বাহান্ন বাজার তিপান্ন গলি ,
তবে জানলি তুই চন্দ্রকোণা এলি ।
চন্দ্রকোণা শহর সম্পর্কে লোকমুখে একদা শোনা যেত এই বুলি। বোঝাই যায় একসময় যথেষ্ট বর্ধিষ্ণু অঞ্চল ছিল এটি। কিন্তু ইতিহাসও কি তাই বলে? চলুন দেখে নেই একবার। ঘুরে দেখা যাক বর্তমানের আরশিতে অতীতের চন্দ্রকোণা।
এই ব্যাপারে প্রথমেই ধন্যবাদ জানিয়ে রাখি বর্তমান চন্দ্রকোণা ২ ব্লকের বিডিও সাহেবকে।সে আমার বেড়ানোর পাগলামিকে এইভাবে প্রশ্রয় না দিলে হয়তো সেদিনের প্রথম শহর চন্দ্রকোণা দর্শন নিতান্তই আর পাঁচটা কেজো অফিস ট্যুরের মতো অফিসিয়াল কাজের চৌহদ্দিতেই সীমাবদ্ধ থাকতো।
বর্তমানে শহরটিতে ঐতিহাসিক নিদর্শন আর গুটিকয়েকই মাত্র অবশিষ্ট আছে। তারই কয়েকটি মাত্র দেখার সৌভাগ্য হয়েছে এ যাত্রা। শহর চন্দ্রকোনাকে ঘিরে গড়ে ওঠা রামগড়, রঘুনাথগড বা কিরাতগড়ের মতো দুর্ভেদ্য গড়গুলির কোনো নিদর্শনই খুঁজে পাওয়া যায় না আর। আজ সেগুলি শুধুমাত্র জায়গার নাম হিসেবেই তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছে। পথে যেতে যেতে স্থানীয় ব্লক প্রশাসনের অভিজ্ঞ সহকর্মীর মুখে শুনলাম প্রায় বছর তিরিশেক আগে লালগড় থেকে পাওয়া গিয়েছিলো একটি কামান যেটি লালগড়ের দুর্ভেদ্যতা রক্ষার প্রয়োজনে ব্যবহৃত হতো। তাঁর মুখেই শুনলাম ও পরে দেখলামও যে চন্দ্রকোণার অপর গুরুত্বপূর্ণ প্রাণকেন্দ্র অযোধ্যা মহল্লার রঘুনাথ বাড়ির দেউল শৈলীতে নির্মিত মন্দিরগুলির অবস্থাও যথেষ্ট সঙ্কটজনক।
এই প্রসঙ্গে চন্দ্রকোণা নামকরণের বিষয়টি একটু ছুঁয়ে রাখা ভালো।তাহলে চন্দ্রকোণা শহরকে জানতে বুঝতে একটু সুবিধা হবে।অনেকে এই শহরের নামকরণের সাথে রামায়ণের কাহিনীর যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন। বাল্মীকি রামায়ণের উত্তরা কাণ্ডের ১০২ সর্গে বর্ণিত আছে বৈকুন্ঠ যাত্রার পূর্বে শ্রীরামচন্দ্র ভরতকে আদেশ করেন কুমারগণকে বিভিন্ন রাজ্যে অভিষিক্ত করার জন্য। সেই মোতাবেক লক্ষ্মণ পুত্র চন্দ্রকেতু মল্লভূমির অন্তর্গত চন্দ্রকান্তা নগরে অভিষিক্ত হন।অনেকের মতে এই চন্দ্রকান্তা পুরীই বর্তমানের শহর চন্দ্রকোনা।
কিন্তু ইতিহাসের কষ্টিপাথরে এই মতামতের তেমন কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই আমাদের কাছে স্থানীয় গবেষক ও ঐতিহাসিকদের রচনাই এই বিষয়ে বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। চন্দ্রকোণার প্রাচীন কবি অখিল চন্দ্র দাঁ ১৮৩১ সালে তাঁর কবিতায় লিখেছেন-“চন্দ্রবংশধর রাজ্ রাজেশ্বর , চন্দ্রকেতু নাম নৃপবর। এই চন্দ্রকোণা পবিত্র শহর, যশোকীর্তি যার বিখ্যাত ভুবনে “I সুতরাং তাঁর বক্তব্যানুসারে চন্দ্রকেতু রাজার নামে শহরের নাম হয় চন্দ্রকোনা।আরো জানা যায় যে এই চন্দ্রকেতু রাজা কোনো এক মল্ল রাজাকে যুদ্ধে পরাস্ত করতে এই স্থানে রাজত্ব কায়েম করেন।এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় Chronicles of Chandrakona প্রবন্ধটির কথা। প্রাবন্ধিক চন্দ্রশেখর বন্দ্যোপাধ্যায় Calcutta Review পত্রিকায় ১৮৮৩ সালে Chronicles of Chandrakona প্রবন্ধে বলেন-“প্রাচীন মানা রাজ্যের নৃপতি আদি মল্ল ওরফে খয়ের মল্লকে পরাজিত করে মানা অধিকার করলেন বহিরাগত চন্দ্র বংশীয় চন্দ্রকেতু নামে এক রাজপূত।মানা রাজ্যের নতুন নামকরণ হলো চন্দ্রকোনা”I আবার বিদেশী নাবিক ও পর্যটকদের মানচিত্রে যেমন ১৬৬০ সালে ফান জেন ব্রুস , ১৬৭০ সালে ভ্যালেন্টিনের এবং ১৭৭৪ সালে রেনেলের মানচিত্রে এই স্থানটির নাম ছিল চাঁদের কণা যা থেকে চন্দ্রকোণা নামটি এসেছে বলে কিছু লোকের অনুমান।
