Home / বাঘু সিরিজ / পাঠশালা মহাসভায় হাতুশি – মৌসুমী পাত্র

পাঠশালা মহাসভায় হাতুশি – মৌসুমী পাত্র

শিল্পী- গুঞ্জা/ পাঠশালা মহাসভায় হাতুশি
শিল্পী- গুঞ্জা

 

 

প্রার্থনার পর ক্লাসে ঢুকেই চশমাটা নাকের ডগায় নামিয়ে আনল শিয়ালনী, “মনে আছে তো, আজ ‘ভূগোল ভাবনা’ পড়াবো বলেছিলাম?”

          বাঘু পাশে বসা ভালকিকে ফিসফিস করে বলল, “ভারি ভাবনায় পড়া গেল!”

          ভালকি পাত্তা দিল না। পাত্তা দিলেই বাঘু আরও ভুলভাল বকতে থাকবে! ওদিকে দিদিমণি বই খুলে পড়াতে শুরু করেছেন, “আজ তোদের আমি পড়াবো দিক নিয়ে।”

          বাঘু পাশে বসা ভালকিকে থাবার ঠেলা দিল, “দিক নিয়ে পড়ালেই কি আমরা দিগ্‌গজ হবো?”

          ভালকি সরেই বসল। দিদিমণি ততক্ষণে প্রশ্ন করেছেন, “বল্‌ দেখি তোরা, দিক কয়টি?”

          হাতুশি সঙ্গে সঙ্গে থাবা তুলল মাথার ওপর, “দিদিমণি, আমি জানি।”

          শিয়ালনী চশমাটাকে বাঁ কানে ঝুলিয়ে বলল, “বল্‌, শুনি।”

          হাতুশি পিছনের দুই থাবায় ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল, “দিক চারটি। পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর আর দক্ষিণ।”

          শিয়ালনী চশমাটাকে এবার ডান কানে ঝোলাল, “হল, আবার হল না।”

          শুনে সবাই এ ওর মুখের দিকে চায়। এ আবার কেমন কথা? বাঘু সামান্য সরে ফের ভালকির কাছ ঘেঁষে বসল, “আগেই বলেছিলাম, ‘ভূগোল ভাবনা’ মানেই ভাবনার কথা!”

          শিয়ালনী চশমাটাকে গলায় ঝুলিয়ে বলল, “মূল দিক চারটি। সেটা ঠিকই বলেছে হাতুশি। কিন্তু মোট দিক হচ্ছে দশটি।”

          কুমরু অমনি থাবাতালি দিয়ে উঠল, “ঠিক! ঠিক! দশে দিক।”

          শিয়ালনী প্রশ্রয়ের হাসি হাসল, “ঠিকই বলেছিস। এই দশটি দিক হল- পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, নৈঋত, ঈশান, অগ্নি, বায়ু, ঊর্ধ্ব আর অধঃ।”

          বাঘু লেজখানাকে মুখের মধ্যে ভরে চুষতে চুষতে বলল, “এত দিক থাকলে জন্তুজানোয়ারদের দিগ্ভ্র‌ম হতে বাধ্য।”

          শিয়ালনী বাঘুর কথা শুনতে পায়নি, কিন্তু লেজচোষাটা চোখে পড়েছে। এক ধমক দিয়ে বলল, “বাঘু, লেজচোষা, থাবাচোষা- এসব বদ অভ্যেস। যেন আর না দেখি। আচ্ছা বেশ, তারপরে শোন, ঈশান হল উত্তর-পূর্ব কোণ, অগ্নি দিক হল দক্ষিণ-পূর্ব কোণ, নৈঋত দিক হল দক্ষিণ-পশ্চিম আর বায়ু হল উত্তর-পশ্চিম কোণ।”

          শিয়ালনী পড়াতে পড়াতে হঠাৎ দেখে যে হাতুশি উদাসমুখে নিজের গালে শুঁড় বুলোচ্ছে তো বুলোচ্ছেই। এমনকি নিজের গালে শুঁড় বুলোতে গিয়ে একবার হিনিমিনির গালে অব্দি মনের ভুলে শুঁড় বুলিয়ে ফেলল! হিনিমিনি হাতুশিকে এক ঠেলা দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু দিদিমণি তাদের পানেই চেয়ে আছেন দেখে চুপচাপ রইল।

          শিয়ালনী জোরে ডাকল, “হাতুশি! হাতুশিইইইই!”

          হাতুশির থেকে কোন জবাব তো এলোই না, উপরন্তু তার শুঁড় এবারে গিয়ে হিনিমিনির কান চুলকোতে আরম্ভ করল।

          লাফ দিয়ে উঠল হিনিমিনি, “আরে, ছাড়! ছাড়! কানে কাতুকুতু লাগে যে!”

          সুযোগ পেয়ে তেড়ে এল বাঘু, “অ্যাইয়ো হাতুশি, ক্লাসের পড়ার সময় ফাঁকিবাজি করছিস যে বড়? মন দিয়ে পড়তে পারিস না! দিদিমণি বলে কত্তো যত্ন করে পড়াচ্ছেন। তাই না, দিদিমণি?”

          শিয়ালনী দাঁত খিঁচিয়ে তেড়েই এল, “আহা! যেন বিদ্যার জাহাজ এলেন রে! নিজে ফাঁকি দিয়ে দশদিক উল্টে দিল, আর এখন উনি এলেন হাতুশির পড়ার খবরদারি করতে! যা, নিজের জায়গায় বসবি যা। হাতুশির ভাবনা তোমায় ভাবতে হবে না, বাঘুবাবু!”

          দিদিমণির কাছে বকুনি খেয়ে বাঘু চলে গেল মুখ গোঁজ করে। হাতুশি যেন ঘুম থেকে উঠল, “আমায় কিছু বলছিলেন, দিদিমণি?”

          শিয়ালনী বকল না। নরম সুরে বলল, “কী হল রে, হাতুশি? তুই আজ এত আনমনা যে! শরীর-টরির ঠিক আছে তো?”

          হাতুশি ভারি লজ্জা পেয়ে কানখানা একবার চুলকে নিল। নিজেরই কান। তারপর বলল, “না দিদিমণি, সেরকম কিছু নয়। মানে আমি ভাবছিলাম যে ‘পাঠশালা মহাসভা’য় যাবার কথা!”

          শিয়ালনী চমকে উঠে বলল, “এই রে! একদমই ভুলে গেছি। কাল বিকেলেই কাছুয়া চিঠি দিয়ে গেল তোরা যাবার পরপরই। এই যে, নে।”

          বলতে বলতে শিয়ালনী ওর লেজে বাঁধা ফুলের গোছার মধ্যে ভাঁজ করা দুটো কাগজ বাড়িয়ে ধরল হাতুশির দিকে। হাতুশি প্রায় হুমড়ি খেয়েই পড়ল কাগজটার উপর। সেখানে লেখা আছে-

প্রতি

মাননীয়া শিয়ালনী মহোদয়া সমীপেষু,

          আপনার চিঠি পাইয়া যৎপরোনাস্তি আনন্দিত হইলাম। আগামী ১৮ই জ্যৈষ্ঠ আমাদের পাঠশালা মহাসভার দশম বর্ষ পূর্তি। তাহার পূর্বে সপ্তাহব্যাপী নানা কর্মসূচী রহিয়াছে। ফলতঃ, আপনার পশুয়া ‘হাতুশি’কে আপনি আগামী ১১ই জ্যৈষ্ঠ বেলা ১১ঘটিকার মধ্যে নিম্নলিখিত ঠিকানায় প্রেরণ করিবেন। নিয়মাবলী ও বিস্তারিত বিবরণ সংলগ্ন করা হইল।  

          অতএব মহাশয়া, অনুগ্রহপূর্বক যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করিলে বাধিত হই।

          নমস্কারান্তে,                        

                                                                                                                      শিয়ালিকা বিদ্যাচন্দ্রিকা

                                                                                                                               অধ্যক্ষা,

                                                                                                                     পাঠশালা মহাসভা।

পুঃ- আপনার স্বাক্ষর সংবলিত একটি পরিচয়পত্র প্রেরণ করা আবশ্যক

          চিঠিটার সঙ্গে একটা হলুদ রঙের ছাপানো কাগজ। সেটার একপিঠে লেখা-

পাঠশালা মহাসভার নিয়মাবলী ও বিস্তারিত বিবরণ

১। পশুয়াদের আহার ও শয়নের সম্পূর্ণ ব্যবস্থা করা হইবে। কোনরূপ কোন সামগ্রী আনয়নের প্রয়োজন নাই।

২। প্রয়োজনবোধে পশুয়ারা প্রয়োজন অনুযায়ী সামান্য কিছু পোশাক আশাক আনিতে পারে।

৩। প্রত্যেককে দুইটি করিয়া বাহারি লেজস্ত্রাণ দেওয়া হইবে। ফলে লেজস্ত্রাণ আনইবারও প্রয়োজন নাই।

৪। সাবান, শ্যাম্পু, তৈল, গাত্রমার্জিকা (গামছা), দন্ত মাজন, দাঁতন (নিমডালের) ইত্যাদি আবশ্যক জিনিসপত্রাদি প্রদান করা হইবে

