– ইনি কে তাও জানেন না বুঝি? ইনি একজন প্রার্থী।
– কিসের প্রার্থী? আমার কাছে কিন্তু এই মুহূর্তে প্রার্থনা করে কোন লাভ হবে না, আগেই বলে রাখলাম।
– আহা, এ প্রার্থী সে প্রার্থী নয়। ইনি ভোটে দাঁড়ান।
– ও, আচ্ছা। বেশ বুঝলাম। তা এনার নামটি কী?
– এঁর নাম হানাহানি হাটুই।
– বাঃ! দিব্যি চমৎকার নাম। তা উনি কি ভোটে শুধুই দাঁড়ান না কখনোসখনো বসেনও?
– না, বসার রেকর্ড অবশ্য ওনার বিশেষ নেই। উনি দাঁড়ান, চলেন। মোবাইলই থাকেন প্রায় সবসময়।
– বাঃ! বাঃ! বেশ। বেশ। হাতে মোবাইল, কানে মোবাইল, আবার পায়েও মোবাইল?
– হেঁ হেঁ দাদা, এটা বেড়ে বলেছেন। আপনারা সব্যসাচীর কথা শুনেছেন, কিন্তু ইনি আবার দু’পায়েও সব্যসাচী। সেদিন ওঁর দলেরই কয়েকজন কিসব কটুবাক্য বলেছিল, উনি তাই শুনে সামান্য একটু হাতপা ঝাড়া দিলেন। ব্যস, চারদিকে চারজন ফ্ল্যাট।
– বাবা! শুনেই রোমাঞ্চ হচ্ছে। উনি তো তাহলে একজন মহাপুরুষ!
– মহাপুরুষ বলে মহাপুরুষ? শুনবেন?এই তো, মনোনয়নের সময়েই, অফিসার ভুল করে ওঁর নাম বলে ফেলেছিলেন, হাতাহাতি হাটুই। আর যায় কোথা? পরের মুহূর্তেই দু’ আঙুলের ভেল্কিতে অফিসার একদম শূন্যে। পুরোদস্তুর ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। শেষে ওনার দলের লোকজনই অবস্থা সামাল দেয়। যদিও তার পর ওনার বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ করা হয়েছে, তবে উনি ওসবের কেয়ার করেন না। জেলেও ওনার হয়ে প্রক্সি খাটার লোকজন আছে কিনা। থানার বড়োবাবু তো এতটাই ভক্তিশ্রদ্ধা করেন যে ওনাকে জিজ্ঞেস না করে কোন বড় কাজে হাত দেন না।
– দারুণ বলে দারুণ!
– দারুণ বলে দারুণ! এই তো আগের ভোটের সময়ই, প্রিসাইডিং অফিসার কিছুতেই ওনাকে ব্যালট পেপারগুলো দেবে না। আরে বাবা, টুকটাক ছাপ্পাই যদি না পড়ল, তাহলে আর ভোটের মজাটা কী? পিকনিক করতে গিয়ে যদি সবই ঠিকঠাক থাকে, তবে আর হলটা কী? কোনটায় নুন বেশি, কোনটা পোড়া- তবেই না পিকনিকটা লোকে মনে রাখে! সেরকম তো ভোটও। তা যেকথা বলছিলাম। প্রিসাইডিং অফিসারটা ছিল মহা বেরসিক। তবে আমাদের ইনি তো মহানুভব। প্রয়োজনের বাইরে মারদাংগা একদম পছন্দ করেন না। উনি তাই কিছুই করলেন না। খালি পকেট থেকে পিস্তলটা বের করে আনমনে দেখতে থাকলেন। উদাসীন হয়ে পড়েছিলেন কিনা। তা প্রিসাইডিং অফিসারটা এমনি ভীতু যে তাই দেখেই চোখের জলে নাকের জলে হয়ে ব্যালট পেপার আর যা যা ছিল, সব বিনা বাক্যে দিয়ে দিল। ওনার আর কী দোষ বলুন? কিন্তু হতভাগা পেপারওয়ালারা এমন বজ্জাত যে ওনার নামে সাতকাহন করে লিখল। মানুষের সুমতি যে কবে হবে?
– ঠিকই বলেছেন। মানুষের সুমতি হওয়া বড়ো দুষ্কর। তবে চিন্তা করবেন না। আজ না হোক, হয়তো দু’শো বছর পরে লোকে ওনাকে মহান দেশপ্রেমী বলে চিনবে।
– তাই যেন হয় দাদা, তাই যেন হয়। আপনার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক।
– ফুলচন্দন না পড়ে চপ কাটলেট পড়লে বেশি ভালো হত না কি?