চন্দ্রকোণার নামকরণ ও ইতিবৃত্ত সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে ঐক্যমত্য অপেক্ষা ভিন্নসুরের প্রতিধ্বনিই বেশি শোনা যায়।স্থানীয় ইতিহাসে পাওয়া তথ্যানুসারে একদা ভানদেশ নাম পরিচিত চন্দ্রকোণা প্রাচীন ও মধ্যযুগে শাসিত হয়েছিল তিনটি রাজবংশ যথাক্রমে মল্ল, কেতু ও ভান বংশীয় রাজাদের দ্বারা।যদিও প্রথমোক্ত দুই রাজবংশ সম্পর্কে বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।ঐতিহাসিক চন্দ্রশেখর বন্দোপাধ্যায়ের মতে মল্ল বংশের শেষ নৃপতি খয়ের মল্ল ছিলেন শৈব এবং তিনি এই চন্দ্রকোনাতে মল্লনাথ বা মল্লেশ্বরের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।History of Bishnupur Raj গ্রন্থে অভয়পদ মল্লিক জানান খয়ের মল্লের রাজ্যাভিষেক ঘটেছিলো ৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে। তিনি রাজপূত বীর চন্দ্রকোণার কাছে পরাজিত হয়ে চন্দ্রকোণা থেকে পলায়ন করেন ও বিষ্ণুপুরে রাজত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।অপরদিকে The annals of Bissenpur এ এই ঘটনার সময়কাল ৭১৫ খ্রিস্টাব্দে নির্ধারিত হয়েছে।এইসকল ঘটনার সূত্র ধরে “ চন্দ্রকোণার ইতিবৃত্ত” গ্রন্থের লেখক মৃগাঙ্কনাথ রায় সপ্তম শতাব্দীতে চন্দ্রকেতু কর্তৃক চন্দ্রকোণা রাজ্যটি প্রতিষ্ঠিত বলে মত প্রকাশ করেছেন।
রামেশ্বর রচনাবলীর গ্রন্থকার পঞ্চানন চক্রবর্তী বলেছেন ইন্দ্রকেতু ও চন্দ্রকেতু -দুই ভাই যথাক্রমে কর্ণগড় ও চন্দ্রকোনায় রাজত্ব স্থাপন করেন।অন্যদিকে মেদিনীপুর ইতিহাস গ্রন্থের রচয়িতা যোগেশ চন্দ্র বসু এ বিষয়ে ভিন্ন মোট পোষণ করে বলেছেন কেতু বংশের আদি পুরুষ ইন্দ্রকেতু পঞ্চদশ শতকে আনন্দপুরকে কেন্দ্র করে চন্দ্রকোনাসহ এক বিস্তৃত এলাকা নিজ দখলে আনেন।মেদিনীপুর গ্রন্থের প্রণেতা তরুণ দেব ভট্টাচার্য্য , যোগেশ চন্দ্রের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে বলেছেন ইন্দ্রকেতু ও তার পুত্র নরেন্দ্র কেতুর সময় চন্দ্রকোণার রাজধানী ছিল আনন্দপুর। নরেন্দ্রকেতুর পুত্র চন্দ্রকেতু আনন্দপুর থেকে উঠে এসে চন্দ্রকোনায় রাজধানী স্থাপন করেন। তিনি তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে তুলে ধরেন মল্লেশ্বর মন্দিরেরপ্রাপ্ত ফলকটির কথা যেখানে ১৫০ বছরের মধ্যে চন্দ্রকেতু ও তাঁর বংশধর হিসেবে করভসন্ত ,জয়কেতু,পুস্পকেতু ও দ্বিতীয় চন্দ্রকেতুর নাম রাজা হিসেবে পাওয়া যায়।এই মল্লেশ্বর মন্দিরে আজও গেলে দেখতে পাবেন গর্ভগৃহের মধ্যিখানে বৃত্তাকার একটি গভীর গর্ত । শুনলাম এখানেই দ্বিতীয় চন্দ্রকেতুর রাজত্ত্বকালে বাংলার নবাব সুলেমান কররানীর সেনাপতি কালাপাহাড়ের প্রলয়ংকারী আক্রমনের হাত থেকে কুলদেবতা মল্লেশ্বর শিবের বিগ্রহটিকে রক্ষা করার জন্য সেটিকে এই ক্ষেত্রে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়। কেতু বংশের সুসময়ে এই শহরে ,এই মন্দিরের চারপাশে গড়ে উঠেছিল একের পর এক দেবালয়, দুর্গ ও পরিখা । বারদুয়ারী, লালগড়, রামগড় , রঘুনাথগরের দুর্গ নির্মিত হয়েছিল এই যুগেই।