৫। বইপত্র আনা অনাবশ্যক। প্রয়োজনীয় বইপত্র, খাতা ইত্যাদি প্রদান করা হইবে। সঙ্গে পেনসিল, কলম, প্রভৃতি আনুষঙ্গিক দ্রব্যসামগ্রী।

ঠিকানাঃ-

পাঠশালা মহাসভা

৩ নং শুঁড়িপথ,

১/গ, জানোয়ার মুলুক,

(ধাঁইধাঁই ঝর্নার নিকট)

হালুঞ্চি বন।

 

শিয়ালনী বলল, “একদম সোজা রাস্তা। পড়েই সব দিব্যি বোঝা যাচ্ছে।”

          হাতুশি টকাত করে শুঁড় হেলাতে গিয়েও থেমে গেল, “কিন্তু দিদিমণি, আমি যে কিছুই বুঝলাম না।”

          শিয়ালনী চোখ কপালে তুলল, “সে কী রে? তুই এত পড়াশুনায় ভালো, তুই এই সহজ ব্যাপারটা বুঝলি না? ওটা ঝালুমালু থেকে বেশি দূর নয়। ঝালুমালু মনে আছে? সেই যে, আমরা বনভোজনে গেলাম। আচ্ছা বেশ। তোকে আমি পরে আরও ভালো করে বুঝিয়ে দেবো। নে এখন, ভালো করে পড় সবাই।”

          সহসা হাঁউমাঁউ করে উঠল বাঘু, “হাতুশি ওখানে গিয়ে কত ভালো ভালো জিনিস পাবে! আমি কিছুই পেলাম না! ওরা সবাই আমাকে ইচ্ছে করে ভোটে হারাল!”

          শিয়ালনী চোখ সরু করে তাকাল, “ভোটের প্রস্তাব তো তুই-ই দিয়েছিলি বাঘু! তা নিজে হেরেছিস, এখন বললে হবে?”

          বাঘু থাবা দিয়ে বারদুয়েক কপাল চাপড়াল, “জানেন দিদিমণি, এই কুমরু আর হাতুশিকে ভোটের জন্য আমি কম জিনিস দিয়েছি? ভালকিকে গাদা গাদা টুথপেস্ট, মধু; কুমরুকে এত এত মাছ- সব জলে গেল গো দিদিমণি! ও হো হো হো!”

          ভালকি হোহো করে  হাসতে হাসতে বলল, “জলে যায়নি রে বাঘু! আমাদের পেটে আর মুখে গেছে! হে হে! তোকে কেমন ভড়কি দিয়েছি বল্‌! হো হো!”

কুমরু থাবা নাচাতে নাচাতে বলল, “তুই সারা বছর আমাদের টিফিন কেড়ে খাবি আর ভোটের সময় দু’চারদিন দু’চারটে ভালো কথা বলে আর দু’চারটে ভালোমন্দ জিনিস দিয়েই ভাবছিস আমাদের ভোট পেয়ে যাবি? আমরা কি অতোই বোকা?”

বলেই কুমরু আর ভালকির সে কী হাসি! হিনিমিনিও ফুচুক ফুচুক হাসল, “দিদিমণি, হাতুশি না যা ভয় পেয়েছিল! হো হো হো হো! ভেবেছিল, কুমরু আর ভালকি বাঘুকেই ভোট দেবে। আর তারপর বাঘনি হাজার হলেও বাঘুরই বোন, সেও নিশ্চয়ই বাঘুকেই দেবে। জানেন দিদিমণি, ওর শুঁড় না শুকিয়ে এইটুকুন হয়ে গিয়েছিল! হি হি হি হি!”

তাই শুনে শিয়ালনীর মুখেও মিটিমিটি হাসি। বাঘু বেজায় চটিতং হয়ে বলল, “কী, আমাকে নিয়ে হাসাহাসি? আমাকে ব্যঙ্গ? আমাকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য?”

শিয়ালনী এগিয়ে এসে বাঘুর লেজ ধরে হালকা এক টান মেরে বলল, “ওরা যা করেছে বেশ করেছে। অন্ততঃ পাঠশালার মানসম্মানের কথা ভেবেছে। নিজেদের বিকিয়ে দেয়নি!”

          আবার হাহা-হিহি-হোহো! বাঘু হাঁড়িমুখ করে বসল নিজের জায়গায়। শিয়ালনী বলল, “বেশ, এবারে পড়া শুরু। তার আগে হাতুশি, এই কয়েকটা দিন সন্ধেবেলা তোর বাড়ি গিয়ে এক ঘন্টা করে পড়িয়ে আসবো। ওখানে গিয়ে কী হবে না হবে জানা তো নেই। যথাসম্ভব এগিয়ে থাকা ভালো। ”

 

          পরের কয়েকটা দিন যেন পাঁইপাঁই করে দৌড়েই পগার পার! পাঠশালের পড়া যদি ছোটখাটো ঢিপি হয়, তার উপরে দিদিমণির পড়ানো যেন আস্ত পাহাড়! যাবার তোড়জোড় তো আছেই। হাতুশির বাবা হস্তী তাকে দেখতে পেলেই তাড়া লাগাচ্ছে, “খবরদার, ঠাণ্ডা লাগাবি না। শুঁড় ঝুলিয়ে রাখবি না। হায় বামদিকে নয় ডানদিকে কাত করে রাখবি। আর লেজ উপরের দিকে তুলে রাখবি না। দেখতে বাজে লাগে। আর থাবা…”

          শুনতে শুনতে হাতুশির কান ঝালাপালা! তার মা হস্তিনী অতকিছু বলেনি। খালি বলেছে, “ওরা যত যাই বলুক, দু চারটে জিনিস তো নিতে লাগেই। গোছগাছ করে নিস সেইমতো। আর ঘাবড়াবারও কিছু নেই, মন খারাপ করারও কিছু নেই। এত বড় একটা সুযোগ পেয়েছিস, সবাই তো পায়না! দেখতে দেখতেই সাত দিন কেটে যাবে।”

          তা হাতুশি ঘাবড়াচ্ছেও না, মন খারাপও করছে না। সে যাবার আনন্দে মশগুল। এর মধ্যে একদিন হিনিমিনি এসে এক বোতল ‘রম্ভা রস’ দিয়ে গেল। এ রস খেলে নাকি হাঁইহাঁই করে তেজ বাড়ে, সাঁইসাঁই করে সাহস বাড়ে, ঢাঁইঢাঁই করে ঢেঁকুর উঠে খাবার দাবার সব হজম হয়ে যায়। আর তার সঙ্গে জবরদস্ত ঘুম হয় কিন্তু নাক বা শুঁড় ডাকে না।

          যাবার আগের দিন হাতুশি বাবা-মায়ের সঙ্গে একবার পাঠশালা গিয়ে দিদিমণিকে থাবাপ্রণাম সেরে এল, বন্ধুদের সংগেও দেখা করল। বাঘু বেজায় কায়দা করে বলল, “যখনই বিপদে পড়বি, আমাকে স্মরণ করবি। আমি উদ্ধার করব!”  শিয়ালনী অনেক আশীর্বাদ করে যাবার পথ ফের বাতলে দিল। আর পইপই করে বলল, “মনে রাখিস, হাতুশি। বাইরে যাচ্ছিস। পাঠশালার মানসম্মানের ভার তোর থাবায়!”

 

          ‘পাঠশালা মহাসভা’ নেহাত কম দূর নয়। ভোর ভোর বেরিয়েছে হাতুশি। মেজাজ তার ভারি ফুরফুরে। হস্তী আর হস্তিনী থাবা নেড়ে টা টা করল। হাতুশির গলায় একটা ঝোলা। তার মধ্যে একটা ছোট খাতা, এক-দুটো গল্পের বই, কলম, একটা বাহারি টুপি আর গামছা আছে। আর আছে তার প্রিয় পাশবালিশ। বালিশটার নাম- আব্বুলিস। বালিশ ছাড়া অর ঘুম আসে না বলে নিতেই হয়েছে ওটাকে।

          হাতুশির মাথায় একটা জম্পেশ করে পাগড়ি বেঁধে দিয়েছে তার বাবা। আর তার মা শুঁড়ে সুন্দর নকশা করে দিয়েছে। একটা থলেতে ‘কলাচুর’ও বানিয়ে দিয়েছে। মানে আচার-তেল-চানাচুর দিয়ে একটা ছোট কলাগাছ মাখা। সে গান ভাঁজছে আপনমনে-

 

হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ

পুঁ পুঁ পুঁ পুঁ

পাগড়ি বেঁধে যাই রে আমি-

পাগড়ি বেঁধে যাই

ভাবছি আমি মনে মনে

কোথায় কী বা খাই!