– হেঁ হেঁ দাদা, আপনি তো ভারি রসিক।
– এটা অবশ্য আমার গিন্নীও বলে। আমার রসবোধ নাকি কিঞ্চিৎ বেশি। তা উনি কোন্ দলের হয়ে দাঁড়াইয়েছেন?
– উনি বিক্ষুব্ধ নির্দল পার্টি।
– হুমমমম। এবারে বুঝলাম। তা এখানে কী করছেন?
– দাদার এতো বুদ্ধি, আর এই সহজ কথাটা বুঝলেন না! কী আর বলি দাদা? এই আজকালকার জনগণ এতো অকৃতজ্ঞ যে ঘেন্না ধরে যায়। উনি এতো তাদের কথা ভাবেন, বনুক পিস্তল গুলি এতো সহজলভ্য করে দিয়েছেন, ফ্রিতে তাদের সব গ্রামের লোকেদের ধরে ধরে গুলি চালাবার ট্রেনিং দিচ্ছেন, কোনদিন স্বপ্নেও ভেবেছিলি? তার বিনিময়ে সামান্য একটু সিধে পাঠাতেও আপত্তি? আবার বলে, ভোট দেবো না? উনি তাই অল্প একটু বোঝাতে এসেছেন।
– ঠিক, ঠিক। ওইদিকে বোমাবাজির আওয়াজ পাচ্ছি। ওটা বুঝি বোঝানো চলছে?
– দাদার তো অসাধারণ বুদ্ধি! কী সহজে ধরে ফেললেন!
– না, না, বুদ্ধি আর কোথায়? সে হলে তো ওনার মতো কেউকেটাই হয়ে যেতাম!
– তা যা বলেছেন। তবে শুধু বুদ্ধিই নয়, ওনার সমাজসেবাও অসাধারণ।
– কীরকম? কীরকম?
– এই ধরুন, আজকালকার এই বেকারত্বের যুগে উনি এতগুলো তাজা তাজা ছেলেকে স্বাবলম্বী করে তুলেছেন। ওনার বাহিনীতে এখন কম করেও জনা দুশো ছেলে আছে। সবাই বোমা, পিস্তল, গোলাগুলিতে অসম্ভব পারদর্শী। এই এতগুলো পরিবারের মুখে উনি অন্ন তুলে দিচ্ছেন। কম কথা নাকি? এই তো, আগামীকালও একটা পেটো বাঁধার রিক্রুটমেন্ট টেস্ট আছে, জনা দশেক চাকরি পাবে। তারপর ওনার নিজের কথাটাই ধরুন না। চারটে বিয়ে। সবই গরীব ঘরের মেয়ে। এখন সকলেই রানির হালে। ভাবুন দেখি একবার, চার চারজন গরীব পিতাকে উনি কন্যাদায় থেকে মুক্তি দিয়েছেন। আজকালকার দিনে ক’জন এমন করে? যদিও ওয়ান পিস বৌ সম্প্রতি পিসফুলি সদুইসাইড করেছে, ওখানে একটা ভ্যাকান্সি তৈরি হয়েছে। আবার হয়তো কোন গরীব পিতাকে কন্যাদায় থেকে নিষ্কৃতি দেবেন। তারপর ধরুন, উনি নিজে এই কয়েক বছরে ভাঙা টালির ঘর থেকে সাতমহলা বাড়ি তুলেছেন। বাথরুম, গোয়াল সব এ সি। কী বিপুল পরিমাণ উদ্যোগীপুরুষ একবার চিন্তা করুন।
– তা তো বটেই। তা তো বটেই।
– শুধু তাই নয়। উনি রীতিমতো উঁচুদরের শিল্পীও।
– তাই নাকি? সেটা আবার কিরকম?
– এই ধরুন, যত পার্টির মিটিং হয়, তার সবকটাতেই ওনাকে ছাড়া উদ্বোধনী সঙ্গীতের কথা ভাবাই যায় না। এই তো সেবার, নজরুলগীতি গাইলেন, -আজি এ প্রভাতে রবির কর। এত দুর্দান্ত গাইলেন, কী আর বলি দাদা, শুনতে শুনতে কয়েকজন তরুণ ভাবাবেগ সামলাতে না পেরে দিল কয়েক রাউণ্ড গুলি চালিয়ে। একটা গুলি তো ছিটকে ওনারই পায়ে এসে লাগল। কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হল। কিন্তু একটা হতভাগা কাগজ পরের দিন কিরকম বিকৃত তথ্য পরিবেশন করল ভাবুন- ‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চরমে, নেতার পায়ে গুলি’। বলুন তো, কোন মানে হয়?