এরপর ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই অঞ্চল সহ বাংলায় গৌড়েশ্বর হুসেন শাহের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৫৫৬ সালে দিল্লিতে ক্ষমতাসীন মোঘল শক্তির সাথে বাংলার মসনদে আসীন পাঠান শক্তির সংঘর্ষের সুযোগ নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থের অধিবাসী চৌহান বংশীয় বিরভান সিং চন্দ্রকোনাসহ কেতু বংশীয় রাজ্যগুলি একেরপর এক স্বীয় দখলে আনেন। নতুন রাজ্যের রাজধানী হয় এই চন্দ্রকোনা।ঐতিহাসিক যোগেশ চন্দ্র বসুর মতে বগরীর রাজা রঘুনাথ সিং (১৪৭০-১৫৪০ খ্রি ) কেতু বংশের শেষ রাজা দ্বিতীয় চন্দ্র কেতুকে হত্যা করেন। কিন্তু মৃগাঙ্ক রায় দ্বিমত প্রকাশ করে জানিয়েছেন যে বীরভানের হাতেই নিহত হন দ্বিতীয় চন্দ্র কেতু।
মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্ব কালে রচিত বাহারিস্তান – ই -গোয়ের্বিতে সেই সময় এই অঞ্চলে স্থানীয় ভান রাজবংশের রাজা চন্দ্রভান ও বীরভানের নাম পাওয়া যায়। ভান বংশের ইতিহাস জানা যায় এই বংশের শেষ রাজা মিত্রসেনের প্রদত্ত একটি পাট্টায় (খ্রি সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগ) এবং লালগড়ে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে। তখন চন্দ্রকোণা পরগনা পরিচিত ছিল মানা নামে। শিলালিপি থেকে পরপর কয়েকজন রাজার ও একজন রানী-লক্ষ্মণাবতীর নাম জানা যায়।দক্ষিণ বাজার এলাকায় এই ভান রাজবংশের সময়ের একটি পাথরের রাধামাধবের জোড়বাংলা মন্দির চোখে পড়ে আজও। প্রায় জনশূন্য সেই মন্দিরের শিল্প-সুষমা আজও যেকোনো চিত্রশিকারীর কাছে যথেষ্ট লোভনীয়।
চন্দ্রকোণার বারদুয়ারী গড়ে ছিল ভান রাজাদের রাজপ্রাসাদটি যেখানে আজ ভেঙে পড়া পরিখা ছাড়া কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। বীরভান রাজা হিসেবে একেবারেই জনদরদী ছিলেন না। সেকালের কবির রচনায় মেলে তার জ্বলন্ত প্রমান-“চকোর সে চন্দ্র লুঠ লিয়া ,কৌন রহে নিদান , সব সুখনে হর লিয়া , রাজা বীরভান চৌহান ” I বীরভান ছাড়া হরিভান, মিত্র সেন ,সূর্য্য ভান, চন্দ্র ভান, দুই রঘুনাথ ও সমসেনের নাম পাওয়া যায় ভান বংশীয় রাজা হিসেবে যদিও সব রাজাদের বিশদ তথ্য আজও অজানার অন্ধকারে ঢাকা। যেটুকু তথ্য পাওয়া যায় তাই সক্ষেপে বিবৃত করলাম।
১৫৯৬ সালে তৎকালীন চন্দ্রকোণার অধিপতি রঘুনাথ সিংহ পরাস্ত হন দিল্লীর বাদশাহ আকবরের দক্ষ সেনাপতি মান সিংহের কাছে। চন্দ্রকোণা মোঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। আকবরের রাজস্বমন্ত্রী টোডরমলের পরিকল্পনামাফিক সেই সময় সারা বাংলা বিভক্ত হয়েছিল ১৯টি সরকার ও ৬৮২টি মহালে।সেই অনুযায়ী মান্দারণ সরকারের অন্তর্গত হাভেলি মহালের অন্তর্গত ছিল চন্দ্রকোনা।বীর ভানের পুত্র হরিভান ছিলেন এই বংশের সবচেয়ে পরাক্রমী রাজা। তুজুক-ই-জাহাঁগিরি,পাদশাহনামা ও Midnapore District Gazetteer থেকে প্রতীয়মান হয় যে তিনি প্রথমে জাহাঙ্গীরের আমলে বাংলার সুবেদার কাশিম খাঁর বিরুদ্ধে ও পরে ১৬১৭ খ্রিস্টাব্দে মোঘলদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরলেও পরে তিনি মোঘলদের বশ্যতা স্বীকার করে নেন ও পাঁচহাজারী মনসবদারী লাভ করেন। হরিসিংপুরে তিনি একটি নতুন জনপদ গড়ে তোলেন ও তার পত্নীর মৃত্যুর পর স্মৃতির উদ্দেশ্যে সমাধি মন্দির স্থাপন করেন যা স্থানীয় ভাবে সতীমন্দির নাম পরিচিত।একটি নবরত্ন মন্দিরে প্রাপ্ত লিপি থেকে জানা যায় হরিভানের মৃত্যুর পর তার পুত্র মিত্রসেন চন্দ্রকোণার সিংহাসনে আরোহন করেন এবং ১৬৬৮/৬৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।তাঁর রাজত্বকালে তাঁর মাতা মল্লরাজ পরিবারের কন্যা লক্ষ্মণাবতী লালগড়ে নবরত্ন মন্দিরে গিরিধারী লালজিউর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মিত্রসেন মিত্রসেনপুর নামে একটি জনপদ গড়ে তোলেন এই অঞ্চলে। তিনি নিঃসন্তান হওয়ায় তাঁর মৃত্যুর পর বিষ্ণুপুরের মল্লরাজবংশীয় রঘুনাথ সিংহ চন্দ্রকোণার অধীশ্বর হন। ভান রাজাদের শাসনাধীনে চন্দ্রকোণা যথেষ্ট কর্মচঞ্চল সমৃদ্ধ নগর হিসেবে পরিচিত ছিল। লোকে তখন থেকেই এই চন্দ্রকোনাকে বাহান্ন বাজার তিপান্ন গলির শহর বলতো। আজও এখানে অনেক বাজার বসে যদিও তাঁর সেই মহিমা নেই আজ আর।