 

কয়েকটা দিন ফূর্তি ভারি,

মহাসভার খাতিরদারি-

কত কিছু দেখি, শুনি

ভাবনা মোটেই নাই।

 

নতুন নতুন বন্ধু কত,

মিশব সুখে মনের মত-

পড়া যত, মজাও তত

মনটি আইঢাই।

 

শুঁড় তুলে গান গাইতে গাইতে এগিয়ে চলেছে হাতুশি। আর খানিকটা এগোলেই ঝালুমালু। গান গাইতে গাইতে পেটের মধ্যে খিদেটা বেশ চাগাড় দিয়ে উঠেছে। থলে থেকে কলাচুরের মোড়কটা খুলে খেতে থাকল সে। চিবোতে চিবোতেই পেরিয়ে গেল ঝালুমালু। এইখানেই সেবারে তারা বনভোজন করেছিল। সেই মাংসের ঝোলে ফুটবল পড়ে যাওয়া আর মাংস ভেবে বাঘুর সেটাকে খেতে যাওয়া! কি মজাটাই না হয়েছিল সেবার! কলাচুর খাওয়া শেষ হতেই হাতুশি শুঁড় দিয়ে মুখের ভেতরটা চাটল। ইসস, একটু শরবত গোছের কিছু খেতে ইচ্ছে করছে। যাকগে, কী আর করা! হিনিমিনির দেওয়া ‘রম্ভা রস’টা আছে অবশ্য। কিন্তু থাক্‌। ওটা পরে কাজে লাগবে।

          হাতুশির কপাল ভালোই বলতে হবে। কিছুটা এগিয়েই তার চোখে পড়ল, রাস্তার ধারে সুন্দর চাঁদোয়ার তলায় একটা দোকান। ওপরে বড়ো বড়ো করে লেখা আছে-

 

হস্তীকর্ণের রস ফোয়ারা

আহ্লাদে হও মাতোয়ারা

          এখানে  বিশুদ্ধ হস্তীমার্কা লেবুর রস, বেদানার রস, আমের রস, আখের রস, কমলালেবুর রস, মুসুম্বির রস ইত্যাদি সকল প্রকার রস পাওয়া যায়। সঙ্গে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দুই টুকরো বরফ।

দাম- মাত্র একটি কলাগাছ।

          হাতুশি থলের ভিতর হাতড়াল। আরেকটা ছোট কলাগাছ আছে। যদি পৌঁছতে দেরি হয়, সেই ভেবে ওর মা আরেকখানা বাড়তি কলাগাছ দিয়েছিল। ওকে থমকে দাঁড়াতে দেখে দোকানের মালিক হস্তীকর্ণ কান ঝাপটাতে ঝাপটাতে শুধোল, “কী গো হাতিরানী, রস খাবে নাকি?”

          হস্তীকর্ণের কান দু’খানা বেজায় বড়ো, আর গাল দুটো ফুলো ফুলো। তুলনায় শুঁড়খানা ছোট। হাতুশি খানিকক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে বলল, “আমার কাছে এই একটাই কলাগাছ আছে। এটাতে চলবে?”

          হস্তীকর্ণ কান দুখানা দিয়ে মাথাটাকে টুপির মতন ঢেকে বলল, “চলবে না কেন? দিব্যি চলবে। খাসা চলবে। বেজায় চলবে। দারুণ চলবে! দুর্দান্ত চলবে! অসাধারণ চলবে! অসামান্য চলবে! জবরদস্ত চলবে…”

          হাতুশি ঘাবড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি করে বলল, “তাহলে এই নিন কলাগাছ। আর আমাকে আখের রস দিন।”

          হস্তীকর্ণ বলল, “আখের রস? বেশ বেশ! তা কী দিয়ে বানাবো? নুন? চিনি? এলাচ গুঁড়ো? গোলমরিচ? ওপরে গোলাপ ফুলের পাপড়ি? বরফের কুচি- এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়…”।

          হাতুশি দেখে, এ তো মহা ঝামেলায় পড়া গেল। সকাল এগারোটায় পৌঁছোতে বলেছে, এখানেই না ঘন্টাখানিক লেগে যায়! চটপট করে শুঁড় নাড়ল হাতুশি, “যেটা খেতে ভালো হবে, সেরকম বানিয়ে দিন।”

          একপাশে একগোছা আখ রাখা ছিল। হাতুশির চোখে পড়ল, এককোণায় পরিষ্কার একটা পাটাতনের ওপরের ঝকঝকে একটা সাইকেল। আখগুলোকে সাইকেলের তলায় রেখে হস্তীকর্ণ গিয়ে বসল সাইকেলের সিটে আর জোরে জোরে প্যাডল করতে থাকল। আর পাটাতন বেয়ে আখের রস গড়িয়ে জমা হতে থাকল একটা বড় চৌকোণো গামলায়।

          হস্তীকর্ণ এটা মেশায়, সেটা নাড়ায়। হাতুশি অধৈর্য হয়ে পড়ছে রীতিমতো। অনেক অনেকক্ষণ পর, এক কলসি ভর্তি আখের রস এনে হাজির করল হস্তীকর্ণ। তার ওপর সত্যিই গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো। এলাচগুঁড়োর মনমাতানো সুবাস। বাঁশের একটা বাঁকানো নলও দিয়েছে। শুঁড়ে করে ঠাণ্ডা মিষ্টি আখের রস টানতে টানতে মনটা জুড়িয়ে এল হাতুশির। নাহ্‌। এই হস্তীকর্ণকাকুটা কথা বেশি বললে আর কান ঝাপটালে কী হবে, আখের রসটা বানিয়েছে অপূর্ব! কিন্তু সে প্রসংগে আর গেল না হাতুশি। পাছে আরও দেরি হয়ে যায়!

          আখের রস খেয়ে জোরকদমে হাঁটা লাগাল হাতুশি। যাচ্ছে, যাচ্ছে, যাচ্ছে। যেতে যেতে এক জায়গায় গিয়ে দেখে, রাস্তাটা দুদিকে দুটো ভাগ হয়ে গেছে। একদিকে তীরচিহ্ন দিয়ে লেখা- ‘হাঁইহাঁই ঝর্না’ । আর একদিকে তীরচিহ্ন দিয়ে লেখা- ‘ধাঁইধাঁই ঝর্না।’

          হাতুশি ওর সংগের হলুদ কাগজটা খুলল। তারপর ধাঁইধাঁই ঝর্নার পথ ধরল। কিছুদূর গিয়েই দেখে, ছোট একটা টিলার বুক চিরে ঝাঁপিয়ে পড়া এক উচ্ছল ঝর্না।  

           দেখেই চান করার লোভ হল হাতুশির। থলে হাতড়ে দেখে, একটা ছোট তোয়ালে আর সাবান তার মধ্যে ভরা। ব্যস, আচ্ছাটি করে সাবান মেখে মহানন্দে চান সারল সে। শুঁড় দিয়ে এদিক ওদিক ইচ্ছেমত জল ছেটাল।

          চান সেরেই ছোটা শুরু করল। অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। যাচ্ছে, যাচ্ছে। সহসা পেছন থেকে এক ডাক, “হাতুশিইইইই!”

          হাতুশি চমকে তাকিয়ে দেখে, কাছুয়াদিদি তড়বড় তড়বড় করে সাইকেল চালিয়ে আসছে। ওর কাছে এসে থামল, “জানিস, আজ সকালে আমার একটা মিষ্টি বোন হয়েছে। মা তো খরগোশাই ডাক্তারদিদির হাসপাতালে। আমি যাচ্ছি মিষ্টিপত্র নিয়ে আমার মাসীদের খবর দিতে। তা তুই কোথায়… ও হো? ‘পাঠশালা মহাসভা’য় যাচ্ছিস বুঝি?”

          হাতুশি শুঁড় কাত করল, “হ্যাঁ।”

          কাছুয়া বলল, “কাল দিদিমণির সঙ্গে দেখা হল। বলছিলেন। নে, তুই এক কাজ কর। আমার সাইকেলের পিছনের ক্যারিয়ারে বসে পড়। আমিও জানোয়ার মুলুকেই যাবো। তোকে ৩ নম্বর শুঁড়িপথের মুখে নামিয়ে দেবো। ওখান থেকে কাছেই। তুই চলে যাস।”

          ভালোই হল হাতুশির। কাছুয়াদিদির সাইকেলের ক্যারিয়ারে চেপে শুঁড় দিয়ে পুঁ পুঁ পুঁ পুঁ করে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে চলল। মাঝেমাঝে কাছুয়াদিদির সঙ্গে টুকটাক গল্প।   

          ৩নম্বর শুঁড়িপথের মুখে এসে হাতুশিকে নামিয়ে দিল কাছুয়া। “শোন্‌, এই এক ভাঁড় মিষ্টি তুই রাখ। সময় সুযোগমত খাবি। আর হ্যাঁ, দিদিমণির পাঠশালার মান সম্মান যেন বজায় থাকে।”

          কাছুয়া বিদায় নিল। হাতুশি অল্প পথ গিয়েই একটা বাঁক ঘুরে দেখে, সামনেই বিরাট এক খোলা জায়গায় বিশাল ছাউনি। এদিক ওদিক অনেক তাঁবু। আর তার মাথার ওপর বড় বড় করে হলুদ রঙের শালুতে লেখা-

পাঠশালা মহাসভায় স্বাগতম্‌।

 

          রকমসকম দেখে হাতুশির শুঁড় প্রায় মাথার উপরেই উঠে গেল। পাশ থেকে একজন ভারিক্কি গোছের শিয়াল বলল, “যাও, যাও। ভেতরে যাও। তোমাদের জন্যই তো সবকিছু।” হাতুশি তাঁর দিকে একবার তাকিয়ে শুঁড় দিয়ে একটা প্রণাম ঠুকে ‘প্রবেশপথ’ লেখা তোরণ দিয়ে ঢুকে পড়ল।

          ঢুকতেই কে যেন মিহিসুরে ডাকল, “ওইদিকে না, আগে এইদিকে।”

          ও তাকিয়ে দেখে, একপাশে একটা পেল্লায় টেবিলের সামনে একটা পুঁচকে চেয়ারে এক কাঠবিড়ালি বসে। তার চশমাটা এতোই বড় যে মুখখানাই ঢেকে গেছে প্রায়। টেবিলে একটা মোটা খাতা, কলম আর অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর ব্যাগ।

          হাতুশিকে দেখেই চোখমুখ কুঁচকে তাকাল কাঠবিড়ালীটা, “কোত্থেকে আসা হচ্ছে?”

