Home / বাঘু সিরিজ / উল্কার কবলে বাঘু – মৌসুমী পাত্র

উল্কার কবলে বাঘু – মৌসুমী পাত্র

উল্কার কবলে বাঘু
শিল্পী- সোমক সেনগুপ্ত
(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা  তোমাদের দিযছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ গল্পে। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে পাঠশালার খবর লুকিয়েচুরিয়ে চলে আসে মাঝেসাঝেই। সেসব খবরটবর পেলেই ঝপাং করে তোমাদের জানিয়ে দি। পাঠশালাটা কোথায় জানো? বনের ঠিক সেই জায়গায়, যেখানে প্রচুর গাছপালা মিলে মাথার উপরে একটা চাঁদোয়ার মত বানিয়েছে, আর দুটো সেগুনগাছের ইয়া মোটা মোটা গুঁড়ি দুদিক থেকে এসে একটা দরজার মতো তৈরি হয়েছে। জঙ্গলের যত ছানাপোনা জন্তুজানোয়ার, সবাই আজকাল সক্কালবেলা হলেই হাতমুখ ধুয়ে চাট্টি মুড়ি খেয়ে ওখানেই পড়তে যায়। তাদের মধ্যে আছে বাঘিনীর বাচ্চা ছেলে বাঘু, হাতির বাচ্চা মেয়ে হাতুশি আর হনুমানের ছানা মেয়ে হিনিমিনি। এছাড়াও আছে ভালুকের পুঁচকি মেয়ে ভালকি আর কুমীরের বাচ্চা ছেলে কুমরু।)   

রাতের দিকে হিম পড়ছে বেজায়। আঁধারের বুক ছুঁয়ে ছুঁয়ে শিশিরকণারা চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামে পৃথিবীর বুকে। ভোরের বেলা বনের ঘাসে, গাছের পাতায়, ঝোপেঝাড়ে ইতিউতি টলটলে চোখের উঁকি। যদিও আকাশে সূর্যস্যার উঠে গেলেই তাঁর চোখরাঙানিতে তড়িঘড়ি যে যার চোখের জল মুছে ফেলে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

          সন্ধের পর প্রায়ই জন্তু জলসার আসর বসছে জঙ্গলের ‘পশু প্রান্তরে’। গতকাল ভালকি আর হাতুশি গিয়েছিল তাদের মায়েদের সঙ্গে। ময়ূরাট নর্তনসম্রাটের নাচ আর তার সঙ্গে বাঘবাজ গলাবাজের গানে আসর পুরো জমে গিয়েছিল। অবশ্য ময়ূরাট নর্তনসম্রাটের নাচের অনুষ্ঠান আগেও দেখেছে হাতুশি। সেবারে পাঠশালা মহাসভায়। অনেকদিন পর আবার এরকম জোরদার নাচগান দেখে দিল খুশ হবারই কথা। কিন্তু মুশকিলটাও বাধল ওখানেই। এত রাত অব্দি খোলা মাঠে বসে থেকে। হাতুশি তার শুঁড়স্ত্রাণ দিয়ে তার শুঁড় ভালো করে ঢেকে নিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ভালকিকে কিছুতেই মাথায় জুমাল (মানুষদের যেমন রুমাল, ওদের তেমনি জুমাল। মানুষদের দেওয়া নাম ওরা নেয় না কিনা!) বাঁধতে রাজি করানো গেল না। তার সাফ কথা, “আমি রোজ গাদা গাদা মধু খাই, আমার কিছু হবে না।” তা হাতুশিও পাল্টা বলতে ছাড়েনি, “আর তার সঙ্গে যে টুথপেস্টও খাস, সেটাও বল!” নেহাত তখন জোর জোর নাচগানের আওয়াজে ভালকি হাতুশির কথা শুনতে পায়নি, তাই বাঁচোয়া!

          তা কী হবে না হবে, সে বোঝা গেল সকালে পাঠশালার শুরু থেকেই। ভালকি বইখাতা নিয়ে দিদিমণির পড়া শুনছে আর কিছুক্ষণ ছাড়া ছাড়াই ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে হাঁচছে। আর একখানা জুমাল দিয়ে তার মাথা কান জবরদস্ত ঢাকা। বাঘু চোখের কোণা দিয়ে টেরিয়ে টেরিয়ে ভালকিকে দেখছে আর ভালকি হাঁচলেই দিদিমণির চোখের আড়ালে থাবাজোড় করে ভালকিকে নমস্কার ঠুকছে।

          শিয়ালনী হাতের ‘আশ্চর্য আকাশ’ বইটা দেখতে দেখতেই হুঙ্কার ছাড়ল, “বাঘু! বাঘুউউউউ! বলি, কী ভেবেছিসটা কী? আমি কিছু  দেখতে পাই না, না? ভালকি হাঁচলেই পেন্নাম ঠুকছিস? বল দেখি, ‘তারা’ কাদের বলে?”

          ভালকি ততক্ষণে ওদিকে আরেকখানা বিকট হাঁচি দিয়েছে। বাঘু খুব ভক্তিভরে পেন্নাম ঠোকার তাল করছিল, আচমকা দিদিমণির প্রশ্নে গেল ঘাবড়ে। হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “তারা? তারা মানে… তাহারা, মানে ওরা… মানে একের বেশি জন।”

          বলেই বাঘু খুব আহ্লাদী আহ্লাদী মুখে চারপাশে চাইল। তবে তার চুপসে যেতেও সময় লাগল না দিদিমণির দাবড়ানিতে, “বাঘু! ভুলভাল উত্তর দিয়ে আবার কায়দা ফলানো হচ্ছে? তারা… তারা… মানে তারকা… বলি, তারকা মানে কী?”

          বাঘু তার ডান থাবা গালে দিয়ে খানিক কষে ভাবল। তারপর বলল, “ও হো! বুঝেছি দিদিমণি! তারকা মানে তাড়কা রাক্ষসী! সেই যে, আপনি মানুষদের রামায়ণের গল্প শুনিয়েছিলেন, না? সেই যে রাম আর তার ভাই লক্ষ্মণ…”

দুমদুম করে পা ফেলে এগিয়ে এল শিয়ালনী। চোখদুটোকে টর্চলাইটের মত ফেলল বাঘুর ওপরে। তারপর টর্চলাইটটাকে ঘোরাতে ঘোরাতেই প্রবল হাঁক ছাড়ল, “ওরে, ভুসকুমড়ো! ‘তাড়কা’ বলিনি রে, ‘তারকা’ বলেছি! আকাশে যা দেখা যায়!”