চন্দ্রকোণার ইতিহাসের পরবর্তী উল্লেখযোগ্য তথ্য মেলে ১৬৮৫ খ্রিস্টাব্দে।বাংলায় তখন শায়েস্তা খানের শাসন। এই সময় আফগান সর্দার রহিম খান ,বিষ্ণুপুরের অধিপতি গোপাল সিং এবং চন্দ্রকোণার রঘুনাথ সিং বরোদার রাজা বিদ্রোহী শোভা সিংহের পাশে দাঁড়িয়ে একযোগে বর্দ্ধমান রাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।ইতিমধ্যে ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে বর্দ্ধমান রাজ্ কৃষ্ণরাম রায় তদানীন্তন সম্রাট আওরঙ্গজেবের নিকট একটি ফরমানে বর্ধমান পরগনার জমিদারি ও সমস্ত বর্দ্ধমান চাকলার সরকারি রাজস্ব আদায়ের ভারপ্রাপ্ত হন।বর্ধমান রাজের এই ক্ষমতাকে অগ্রাহ্য করে শোভা সিং ,চন্দ্রকোণার রাজা চন্দ্রভান এবং তাঁর পুত্র যুবরাজ দ্বিতীয় রঘুনাথ সিং ও উড়িষ্যার পাঠান সর্দার রহিম খান পুনরায় জোটবদ্ধ হন I তারা একযোগে ১৬৯৬ সালে বর্ধমান রাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। বর্ধমান রাজ্ কৃষ্ণরাম পরাজিত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর পুত্র গোপনে ঢাকায় গিয়ে ঢাকার সুবেদার ইব্রাহিম খানের সাহায্য প্রার্থনা করলে ইব্রাহিম খানের নির্দেশে যশোরের ফৌজদার নুরুল্লা খান বিদ্রোহ দমনে নিযুক্ত হন। কিন্তু অচিরেই ব্যর্থ হয় তাঁর প্রয়াস। নুরুল্লা খান বিদ্রোহ দমন করতে না পেরে যশোরে পালিয়ে যান। উপযুক্ত শাসক ও দক্ষ শাসনের অভাবে চন্দ্রকোনাসপ্তগ্রাম, মুর্শিদাবাদসহ সারা বাংলায় মাৎসন্যায়ের পরিস্থিতি তৈরী হয়। এইভাবে ৩০ বছর ধরে সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাবে বাংলার বুকে অরাজকতা ও সন্ত্রাসের বাতাবরণ ঘনীভূত হতে থাকে। ক্রমে বাংলার এই দুর্দিনের কথা কর্ণগোচর হয় দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধরত দিল্লীশ্বর আওরঙ্গজেবের। তিনি নিজ পুত্র আজিমুশ্শানকে বাংলার দায়িত্ব দিয়ে বঙ্গদেশে প্রেরণ করেন। এই সময় শোভাসিং ও পাঠান সর্দার রহিম খানের মৃত্যুর ফলে বর্ধমানে বিদ্রোহের আঁচ স্তিমিত হয়ে এসেছিলো। শাহজাদা আজিমুশ্শান কৃষ্ণরামের পুত্র জগৎরামকে বর্দ্ধমানের দায়ভার অর্পণ করে শান্তি ফিরিয়ে আনেন। জগৎরামের জ্যেষ্ঠপুত্র পরাক্রমী কীর্তিচাঁদ তাঁর রাজত্বকালে চন্দ্রকোণা রাজ্য আক্রমণ করে নিজ অধিকার স্থাপন করেন। এই সময় চন্দ্রকোণার রামগড়,লালগড় ও রঘুনাথগড় বিধ্বস্ত হয় বাদশাহী তোপে। এই আক্রমণে চন্দ্রকোণার রাজা সপরিবারে নিহত হন।
এর পরের ইতিহাস শুধুই লুন্ঠনের ইতিহাস। ১৭৪০-১৭৪১ খ্রিস্টাব্দে মারাঠা বীর ভাস্কর পন্ডিত তাঁর বর্গী বাহিনীর সাহায্যে মোঘলদের হাত থেকে সমগ্র মেদিনীপুরসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে নেয়। পরে ১৭৫১ সালে ১২ লক্ষ টাকা চৌথের বিনিময়ে তা আলীবর্দীর হাতে প্রত্যার্পিত হয়। কোম্পানির শাসনাধীন বাংলায় বর্ধমানরাজ চন্দ্রকোনাসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। বর্গী হামলার ক্ষত তখনো দগদগে। সেই সময় বর্ধমান রাজ্যর প্রতিনিধি হিসেবে সভাপন্ডিত রামদেব তর্কপঞ্চাননের পৌত্র তথা বর্ধমান রাজ্যের দেওয়ান রামেশ্বর রায় ১৭৪০ সালে চন্দ্রকোণা পরগনার রাজস্ব আদায়ে নিযুক্ত হন। তাঁর মৃত্যুর পর ১৭৪৮ সালে পুত্র রামগোপাল রায় ওরফে গোপাল রায় চন্দ্রকোণার তদারকিতে নিযুক্ত হন। ১৭৫৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। চন্দ্রকোণা সম্পূর্ণরূপে ব্রিটিশ পদাধীন হয়। গঙ্গারাম দত্তের মহারাষ্ট্র পুরান থেকে জানা যায় ইতিমধ্যে ১৭৬৮-৬৯ সালে কটকের মারাঠা সুবেদার সূক্ষ্মজি গনায়সের সেনাপতি নীলু পন্ডিতের নেতৃত্বে বর্গী হানায় পুনরায় রক্তাত্ব হয় চন্দ্রকোণার ভূমি।