          হাতুশি বলল, “শিয়ালনীর পাঠশালা।”

          “বেশ, বেশ। তা খুকি, তোমার নাম কী?”

          “হাতুশি।”

          “বাহ্‌, বেশ মিষ্টি নাম তো তোমার।”, বলতে বলতেই কাঠবিড়ালীর চশমাটা চোখ থেকে খসে পড়ে যাচ্ছিল। হাতুশি দেখল, চশমার ডাঁটিদুটোতে লাল রঙের লম্বা সুতো বাঁধা। কাঠবিড়ালী ভালো করে মাথার পিছনে গিঁট বেঁধে চশমাটাকে ঠিকঠাক করে বসাল। তারপর প্যাটপ্যাট করে তাকাল হাতুশির দিকে, “আমার নাম জানো? আমার নাম কাঠচশমালী! আমার মতন নাম এ তল্লাটে আর কারুর নেই, বুঝেছো?”, বলেই গলাটা খাদে নামিয়ে আনল কাঠচশমালী, “বুঝলে, তোমাকে বেশ ভালো লেগেছে বলেই এত কথা বললাম। নইলে আমি কথা কমই বলি।”

          হাতুশির বেজায় হাসি পাচ্ছিল। কিন্তু হাসিটা কোনমতে চেপে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে রইল। কাঠচশমালী ওর গলায় ঝোলানো ঘড়ির দিকে চাইল, “তুমি ঢুকেছো… ঢুকেছো… একদম এগারোটা বাজতে চারে। তাই বেঁচে গেছো!”, বলেই ফের গলা নামাল কাঠচশমালী, “যারা প্রথম দিনেই দেরি করে ঢুকবে, তাদের দু নম্বর করে কাটা যাবে। তোমাকে চুপিচুপি বললাম। কাউকে বোলো না।”, বলেই গলা তুলল সে, “তা তোমার সঙ্গে কাউকে দেখছি না যে! বাবা, মা? তাঁরা বুঝি বাইরে? ডাকো তাঁদের।”

          হাতুশি বলল, “আমি একাই এসেছি।”

          “একাই এসেছো?”, কাঠবিড়ালীর চশমা এবার মাথার উপর দিয়ে ঠিকরে যাবার উপক্রম হল, “বলো কী? তুমি দেখছি দারুণ সাহসী মেয়ে! তোমার আগে যারা এসেছে, এক একেকজনের সঙ্গে তো বাড়ির লোকের বন্যা বয়ে গেছে!”

          তারপরে হাতুশির থেকে পরিচয়পত্রটা নিয়ে সে খাতার উপর ঝুঁকে খসখস করে লিখতে শুরু করল, “নাম হাতুশি… সময় ১০টা ৫৬ মিনিট… শিয়ালনীর পাঠশালা… একাই এসেছে। মোট তিরিশজনের আসার কথা… তুমি হলে গিয়ে কুড়ি নম্বর… এখনো দশ জন বাকি…উফফ… সকাল থেকে এই করতেই আমার দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে…”।

          বলতে বলতেই সে পাশে রাখা ব্যাগগুলো থেকে একটা ব্যাগ তুলে হাতুশিকে দিল, “এটা তোমার। এর মধ্যে তোমার প্রয়োজনীয় সব জিনিস আছে। এখান থেকে সোজা নৈঋত কোণে চলে যাও। ওই যে ছাতিম গাছটা দেখছ, ওটা পেরিয়ে। ওই যে দূরের হলুদ ফুলে ভরা কনকচূড়া গাছ দেখছ, ওইখানে গেলেই দেখতে পাবে তোমাদের থাকার জায়গা। এক একটা ঘরে দশজন করে থাকার ব্যবস্থা। তুমি যাবে দুই নম্বরের ঘরে। আরও অনেক পশুয়া আছে ওখানে। গেলেই দেখতে পাবে।”

          কনকচূড়া গাছের কাছে গিয়েই তাক লেগে গেল তার। বাপরে! চারিদিকে যেন পশুয়াদের মেলা বসে গেছে। একদিকে এক হরিণীকে জড়িয়ে ধরে তার বাবা হাউহাউ করে কাঁদছে, অন্যদিকে একটা মোটাসোটা ভালুকছানাকে তার মা সমানে তর্জন গর্জন করে যাচ্ছে। হাতুশি একটু সরেই দাঁড়াল। পাশেই এক খরগোশ মা-বাবা-ছেলের জোর কথাবার্তা চলছে। তার মা বোঝাচ্ছে, “দ্যাখ, খরগোরেস, দূরে দেখতে পাচ্ছিস, ওই কচ্ছপ মেয়েটাকে? আমাদের সেই পূর্বপুরুষ বা পূর্বমহিলা খরগোশের কথা মনে আছে তো, যে কচ্ছপের কাছে হেরে গিয়েছিল? বলা যায় না, এখানেও কিন্তু ওরা কচ্ছপের সঙ্গে রেস লাগিয়ে দিতে পারে। সেরকম হলে একদম ঘুমিয়ে পড়বি না কিন্তু। তাহলেই হেরে যাবি।”

          বাচ্চা খরগোশ, যার নাম কিনা খরগোরেস, সে সরল মুখে বলল, “কিন্তু মা, খরগেস্টকাকু বলছিল যে, আগের রাতে অনুষ্ঠানের আয়োজকরা নাকি খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিল আর তাইতেই তিনি কচ্ছপের কাছে হেরে যান।”

          খরগোরেসের বাবা গলা তুললেন, “শোনো, সে হতেই পারে। আমারও তাই ধারণা। কিন্তু তুমি সতর্ক থাকবে। আলাদা করে কেউ কিছু দিতে এলে খাবে না। আর কিছুতেই রেসের সময় ঘুমিয়ে পড়বে না।”

          হাতুশি ভাবল, এবার বরং কচ্ছপদের কাছে গিয়ে দেখি ওদের হালচাল। গুটিগুটি থাবায় তাদের কাছে গিয়ে হাতুশি দেখে সেখানে সেই ছোট কচ্ছপের বাবা তাকে উপদেশ দিচ্ছে, “শোন্‌, যদি তোর খরগোশের সঙ্গে রেস হয়েই যায়, মনে রাখিস, এবারে অত সহজ হবে না। কিন্তু তুই শেষ অব্দি থামবি না। তোকে  কী শিখিয়েছিলাম, বল্‌ তো কচ্ছপিকা?”

          কচ্ছপিকা খুব ধীরে ধীরে বলল, “স্লো অ্যাণ্ড স্টেডি উইনস দা রেস।”

          হাতুশি বিভোর হয়ে শুনছে, এমন সময় কে যেন পেছন থেকে তার থাবায় আলগা টোকা দিল। হাতুশি পেছনে তাকিয়ে দ্যাখে, একটা বাচ্চা মেয়ে শজারু! সে বলল, “মজা দেখছ বুঝি? আমি সকাল থেকে মজা দেখে দেখে হেদিয়ে গেলুম!”

          হাতুশি হাসল, “তুমি বুঝি সকালেই এসেছ? আমার দেরি হয়ে গেল রাস্তায়। তা তোমার নাম কী? আমার নাম হাতুশি।”

          শজারু বলল, “আমার নাম শজারুই।”

          হাতুশি ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “তোমাদের এরকম নাম হয় বুঝি? সোজা রুই, বাঁকা রুই? উল্টো রুই? পাল্টা রুই?”

