Home / কিশোর গল্প / ভালুকের অঙ্ক কষা -মৌসুমী পাত্র

ভালুকের অঙ্ক কষা -মৌসুমী পাত্র

-ও মা, মা! একটা গল্প বলো না।

-উঁহু। তুই খালি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়িস।
-আজ ঘুমোব না। বলো না গো।
-না বুজাই। আজ থাক। ঘুম পাচ্ছে।
-বলোই না। আচ্ছা মা, দাদু যে বলে, তুমি যে গল্পগুলো বলো, তার সবই নাকি গুল!
-হুমম। তা তো তোর দাদু বলবেই। সত্যি কথাগুলো ফাঁস হয়ে যায় কিনা।
-জানো, রোজ সকালে আমাকে জিজ্ঞেস করে, কি রে বুজাই, তোর মা কাল রাতে কত নম্বরের গ্যাস দিল? হিসেব রাখবি। আজ সকালেও তো জিজ্ঞেস করল, ইণ্ডেন না ভারত গ্যাস? তোর মায়ের গ্যাসের সাপ্লাই তো বেশ ভালো রে, বুজাই।

-বুঝলাম। দ্যাখ বুজাই, মানুষ বড়ো হয়ে গেলে অনেক সময় নিজের ছোটবেলার কুকীর্তিগুলো মানতে চায় না। আজ যে মন্ত্রী, সে কখনো স্বীকার করবে, স্কুলে পড়া পারত না বলে মাস্টারমশাইয়ের কাছে চাঁটি খেত? ব্যাপারটা সেরকমই।
-ও মা! তুমি দাদুর কথায় কান দিও না। তুমি গল্প বলো।
-কী শুনবি বুজাই? তোর দাদুর ছোটবেলার গল্প?
-সেই ভালো, মা। তাই বলো।

-আচ্ছা বেশ, দাঁড়া। একটু ভাবি। হ্যাঁ, হয়েছে। আসলে তোর দাদুর ছোটবেলার এতো গল্প যে মাঝেমধ্যে গুলিয়ে যায়।
-মা তুমি শুরু করো। আমি এই তোমার কোল ঘেঁষে শুলাম।
-বুঝলি বুজাই, তোর দাদু অঙ্কটা নেহাত খারাপ পারত না। মোটামুটি ভালোই বলা চলে। কিন্তু প্রচণ্ড ফাঁকিবাজও ছিল। অঙ্ক করতে খুব ভালোও বাসত, আবার ফাঁক পেলেই ফাঁকি দিত। তো একদিন এখন হয়েছে কী, তোর দাদু ঘাড় গুঁজে বসে অঙ্ক করছে তো করছেই। তার আর বাহ্যজ্ঞান নেই।
এদিকে তোর দাদুর বাড়ির কাছাকাছি তো বিশাল পলাশ গাছের জঙ্গল। তুই তো দেখেছিস, বুজাই।
-হ্যাঁ, মা। দেখেছি তো। গত বছর শীতে আমরা তো ওখানেই পিকনিক করলাম।
-তবেই দ্যাখ, বুজাই। আমি কি গুল দিচ্ছি?
-দাদুর কথা ছাড়ো। তুমি চালিয়ে যাও।