বাঘু মহা ভাবিতং হয়ে বলল, “আকাশে? আকাশে তো দিদিমণি, পাখি টাখি দেখা যায়! গোরু-ছাগল-মোষ… এসব তো আর আকাশে দেখা যায় না। তাপ্পর ধরুন গিয়ে, আকাশে ঘুড়ি উড়লে দেখা যেতে পারে। তাপ্পরে ধরুন না কেন, আকাশে মেঘ থাকলে তাও দেখা যেতে পারে। তাপ্পরে…”

জ্বলন্ত কাঠকয়লার মতোই গনগনে চোখে চাইল শিয়ালনী, “তাপ্পরে? তাপ্পরে…? তাপ্পরে তোমার লেজ ধরে বাঁই বাঁই করে কয়েক পাক ঘুরিয়ে আকাশে ছুঁড়ে দিলে তোকেও আকাশে দেখা যেতে পারে, বাঘুবাবু!”

রাগের চোটে তুমি-তুই গুলিয়ে গেছে শিয়ালনীর। সে সমানে দাবড়েই যাচ্ছে, “চালাকি পায়া হ্যায়? কায়দাবাজি পায়া হ্যায়? তাপ্পরে… বর্ষাকালে আকাশে রামধনুও দেখা যায় আর বাঘুবাবু তার উপরে চড়ে বসে লেজ দুলিয়ে নাচতা হ্যায়!”

লেজে পাক দেবার কথায় বাঘু লেজখানায় আলতো করে থাবা বুলিয়ে চোখ পিটপিট করল, “ইয়ে মানে বলছিলাম কি দিদিমণি, বলছিলাম কী যে… ওরকমভাবে ঘোরালে তো আমার লেজের মাথাও ঘুরতে পারে আর সেরকম হলে আমার তখন পাঠশালা আসাও বন্ধ হয়ে যাবে… তখন আবার আমি পড়ায় পিছিয়ে যাবো… আবার পিছিয়ে গেলে তখন আপনিই আমায় বকুনি দেবেন…”

হাতুশি দেখে, এইসব গোলমালে দিদিমণি পড়ার কথাই ভুলে যাচ্ছেন। তাই সে চটপট চটপট শুঁড় দোলাল, “দিদিমণি, আপনি ‘তারা’ মানে জিজ্ঞেস করছিলেন বাঘুকে।”

ভালকিও এগিয়ে এসেছে, “দিদিমণি, আপনি আকাশের তারার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন, না? তারা মানে রাতের আকাশে আমরা যাদের দেখতে পাই, যাদের আলো মিটমিট করে…”

কুমরু সুর খেলাল, “সূয্যিমামা, চাঁদমামা, গুটিগুটি দেয় হামা…”

হিনিমিনি তুড়ুক তাঁই করে এক লাফ দিল দুম করে, “আচ্ছা দিদিমণি, চাঁদ যদি চাঁদমামা হয়, সূয্যি যদি সূয্যিমামা হয়, তাহলে তারাদের কি তারামাসি বলবো? আর গ্রহদের গ্রহকাকু?”

কুমরু লেজখানাকে মাথার ওপর প্রশ্নচিহ্নের মত ঝোলাল , “আর উল্কারা কি তাহলে উল্কামামী? আর ধূমকেতু কি ধূমকেতুজ্যাঠা?”

শিয়ালনী চটিতং হয়ে পেল্লায় এক ধমক দিতে যাচ্ছিল হিনিমিনিকে, কিন্তু তার আগেই টিং টিং করে সাইকেলের ঘন্টি বেজে উঠল বাইরে। তার সঙ্গেই ভেসে এল কাছুয়ার গলার ডাক, “চিঠি আছে, দিদিমণি। সিংহালুর চিঠি।”

চিঠি দিয়ে খানিক গল্পগুজব করে চলে গেল কাছুয়া। কাছুয়া চলে যেতেই বাঘু লাফিয়ে পড়ল, “দিদিমণি, সিংহালুর চিঠিটা খুলুন না!”

ব্যস, পড়াশুনো লাটে উঠল। সিংহালুর চিঠির ওপর হামলে পড়ল সবাই। সিংহালু লিখেছে-

সিংহ নিবাস

গির অরণ্য

গুজরাট।

 

প্রিয় হাতুশিদিদি, হিনিমিনিদিদি, ভালকিদিদি, কুমরুদাদা ও বিচ্ছু বাঘুদাদা

           এবং পরম পূজনীয়া শিয়ালনী দিদিমণি,

 

          চিঠির শুরুতেই দিদিমণিকে প্রণাম ও তোমাদের সকলকে নতুন বছরের অনেক আদর আর আহ্লাদ জানাই। আর বাঘুদাদার জন্য স্পেশাল হিসেবে শতকোটি ভেংচি।

হাতুশিদিদির চিঠিতে পাঠশালার খবর মাঝেমাঝে পাই। বাঘুদাদার ল্যাজুকতার খবর পড়ে কী যে হেসেছি! আচ্ছা, বাঘুদাদা কি এখনও ওইরকমই ছবি আঁকে? মানুষেরা শুনলাম দিদিমণির পাঠশালার খবর নিয়ে কীসব বইটই বের করছে। কী কাণ্ড বলো দেখি! আচ্ছা, আমার খবরও নিশ্চয়ই থাকবে! বই বেরোনোর খবর পেলে ফিরতি চিঠিতে জানিও। আর জান্তা জট এবছর তোমাদের কাকে কী উপহার দিল, তাও জানিও কিন্তু। আমি পেয়েছি… না থাক। চিঠিটা লম্বা হয়ে যাচ্ছে।

           এই দ্যাখো! ধান ভানতে শিবের গীত শুরু করে দিয়েছি। আসল কথাটা বলি ঝটপট। বলি, আর ক’দিন পরেই তোমাদের ওখান থেকে যে উল্কা পড়া দেখা যাবে, সে খবর জানো তো? আগামী পয়লা জানুয়ারি রাত দুটো থেকে তিনটের মধ্যে উল্কাপাত হবার কথা।  ঝালুমালু বন যাবার পথে বাঁ দিকে ‘অচেনা অটবী’ নামের যে জায়গাটা আছে, সেখানেই কোথাও হয়তো পড়তে পারে। তবে কিনা, আমার কথা শুনে তো আর পড়বে না। ও হ্যাঁ, আমরাও আসছি। মা বলেছে এবারে আমাকে পশু প্লেনে চাপিয়ে নিয়ে যাবে। তাহলে তোমাদের সঙ্গে ওইদিন দেখা হচ্ছে অচেনা অটবীতে। এই উপলক্ষ্যে আমি একটা ছড়াও লিখেছি। সেটা শোনাই?