          শজারুই সারা গায়ে ঝাঁকুনি দিয়ে ঝনঝন আওয়াজ তুলে বলল, “আরে, না না। সোজা রুই নয়। আমার নাম শজারুই। তালব্য শ, বর্গ জ-এ আ-কার…”

          হাতুশি বলল, “থাক্‌, থাক্‌, বুঝেছি।”

          শজারুই গলা নীচু, “ঠিক আছে। চলো, তোমার হাতে দেখছি কুড়ি নম্বর লেখা। মানে দু নম্বর ঘর। আমারও তাই। ওদিকে দেখে এলাম, খাবার জায়গা বেবাক খালি। গরম গরম লুচি, ছোলার ডাল আর রসগোল্লার ব্যবস্থা। চলো, এইবেলা খেয়ে নি। একটু পরেই এদের বাবামায়েরা সব চলে যাবে, আর খাবারের লাইন লেগে যাবে। চলো, চলো।”

          পাশেই বট, অশ্বত্থ, ছাতিম, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, শিমূল গাছের ছাওয়ায় ঢাকা সরু একটা রাস্তা চলে গেছে। সজারু বেশ গ্রাম্ভারি চালে বলল, “এটা হল তিনের ক’ নম্বরের শুঁড়িপথ। এদিক দিয়েও আসা যায়। আমি কী করেছিলাম, জানো? পরশুদিন একবার এসে সব ভালো করে দেখেশুনে গেছি। তাই আজ চটপট চটপট পৌঁছে গেছি।”

          হাতুশি অবাক হয়ে বলল, “সে কী? তোমার পরশু পাঠশালা ছিল না?”

          শজারুই ফিকফিক হাসল, “আরে দূর! আমি এখানে আসব বলে পাঠশালা থেকে সাতদিনের ছুটি পেয়েছিলাম না? তুমি ছুটি পাওনি?”

          শুনেই হাতুশির শুঁড় উঠে গেছে মাথার ওপরে, “তা তোর মানে তোমার পাঠশালার নাম কী?”

          শজারুই মিটিমিটি তাকাল, “তুই বললেই ভালো। আমরা বন্ধু হয়ে গেছি কিনা। আমাদের পাঠশালার নাম ছোটাছুটিশালা।”

          হাতুশি হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, “এ আবার কেমনতরো নাম?”

          শজারুই ঝুনঝুন করে গায়ের কাঁটা নাচিয়ে বলল, “বুঝলি না? হয় আমাদের পাঠশালা ছুটি থাকে, নয় আমরা বেশির ভাগ সময় পাঠশালায় ছোটাদৌড়া করি। দৌড়োনোর জন্য ‘ছোটা’ আর ছুটি থাকে বলে ‘ছুটি’। তাই ছোটাছুটিশালা।”

          হাতুশি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই চোখে পড়ল, শামিয়ানা টাঙানো একটা বড় জায়গা আর তার ওপরে লেখা ‘আহা রে! আহারে!’

          বেশ মজা লাগছে হাতুশির। যা দেখছে, যা শুনছে- সবই ভারি চমৎকার! ‘আহার’ মানে যে খাওয়া সে ও ভালোই জানে। তাই চটপট শুঁড় দুলিয়ে ঢুকে পড়ল শজারুর পিছু পিছু! ঢুকেই তাজ্জব! উরিব্বাস! এককোণায় ছোট্ট একটা ঝোরা থেকে কুলকুল করে জল বয়ে এসে একপাশে সরু একটা নালা দিয়ে বয়ে চলে যাচ্ছে। থাবা ধোবার জন্য পাশে সাবানও রাখা আছে।

          সাবান দিয়ে থাবা পরিষ্কার করে খেতে বসল দুজনে। গোবর দিয়ে নিকানো মেঝের উপর শতরঞ্জি পাতা। এদিক ওদিক খানকয়েক কেঁদো কেঁদো চেহারার ভালুক গামছা পরে শশব্যস্ত হয়ে বড় বড় বালতি হাতে ছোটাছুটি করছে। আর একটা সিড়িংগে চেহারার শিয়াল এক পাশে দাঁড়িয়ে তদারকি করছে। ওদের দেখেই একটা ভালুকমাসী চেঁচিয়ে উঠল, “এই যে অতিথি মহোদয়ারা, এদিকে আসতে আজ্ঞা হোক। বসতে আজ্ঞা হোক।”

          হাতুশি গিয়ে লাজুক লাজুক মুখে বসে পড়ল। শজারুইয়ের অবশ্য অত লজ্জাবোধ নেই। হাতুশির পাশে ধপ করে বসেই ফিসফিস করে বলল, “বুঝলি, খাওয়াদাওয়া মনে হচ্ছে বেশ জোরদারই হবে।”

          তা হলও বা। ভরপেট লুচি, ছোলার ডাল আর রসগোল্লা খেয়ে দুজনেরই হাঁসফাঁস দশা। দূরের দিকে একপাল বাচ্চা শিয়াল হুয়াহুয়া করতে করতে খাচ্ছে। সিড়িংগে চেহারার শিয়ালটা কাছে এসে বলল, “বুঝলে খুকুমণিরা, একদম লজ্জা করবে না। নিজেদের পাঠশালা মনে করে যত খুশি খেও।”

          খাওয়াদাওয়া শেষ হতে না হতেই হই হই করতে করতে অনেক জন্তুজানোয়ার ঢুকে পড়ল। শজারুই চোখের ইশারা করে বলল, “কী বলেছিলাম?”, বলেই ঝুনুক ঝুনুক আওয়াজ তুলে বলল, “আমার সাথে রইলে ‘পরে/ ফায়দা পাবি ধীরে ধীরে!”

          হাতুশি ততক্ষণে বুঝে গেছে যে শজারুই একটু বাগাড়ম্বর করে ঠিকই, কিন্তু মোটের উপর মনটা ভালো। খাওয়া দাওয়া শেষে ঘরে ঢুকল ওরা। ঘর মানে ওরকমই একটা শামিয়ানা টাঙিয়ে ভেতরে বিছানা ফেলে থাকার ব্যবস্থা। হাতুশির মন্দ লাগল না। প্রত্যেকের জন্যই একটা করে পড়াশোনার টেবিল আর একটা করে ছোট আলমারি রাখা। শজারুই বলল, “তোর পাশের বিছানাটায় আমি থাকব। দাঁড়া, আমার কাঁটাগুলো ব্যথা করছে। একটু গড়িয়ে নিই।”

          বলেই সে ধপাস করে শুয়ে ফুর ফুর করে হালকা নাক ডাকতে শুরু করল। হাতুশি কাঠচশমালীর দেওয়া ব্যাগখানা খুলল। আরিব্বাস! কত কী জিনিস! একটা গামছা, একটা চাদর, একটা লেজস্ত্রাণ, পেনসিল, কলম, রাবার, পেনছিল ছোলার কল, খাতা, দন্তমঞ্জন, নিমডালের দাঁতন এক গোছা, – আরও কত কী জিনিস!

          হাতুশি সব গুছিয়ে তুলে রাখল তার আলমারিতে। ওর পাঠশালার বন্ধুদের কথা মনে হতেই চোখদুটো জ্বালা করে উঠল! ইসস, হিনিমিনিটা এলে কত্ত মজা হত। বাঘুটারও ইচ্ছে ছিল বড্ডো। ওরা সবাই নিশ্চয়ই এখন দিদিমণির কাছে পড়া করছে!

          হাতুশি বাড়ি থেকে আনা ওর খাতাটা টেনে নিল। সকাল থেকে যা যা হয়েছে, সব এতে লিখে রাখবে। প্রতিদিনের রোজনামচা। তন্ময় হয়ে লিখতে শুরু করল।

          একমনে লিখে যাচ্ছে, আচমকা পিঠে ধাঁই করে কিল! চমকে দ্যাখে হাতুশি, তার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে সিংহালু হি হি করে হাসছে! হাতুশি ভারি অবাক। সিংহালু হাসতে হাসতেই বলল, “আমি তো তোমার পরপরই ঢুকেছি একুশ নম্বরে। তুমি তখনই অন্যদিকে চলে গেলে। আমি তো জানতামই যে দিদিমণির ওখান থেকে তুমিই আসবে। আমি তোমাকেই ভোট দিয়েছিলাম কিনা।”, তারপরই ফিসফিস করে বলল, “জানো হাতুশিদি, আমাদের গুজরাটের কচ্ছের রাণে বুনো গাধাদের একটা পাঠশালাও চলে। ওখান থেকে একটা গাধাও আসবে শুনেছি। তার নাম গাধুয়া। হিহি! তার কাণ্ডকারখানা নিশ্চয়ই দেখার মতো হবে! হিহি!”