আর সেই সময় চন্দ্রকোনায় এই বর্গী আক্রমণ প্রতিহত হয়েছিল ধুমসি নাম্নী এক বীরাঙ্গনার নেতৃত্বে। প্রাক-আধুনিক ভারতে এমন চরিত্র সত্যি বিরল। এছাড়া বর্গী হাঙ্গামা প্রতিহত করতে স্থানীয় শক্তির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মেদিনীপুরের ইংরেজ রেসিডেন্ট এডওয়ার্ড বাবরস।তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতাবশতঃ ক্ষীরপাইয়ের পড়ান আটা নামে এক মোদক এক নতুন ধরণের মিষ্টি উদ্ভাবন করেন। নাম দেন বাবরসা। চন্দ্রকোণা কখনো গেলে স্বর্গীয় স্বাদের এই মিষ্টিটি খেতে ভুলবেন না যেন।
বর্গী আক্রমণ প্রতিহত করে ব্রিটিশ গভর্নর ভ্যান্সিটার্টের নির্দেশ মোতাবেক চন্দ্রকোনাসহ চাকলা মেদিনীপুরের প্রথম রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন মি জনস্টোন। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চলে ক্ষীরপাইতে অবদমিত হয় সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ। ১৮১২-১৬ সালে অবদমিত হয় নায়েক বিদ্রোহও। চন্দ্রকোণার মাটিতে নায়েক বিদ্রোহের নেতা হাবল,রাজেন্দ্র,ফাল্গু,সুবল,যুগল ও কিশোরকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। তাঁদের আত্মত্যাগের স্মৃতিধন্য এই অঞ্চল আজ পরিচিত ফাঁসিডাঙ্গা নামে।
১৮১৯ সালে চন্দ্রকোণা বর্ধমান থেকে ছিন্ন হয়ে যুক্ত হয় হুগলির সাথে যদিও ফৌজদারি কাজ ১৮২৬ পর্যন্ত হুগলি ও পরে মেদিনীপুরে সংগঠিত হতো। ১৮৪৫ সালে জাহানাবাদ,চন্দ্রকোণা,ঘাটাল,কোতুলপুর ও রায়না নিয়ে প্রথম ক্ষীরপাই মহকুমা তৈরী হয়। ক্ষীরপাই মহকুমার প্রথম ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হন ঈশ্বর চন্দ্র ঘোষ। ১৮৪৬ এ ক্ষীরপাই থেকে মহকুমা কার্যালয় জাহানাবাদে ( বর্তমানের আরামবাগে ) স্থান্তরিত হয়। ১৮৫০ সালে ঘাটাল মহকুমা সৃষ্টি হয় ও চন্দ্রকোণা ঘাটাল মহকুমার পরিধিভুক্ত হয়। চন্দ্রকোণার বিভিন্ন স্থানে ইংরেজদের চাহিদা মেটাতে নীলচাষের বহর বাড়ে। ছত্রগঞ্জ,ধর্মপুর,নীলগঞ্জ ,লাহিরগঞ্জ সহ বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠতে থাকে একের পর এক নীলকুঠি।ক্রমেই বৃদ্ধি পায়বিশ্ববাজারে নীলের ক্রমবর্ধমান চাহিদা অনুযায়ী যোগান দেবার প্রয়োজনে মাত্রাতিরিক্ত পরিমানে নীল চাষে বাধ্য করা হয় চাষিদের।পাল্লা দিয়ে বাড়ে নীলকর সাহেবদের অত্যাচার। বাংলার অন্যান্য স্থানের মতো চন্দ্রকোণার চাষীরাও গর্জে ওঠেন এর প্রতিবাদে। শুরু হয় নীলবিদ্রোহ। অবশেষে ১৮৭১ সালে ছত্রগঞ্জ থেকে নীল ব্যবসার সদর কুঠি গড়বেতার আমলাগোরে স্থানান্তরিত হয়।কঠিন হাতে দমিত হয় বিদ্রোহ। তারপর আন্তর্জাতিক বাজারে নীলের চাহিদা হ্রাস পেলে ক্রমেই ফুরিয়ে যায় নীলচাষের প্রয়োজনীয়তা। ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয়ে পরে নীলকুঠিগুলি। শহরজুড়ে আজ সেগুলির ভগ্নাবশেষ শুধু ইতিউতি ছড়ানো।
