি চরম বিষম খেল। চোখমুখ লালটাল হয়ে কেশে কেঁদে একাকার। আমি আর কাঞ্চী জল টল দিয়ে কোনমতে সামলালাম। বাকি খাবার সময়টা আমরা চুপচাপ নিজের খাবার খেয়ে নিলাম।

কিন্তু মা আমাকে এতক্ষণে একটাবারও ফোন করল না কেন? অন্যদিন বারতিনেক হয়ে যায়। মা বড্ডো বাড়াবাড়ি করছে। দাঁড়াও, বাড়িতে যাই একবার!

কাঞ্চী বলল, “আয় বাবুই, একটু বিল্ডিং ব্লকস খেলি।” এই খেলাটা আমার দারুণ পছন্দ। কিন্তু আজ আর খেলতে মন সরছে না। আন্টিকে বললাম, “আন্টি, মায়ের নাম্বারটা একবার লাগিয়ে দেবে? কথা বলতে ইচ্ছে করছে।”

আন্টি কিরকম অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। আরে বাবা, আমার মায়ের সঙ্গে আমি কথা বলব, তাতে ওরকমভাবে তাকানোর কি আছে? নাঃ, ফিরে গিয়ে মা কে বলতে হচ্ছে সব কথা।

কাঞ্চী ছোট ছোট ব্লক ছড়িয়ে দিয়েছে ভেতরের ঘরের পুরো বিছানায়। অন্যদিন হলে আন্টি একদফা ধমকধামক দিয়ে নিচে মাদুর পেতে দেয়। আজ দেখেও দেখল না যেন। খেলতে বসলাম। কাঞ্চী মহা উৎসাহে রকমারি বিল্ডিং বানাচ্ছে। আমার আর কিচ্ছু ভালো লাগছে না। আন্টি কানে ফোন চেপে সোফার ঘরে বসে কথা বলে যাচ্ছে, বলেই যাচ্ছে। আমার বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে বড্ডো। বাড়ি গিয়ে মা কে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে মন যাচ্ছে।

মা কিন্তু আমাকে নিতে এলোই না। বাবা এল, তাও অনেক রাতে। কীরকম এলোমেলো, উস্কোখুস্কো লাগছে বাবাকে।

স্বপ্নাআন্টি বাবাকে বলল, “দেবজিত, বাবুই তাহলে কয়েকটা দিন এখানেই থেকে যাক।”

বাবা ক্লান্ত সুরে বলল, “স্বপ্নাদি, আমি কাল সকালে ওকে দিয়ে যাবো।”

আমি আর থাকতে পারলাম না। চেঁচিয়ে উঠলাম, “না, আমি কাল মায়ের কাছে থাকবো।”

বাবা আর স্বপ্না আন্টি কিরকম অদ্ভুত দৃষ্টিতে মুখ চাওয়াচায়ি করল। বাবা আমাকে আদর করে কোলে তুলে নিয়ে বলল, “বাবুইসোনা, মা একটা ট্রেনিং নিতে গেছে।”

ক্কী-ঈ-ঈ-ঈ! মা ট্রেনিং নিতে গেল? আমাকে একটাবারো জানানোর দরকার মনে করল না? তাহলে যে আমাকে বলে গেল, তাড়াতাড়ি ফিরে একদম নতুন একটা গল্প শোনাবে? আজ রাতে তাহলে মা আমার কাছে থাকবে না, শোবে না? আমি ঘুমোব কি করে তাহলে?

আর পারলাম না আমি। বাবার কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিলাম।

 

মা কিন্তু আর এলোই না। বাবা, ঠাম্মি যাকেই জিজ্ঞেস করি, সবারই এক কথা, মা নাকি কোন্‌ একটা বিশেষ কাজে বাইরে গেছে। আমি ইচ্ছেমতো জল ঘাঁটি, ফ্রিজ খুলে ঠাণ্ডা জল খাই, কার্টুন দেখি, চিপস খাই- কেউ কিছু বলে না। মনে মনে ভাবি, এই বুঝি মা এসে বকবে, কিন্তু মা আর আসে না।

আজকাল আমাকে বাবা স্কুলে দিতে যায়, বাবাই নিয়ে আসে। সন্ধেবেলা কাঞ্চীদের বাড়ি যাই, ওর সঙ্গে খেলি, স্বপ্না আন্টির কাছে পড়ি দুজনে। মা হঠাৎ করে কেমন যেন উধাও হয়ে গেল। একটাবার ফোনও করে না আমাকে। আচ্ছা, মায়ের কি আমার জন্য মন খারাপও হয় না?

এর মাঝে সেদিন স্কুলে রূপসার সাথে ঝামেলা হয়ে গেল খুব। সেদিন টিফিন টাইমে আমি ক্লাসে একা একাই বসে একটা ছবি আঁকছিলাম। মায়ের আর আমার ছবি। আমি মায়ের হাত ধরে বাগানে ঘুরছি। দুটো প্রজাপতিও আঁকলাম। তারপর কয়েকটা ফুল এঁকে রঙ করতে শুরু করলাম। প্রায় যখন শেষ হয়ে এসেছে, রূপসা এসে আমার ঘাড়ের উপর পড়ল, “কী রে, কী আঁকছিস? দেখি, দেখি।”

খানিক নেড়েচেড়ে বলল, “এটা কীসের ছবি?”