          সিংহালু বকবক করে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। পাঠশালার সবার খবর নিল। কথার আওয়াজে চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসেছে শজারুই। তার সঙ্গে সিংহালুর পরিচয় করে দিল হাতুশি।

          ওদের কথাবার্তার ফাঁকেই ঢং ঢং করে বেজায় জোরে ঘন্টা বাজল। শজারুই বিছানার উপর গ্যাঁট হয়ে বসে বলল, “এটা নির্ঘাত চানে যাবার ঘন্টা।”

          শামিয়ানার দেওয়ালের কাপড়ের এক এক জায়গায় জানালার মতন করা আছে। তাই দিয়ে উঁকি মারল হাতুশি। কাঠচশমালী জোরে জোরে ঘন্টা বাজাচ্ছে। তারপরই পাশে রাখা একটা চোঙা টেনে নিয়ে বেজায় মুরুব্বির ভঙ্গিতে বলতে শুরু করল, “এতদ্দ্বারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হইতে আগত পশুয়াসকলকে জানানো যাইতেছে যে, তারা যেন অবিলম্বে স্নানাদি ক্রিয়া সম্পন্ন করে। নচেৎ ভোজনাদি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হইতে বিলম্ব হইয়া যাইবে। আহারকক্ষের পিছনেই উলুঝুলু নদী। সকল পশুয়াকে বলা হইতেছে, তারা যেন উলুঝুলু নদীতে গিয়া সত্ত্বর স্নান সারিয়া লয়। আজ পাঠশালা মহাসভার প্রথম দিন। সেইহেতু বিশেষ কর্মসূচী নাই। আহারান্তে পাঠশালা মহাসভার অধ্যক্ষা, মাননীয়া শিয়ালিকা বিদ্যাচন্দ্রিকা মহাশয়া তোমাদিগের সহিত মিলিত হইবেন এবং পরিচয় পর্ব হইবে। তোমরা সকলে আজ পরস্পরের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করিবে, চারিদিক ঘুরিয়া দেখিবে।”

          শজারু মুচকি হেসে বলল, “কেমনটি? কী বলেছিলাম? চানেরই ঘন্টা। চল্‌ ঝটপট চান সারি, নইলে আবার খাবার জায়গায় ভিড় হয়ে যাবে।”

          ছুটোছুটি হুটোপাটি করে চান সেরে উঠে আসতে আসতেই দেখা কাঠচশমালীর সঙ্গে। কাঁধে একখানা গামছা ফেলে নাইতে যাচ্ছে। ওদের দেখেই বলল, “বাঃ! বাঃ! লক্ষ্মীসোনা সব! বলতে না বলতেই চান সেরে নিয়েছে। তাড়াতাড়ি যাও। তোমাদের জন্য দুর্দান্ত সব রান্না হয়েছে!”

          শজারুইকে সব কিছুই আগেভাগে জানতে হয়। সে ফস করে জিজ্ঞেস করল, “কী রান্না হয়েছে, মশয়া?”

          শজারুই আগেই খোঁজ নিয়ে নিয়েছে, এখানে স্যারেদের ‘মশাই’ আর দিদিমণিদের ‘মশয়া’ বলতে হয়। ‘মশয়া’ বলায় কাঠচশমালী দারুণ খুশি। উলুস উলুস করে জিভের জল টেনে বলল, “আজ রান্না হয়েছে- ডিমের যা তা, এঁচোড় ভুলভাল আর দইয়ের ছানাবড়া! আরও কিছু থাকবে।”

হাতুশি শুকনো শুঁড়ে শুধোল, “আমি তো ডিম খাই না। আমি তাহলে কী খাবো?”

কাঠচশমালী বলল, “তোমার জন্য মোচার লবডঙ্কা থাকবে। ইসস, তোমাদের সব বলে দিলাম যে! বিদ্যাচন্দ্রিকা মহোদয়া জানতে পারলে আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে!”, বলেই দৌড়োতে দৌড়োতে চলে গেল।

তা খাওয়াদাওয়া ভালোই হল। হরেক কিসিমের জন্তুজানোয়ারেরা পাশাপাশি বসে খাচ্ছে। দু’ একজনের এখনো তেমন বন্ধু হয়নি, তারা একাই খাচ্ছে। খরগোরেস আর কচ্ছপিকা পাশাপাশি বসেছে আর আড়ে আড়ে একে অন্যজনকে দেখছে।

একটু পরেই হাতুশির চোখ পুরোপুরি ছানাবড়াই হয়ে গেল। গুটিগুটি থাবায় একটা ছানা বাঘের সঙ্গে এদিকেই এগিয়ে আসছে বাঘনি! সঙ্গে আরেকটা ছানা বাঘ। বাঘনি হাতুশিকে দেখেই তাড়াহুড়ো করে লাফিয়ে লাফিয়ে আসতে গেছে। আর সেইসময় নাদুসনুদুস চেহারার এক ভালুককাকু ‘ডিমের যা তা’ বালতিতে নিয়ে পরিবেশন করতে আসছিল। সটান বাঘনির সঙ্গে ধাক্কা আর চারিদিকে ডিম ছড়িয়ে সত্যিই জায়গাটা যা তা হয়ে গেল!

শজারুই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “সার্থক নাম!”

যাইহোক, এপাশ ওপাশ থেকে ভালুকেরা ছুটে এসে জায়গাটা পরিষ্কার করল। বাঘনি আর সেই ভালুককাকুকেও তোলা হল। কাঠচশমালী একবার এসে ঘোষণা করে দিয়ে গেল যে, এরপর চারটের সময় ঘন্টা পড়বে। ঘন্টা পড়লেই সবাই যেন ‘ভাষণ ভবনে’ চলে যায়। শিয়ালিকা বিদ্যাচন্দ্রিকা ওখানেই সবার সঙ্গে পরিচয় সেরে ভাষণ দেবেন।

পরিপাটি ভোজনের পর জমাটি গল্পগাছা! বাঘনির সঙ্গের বাচ্চা বাঘটার নাম বাঘনে। সে বাঘনিদের পাশের পাঠশালায় পড়ে। ওরা দুজন একসংগেই এসেছে। সিংহালু এসেছে সিংহাই মাসীর সঙ্গে পশু প্লেনে চড়ে। নেমেছে জানোয়ার তালুকে। সেখান থেকে বনবাহনে চেপে জানোয়ার মুলুক অব্দি এসেছে। বাকিটা হাঁটা। সিংহাই মাসীরও কিসব কাজকর্ম আছে এখানে। সিংহালুর হয়ে গেলে একসংগেই ফিরবে।

আরও কত নতুন কথা শুনল হাতুশি। ওদের ওখানে বাইরের খবর, বিশেষত মানুষদের খবর বড় একটা আসে না। বাঘনি, বাঘনে, সিংহালু অনেক খবর রাখে। মানুষেরা নাকি এখন সবাই ঘরবন্দী। খুব দরকার ছাড়া বেরোয় না। করোনা নামে কিসব ভয়ানক রোগ ছড়াচ্ছে, এক মানুষের থেকে আরেকজনের মিশে যাচ্ছে। তারপর নাকি ভয়ংকর সব ঘুর্ণিঝড় হচ্ছে। ওদের গুজরাটে হল টাউকটে। সেইসময় সিংহালুদের বনজঙ্গল ভেসে গিয়েছিল। ওরা সব পাশের বনে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল।

বাঘনে বলল, “তারপরেই তো যশ নামের ঘূর্ণিঝড় হল।” বাঘনি শুধরে দিল, “আরে যশ কোথায়? ওটা তো ইয়াস!”

এসব গল্পে গল্পেই ঢং ঢং করে ঘন্টা পড়ে গেল চারটের। ওরা গিয়ে ঢুকল ‘ভাষণ ভবনে’। ওরা বসার পরে মঞ্চে বেশ ভারিক্কি চেহারার কয়েকজন শিয়াল ঢুকলেন। প্রথমের জনকে দেখে ওরা এক ঝলকেই বুঝে গেল যে ইনিই শিয়ালিকা বিদ্যাচন্দ্রিকা। তিনি একে একে পরিচয় করিয়ে দিলেন বাকি সবার সঙ্গে- শিয়ালশাই পণ্ডিতধাঁই, শিয়ালুর ফুরফুর, শিয়ালমণি পণ্ডিতজ্ঞানী, শিয়ালেজ মহাতেজ, শিয়ালমঞ্জরী ধাঁইকিড়ি।

          ওরা সবাই এক এক করে উঠে দাঁড়িয়ে নিজেদের পরিচয় দিল। নিজের নাম, পাঠশালার নাম এইসব। গাধুয়া উঠে দাঁড়াতেই বাচ্চাদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। কারণ গাধুয়ার চোখে ইয়াব্বড়ো চশমা, খাড়াখাড়া কান। দেখতেও অনেকটাই বড়ো। সিংহালু ফিসফিস করে বলল, “ও এতদিনে একবারই মাত্র ক্লাসের পরীক্ষায় পাশ করেছে। কিন্তু ও ছাড়া আর কেউ একবারও পাশ করেনি কিনা, তাই ওকেই পাঠিয়েছে।”

          গাধুয়া এদিকে বলতে শুরু করেছে, “নমস্কার দিদিমণিরা ও দাদামণিরা। আমি হলাম এখানে সবার মধ্যে বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। আজ দশ বছর ধরে একটানা পাঠশালায় পড়ছি। মনে হয়না এখানে আর কারুর পাঠশালা সম্পর্কে এত জ্ঞান আছে। আমার নাম গাধুয়া। আমি এসেছি বিখ্যাত ‘গর্দভ গাধুশালা’ থেকে।  আমি এই দুদিন আগেই ‘গাধাচূড়ামণি’ খেতাব পেয়েছি। গর্দভেশ্বর রাসভেন্দ্র আমাদের পাঠশালার প্রধান। টানা আঠেরো বছর তিনি সব পরীক্ষায় শূন্য পেয়েছেন। ফলে বুঝতেই পারছেন…।”

          শিয়ালিকা বিদ্যাচন্দ্রিকার জোরালো গলার আওয়াজে আচমকা থেমে গেল সব। “গাধুয়া, তুমি বোসো। এটা বাচালতার জায়গা নয়।”

          গাধুয়া বসে পড়ে পাশে বসা এক গণ্ডারকে হেঁড়ে গলায় জিজ্ঞেস করল, “বাচালতা মানে কী বলো তো দেখি?”