 

শীতের রাত চাঁদনি তখন,

উল্কা ঝরে পড়বে যখন;

 

পড়বে উল্কা ধপাস ধাঁই

রাতটি তবে জাগা চাই।

 

ঘুমিয়ে যদি হয়েছ কাদা,

উল্কা তোমায় দেবেই ধাঁধা।

 

          কেমন লাগলো? তোমরা অবশ্যই অবশ্যই ওইদিন রাতে অচেনা অটবীতে চলে যেও। ওখানেই তোমাদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। তোমাদের সবাইকে অনেক ভালোবাসা, দিদিমণির জন্য শ্রদ্ধাপূর্ণ প্রণাম আর বাঘুদাদার জন্য একবস্তা ল্যাজমলা রইলো।

                                                                                                                                          ইতি-

                                                                                                                                    সিংহালু’ ধাঁধালু

পুঃ- আমি ধাঁধা বলতে ভালোবাসি কিনা, তাই নিজের নামের শেষে মাঝেসাঝে ‘ধাঁধালু’ লিখি।

ঠিকানাঃ-

হাতুশিদিদি/ হিনিমিনিদিদি/ ভালকিদিদি/ কুমরুদাদা/বাঘুদাদা

প্রযত্নে, শিয়ালনী দিদিমণি,

শিয়ালনীর পাঠশালা,

পাঠশালার মাঠ,  

শাল চাঁদোয়া

বন বাটিকা।          

 

সিংহালুর চিঠি পড়ে চোখ কপালে উঠে গেল সবার। শিয়ালনী ঘাড়টাকে বাঁদিক থেকে ডানদিকে ঘুরিয়ে সবার হাঁ হয়ে যাওয়া মুখগুলো দেখল। তারপর গলা ঝাড়ল, “হুমম। হামম। উল্কা পড়ার খবরটা আমিও কিছুদিন আগে ‘জানোয়ার বার্তা’য় পড়ছিলাম। তবে এত কাছেই যে পড়বে সেটা জানা ছিল না। যাইহোক, জানা যখন গেছে, তখন যেতেই হয়। তোরা কাল খাওয়া দাওয়া সেরে রাত দশটার সময় এখানে চলে আসিস। কষ্ট করে একটু জাগতে হবে, এই যা। কিন্তু না জাগলে তো এমন জিনিস দেখতেও পাবি না।”

শুনেই বাঘুর গালে থাবা, “আচ্ছা দিদিমণি, উল্কা যে রাত্রিবেলা পড়বে, ওর ঘুম পাবে না? ধরুন, ও যদি রাত্রিবেলা না পড়ে দিনের বেলা পড়ত, তাহলে নিশ্চয়ই উল্কা দেখার জন্য পাঠশালা ছুটি থাকত!”, বলতে বলতেই বাঘু এগিয়ে গেছে দিদিমণির দিকে, “ও দিদিমণি, দিদিমণি গো, উল্কাটাকে বলুন না গো দিনের বেলা পড়তে!”

দিদিমণি মুখ খোলার আগেই হাতুশি এক দাবড়ানি দিল বাঘুকে, “তুই থামবি বাঘু? খালি যত রাজ্যের উষ্টুম ধুষ্টুম আবদার! উল্কা কি তোর আমার কথামত পড়বে না দিদিমণির কথা মত চলবে? দিদিমণি, বাঘুর কাথা ছাড়ুন। আপনি বরং বলুন না উল্কা কোথা থেকে আসে?”

          প্রশ্ন শুনে শিয়ালনী খুশিই হল। “হাতুশি, তুই এই যে সব জানতে শুনতে চাস, শিখতে চাস- এইটা আমার বড় ভালো লাগে। শোন তাহলে, বলি। বাঘু, তুইও শোন। মাঝে মাঝে কী হয় জানিস? কোন ধূমকেতুর কোন অংশ, হতে পারে সেটা পাথর বা ধাতুর ছোট টুকরো, কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করল। এইবারে প্রবেশ করার পর পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে ঘর্ষণ হলে কী হবে?”

বাঘু গালে থাবা দিয়ে মহা চিন্তিত হয়ে বলল, “তাই তো দিদিমণি, তাহলে কী হবে? আমিও তো তখন থেকে এই কথাটাই ভেবে যাচ্ছি। ভাবতে ভাবতে আমার সোনার অঙ্গ কালি হয়ে গেল দিদিমণি।”

শিয়ালনী কটমট করে একবার চাইল বাঘুর দিকে। তারপর ফের বলতে শুরু করল, “ঘর্ষণ হলে বায়ুর সংস্পর্শে জ্বলে উঠবে ওই পাথর বা ধাতুর টুকরোগুলো। ওই জ্বলে ওঠাকেই আমরা বলি, উল্কাপাত। আর ওই পাথর বা ধাতুর টুকরোগুলোকেই বলে উল্কা।”

হিনিমিনি লেজ দোলাল, “ওরে বাবা রে! উল্কামামী তো দেখি সাঙ্ঘাতিক জিনিস!”

ভালকি মহা ভাবিত হয়ে বলল, “দিদিমণি, আমি একটা বইতে পড়ছিলাম যে ভিনগ্রহেও নাকি প্রাণ থাকতে পারে! তা এই উল্কায় চেপে যদি কোন ভিনগ্রহী চলে আসে, দিদিমণি?”

বেমক্কা এরকম একটা কথায় বাঘু বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে হাতুশির শুঁড় চেপে ধরল, “ওরে হাতুশি, হাতুশি রে! শোন্‌ না, শোন্‌ না, তুই না খুব ভালো রে! ইয়ে… মানে বলছিলাম কী… মানে বলছিলাম যে তুই না খুব ভালো মেয়ে… মানে ইয়ে… মানে তোকে মোটামুটি ভালোই বলা চলে… তা ইয়ে তুই তো আবার মনিটরও… তা ইয়ে বলছিলাম যে … ইয়ে মানে বলছিলাম যে ধর্‌, ভিনগ্রহী যদি এসেই পড়ে তাহলে তুই একটু বলে দিস যে বাঘু নেই, ও বাঘিপিসীর বাড়ি বেড়াতে গেছে… বাঘিপিসীর নাম শুনলে নিশ্চয়ই ভিনগ্রহীও ভয় পাবে। ইয়ে… হাতুশি, তুই একটু বলে দিস মনে করে, অ্যাঁ? আমি বরং তোকে আমার হলুদ রঙের আধভাঙা পেনসিলটা দেব।”

শিয়ালনী বেজায় বিরক্ত হয়ে বলল, “থাম দেখি তোরা সব। পড়া নেই, শোনা নেই, ঢোল কত্তাল নিয়ে তখন থেকে যেন কেত্তনের বাজনা বাজিয়ে চলেছে! উল্কা নিয়ে আর একটাও কথা নয় এখন! যা কথা হবার, ক্লাস শেষের পর হবে। এখন বাছাধনেরা, যে যার জায়গায় বসুন দেখি। ক্লাস শুরু হবে।”

দিদিমণির ধমকধামক খেয়ে সুড়সুড় করে বসল যে যার জায়গায়। ক্লাসও শুরু হল।

 