১৮৭২ সালে চন্দ্রকোণা মেদিনীপুর জেলাভুক্ত হয়।ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুর যখন উত্তাল তখন পিছিয়ে ছিল না চন্দ্রকোনাও। ১৮৮৫ সালে উমেশ চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে বোম্বাইয়ে জাতীয় কংগ্রেসের যে সর্বভারতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতে মেদিনীপুর জেলার বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে চন্দ্রকোণা থেকে যোগেন্দ্র চন্দ্র রায়, বিহারীলাল সিংহ ও নাগেশ্বর সিংহের মতো নমস্য ব্যক্তিগণ যোগদান করেন। সেই শুরু। এরপর ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন-সবেতেই ছিল চন্দ্রকোণার অধিবাসীদের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান। বিভিন্ন পর্বের এই ব্রিটিশ বিরোধী গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কখনো তৎকালীন চন্দ্রকোণার পৌরসভার পৌরপতি ভরত রামানুজ দাস মোহান্ত মহারাজ, কখনো জারার সাতকড়ি পতি রায় ,কখনোবা কেঁচকাপুরের আশুতোষ সিংহ। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে ১৯৩৮ সালের ৩রা মে চন্দ্রকোণা রোড হয়ে ঘাটাল যাবার পথে ডা: জোতিষ ঘোষের আহ্বানে ও তত্ত্বাবধানে তৎকালীন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি সুভাষ চন্দ্র বসু এই চন্দ্রকোণার কালিকাপুরে একটি সভা করেন।এই মঞ্চ থেকেই চন্দ্রকোনাবাসীকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেন তিনি । স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে চন্দ্রকোণার ইতিহাসকে আরো বিশদে আলোচনার প্রয়োজন আছে।সুযোগ পেলে কখনো অন্য কোনো পরিসরে সেই আলোচনা করবো। আপাতত এই প্রবন্ধের আলোচনা পর্যটন প্রসঙ্গেই সীমাবদ্ধ রাখছি।
আমার চোখে শহর চন্দ্রকোণা পরিদর্শনের সুযোগে যে কটি কালোত্তীর্ণ স্থাপত্য পর্যটনের বিচারে যথেষ্ট স্বভাবনাময় মনে হয়েছিল তারই একটি হলো রঘুনাথ জীউ মন্দির। মন্দিরটি পুরী ধামের জগন্নাথ দেবের মন্দিরের আদলে তৈরী। মন্দিরগাত্রে দেখা যায় নানা কিন্নর-কিন্নরী মূর্তি। মন্দিরের ভগ্নদশার কারণে মন্দিরের নানা দেববিগ্রহ সরিয়ে ঠাকুরবাড়ি বাজারস্থিত গুন্ডিচাবাড়িতে রাখা হয়েছে।মন্দিরের সামনের দিকে প্রাচীর ছাড়িয়ে দেখা যায় হনুমান জীউর মন্দির, জীর্ণ নাটমন্দির, চার চIলা যুক্ত তোষাখানা ,রাসমঞ্চ, ভোগ ঘর, অতিথিশালা, ঝুলন মন্দির প্রভৃতি। রঘুনাথ মন্দিরের উত্তরদিকে রয়েছে লালজীউর দক্ষিণমুখী মাকরা পাথরের মন্দির। এই মন্দিরের অলংকরণের মধ্যেও কৃষ্ণাবতারের নানা অবয়ব পরিলক্ষিত হয়। মন্দিরে উদ্ধার হওয়া ও ঠাকুরবাড়ির সংগ্রহশালায় রক্ষিত ফলক থেকে জানা যায় যে এটির নির্মাণকাজ ১৫৭৭ শকাব্দে রাজা বীরভানের আমলে শুরু হয় এবং সম্পন্ন হয় রাজা মিত্রসেনের সময়কালে। যোগেশ চন্দ্র বসুর মতে শিলালিপি অনুসারে ১৫৭৭ সালে নির্মিত লালজীউ মন্দির এবং রঘুনাথ জীউ মন্দিরদুটির কোনোটিই বর্তমানে পরিচিত লালজীউ মন্দির বা রঘুনাথ জীউ মন্দির নয়। পুরোনো লালজীউ মন্দির লালগড় দুর্গে এবং রঘুনাথ জীউ মন্দির রামগড় দুর্গে প্রতিষ্ঠিত ছিল। বর্ধমান রাজ্ কীর্তি চাঁদের সঙ্গে চন্দ্রকোণা রাজ্যর যুদ্ধে দুটি গড়ই বিধ্বস্ত হয়। তখনি বিনষ্ট হয় মন্দির দুটি।এরপর বর্তমান রঘুনাথ বাড়িতে মন্দির দুটি নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে বর্দ্ধমানরাজ্ তেজচাঁদ এই স্থানের মন্দিরগুলির সংস্কার করিয়েছিলেন। চন্দ্রকোণার মল্লেশ্বরপুর ঠাকুরবাড়ির মন্দিরও ঐসময় তেজচাঁদ সংস্কার করান। রঘুনাথ বাড়ির চৌহদ্দিতে আরো একটি পঞ্চানন শিবের মাকরা পাথরে তৈরী পঞ্চরত্ন মন্দির আছে। এই বাড়িতেই পাওয়া গিয়েছিলো লিপিযুক্ত লৌহ কামান যা অনেকের মতে রাজা মিত্রসেনের আমলে ব্যবহৃত হতো।