– সত্যি, কোন মানে হয় না।
– আরে বাবা, ছাপবি ছাপ, দেখেশুনে ঠিকঠাক খবর নিয়ে ছাপ। একবার তো ওনার কাছে বাইটও নিতে পারতিস। এতবড়ো একটা মানুষ, সবাই মান্যি করে। তা মানমর্যাদার একটু ধার ধারলি না?
– তা তো বটেই। কিন্তু এতোবড়ো একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেননি কেন উনি?
– করেননি কে বলল? অন্যায়কারীকে শাস্তি না দিলে উনি ধর্মের চোখে অপরাধী হয়ে যেতেন না? উনি তাই তক্কে তক্কে ছিলেন। কয়েকদিন পরপরই নতুন কর্মচারীদের প্র্যাকটিকাল ট্রেনিং ছিল একটা। রাস্তায় রাস্তায় গলিতে গলিতে মোড়ে মোড়ে ট্রেনিং চলছে, হেনকালে সেই পাকা সাংবাদিকটা কোন্দিক থেকে ভুলভাল খবর পেয়ে এসেছে কভার করতে। দাদা আর কী করেন? দিলেন ঠ্যা- ঠ্যা- ঠ্যা- ঠ্যা করে গুলি চালিয়ে। ব্যস্, সেই সাংবাদিক ছ’মাসের জন্য হাসপাতালে। মধুর প্রতিশোধ!
– মধুর বলে মধুর!
– আরো আছে। সরকারি কোষাগারে রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য উনি দিনে রাতে যে পরিমাণ অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন, কেউ ভাবতেই পারবে না।
– মানে?
– মানে খুব সহজ। ওনার আর ওনার দলবলের দিনে প্রায় শ’ চারেক বোতল লাগেই। তাহলে মাসে কত হল? বারো হাজার। বছরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে বারোহাজার ইন্টু বারো। মানে এক লাখ চুয়াল্লিশ হাজার। উনি তাহলে একাই বছরে সরকারকে কত টাকা দিচ্ছেন একবার ভেবে দেখুন।
– বাবারে! আমি তো এরকমভাবে কখনো ভাবিইনি।
– তাহলেই দেখুন। আমি আজকাল কী ভাবি জানেন দাদা?
– কী?
– ওই যে, গীতায় বলেছে না, পরিত্রাণে দুষ্কৃতাং বিনাশে সাধুং, উনি বোধহয় সেরকমই একটা কিছু।
– আহা, কথাটা অন্য। পরিত্রাণায় সাধূণাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্। তবে আপনি যেটা বললেন, সেটাই বোধহয় যথোপযুক্ত।
– এ হে, মাঝে মাঝে স্লিং অফ টাপ হয়ে যায় কিনা। মুখ্যুসুখ্যু মানুষ!
– স্লিং অব টাপ নয়, ওটা স্লিপ অফ টাঙ।
– ওই হল। একই ব্যাপার। তা সে যাই হোক, দেখুন দাদা, গীতাও তো তাহলে ওনার মাহাত্ম্য স্বীকার করে নিয়েছে। আমার কী মনে হয় বুঝলেন?
– কী মনে হয়?
– এই ধরুন, সব যুগেই ভগবানের কিছু না কিছু অবতার। যেমন, সত্যযুগে মৎস্যাবতার, ত্রেতাযুগে রামাবতার, দ্বাপরে কৃষ্ণাবতার, আর কলিতে আমাদের এই ইনি।
– হুমমমম। ভোটাবতার।
– ব্যাপক বলেছেন দাদা। উনি জানলে আপনাকে এই বাজারে এক্ষুণি বাজারে এক কিলোর সোনার চেন বানিয়ে দেবেন।
– তাই না কি? তবে তো আলাপ করতেই হচ্ছে।
– করবেন? ডাকব? আমি বললে উনি না করবেন না।
– ডাকুন তাহলে। একটু আলাপ, করমর্দন করে জীবন ধন্য করি।
– ওই যে, ওই তো। উনি আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছেন।
– বাঃ! বাঃ! এ তো মেঘ না চাইতেই জল! আলাপটা মনে হয় জম্পেশই হবে।
– স্যার, স্যার, উনি আপনার একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত। এ কী দাদা, আপনি ওনার হাত অত জোরে চেপে ধরছেন কেন? পকেট থেকে ওগুলো শেকলের মত কী বের করছেন?
– আমি সি আই ডি থেকে আসছি। ওগুলো হাতকড়া। হি ইস আণ্ডার অ্যারেস্ট নাউ। থ্যাংকস ফর ইয়োর ইনফরমেশন!