পরের রাত। ঝিকিমিকি জ্যোৎস্না লুকোচুরি খেলছে বনের ডালপালা পাতার ফাঁকে ফাঁকে। হাতুশি শুঁড়ে একটা টর্চলাইট ঝুলিয়ে চলেছে একা। আরও একটা কর্মব্যস্ত দিনের শেষে ঘুমন্ত বনের স্তব্ধতা কেঁপে কেঁপে উঠছে রাতচরা পাখিদের ডানা ঝাপটানি আর টি-ই-ই-ই ডাকে। হাতুশির বিশেষ ভয়ডর নেই। চাঁদের আলো ঢালা উঁচুনিচু এবড়ো খেবড়ো মেঠো পথ দিয়ে সে দুলকি চালে এগিয়ে চলেছে। উত্তুরে হাওয়া কাঁপুনি ধরাচ্ছে সর্বাংগে। হাতুশি একটা ঢিলেঢালা ব্যাগি সোয়েটার পরেছে, চার থাবায় থামোজা (থাবা+মোজা আর কী!), আর তার সাথে জান্তা জটের দেওয়া সেই শুঁড়স্ত্রাণ তো আছেই! আর মাথায় পরেছে একটা পুপি (পশু + টুপি ছাড়া আবার কী!)।

আকাশের তারাগুলোও বড় চেকনাই দিচ্ছে আজ। হাতুশি তাকাল সেদিকে। আকাশটা যেন একটা বিশাল স্লেট, আর সেই স্লেটে কে যেন তারাদের আঁকিবুঁকি কেটে রেখেছে যতদূর দেখা যায়।

খানিকটা অন্যমনস্কই হয়ে পড়েছিল হাতুশি, আর তার জন্যই পথের উপরে কোন কিছুর গায়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল সে। গগনফাটানো আওয়াজ উঠল একটা, “ওরে বাবা রে! আমার ঘাড়ে উল্কা পড়ল রে! ওগো দিদিমণি গো, কোথায় আছেন গোওওও? উল্কার হাত থেকে আমাকে বাঁচান গোওওওও! ওরে মনিটর হাতুশি রে এ এ এ এ, উল্কাটাকে ফুঁ দিয়ে আকাশে পাঠা রে এ এ এ।”

হাতুশি গায়ের ধুলোবালি ঝেড়ে উঠে বসে শুঁড় বাগিয়ে গুচ্ছখানিক কাতুকুতু দিয়ে বলল, “বাঘুউউউ! তুই এখানে পথের মাঝে বসে কী করছিলি?”

বাঘু আশ্বস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কোমরে থাবা দিয়ে একগাল হাসল, “অ! তুই হাতুশি? আমি ভাবলাম বুঝি উল্কা!”

হাতুশি ততক্ষণে থামোজা, পুপি, শুঁড়স্ত্রাণ সব ঝেড়েঝুড়ে ঠিক করে নিয়েছে। বাঘুর গায়ের ধুলোও ঝেড়েঝুড়ে দিল হাতুশি। বাঘু একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলল, “যাক্‌ বাবা, তুই উল্কা নোস।”

হাতুশি বাঘুকে দেখতে দেখতে বলল, “আরে, তুই বালিশ, লেপ- এইসব নিয়ে এসেছিস কী করতে?”

বাঘু বলল, “বা রে! উল্কা এসে যদি মাথায় ঘাড়ে পড়ে? উল্কার তো আর কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই!”

হাতুশি অবাক হয়ে গালে শুঁড় ঠেকাল, “তাই বলে লেপ- বালিশ?”

বাঘু বলল, “হ্যাঁ। ভালো করে লেপে গা ঢাকা দিয়ে মাথায় বালিশ দিয়ে বসবো। তাহলে উল্কা পড়লেও তেমন বেশি লাগবে না।”

বাঘু আর হাতুশি হাঁটা শুরু করতেই পাশের একটা গাছের ডাল থেকে কে যেন ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ল হাতুশির পিঠে। না তাকিয়েই উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল হাতুশি, “আরে, এ যে হিনিমিনি!”

বাঘু পেছনের দিকে তাকিয়েই বলল, “দ্যাখ, দ্যাখ, ভালকি আর কুমরুও আসছে মনে হচ্ছে!”

সবাই একসঙ্গে জুটলে ’পর আবার চলা শুরু হল। খানিকদূর গিয়েই বাঘু থমকে দাঁড়িয়ে জিভ কাটল, “এই যা!”

হিনিমিনি শুধোল, “কী হল রে বাঘু?”

বাঘু দুখী দুখী মুখ করে বলল, “দেখেছিস কাণ্ড! আমার লেজবালিশটাই আনতে ভুলেছি!”

কুমরু হেসে গড়িয়েই পড়ে আর কী, “লেজবালিশ? হো হো! লেজের আবার বালিশ হয় নাকি?”

বাঘু চটেমটে বলল, “দ্যাখ কুমরু, অমন লেজ তুলে খোঁটা দিবি না, বুঝেছিস? জানিস, ওটার ওপর লেজ রেখে শুলে আমার লেজের দারুণ ঢুলুনি আসে! তাই আমি ওটার নাম রেখেছি লেজঢুলিশ!”

এবারে হাহা হিহি হেহে হোহো করে আরও একচোট হাসির হররা ছুটল। শেষমেশ হাতুশি বলল, “বাঘু! আর তোর লেজঢুলিশ নিয়ে কাজ নেই। ওখানে পৌঁছেই ইচ্ছেমতন ঢুলিস বরং!”

যাইহোক, এইসব হাহা হিহি করতে করতেই অচেনা অটবীতে পৌঁছে গেল ওরা। গিয়ে দেখে, দিদিমণি তখনো আসেননি। ভালকি কিসব ভাবতে ভাবতে বলল, “দিদিমণি যখন আসেননি, তখন মনে হয় উল্কারও পড়তে দেরি আছে। যাই বরং, বাড়ি থেকে লেপ-বালিশ নিয়ে আসি।”

কুমরু সায় দিল, “হ্যাঁ রে, ঠিকই বলেছিস। লেপ- বালিশ না আনলে সেই রাগে উল্কা যদি আমাদের ঘাড়ে এসেই পড়ে? কী দরকার বাবা!”