          আর কিছু গোলমাল হল না তেমন। শিয়ালিকা বিদ্যাচন্দ্রিকা বেশ জমজমাট বক্তব্য রাখলেন- সকলকে জন্তুর মত জন্তু হতে হবে। হতে হলে উন্নত জানোয়ার, ‘পাঠশালা মহাসভা’ দরকার। খোলা রাখো চোখ-কান-লেজ, হবে পশু মহাতেজ। হবে পশু বলীয়ান, পড়ো বই ঢালি প্রাণ।

 

          চাঁদনি রাত। ঝরো ঝরো চাঁদের হাসি শব্দহীন জলধারার মতো ধুইয়ে দিচ্ছে বনের আনাচ কানাচ। আধো ঘুমন্ত পাখিরা আর গাছেরা মায়ামাখানো সেই আলোর চাদরের ওম মেখে তলিয়ে যাচ্ছে গভীর ঘুমে।

          পাঠশালা মহাসভায় হাতুশিদের নৈশভোজ সাঙ্গ হয়েছে সবে। খোলা জায়গার মাঝে এক বিশাল নিমগাছ। ঝিরিঝিরি হাওয়া। চাঁদের আলোয় চিকচিক পাতা। নিমগাছের তলায় জোর মজলিশ বসেছে হাতুশিদের। খরগোরেস পাঁইপাঁই করে মাঠের চারপাশে পাক দিয়ে যাচ্ছে তো দিয়েই যাচ্ছে। দূরে একটা বাদাম গাছের তলায় গাধুয়ার অস্পষ্ট আদল দেখা যাচ্ছে আর তার হেঁড়ে গলায় গলা সাধা ভেসে আসছে… “মা… পা… মা মা… পা পা… গা… ধা… গা ধা… গা ধা… গা আআআআ ধা আআআআ……”     

          তিন নম্বর ঘর থেকে সরু-মোটা নানারকম গলায় চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে, ‘আজ আমি চায়ের সঙ্গে মাখন খেতে পাইনি’, ‘আমার ছোলাসেদ্ধর সঙ্গে পান্তুয়া খাবার অভ্যেস, এখানে কোন ব্যবস্থা নেই’, ‘আমি রোজ দইভাজার সঙ্গে তেঁতুলের শরবত খাই, আমার মা চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিল- তাও কোন ব্যবস্থা রাখেনি’, ‘আমি প্রতিদিন ভোরে উঠেই পাঁপড়সেদ্ধ খাই, কাল পাব কিনা কে জানে’!   

          হাতুশি, শজারুই, বাঘনে, বাঘনি, সিংহালু মিলে গোল হয়ে বসে জোর আলোচনা বসেছে। আর হনুমনু নামের এক বাচ্চা হনুমান। সে আবার নাকি হিনিমিনির কিসব দূর  সম্পর্কের ভাই হয়। কাল থেকে এখানে পুরোদস্তুর কর্মসূচী শুরু হবে, সেই নিয়ে প্রবল উত্তেজনা। শজারুই এদিক ওদিক বিস্তর খবর জোগাড় করে এনেছে। ও নাকি বড় হয়ে ‘জানোয়ার বার্তা’য় সাংবাদিক হবে! শিয়ালেজ মহাতেজের সত্যিই নাকি মহাতেজ! তিনি পশুয়াদের বেচাল মোটেই বরদাস্ত করেন না। ওরা আসার সময় তিনিই দাঁড়িয়েছিলেন মহাসভার বাইরে। শিয়ালিকা বিদ্যাচন্দ্রিকা খুব জ্ঞানী, প্রচুর বই পড়েন। শিয়ালুর ফুরফুর রান্নাবান্নার তদারকি করেন। শিয়ালশাই পণ্ডিতধাঁই আর শিয়ালমণি পণ্ডিতজ্ঞানী ওদের পড়ার ব্যাপারটা দেখবেন। শিয়ালমঞ্জরী ধাঁইকিড়ি সকালের ব্যায়াম, শারীরিক কসরত আর সন্ধেবেলার অনুষ্ঠান এসবের দায়িত্বে। গাধুয়া নাকি এরমধ্যেই তাঁর কাছে গিয়ে গান গাইবার জন্য নাম লিখিয়ে এসেছে। গণ্ডামণ্ডা নামের যে গণ্ডারটা, তার আবার ভয়ানক গোঁ! গণ্ডারনীর পাঠশালা থেকে এসেছে। সে গিয়ে শিয়ালুর ফুরফুরকে বলে এসেছে রোজ যেন তাকে গরম ভাতে ঘি-নুন-লেবু দেওয়া হয় আর বিকেলে গণ্ডাদশেক ঘাসের পরোটা আর যে কোন ফুলের চাটনি!

          কথার মাঝেই কাঠচশমালী এসে ঘন্টা বাজিয়ে ঘোষণা করে দিল- পশুয়ারা! শুইতে যাও বাছারা! ভোর ভোর উঠিবে, শরীর ভালো থাকিবে।

          বিছানায় শুয়ে হাতুশির একটু একটু মন খারাপ করছিল মায়ের জন্য। কিন্তু পাশে শুয়ে থাকা শজারুর বকবকানি শুনতে শুনতে আর পাশবালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল এক সময়!

          হাতুশির ভোর ভোর ওঠা অভ্যেস। ভোরে উঠেই দাঁত মুখ মেজেটেজে ঘুরছিল এপাশ ওপাশ। ভোরের হাওয়ার মিষ্টি আমেজ। এমন সময় চোখে পড়ল, একটা গাছের তলায় বসে গাধুয়া হাতে একটা আয়না নিয়ে আচ্ছাটি করে কানে, মুখে পাউডার ঘষছে। এমনকি, চশমার কাঁচটাকে অব্দি পাউডার মাখাচ্ছে। হাতুশিকে দেখে গর্বভরা গলায় বলল, “আমায় দেখতে বেশ রাজপুত্তুরের মত লাগছে না!” খেয়াল করে দেখল হাতুশি, ওর হাতে ধরা আয়নায় পিছনের হরিণীকে দেখা যাচ্ছে। হরিণী একটা বুরুশ হাতে নিয়ে মাথার শিঙগুলো পরিপাটি করে আঁচড়াচ্ছে, গায়ের লোম ঠিকঠাক করছে, চোখে কাজল ঘষছে! গাধুয়া এদিকে সাজগোজ সেরে উঠে দাঁড়াল, “যাই, হরিণীর সঙ্গে দুটো কথা কয়ে আসি।”, বলেই সামনে ফুটে থাকা ঝোপের থেকে একটা ঘেঁটুফুল পটাস করে ছিঁড়ে নিয়ে ভাব জমাতে গেল হরিণীর সঙ্গে।  

হাতুশি পুরো হাঁ! কত কিসিমের যে জন্তু আছে না এলে জানতেই পারত না! এদিকে খরগোরেস ভোরে উঠেই ফের পাঁইপাঁই করে দৌড় শুরু করে দিয়েছে।

একটু পরেই শুরু হয়ে গেল হইহই। কাঠচশমালী ঘোষণা করল- হাত মুখ ধোও সবে, খাও মধুলেবু জল / লাইন করে দাঁড়াও এবে, পশুয়া সকল!  

            লাইনে দাঁড়ানো মেয়েদের সাদা রঙের স্কার্ট আর ছেলেদের সাদা রঙের হাফপ্যান্ট বিতরণ হল। আর লাল, সবুজ, কমলা রঙের বেল্ট। কোমরে আটকাবার জন্য। সঙ্গে থাবার মাপ অনুযায়ী সাদা রঙের কেডস। শজারুই ফিসফিস করে বলল, “হাতুশি, মজাটা দ্যাখ। গাধুয়াটা নিচু হয়ে হরিণীর কেডসের ফিতে বেঁধে দিচ্ছে! হি হি!”

          মজার আরও বাকি ছিল। হাতুশির সামনে একটা ভালুক, তার নাম ভালুকা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাফপ্যান্ট পরতে পরতে একদম উল্টেই পড়ে গেল। শিয়ালমঞ্জরী ছুটে আসতে না আসতেই ভালুকা তাঁর পা জড়িয়ে ধরল, “ওগো মশয়া গো, আমি ঘুমের চোটে উল্টেই পড়ে যাচ্ছি গো! আমি কেডস মাথায় দিয়ে এখানেই চাট্টি ঘুমিয়ে পড়ি গো! নতুন কেডস গো, বালিশ করা যেতেই পারে গো!”