যাত্রাপথে এর পরের দ্রষ্টব্য রাজা খয়েরমল্ল প্রতিষ্ঠিত মল্লেশ্বর জীউর ঠাকুরবাড়ি। মন্দিরের চারপাশের পরিখা ভেঙে পড়লেও মূল মন্দিরটি এখনো প্রায় অক্ষত আছে। অসামান্য শৈল্পিক দক্ষতটার নিদর্শন এটি। চন্দ্রকোণার প্রাচীন রাজবংশের বারদুয়ারী গড়ের উপস্থিতি ছিল এখানেই যা বর্তমানে সম্পূর্ণ লুপ্ত। বর্ধমান রাজ্ তেজচন্দ্র ১৩২৮ সালে এই মন্দিরটি সংস্কার করেন।সমগ্র মন্দিরটি তৈরী মাকরা পাথরে। ত্রিখিলান প্রবেশ পথ যুক্ত অলিন্দ বেষ্টন করে আছে গর্ভগৃহকে। কালাপাহাড়ের আক্রমণ হতে বিগ্রহকে রক্ষা করার জন্য মধ্যযুগ থেকে এই পঞ্চরত্ন মন্দিরে মল্লেশ্বরজীউ গম্ভিরার মধ্যে প্রস্তরাবৃত অবস্থায় বিরাজিত আছেন।এই ইতিহাস পূর্বে বলেছি একবার।ঠাকুরবাড়িতে সিদ্ধ পুষ্করিণী নামে একটি ছোট পুকুর ,জপ স্থান নাম ছোট একটি আটচালা,বৃষভ মন্দির ও মনসা মন্দির আছে। ঠাকুরবাড়ির বাইরে স্বরূপ নারায়ণ ধর্মের একটি আটচালা আছে। এই মন্দিরে এখনো নিত্য পূজা হয়। প্রতি বছর মহা আড়ম্বরে মহিষবলি সহযোগে দুর্গাপূজা হয় এখানে।
আমার সেদিনের ভ্রমণ তালিকায় পরবর্তী সংযোজন মিত্রসেনপুরের প্রসিদ্ধ শান্তিনাথ শিবের মন্দির। ১৮২৮ সালে মন্দিরটি নির্মিত হয়। বিগ্রহটি পরিচিত বাইশ শিব নামে। মন্দিরগাত্রে রয়েছে বহু টেরাকোটার সুদৃশ্য মূর্তি যার বেশিরভাগই মহাভারত ও রামায়ণের কাহিনী দ্বারা অনুপ্রাণিত। মন্দিরটি বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত পুরাকীর্তিগুলির অন্যতম।জেনে ভালো লাগলো যে সরকারি আর্থিক আনুকূল্যে সম্প্রতি এর সংস্কার সম্পন্ন হয়েছে।
এরপর দেখলাম চন্দ্রকোণা পৌরসভার দক্ষিণ বাজারের কাছে মাকরা পাথরে তৈরী একটি জোড়বাংলা মন্দির। পরিত্যক্ত মন্দিরের শীর্ষদেশে প্রতি ভাগে ৩টি করে মোট ছটি চূড়া বর্তমান। জানা যায় যে পূর্বে এই মন্দিরে বুদ্ধ মূর্তি ছিল। প্রায় ৪০০ বছর আগে যখন এই অঞ্চলে বৈষ্ণব ধর্ম প্রাধান্য পায়, তখন এই মন্দিরে বিভিন্ন দেব বিগ্রহ সহযোগে বিষ্ণু শিলা পূজিত হতে শুরু করে। বিগ্রহগুলি বর্তমানে অন্যত্র সরানো হয়েছে। এই জোড়বাংলা মন্দিরে প্রবেশ করতে হলে একটি ছোট কক্ষের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এর দুপাশে দুটি ক্ষুদ্রাকৃতি কক্ষ আছে। আয়তক্ষেত্রকার গর্ভগৃহের উত্তরদিকের দেওয়ালের কাছে একটি বিগ্রহ বেদি বর্তমান। মন্দিরের দুদিকের দেওয়ালে কৃষ্ণ-বলরাম সহ নানা দেব-দেবীর ভাস্কর্য রয়েছে। নির্মাণ কাল আনুমানিক সপ্তদশ শতক। অধুনা পশ্চিমবঙ্গের পুরাকীর্তি সংরক্ষণ বিভাগ থেকে পুনরায় সংস্কার করা হয়েছে মন্দিরটি।
যুগে যুগে চন্দ্রকোণার পুণ্যভূমিতে সমবেত হয়েছে নানা ধর্মের মানুষ। তারা আপন গতিতে নিজেদের স্বকীয় পরম্পরায়, সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে শক্ত করেছে সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধন। এরপর আমাদের গাড়ি থামলো চন্দ্রকোণার সেরকমই একটি স্থান নানক-অস্থল বা নানক সঙ্গতের সামনে। ইতিহাস কথিত রামগড় ও রঘুনাথগরের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান। এখানেই আমরা সেদিনের দ্বিপ্রাহরিক ভোজন সমাপন করি। লঙ্গরখানায় পরম মমতায় ও আন্তরিকতায় যে স্বর্গীয় আহার্য পরিবেশিত হয়েছিল তা আস্বাদন না করলে বোধ হয় জীবনে আক্ষেপ রয়ে যেত। গুরুমুখী ভাষায় রচিত নানক প্রকাশে উল্লেখ আছে যে গুরু নানক ২০বছর বয়সে পুরি যাবার পথে এই