ভালকি, হিনিমিনি আর কুমরু চলে গেল। হাতুশি গেল না। সে বাঘুর সঙ্গে বসে রইল। কিছু পরে বাঘুও লেপমুড়ি দিয়ে হ্যা-ও-ও-ও করে বিশাল একখানা হাই তুলে বলল, “হাতুশি রে, আমার না একটু ক্লান্ত ক্লান্ত লাগছে। সারাদিন কত পরিশ্রম করি বল তো? এত দুষ্টুমির কাজ থাকে সারাদিনে, এত ফাঁকিবাজির ব্যাপার থাকে- হাঁফিয়েই যাই! যাকগে, যদি ঘুমিয়ে পড়ি, আর যদি উল্কা এসেই পড়ে- আমাকে ডেকে দিস।”

বলেই বাঘু ঘ্যাঁ-ঘুঁ-ঘ্যাঁউ ফুঁস-ফুঁস-ফ্যাঁউ  করে বিচ্ছিরি রকমের নাক ডাকতে শুরু করে দিল। হাতুশি চুপচাপ বসে রইল খানিকক্ষণ। পাশেই বিশাল মাঠ। চাঁদের কিরণেরা যেন এতবড় ফাঁকা মঞ্চ পেয়ে মনের আনন্দে নাচ জুড়ে দিয়েছে। হাতুশি চুপচাপ বসে চারিদিক দেখল খানিকক্ষণ। কিন্তু তারপর তারও কিরকম কিরকম জানি মনে হতে লাগল, তাই তো, সত্যিই যদি উল্কা এসে ঘাড়ের উপরই পড়ে? অত উঁচু থেকে আসছে, বেজায় ভারি হবে নিশ্চয়ই। তার উপর বেগও নিশ্চয়ই সেরকমই হবে।  আচ্ছা, তাও যদি না হয়, ঠাণ্ডা তো জবরদস্ত পড়বেই রাতে। আর ঠাণ্ডা যদি তেমন নাও হয়, তাহলেও লেপ গায়ে জড়িয়ে বসে থাকতে তো আরামই লাগবে। আর বালিশটা নাহয় হিনিমিনির পিঠের ওপর চেপে ধরে আরাম করেই ঘুমোনো যাবে। ভাবতে ভাবতেই উঠে একসময় হাতুশিও জোরকদমে হাঁটা লাগাল, বাড়ি থেকে লেপ- বালিশ আনতে।

হাতুশি বেরিয়ে যাবার একটু পরেই শিয়ালনী ঢুকেছে। অচেনা অটবীর পুরো জায়গা জুড়েই নানা ধরনের পুরনো বিশাল বিশাল গাছ। এপাশ ওপাশ করে কিছুটা এগোতেই শিয়ালনীর কানে এল বেশ জোরালো একটা শব্দ- ঘ্যাঁ-ঘুঁ-ঘ্যাঁউ ফুঁস-ফুঁস-ফ্যাঁউ

শব্দের উৎসের দিকে এগিয়ে গেল শিয়ালনী। জায়গাটা কেমন যেন ঝুপসি অন্ধকার। চাঁদের আলোয় গাছেদের ছায়া পড়ে একটা রহস্য যেন জমাট বেঁধে আছে ওখানে। আর সেই অন্ধকারের মধ্যে কী যেন একটা বড়সড় বস্তু।

কিছুটা দুরুদুরু বুকেই এগিয়ে গেল শিয়ালনী। আগের দিন ক্লাসের ভিনগ্রহী প্রাণীর আলোচনা মনে পড়ে গেল তার। অনেকটা দেরিই হয়ে গেল এখানে পৌঁছোতে! যদি উল্কাটা পড়ে গিয়ে থাকে আর সেই উল্কা থেকে কোন ভিনগ্রহের জীব নেমে ওখানে ডেরা বেঁধে থাকে! অবশ্য উল্কায় চেপে তো ভিনগ্রহী আসবে না, ভিনগ্রহীকে আসতে হলে তো মহাকাশযানেই আসতে হবে!

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই আরেকটু এগিয়ে গিয়ে মনে জোর এনে উঁচুগলায় জিজ্ঞেস করল শিয়ালনী, “কে তুমি?”

সেই বিকট জীবটার থেকে এবার অন্যরকম রব ভেসে এল- ঘুঁ আঁআঁ আঁও, ফুঁ উঁ উঁ উয়াও!

বেজায় ঘাবড়ে গেল শিয়ালনী। তারপরেই তার মনে হল, ভীনগ্রহের জীব। সে কি আর বাংলা বুঝবে? বরং হিন্দী বলে দেখা যেতে পারে। সেই ভেবে শিয়ালনী হিন্দী করে বলল, “তুম কৌন হো?”

এবারে আওয়াজ এল- ভুঁ ভাঁ ভ্যাঁ, পুঁ পাঁ প্যাঁ।

শিয়ালনী হতভম্ব। ভিনগ্রহীর ভাষার কী রকমসকম রে বাবা! তারপরেই তার মনে হল, বাংলা হিন্দী কি আর ভিনগ্রহী বুঝবে? বরং ইংরেজি বলে দেখা যেতে পারে। হাজার হোক, আন্তর্জাতিক ভাষা। এই ভেবে শিয়ালনী ফের বলল, “হু আর ইউ?”

এবারে খুব সংক্ষিপ্ত রব এল- ফুঁ আ ফুরর, ঘুঁ আ ঘুরর!

কোথাও কোন কাজ হচ্ছে না। আচমকাই শিয়ালনীর মনে হল, আরে তাই তো, সংস্কৃতের মত এত পুরনো ভাষা, লোকে বলে দেবভাষা, তা ছেড়ে ভিনগ্রহী অন্য ভাষায় যাবেই বা কেন? এই ভেবে শিয়ালনী সংস্কৃতে বলল, কস্ত্বম্‌?

সহসাই সেই জীবটা নড়েচড়ে বসল। শিয়ালনী বুঝল, সংস্কৃতে কাজ দিয়েছে! আরেকবার সংস্কৃতে কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময় সেই জীবটা বিশুদ্ধ বাংলায় বলে উঠল, “ওরে বাবা রে! কী মশা রে! শান্তিতে একটু ঘুমোনোও যায়না রে!”

শিয়ালনী রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে উঠল, “কিমাশ্চর্যম্‌! ভিনগ্রহীও বাংলায় কথা বলে! বিজ্ঞানের কি অভাবনীয় উন্নতি!”

এমন সময় সেই জীবটা হাঁউমাঁউ করে উঠল, “অ্যাঁ, দিদিমণি? আপনি এসে গেছেন? উল্কাটুল্কা কিছু পড়ল?”

শিয়ালনী ঘোরতর হতভম্ব হয়ে প্রায় আঁতকেই উঠল, “ই কী ভয়ানক কাণ্ড! ভিনগ্রহী যে বাঘুর গলাও অবিকল নকল করে ফেলেছে দেখি!”

তাই শুনে সেই প্রাণীটা তারস্বরে আর্তনাদ করে উঠল, “ওগো দিদিমণি গো! আমি সত্যিই বাঘু গো!”

শিয়ালনী লেজখানাকে বারদুয়েক আচ্ছাসে ঝাঁকিয়ে এপাশ ওপাশ ঘাড় নাড়ল, “তুই বাঘু? সত্যি বাঘু? তাহলে বেশ, এই আমার সামনে লম্বাগুড়ি দিয়ে দেখা।”

সেই জীবটা লাফাতে লাফাতে ঝাঁপাতে ঝাঁপাতে এসে সত্যি সত্যিই লম্বাগুড়ি দিয়ে দেখাল। শিয়ালনী তাজ্জব, “আজব কাণ্ড! ভিনগ্রহী লম্বাগুড়িও দেয়! চেহারাখানাও বাঘু-বাঘুই লাগছে।”

প্রাণীটা ককিয়ে কেঁদে ফেলেই আর কী, “দিদিমণি, আমি সত্যিই বাঘু!”