-তো সেই জঙ্গলে না, একটা ভালুক ছিল। আর জানিসই তো, ভালুক পলাশফুলের মধু খেতে খুব ভালবাসে। এখন তোর দাদুদের বাড়ির ঠিক পাশেই বেশ কয়েকটা পলাশগাছ ছিল সেসময়।
-হ্যাঁ মা, ঠিক ঠিক। দুটো গাছ এখনো আছে।
-তাহলেই বল, সত্যি না মিথ্যে? যাই হোক, শোন। যাইহোক, সেদিন পলাশবনে ঘুরে ঘুরে হয় ভালুকটার পেট ভরেনি, নাহয় মন ভরেনি। কিছু একটা হবে। মোটকথা, ভালুকটা চলে এল তোর দাদুর বাড়ির একদম পাশের পলাশগাছগুলোর ফুলের মধু খেতে। তা মধু খাচ্ছে, খাচ্ছে,খাচ্ছে…। খেতে খেতে ভালুকটার চোখ চলে গেছে কিছু দূরের জানালায়, যেখানে তোর দাদু আপনমনে অঙ্ক কষে চলেছে। ভালুকটার আবার না, বিশাল অঙ্ক কষার শখ। গাঁয়ের পাঠশালার পিছনে মাঝেমধ্যেই আড়ি পেতে টুকটাক অঙ্ক শেখে।
ভালুকটা ভাবল, বাচ্চা ছেলেটার কাছেই যাই। দেখি, ওর কয়েকটা অঙ্ক কষে দিয়ে যদি কিছু সাহায্য করতে পারি!
শীতের পড়ন্ত দুপুর। সবাই লেপমুড়ি দিয়ে আরামে ঘুমোচ্ছে। ফলে একটা আস্তো ভালুক কখন যে সুট করে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ল, কারুর নজরেই এল না।
তোর দাদু তখন খুব মন দিয়ে একটা অত্যন্ত জটিল অঙ্ক সমাধান করছিল। ভালুক পিছনে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিল, ‘হাম হুম।’ অন্যমনস্ককভাবে তোর দাদুও গলা ঝাড়ল, “এহুম হুম!”
ভালুকটা হাই তুলল, ‘হা-আ-আ-লো।’
দাদু সেই শুনে একটা সমীকরণ লিখতে লিখতেই বলল, ‘কি-ই-ই-লো।’
ভালুকটা এবারে গলা তুলল, ‘গাঁ-আঁ-আঁ-ক।’
দাদুও অঙ্কের ঘোরে বলল, ‘টা-আ-আ-ক।’
ভালুক দেখল, আচ্ছা বিপদ! বাচ্চা ছেলেটা তো মুখই তোলে না দেখি! সে তখন তোর দাদুর পিঠে দুবার টোকা মারল।

পিছন ফিরে ঘোর কাটতে একটু সময়ই লাগল দাদুর। আর যেই না ঘোর কাটল, অমনি আঁ-আঁ-আঁ-ক করে তোর দাদু অজ্ঞান।
সেই দেখে না, ভালুকটার বেজায় জ্বর চলে এল। ভালুকের তো জানিসই, মাঝে মাঝে ভালুকজ্বর হয়।
দাদুর বিছানাটা ছিল পাশেই। জ্বরের চোটে কাঁপতে কাঁপতে ভালুকটা বিছানায় শুয়ে তোর দাদুর লেপটা গায়ে টেনে দিল।

-হুঁ। তারপর? দাদুর অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়ে খুব লেগেছিল না?
-না, না। মোটেই বেশি লাগেনি। তখন তো মাটির বাড়ি ছিল। আর তোর দাদু মেঝেতে মাদুর, কম্বল বিছিয়ে বসেছিল। ফলে একদমই লাগেনি। যাইহোক, তোর দাদু তো খানিক পরে ঝেড়েঝুড়ে উঠে বসেছে। ভালুক দেখে যে অজ্ঞান হয়েছিল, সেকথা বেমালুম ভুলে গেছে। ভেবেছে, অঙ্ক করতে করতে চোখ লেগে গিয়েছিল। ভাবতে ভাবতেই তার নজর গেছে পাশের বিছানায়। দ্যাখে, কে যেন একটা কালো কোটপ্যান্ট পরে ঘুমাচ্ছে। ভালুকটা তোর দাদুর দিকে পিছন ফিরে শুয়েছিল। তার গা থেকে লেপ যেটুকু সরে গিয়েছিল, তাতে তার কালো কুচকুচে শরীরটা অনেকটা কালো কোটপ্যান্টের মতোই লাগছিল।
তোর দাদুর মাথায় তো দুর্দান্ত বুদ্ধি খেলে! দাদু ভাবল, কোটপ্যান্ট পরা যখন, তখন নিশ্চয়ই অঙ্ক খুব ভালো পারবে।
এই ভেবে তোর দাদু একটা কাগজে বড়ো বড়ো করে লিখল, ‘প্রিয় মহাশয়, আপনি যদি এই আট আর নয় প্রশ্নমালার সব অঙ্কগুলি করে দিতে পারেন, তাহলে আপনাকে আমি বড়ো বড়ো দুটি চকলেট দেব।’
এই লিখেটিখে তোর দাদু খাতা বই গুছিয়ে রেখে তার উপরে কাগজটা পাথরচাপা দিয়ে খেলতে চলে গেল।
আগের দিন দাদুর বন্ধু, তোর নিতাইদাদু, দাদুকে দু’গোল দিয়েছিল। দাদু ভাবল, ও মাঠে আসার আগেই আমি ওকে খানকতক অগ্রিম গোল দিয়ে রাখি!
ভালুকটার ঘুম অল্প পরেই ভাঙল। উঠে বসে, ভালুকটার চোখে পড়ল দাদুর লেখা কাগজটা।
চকোলেট পাবে জেনে ভালুকের মহা ফূর্তি! সাততাড়াতাড়ি বসল অঙ্ক করতে। বেছে বেছে সবচেয়ে কঠিন দুটো প্রশ্নমালাই দিয়েছিল তোর দাদু।
অঙ্কও শেষ হএয়েছে, ভালুকেরও আবার জ্বর এসে গেছে। তাড়াতাড়ি করে লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল সে।
কিছুক্ষণ পরে তোর দাদু ফিরল খেলা সেরে। এসে দেখে, কোটপ্যান্ট পরা ভদ্রলোক তখনো শুয়ে। দুই প্রশ্নমালা অঙ্ক খাতায় কষা। দেখে টেখে দাদু অঙ্কখাতার উপর দুটো বড়ো চকলেট আর অন্য একটা কাগজে বিশাল বিশাল হরফে ‘ধন্যবাদ’ লিখে হাত-পা ধুয়ে খেতে গেল।
দাদুও বেরোল, ভালুকও আড়মোড়া ভেঙে উঠেছে। সাথেসাথেই কাগজ আর চকলেটদুটোর দিকে দৃষ্টি পড়েছে তার। ঝটপট সেগুলো বগলদাবা করে ভালুক মহানন্দে শিস দিতে দিতে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।
কী রে, বুজাই, ঘুমোলি নাকি?
-উঁ, না।