চন্দ্রকোনায় এসেছিলেন। সঙ্গে ছিল তাঁর দুই অন্তরঙ্গ অনুচর বালা ও মর্দ্দIনা। এই রামগড় স্থানে তিনি বেশ কিছুদিন রাত্রিযাপন করেছিলেন। জনশ্রুতি অনুসারে নানকের আশীর্বাদে সেই সময় রাজা চন্দ্রকেতু পুত্র সন্তান লাভ করেন। যে স্থানে তিনি অবস্থান করেছিলেন সেটিই আজকের নানক ভিটা নামে পরিচিত। এই ঘটনার বেশ কয়েকবছর পরে এই স্থানে আনুমানিক ১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দে শিখ সম্প্রদায়ের জনৈক বৈশাখী দাস উদাসীন নামে এক সিদ্ধ পুরুষ এই স্থানে বসবাস শুরু করেন। তিনিই নানক সংগতের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম মোহান্ত। নানক অস্থলের এক প্রান্তে মাকড়া পাথরে তৈরী বৈশাখী দাসের সমাধি মন্দির চোখে পরে আজও। লোককথা অনুসারে বৈশাখী দাসের দেহান্তের পর অনেকদিন কোনো মোহান্ত না থাকায় অযোধ্যার এক পুণ্যাত্মা দম্পতি আশ্রমের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তাঁদের একত্রে দেহাবসানের পর তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে বেদি স্থাপিত হয়। এছাড়া আশ্রমে প্রবেশের মুখেই চোখে পরে একটি হনুমানজীর মন্দির।
এর পরের গন্তব্য সঙ্গীতাচার্য্য রমাপতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভগ্নপ্রায় প্রাসাদোপম অট্টালিকা যেটি স্থানীয় ভাবে লালবাবুর পাকা নামেই পরিচিত। দরবারী শিল্পী ও গীতিকার রমাপতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতI গঙ্গাবিষ্ণু বন্দোপাধ্যায়,পিতামহ রামসুন্দর বন্দোপাধ্যায় ও স্ত্রী করুণাময়ীও ছিলেন রাগাশ্রয়ী সংগীত বিশারদ। রমাপতি বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৩১ সালে বর্ধমান রাজার স্টেটে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন এবং অনতিবিলম্বেই রাজার সভাকবি ও গায়ক নিযুক্ত হন।তাঁর বংশধর কেউই আর এখানে বসবাস করেন না। বাড়ির দালান জুড়ে শুধুই খসে পড়া পলেস্তারা আর আগাছার জঙ্গল।তবু ভেঙে পড়া পাষাণপুরীতে এখনো যে দুর্গামণ্ডপ ও তার খিলানগুলি দেখতে পাওয়া যায় সেগুলি আক্ষরিক অর্থেই অত্যন্ত উচ্চ শিল্পগুণমর্যাদাসম্পন্ন। প্রাসাদের একপাশে রয়েছে কুলদেবতা দামোদর জীউর ঠাকুরঘর। দালানবাড়ির সামনে দেখা যায় ঘাট বাঁধানো পুষ্করিণী এবং মাকড়া পাথরে বাঁধানো বকুলবীথি। বাড়ির সন্নিকটেই রয়েছে রমাপতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমাধি মন্দির। সেটিতে তখন এসে পড়েছে শীতের কুয়াশাভেজা শেষ বিকেলে আলো। কেমন যেন মন ভারী করা ভেজা মাটির সোঁদাগন্ধ মাখা বাতাস ভেসে এলো মাঠের ওপার থেকে।শুনলাম কাছেই নাকি আছে জহরা পুষ্করিণী। দ্বিতীয় চন্দ্রকেতুর আদরের দুলালী ছিল জহরা। তার নামেই পুকুর আর এই পুকুরেই কালাপাহাড়ের আগমনের খবর পেয়ে রাজমহিষীরা নাকি জহরব্রত গ্রহণ করে প্রাণত্যাগ করে ব্রতসমাপন করেন।মনে হলো যেন আজও বাতাসে ভেসে বেড়ায় সেই দিনের অন্তঃপুরিকাদের রুদ্ধশ্বাস ক্রন্দন।
দেখতে দেখতে ধান-নিড়ানো মাঠের কোলে টুপ্ করে অস্ত গেলেন সূর্যদেবতা। একে একে জ্বলে উঠতে লাগলো সাঁঝবাতিরা। আমরা ফিরে চললাম আলপথ ধরে।বাকি রয়ে গেলো অনেক কিছু দেখা ও জানা। পরেরবার অবশ্যই চেষ্টা করবো না দেখা জায়গাগুলো ছুঁয়ে দেখার। আপাতত আজকের মতো পথ চলা শেষ এখানেই। আপনারাও রেডি থাকুন রুকস্যাক বেঁধে নিয়ে। ছুটির দিন দেখে বেড়িয়ে পড়ুন। শীতের মিঠে রোদ সঙ্গী করে চষে ফেলুন চন্দ্রকোনা। শীতযাপনের এমন মজা যে আর কিছুতে নেই তা নিশ্চই আর বলার অপেক্ষা রাখে না।