শিয়ালনী গালে থাবা দিয়ে চোখ পিটপিট করল, “আচ্ছা, তোকে ক’টা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি। তোর উত্তর শুনলেই আমি বুঝে যাবো তুই বাঘু কি বাঘু নোস।”, বলেই শিয়ালনী প্রশ্ন শুরু করল, “আচ্ছা, একটা গোরুর যদি একটা ঘাসের কেক খেতে আধ ঘন্টা লাগে আর তার জাবর কাটতে সময় লাগে এক ঘন্টা, তাহলে দুটো গোরু মিলে একটা ঘাসের কেক খেয়ে কতক্ষণ জাবর কাটবে?”

সেই প্রাণীটা এবার ডাক ছেড়ে কেঁদেই ফেলে আর কী, “ওগো দিদিমণি, না! এত পাষাণ হবেন না গো! দু-দুটো ঘাসের কেক গোরুতে খেয়ে শেষ করবে গোওও! আমি একটাও পাবো না গোওও? একটা অন্ততঃ আমায় গোটা দিন গো! বাকি ওরা মিলে নাহয় খাক গো!”

শিয়ালনী এবারে হাসল চশমার ফাঁক দিয়ে, “গুড। এইবারে বোঝা গেল যে তুই সত্যি-ই বাঘু! আর আমার কোন সংশয় নেই। কারণ ভিনগ্রহী হলে আর যাই হোক, ঘাসের কেক খেত না!”

বাঘু ফিচিক ফিচিক হেসে কী একটা বলতে যাবে, এমন সময় ধুপধাপ হুপহাপ করে বিস্তর শব্দ পাওয়া গেল। দেখতে না দেখতেই ভালকি, কুমরু আর হিনিমিনি মাথায় লেপ-বালিশ নিয়ে হুড়মুড় করে এসে পড়ল। আর তারপরেই বাঘুকে দেখে ধপাস ধাঁই করে সব বালিশ আর লেপ ফেলল বাঘুর ঘাড়ে। লেপ-বালিশ চাপা পড়ে বাঘুর যখন হাঁইফাঁই অবস্থা, ঠিক সেই সময়েই পিছন পিছন হাতুশি হাঁফাতে হাঁফাতে এসে একফুট লম্বা শ্বাস ছাড়ল, “ও! তোরা এখানে সবাই লেপ-বালিশ রেখেছিস! আচ্ছা, আমিও রাখি।”, বলে লেপ-বালিশ তো রাখলই, তারপরে ফের হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “আমার না লেপের গাদায় শুতে দারুণ আরাম লাগে!”, বলেই বাঘুর উপরে ডাঁই হওয়া পাহাড়প্রমাণ লেপ-বালিশের গাদার উপর আরাম করে শরীর এলিয়ে দিল।

বাকিরা সব হাঁইহাঁই করে উঠে হাতুশিকে সরিয়ে দিয়ে লেপ-চাপা বাঘুকে উদ্ধার করল। বাঘু বেচারির তখন সত্যিই নাজেহাল দশা! কোনমতে উঠে বসেই বাঘু শুকনো মুখে প্রশ্ন করল, “আচ্ছা দিদিমণি, উল্কাটা কোথায় গেল?”

যাই হোক, সকলে মিলে বাঘুকে বোঝানো গেল যে, ওটা উল্কা নয়, ওটা হাতুশি। তাই শুনে বাঘু ভারি চিন্তিত হয়ে পড়ল, “আচ্ছা, উল্কার কি মাথা ঘোরে? তাই অত জোরে পড়ে? এত মাথা ঘোরা মোটে ভালো কথা নয়।”

শিয়ালনী ধমকধামক দিয়ে চুপ করালো বাঘুকে। হাতুশি বলল, “দিদিমণি, আপনার তো লেপ- বালিশ কিছু নেই। এক কাজ করুন। আপনি আমাদের মাঝে বসুন। তাহলে আমাদের লেপ-বালিশে আপনারও হয়ে যাবে।

সেইমতো সার দিয়ে বসল সবাই। সবারই মাথায় বালিশ, গায়ে লেপ। সামনে চাঁদের আলো-আঁধারিতে আধোঘুমে খোলা মাঠ। আকাশের তারা চেনাচ্ছে শিয়ালনী। ধ্রুবতারা, সপ্তর্ষিমণ্ডল, কালপুরুষ…। শুনতে শুনতে খানিক বাদেই বাঘুর হাই উঠল। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে মুখ দিয়ে ফু-উ-উ-উস করে একটা আওয়াজ ছেড়ে বাঘু বলল, “দিদিমণি, একটু শুলে তো কোন দোষ নেই। না ঘুমোলেই হল। আমি বরং শুয়ে শুয়েই আকাশ দেখি।”

কুমরু একবাক্যে সায় দিল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, একটু শুলে তো কোন দোষ নেই। না ঘুমোলেই হল।”

দেখা গেল, হিনিমিনি আর ভালকিরও একই মত। ওরাও শুয়ে পড়ল। হাতুশি আর শিয়ালনী বসেই রইল। একটু বাদে হাতুশি বলল, “দিদিমণি, আমিও শুই। শুলে তো আর দোষ নেই। না ঘুমোলেই হল।”

হাতুশিও শুয়ে পড়ল। শিয়ালনী মাঝেমাঝেই খোঁচাতে থাকল ওদের, “ওই দ্যাখ, লুব্ধক। ওই দ্যাখ…। ওইদিকে তাকা, মংগল দেখতে পাবি।”

শিয়ালনী বলার এক ফাঁকেই বাঘুর গলা পাওয়া গেল, “দিদিমণি, আমি চোখ বুজছি। চোখ বুজতে তো দোষ নেই। না ঘুমোলেই হল।”

কুমরু একবাক্যে সায় দিল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। চোখ বুজতে তো দোষ নেই। না ঘুমোলেই হল।”

হিনিমিনি আর ভালকিও একযোগে হাই তুলে বলল, “চোখ বুজতে তো দোষ নেই। না ঘুমোলেই হল।”

ওরা চোখ বুজল। শিয়ালনী কথা চালাতে থাকল হাতুশির সঙ্গে। একটু বাদে হাতুশিও আলসে ভঙ্গিতে শুঁড় তুলে বলল, “দিদিমণি, আমিও চোখটা সামান্য বুজি। চোখ বুজতে তো দোষ নেই। না ঘুমোলেই হল।”

হাতুশিও চোখ বুজল। একটু বাদেই সবার নাক দিকে ঘুঁস ঘুঁস ফুঁস ফুঁস করে বিচিত্র সব আওয়াজ বেরোতে থাকল। শিয়ালনী চুপচাপ বসে রইল খানিকক্ষণ। তারপর নিজের মনেই ঘাড় নাড়ল, “শুতে তো দোষ নেই, না ঘুমোলেই হল। চোখ বুজতেও দোষ নেই। না ঘুমোলেই হল। ঘুমোতেও দোষ নেই, নাক না ডাকলেই হল। নাক ডাকলেও দোষ নেই, উল্কা ঘাড়ে না পড়লেই হল!”