-পরের দিন তোর দাদু তো একগাল হাসি নিয়ে পাঠশালে গেছে। দুটো কঠিন কঠিন প্রশ্নমালা শেষ। সোজা নাকি? পণ্ডিতমশাই এলেন অল্প পরেই। তোর দাদু তো আগেভাগেই অঙ্কখাতা জমা দিয়েছে।
খানিক বাদে, দাদুরা সব অঙ্ক করছে, পণ্ডিতমশাই হাঁকলেন, ‘এই খাতাটা কার রে?’
দু’বার ডাকার পর তোর দাদু লজ্জা লজ্জা মুখ করে উঠে দাঁড়াল, “এই যে স্যার, আমার আজ্ঞে।”
“এদিকে আয় , শোন।”
তোর দাদু তো একেবারে বুক ফুলিয়ে পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তিনি শুধোলেন, “হ্যাঁ রে, সবকটা অঙ্ক কি তোর নিজের করা?”
তোর দাদু গর্বের চোটে ঘাড়-ফাড় নেড়ে উত্তর দিল, “হ্যাঁ স্যার, কেন স্যার?”
পণ্ডিতমশাই এবারে সজোরে কান টানলেন তোর দাদুর, “কেন স্যার? হতভাগা, সব কটা অঙ্কই ভুল!”

গল্প শেষ করেন মা। বুজাই ততক্ষণে ঘুমিয়ে কাদা। নিজের মনে অল্প হেসে বুজাইয়ের গায়ের চাদরটা টেনে দেন তিনি।

Leave a comment

Check Also

ভুতুম থুম- মৌসুমী পাত্র

পূর্ণিমার চাঁদটা ভেসে আছে বিরাট একটা গোল থালার মতো। একটা শিশুগাছের ডালের কয়েকটা পাতার ছায়া …

 ছেঁড়া রামধনু – মৌসুমী পাত্র

আমার মা বেজায় দুষ্টু হয়েছে আজকাল। একটা কথাও শুনতে চায় না। এই তো পরশুদিন, বললাম, …

chitrogupter-computer-mp

চিত্রগুপ্তের কম্পিউটার- মৌসুমী পাত্র

“যত্ত সব আদ্যিকালের জিনিস নিয়ে কাজকারবার! আর পারা যায় না বাপু!”, নিজের মনেই গজগজ করতে …

শিল্পী- গুঞ্জা

ফুল-পাখি কথা – মৌসুমী পাত্র

সে ছিল এক গভীর বন। আর সেই বনের ঠিক মধ্যিখানে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় ছিল এক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *