এবারে বোধহয় ভেবে দেখার সময় হয়ে গেছে।
গত কয়েকদিন ধরেই ভাগাড়জাত মাংস বিক্রি নিয়ে শোরগোল পড়ে গেছে। আম বাঙালী যারপরনাই শঙ্কিত। মজার কথা, এতদিন ধরে এইরকম বিশাল ব্যাপ্তি ও পরিধির ব্যবসা রমরমিয়ে চলল, অথচ কেউ কিছু জানতেই পারল না! তবুও, যাঁদের দৌলতে অন্ততঃ সত্যিটা প্রথমবার সামনে এল, তাঁদের কিছুটা হলেও ধন্যবাদ প্রাপ্য।
আমার দুঃশ্চিন্তা তুলনায় কম, কারণ মাংস বস্তুটির ওপর আমার একটা অহেতুক অভক্তি আছে। পারতপক্ষে এড়িয়ে চলি। কিন্তু ওই যে বলে না, “বিপাকে পড়িলে সাধু কলাখোসা খায়”- সেই অবস্থা আমার হয় মাঝেমাঝেই। “আহা, একটা অন্ততঃ টেস্ট করুন”, “এত যত্ন করে রাঁধলাম, একটা খা”, “একপিস খেতেই হবে”- এইধরনের উপরোধের সম্মুখীন হয়ে কতবার যে মাংস নামধারী ঢেঁকি উদরস্থ করতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।
তার উপর আছে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত আরো বিপদ। মিটিং ইত্যাদিতে আজকাল খুব চল হয়েছে এক প্যাকেট করে বিরিয়ানি ধরিয়ে দেওয়ার। নিদেনপক্ষে চিকেন রোল বা চিকেন চাউমিন। এবং “আমাদের কোন বিকল্প নেই”-র মত নঞ্ মাংসাশীদের জন্য প্রায়শই কোন বিকল্প কোন খাবার থাকে না। খেতে হলে খাও, না হলে বাড়ি যাও- এই মোটামুটি নীতি। ফলে খিদের জ্বালায় প্রবল অরুচি নিয়েও অনেকসময় বাধ্য হয়েছি খেতে।
ভাগাড় কাণ্ডের পর কিঞ্চিৎ মাথা ঘামাতে শুরু করলাম। বাঙালির এই প্রবল মাংসপ্রিয়তার আরম্ভ কবে থেকে? ব্যাকগিয়ারে যেতে যেতে যতটুকু মনে পড়ল, বাঙালির এই প্রবল মাংসপ্রিয়তার শুরু সম্ভবতঃ আশির দশকের শেষের দিকে। আমাদের ছোটবেলায় মাংস খাওয়ার রেওয়াজ খুব কমই ছিল। কসাইখানার সংখ্যাও ছিল কম। যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময়ে মফস্বল শহরগুলোতে রেস্টুরেন্ট এর এমন প্রাদুর্ভাব হয়নি। যে সামান্য কয়টা পথচলতি দোকানে মাংসের ঘুগনি পাওয়া যেত, আমরা ছোটরা সবাই জানতাম যে ওগুলোতে কুকুরের মাংস মেশায়। অর্থাৎ, সেইসময়েও মধ্যবিত্ত বাঙালি বাইরের মাংস যে নিরাপদ নয়, তার সম্পর্কে সচেতন ছিল। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এলেও মাংস খাওয়াতেই হবে- এই চলও কম ছিল।
কিন্তু তার পরেই সবকিছু বদলে গেল। সম্ভবতঃ বিশ্বায়নের প্রভাবে আমরা নেটিজেন হবার দৌলতেই। এবং অবাক হয়ে দেখলাম, সংবাদমাধ্যমের একাংশও শনিবার বা রবিবারের পাতাগুলো এই ছুটির দিনে মাংস খাবার প্রবণতাকে প্রবলভাবে তোল্লাই দিতে শুরু করল। (ঠিক যেমনভাবে, মদ খাওয়াকে অনেক সাংবাদিকই ইদানীং তোল্লাই দিয়ে থাকেন)।
বাঙালির চিরকালীন পরিচয় ‘মাছেভাতে’ বলে। অন্যান্য প্রদেশের লোকেরাও তাকে চেনে ‘মছলিবাবু’ বলে। অন্যান্য প্রদেশের লোকজনের অনেকেরই ধারণা, আমাদের প্রত্যেকের বাড়িতেই একটা করে পুকুর আছে। আসলে একটি জাতির খাদ্যাভ্যাস গড়ে ওঠে দীর্ঘকালীন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় গ্রহণ বর্জনের মাধ্যমে। দুম করে পাশ্চাত্যপ্রিয়তার মাশুলটা বোধহয় বড় বেশিই লেগে গেল।
আমরা এখন বাজার যেমন ভাবায়, তেমনি ভাবি। বাজার যেমন চালায়, তেমনি চলি। পিঠেপুলি বা সুক্তো রান্না করতে যিনি নাক সিঁটকান, তিনিই হয়তো বহু আয়াসে লোভনীয় কেক বা অন্য বিদেশি খানা বানান। অথচ পুষ্টিগুণ বা স্বাদ বিচারে আমাদের দেশজ খাদ্যগুলি কম কিসে? বরং, বিদেশি ভোজ্যবস্তুগুলিই পুষ্টিবিচারে হাজার মাইল পিছনে পড়ে থাকবে। মাঝেমধ্যে শখে পড়ে এক আধদিন খাবার কথা বাদ দিলাম, কিন্তু নিত্যদিনের খাদ্যাভ্যাসে অনেক বাঙালি বাড়িতেই একটা পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনটুকুতে আমাদের শারীরিক উপকার হলে বলার কিছু ছিল না, কিন্তু ‘ইন’ জিনিসের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে বা স্ট্যাটাস বজায় রাখার প্রাণপণ তাগিদে এই যে বদল- এতে আখেরে ক্ষতি বই কিছু নেই। রেস্টুরেন্টে , বিশেষতঃ নামী রেস্টুরেন্টে যাওয়া এবং ফেসবুকে ছবি দেওয়াটাও সেই মানসিকতারই অঙ্গ। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসামগ্রীর চাহিদা এই যে দিনদিন বাড়ছে, সময়ের অভাব অবশ্যই তার পিছনে একটা বড় কারণ। কিন্তু আমাদের মানসিকতাও কিছু কম দায়ী নয়। আমরা স্বদেশের ঠাকুর ফেলে বিদেশের কুকুর ধরায় বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েছি। ফলে এই পরিণতি একরকম অবধারিতই ছিল।
তবে বাঙালি যদি এই সুযোগে তার পুরনো অভ্যেসে ফিরে যায়, তাহলে সেটা মন্দ কি?