এই বলে শিয়ালনীও শুয়ে পড়ল আর তার নাকের ভেতর থেকে ঘড়ড়ড় ঘোঁ ফড়ড়ড় ফোঁ করে সুন্দর সব আওয়াজ বেরোতে থাকল!

………

          “কই গো দাদা- দিদিরা, তোমরা যে দেখি সব পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছ? ওদিকে উল্কা যে কখন পড়ে গেল, হুঁশ আছে?”

          ঘুমচোখে ধড়মড় করে উঠে বসল সবাই। সিংহালু সামনে দাঁড়িয়ে গলা ফাটাচ্ছে-

“দুম ফটফট দুম ফটাস,

উল্কা দেখার আগেই ধপাস!”

          বাঘু চোখ মুছতে মুছতে উঠে বসল, “বাজে বকবি না, সিংহালু! আমি মোটেই ঘুমোইনি। উল্কাটা কোন্‌দিকে পড়তে পারে, সেইটা চোখ বুজে ভাবছিলাম।”

          সিংহালু ঝপাং ঝপাং করে দুবার লাফাল,-

“হি হি বাঘুদাদা!

খালি বাজে কথা ফাঁদা!”

          বাঘু মুষড়ে পড়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই সিংহালুর পেছন পেছন সিংহালুর মা সিংহিকা এসে হাজির। রীতিমতো একটা হই চই বেঁধে গেল এর পর। সিংহালুরা দেখেছে উল্কাটাকে পড়তে, কিন্তু সেই বিশাল মাঠের কোথায় যে উল্কাটা পড়েছে, সেটাই আর অন্ধকারে ঠাহর করতে পারেনি। শিয়ালনী তাড়া লাগাল পশুয়াদের, “চল্‌, চল্‌, উল্কাটা কোথায় পড়েছে খুঁজে বের করি। হাতুশি, তুই মনিটর, তুই আগে দৌড়ো। হিনিমিনি, কুমরু, ভালকি- চটপট এদিক ওদিক গোরুখোঁজা কর উল্কাটাকে। আর বাঘুউউউ, এত না ঘুমিয়ে গাত্রোত্থান করো দেখি, বাছাধন।”

          ‘গাত্রোত্থান’ মানেটা জানার ইচ্ছে ছিল বাঘুর, কিন্তু সিংহালু ততক্ষণে তার লেজ ধরে লাফাতে ঝাঁপাতে শুরু করেছে, “বাঘুদাদা, বাঘুদাদা, আমি তোমার লেজ ধরে ছুটবো!”

          বেচারি বাঘু একরকম সিংহালুর ভয়েই প্রাণপণে দে-ছুট। সাঁইসাঁই করে দৌড়োচ্ছে বাঘু, হাঁইহাঁই করে শ্বাস নিচ্ছে, আর তার লেজ পাঁইপাঁই করে চরকিপাক খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। সিংহালু বাঘুর পিছন পিছন ধাওয়া করতে করতে একসময় হাতুশি- হিনিমিনিদের ভিড়েই ঢুকে গেল।

          তারপরেই সিংহালু লেজ ঠেকাল গালে, “আচ্ছা দাদাগণ ও দিদিগণ! চাঁদের আলোয় ধাঁধা শোন দিয়া মন! তোমাদের একটা ধাঁধা বলি। দেখি কেমন পারো।”

          বলেই এক চক্কর এতাল বেতাল ঘুরে সিংহালু শুরু করল, “বলো তো দেখি, ছানার ওপর যদি কোন মৌমাছি বসে, তাহলে তাকে কী বলা হবে?”

          বাঘু একটু দূরে দাঁড়িয়ে চুপচাপ শুনছিল। এবারে তড়াক করে সামনে লাফিয়ে এসে বলল, “কী আর বলা হবে? ছাগল, গোরু, শিম্পাজি এসব বলা হবে। বনবিড়াল, গঙ্গাফড়িং –এসবও বলা হতে পারে!”

          সিংহালু কাঁধ ঝাঁকাল, “উফ! বাঘুদাদা! এটা একটা ধাঁধা!”

          বাঘু ভেবলে গিয়ে বলল, “ও! তাহলে নচ্ছার, ছুঁচো এসব বলা হবে! গোঁফওলা হ্যারিকেনও বলা যেতে পারে!”

          হাতুশি বেজায় বিরক্ত হয়ে বলল, “বাঘু, তুই থামবি? সিংহালু, আমি বলছি উত্তরটা।”

          সিংহালু শশব্যস্ত হয়ে বলল, “আরে না। তুমি না। তুমি পারবে জানি।”

          ভালকি ঘাড় দুলিয়ে বলল, “আমি বলছি। মৌমাছির ইংরেজি কী? বি মানে মৌমাছি। তাহলে বি যোগ ছানা, মানে বিছানা। এই হল উত্তর। কী রে, ঠিক আছে?”

           সিংহালু বেজায় খুশি হল, “এই না হলে ভালকিদিদি! দাঁড়াও, আরেকটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করি। কোন কাকার যদি উলের ব্যবসা থাকে, তাহলে তাঁকে কী বলে ডাকা হবে?”

          উত্তরটা হিনিমিনি আর কুমরু দিয়ে দিল একযোগে, “উল্কা! উল্কা!”

          সিংহালু আরও কিছু ধাঁধা বলার তোড়জোড় করছিল বটে, কিন্তু তার আগেই শিয়ালনী দিদিমণির দিকে নজর গেল ওদের। চাঁদের আলোতেও দিব্যি বোঝা যাচ্ছে, দিদিমণি কোমরে থাবা দিয়ে রাগ রাগ মুখে ওদের দিকেই চেয়ে আছেন। কী আর করা? জোরকদমে উল্কার তল্লাশিতে লেগে পড়ল সবাই। একচোট জোর খোঁজাখুঁজির পরও যখন উল্কার কোন হদিশ পাওয়া গেল না, তখন একে একে হাল ছেড়ে দিল সবাই। বাঘুও প্রথমটায় মনের ফূর্তিতে মাঠের চারপাশে এক চক্কর কেটেছিল বটে, কিন্তু তার পরই কেমন যেন বেদম হয়ে পড়ল। এদিকে হিমেল কুয়াশাও জেঁকে ধরেছে। হিনিমিনি বলল, “বাঘু, ঠাণ্ডা লাগছে না?” বাঘু বলল, “আরে, এ তো নেহাতই বাচ্চা ঠাণ্ডা, কচি ঠাণ্ডা- এরে কয় ঠাণ্ডি! এই ঠাণ্ডায় কাঁপতে হয় কেমন করে জানিস? ঠাণ্ডি- হি হি হি হি!”