আমি বেশ গর্বের সাথেই বললাম, “মায়ের আর আমার ছবি।”

রূপসা এক ঝটকায় কাগজটা আমার হাতে দিয়ে বলল, “মা? তোর মা? তোর মা তো অ্যাকসিডেন্টে মরেই গেছে।”

ক্কী? আমার মায়ের নামে এমন উল্টোপাল্টা কথা? মা মোটে কটা দিন বাইরে কাজে গেছে বলে ও যা খুশি তাই বলবে? রাগে অন্ধ হয়ে গেলাম আমি। ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে কিল-চড়-ঘুঁষি মারতে থাকলাম সমানে। আর বলতে লাগলাম, “আর বলবি? আর কখনো বলবি আমার মায়ের নামে?” শেষটায় রঞ্জনা মিস আর দীপ্তিমিস এসে কোনমতে থামালেন।

সেইদিন রাতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম যে, আমি কোথায় একটা বেড়াতে গেছি আর আকাশে মেঘেরা জড়ো হচ্ছে। আস্তে আস্তে সেই মেঘের ভেতর থেকে ফুটে বেরোল একটা মস্ত বড়ো আর কী সুন্দর রামধনু! আর তারপরই দেখি, রামধনুর ওপরে কে বেশ বসে আছে। কাছে আসতেই দেখি, মা! আমি একছুট্টে গিয়ে মা কে জড়িয়ে ধরলাম। মা আমাকে কোলে তুলে নিল। আমি বললাম, “মা! তুমি এসে গেছো? এতদিন কোথায় ছিলে? আমি তোমার জন্য কত কেঁদেছি!” মা আমার মাথার চুল ঘাঁটতে ঘাঁটতে হাসল, “এই তো বাবুই, আমি এসে গেছি। চল, আমরা ওই রামধনুটায় চেপে পরীদের দেশে যাই।”

আমি অমনি একলাফে মায়ের কোল থেকে নেমে রামধনুটার ওপরে বসতে গেলাম। আর তক্ষুণি রামধনুটা গেল ছিঁড়ে। বেগুনী, নীল, সাদা, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল- সব রঙগুলো যে যার মত আলাদা হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে। মা কে আর কোত্থাও দেখতে পেলাম না। আমি পাগলের মতো মা কে ডাকতে থাকলাম – “মা! মা! মা!”

আচমকা পাশ থেকে বাবার গলা পেলাম, “বাবুই, কী হয়েছে রে?” চোখ মেলে চেয়ে দেখি, আবছা আলো ঘরে। মা কোথাও নেই। বাবার পাশে আমি শুয়ে।

বালিশটা জড়িয়ে ধরে আমি আবার ফোঁপাতে শুরু করে দিলাম।

আমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছি। স্বপ্না আন্টি আমাকে বলেছে, আমার মা পরীদের দেশে আছে। আমি যাতে খুব ভালো মেয়ে হতে পারি, তার জন্যই মা পরী হয়ে গেছে। ওখানে থেকে মা আমাদের সবাইকে সুন্দর করে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। আমি তাই আর আগের মত মন খারাপ করি না।

খালি যখন আমার হাতে কোন কাজ থাকে না, তখন মায়ের কথা মনে পড়ে খুব। সেবারে মামাবাড়ি যেতে যেতে ট্রেনেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়ে গিয়েছিল। মা বলেছিল, “দেখলি বাবুই? গাছপালাগুলো কেমন সবুজ জামা পালটে কালো জামা পরে নিল!” সকাল হলে মা বলত, “দ্যাখ, সূর্যটারও ঘুম ভেঙে গেছে। ও তো সারাদিন কাজ করে, আর সন্ধেবেলা ঘুমোতে যায়। আর রাত্তিরবেলায় চাঁদের ডিউটি।” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করতাম, “আর যেদিন মেঘলা থাকে?” মা উত্তরে বলেছিল, “সেদিন তো সূর্যের ছুটি। ও বেচারিই বা আর কত কাজ করবে বল। চাঁদও তেমনি মাঝে মাঝে ছুটি নেয়। তাকে বলে অমাবস্যা।” এরকম আরো কত শত কথাই এখন আমার গুপ্তধন। স্বপ্নাআন্টি বলেছে, “বাবুই, মায়ের সব কথা, সব গল্প যত্ন করে মনের মাঝে তুলে রাখিস। মাঝেমধ্যে নাড়াচাড়া করিস।”

তাই করি। রূপসা ওই ঘটনার পরের দিনই এসে আমাকে বলে গিয়েছিল, আমার মা সত্যিই পরীদের দেশে গেছে। ও একদমই জানতো না। আমিও ওর সঙ্গে ভাব করে নিয়েছি। অন্য কেউ যদি এখন আমাকে কিছু বলতেও আসে, তাও আমি কিচ্ছুটি মনে করবো না। আমি তো জানি, পরীদের দেশ থেকে মা আমাকে ঘিরে রেখেছে সর্বক্ষণ!

………০………

 

আরো পড়ুন : কিশোর গল্প 

Leave a comment

Check Also

ভুতুম থুম- মৌসুমী পাত্র

পূর্ণিমার চাঁদটা ভেসে আছে বিরাট একটা গোল থালার মতো। একটা শিশুগাছের ডালের কয়েকটা পাতার ছায়া …

chitrogupter-computer-mp

চিত্রগুপ্তের কম্পিউটার- মৌসুমী পাত্র

“যত্ত সব আদ্যিকালের জিনিস নিয়ে কাজকারবার! আর পারা যায় না বাপু!”, নিজের মনেই গজগজ করতে …

শিল্পী- গুঞ্জা

ফুল-পাখি কথা – মৌসুমী পাত্র

সে ছিল এক গভীর বন। আর সেই বনের ঠিক মধ্যিখানে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় ছিল এক …

রসেবশে রামায়ণ- মৌসুমী পাত্র

রামায়ণের গল্প আমরা সবাই জানি। কিন্তু গল্পেরও কিছু ভেতরকার কথা থাকে। যাকে বলে, পেটের কথা। …