কিন্তু বাঘুর কথা শেষ হতে না হতেই এক ঝলক কুয়াশামাখা কনকনে উত্তুরে হাওয়া এসে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল ওদের সকলকে। বাঘু আর্তনাদ করে উঠল, “ওরে না না! ঠাণ্ডি নয় রে! এ তো জবরদস্ত ঠাণ্ডা রে- যারে কয় ঠাণ্ডু! এই ঠাণ্ডায় এমন করে কাঁপতে হয় রে- ঠাণ্ডু হু হু হু হু হু হু!”

বলতে বলতেই বাঘু কাঁপতে কাঁপতেই চেঁচাল, “ওগো, দিদিমণি গো! আমি আর পারছি না গো! আমি এই পাথরটায় একটু বসলাম গো! হুঃ হুঃ ঠাণ্ডু হু হু হু হুহু!”

বলতে না বলতেই মাঠের একপাশে একটা গর্তের মধ্যে পড়ে থাকা একটা বড় পাথরের চাঁইয়ের ওপর আরাম করে বসতে গেল বাঘু আর তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে উঠল, “উরিব্বাবা! এ পাথরটা এত গরম কেন?”

পাথর? সে আবার গরম? সত্যি তো! পাথরটা বেজায়ই গরম! এমন তো হবার কথা নয়! শিয়ালনী আর সিংহিকাও ছুটে এসেছে। শিয়ালনী বলে, আমি আজ সকালেই এই জায়গাটা ঘুরে গেছি। এখানে কোন পাথর ছিল না।

সিংহিকা বলে, “এই জঙ্গলে এরকম পাথর কিন্তু কোথাও নেই। পাথরটা খুব অদ্ভুত ধরনের। আর দেখেছো, এ জায়গাটায় কেমন একটা গর্ত হয়ে গেছে!”

পশুয়াদের চোখমুখ গোলগোল, “তবে কী? তবে কী?”

শিয়ালনীর মুখে বিচিত্র হাসি, “তবে আর কী? এটাই উল্কা!”

সিংহিকা সায় দিল, “ইয়েস, এটাই উল্কা!”

“উল্কা!!!!”, সমস্বরে সোল্লাসধ্বনি উঠল একটা।

বাঘু ঘাড় গোঁজ করল, “এত বড় জিনিসটা, আমি বসলুম বলেই না পাওয়া গেল!”

শিয়ালনী কী যেন ভাবতে ভাবতে বলল, “ঠিক আছে। তুই যখন খুঁজে পেয়েছিস, ওটার নাম হোক বাঘুল্কা! বাঘু যোগ উল্কা!”

 

তারপর? একে তাদের ঘুম ভেঙে ভরপুর ফূর্তি, তায় প্রাণকাড়া জ্যোৎস্না! তার ওপর উল্কা খুঁজে পাবার আনন্দ! চাঁদের আলোয় ঘুরে ঘুরে শুরু হয়ে গেল ওদের গান আর নাচ-

 

চাঁদনী রাতে, হিমটি ঝরে,

রাতদুপুরে, আকাশ জুড়ে-

পড়বে উল্কা ধমাস ধাঁই;

সবার কিন্তু আসা চাই।

                                       জানে কেউ? কিসের ধাক্কা?

                                       বাঘুল্কা! ! বাঘুল্কা!!

 

মাথায় সবার বালিশ চাপা

গায়ে লেপটি কষে ঢাকা;

হাতুশি বসে তার উপর

বাঘুর গায়ে ব্যথা জবর;

                                       লাগল গরম? কিসের ছ্যাঁকা?

                                       বাঘুল্কা! ! বাঘুল্কা!!

 

ঘুমিয়ে সবাই যখন কাদা,

উল্কা পড়ার নেইকো বাধা-

পড়বে উল্কা আপন মনে,

মাঠের ধারে, একটি কোণে-

                                        নামটি তার? কী যায় রাখা?

                                       বাঘুল্কা! ! বাঘুল্কা!!

………০………

অংকনঃ সোমক সেনগুপ্ত

বাঘু সিরিজের অন্যান্য গল্পগুলি থাবাছানি দিচ্ছে নিচের লিঙ্কেঃ-

১। বাগে এলো বাঘু

২। গিঁটের গেরোয় বাঘু

৩। বাঘু খেল ঘাস

৪। বাঘু হলেন মনিটর

৫। শিয়ালনী কুপোকাত

৬। অযোধ্যা পাহাড়ে বাঘু 

৭। পরীক্ষা দিলেন বাঘু

৮। গণ্ডারনী ও গণ্ডগোলিক্স

৯। নামতা শেখেন বাঘুবাবু

১০। শিয়ালনীর পাঠশালায় সিংহালু

১১। বাঘু হল চিৎপটাং 

১২। ঘুম দিলেন বাঘুবাবু  

১৩। পাঠশালায় ধুন্ধুমার

১৪। বাঘুবাবু ও জান্তা জট 

১৫। বনভোজনে বাঘুবাবু

১৬। হোলি খেলল হিনিমিনি      

১৭। ভোটে দাঁড়ালেন বাঘুবাবু

১৮। পাঠশালা মহাসভায় হাতুশি 

১৯। বাঘুর ল্যাজলজ্জা

২০। ছবি আঁকেন বাঘুবাবু         

২১। জানোয়ার বার্তা ও বাঘুবাবু

Leave a comment

Check Also

বিদেশি মোলাকাতে বাঘু- মৌসুমী পাত্র

            ধুস! ধুস! ধুস! ‘দূর ছাতা’ বলে যেদিকে দুচোখ যায়, সেদিকে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে …

baghu_kobi sommelan

কবি সম্মেলনে বাঘুবাবু – মৌসুমী পাত্র

            পাঠশালায় আসছিল শিয়ালনি। আজ দেরিই হয়েছে কিছুটা। কাল সন্ধেবেলা খরগোশাই ডাক্তারদিদির বাড়ি নিমন্ত্রণ …

শিল্পী- সোমক সেনগুপ্ত/ জানোয়ার বার্তা ও বাঘুবাবু

জানোয়ার বার্তা ও বাঘুবাবু – মৌসুমী পাত্র

  পিঠে থলে ঝুলিয়ে বাঘু চলেছে পাঠশালার পানে। মনে বেশ খুশি খুশি ভাব। একটা গাছের …

ছবি আঁকেন বাঘুবাবু- মৌসুমী পাত্র

ছবি আঁকেন বাঘুবাবু – মৌসুমী পাত্র

(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা দিয়েছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ গল্পে। …