          ভালুকাকে ধমক ধামক দিয়ে লাইনে দাঁড় করানো হল। হাতুশি ভয়ে ভয়ে সরে দাঁড়াল। বলা যায় না, ঘুমের ঘোরে এবার যদি তার গায়েই উল্টে পড়ে যায়!

সকালবেলার শারীরিক কসরতের পর ছোলাসেদ্ধ আর গুড় দেওয়া হল সবার থাবায় থাবায়। হনুমনু কান্না জুড়ল কলার জন্য। গণ্ডামণ্ডার গোঁ, দুপুরে তার ঘাসের পোলাও লাগবে। হইচই শুনে গাধুয়া এসেছে ছুটে। তার আর হরিণীর দুপুরে পাকা পেয়ারার চচ্চড়ি চাই-ই চাই!

শিয়ালুর ফুরফুর দিশেহারা! এমন সময় কোন্‌দিক থেকে শিয়ালেজ মহাতেজ হাজির! তার ধমকের চোটে নিমেষে সব ছত্রভঙ্গ।

ক্লাসগুলো হাতুশির ভালো লাগছে বেজায়। প্রত্যেককে একটা করে ফুল বা পাতা ধরিয়ে দিয়ে কী কী দেখছে লিখতে বলা হচ্ছে। কিংবা ‘মশাই’ বা ‘মশয়া’ গোল করে কয়েকটা দল করে দিচ্ছেন। তারপর একটা বা দুটো লাইন বলে দিচ্ছেন। বাকি সবাইকে পরপর মুখেমুখে লাইন বানিয়ে একটা গল্প শেষ করতে হবে। আঁকার ক্লাসে বলা হচ্ছে, তোমার আশেপাশের কোন বন্ধুর ছবি আঁকো।

প্রতিটা ক্লাসই নতুন ধরনের। প্রতিটা ক্লাসেই অফুরান মজা। সন্ধেবেলায় আসর বসে। ‘ময়ূর নৃত্যে’র দিন চটাপট চটাপট থাবাতালি পড়ছে তো পড়ছেই। নাচ করছে ময়ূরকুলের বিখ্যাত নাচিয়ে ময়ূরাট নর্তনসম্রাট। এমন সময় গাধুয়া হঠাৎ করে মঞ্চে উঠে বলল, “ময়ূরদাদা’র নাচের সঙ্গে আমি গাইব। কারুর আপত্তি নেই তো?” সমস্বরে রব উঠল- আপত্তি আছে! আপত্তি আছে!

গাধুয়া মুখ ফেরাল, “ময়ূরাটদাদা, তাহলে তোমার নাচ বরং থাকুক। আমি একাই গান গাই!”

গাধুয়া যেই না বলেছে, আর যায় কোথা! গণ্ডামণ্ডা, ভালুকা, বাঘনে আর বাঘনি গিয়ে গাধুয়ার চারটে পা ধরে তাকে চ্যাংদোলা করে শিয়ালেজ মহাতেজমশাইয়ের জিম্মা করে দিয়ে এল।

এরপর একদিন সত্যিসত্যিই ঘোষণা হল যে পরের দিন খরগোরেস আর কচ্ছপিকার দৌড় প্রতিযোগিতা হবে।   সেই শোনা ইস্তক খরগোরেস আর ক্লাসেও গেল না, অনুষ্ঠানও শুনল না। হাতুশি তাকে সবসময়ই দেখে, পাঁইপাঁই করে ছুটে যাচ্ছে তো ছুটেই যাচ্ছে। হাতুশিকে বললও খরগোরেস, “বুঝলি, এ হল আমাদের খরগোশকুলের ইজ্জত কা সওয়াল। সেই যে ঐতিহাসিক দৌড় হয়েছিল এবং তাতে যে ঐতিহাসিক ভুল হয়েছিল, সে ভুল সংশোধনের দায়িত্ব আমার।”

খরগোরেস খাওয়া দাওয়াও প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। পাছে বেশি খেয়ে ঘুম পায় কিংবা খাবারে কেউ ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয়! ওদিকে কচ্ছপিকা দিব্যি আছে। খাচ্ছে, দাচ্ছে, ক্লাস করছে, রাত হলে ফূর্তিতে ঘুমোচ্ছে।

রেসের দিন সকালে মাঠে গিয়ে হাতুশি দেখে, খরগোরেস শুকিয়ে এইটুকুনি হয়ে গেছে। চোখের তলায় কালি। পাছে রেসের সময় ঘুমিয়ে পড়ে, সেই ভয়ে সারারাত ঘুমোয়নি পর্যন্ত। সারারাতই নাকি মাঠে দৌড় প্র্যাকটিস করেছে। হাতুশিকে দেখে চিঁ চিঁ করে বলল, “দ্যাখ, কচ্ছপিকাকে আজ যদি না আমি হারিয়েছি…”, বলতে না বলতেই বিশাল বড় বড় খানকয়েক হাই উঠে কথাটাই আর শেষ হল না তার।

যাইহোক, রেস তো শুরু হল। জন্তুজানোয়ায়েরা দু’ভাগ হয়ে গেছে। একদল চ্যাঁচাচ্ছে- খরগোরেস, খরগোরেস/ জিতবে তুমি, হাসবে দেশ! কচ্ছপিকার সমর্থকেরা আওয়াজ তুলেছে- কচ্ছপিকা, কচ্ছপিকা/ কপালে তোমার জয়টিকা!

দুজনেই হাতুশির বন্ধু। তাই হাতুশি কারুর দলেই ভেড়েনি। একমনে দেখে যাচ্ছে। সব মশাই, মশয়ারাই আছেন। শিয়ালমঞ্জরী ধাঁইকিড়ি ফুরর করে বাঁশি বাজিয়ে দিলেন। মাঠের এমাথা থেকে ওমাথা দৌড়। মাঝখানে নিমগাছ। হাতুশি দেখল খরগোরেস কেমন যেন ধুঁকছে। বাঁশি বাজতে না বাজতেই ছুটল বটে খরগোরেস, কিন্তু যেন তার শরীর টানছে না। একটু যাচ্ছে আর সমানে পিছন ফিরে তাকাচ্ছে। কচ্ছপিকা ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। নিমগাছের কাছে পৌঁছে খরগোরেস দেখে, কচ্ছপিকা সবে শুরুর জায়গা থেকে সামান্য এগিয়েছে। বড় বড় হাই তুলতে তুলতে খরগোরেস বসল নিমগাছের ছায়ায় আর বসেই গেল উলটে! আর অঘোরে ঘুম!

কচ্ছপিকা গুটি গুটি পায়ে এগিয়েই যাচ্ছে। নিমগাছের তলায় এসে খরগোরেসকে দেখে মুচকি হাসল আর তারপর আস্তে আস্তে এগোল আবার। খরগোরেসের সমর্থকরা জোর রব তুলল, “ওঠো, জাগো খরগোরেস/ দৌড়খানা করো শেষ।”

কচ্ছপিকার দল পাল্টা আওয়াজ তুলল, “জিতবে কে? কচ্ছপিকা!/ মিছে তোদের হাঁকাডাকা!”

এত শোরগোলেও খরগোরেসের ঘুম কি আর ভাঙে? সে দু’দিন দু’রাত ঘুমোয়নি, পেটে দানাপানিও পড়েনি বিশেষ।

কচ্ছপিকা এদিকে পৌঁছে গেল শেষ সীমানায়! শিয়ালিকা বিদ্যাচন্দ্রিকা বললেন, “আমাদের ভয় ছিল, পাছে তুমি জিততে না পারো। তাহলে আবার নতুন করে ইতিহাস লিখতে হত কিনা!”

কচ্ছপিকা লাজুক মুখে হাসল, “আসলে ওদের ওটা ঐতিহাসিক বোকামি কিনা। প্রতিবারেই একই জিনিস হয়। তাই আমি ঘাবড়াইনি।”

হাতুশির পাশ থেকে বাঘনি বলল, “মানুষদেরও এরকম ব্যাপার আছে, দিদি। ওদের খেলায় প্রতি বছরই মা দুগগার কাছে মহিষাসুর হেরে যায়!”

হাতুশির ভালোও লাগছিল আবার খরগোরেসের জন্য একটু একটু খারাপও লাগছিল! আহা, বেচারি! কেন যে এতসব বোকামি করল কে জানে!

 

দেখতে দেখতে ১৮ই জ্যৈষ্ঠ এগিয়ে এল। তার আগের তিনদিন জোরকদমে নানান পড়া হল, অনেক আলোচনা হল আর নতুন নতুন খেলা হল। হাতুশি একদিন ওর মায়ের কাছে শেখা একটা নাচও করল! থাবাতালিও পেল অনেক। সিংহাইমাসীর আবৃত্তি অনুষ্ঠানও হল। সিংহালুও ধাঁধার আসর করল একদিন।

          শজারুই এরমধ্যে আবার খবর এনেছে যে শেষের দিন বিশেষ কিছু পুরষ্কারের ব্যবস্থা থাকছে। কিন্তু কী পুরষ্কার সেটা বলতে পারল না বা চাইল না।

          শেষের দিন সকাল থেকেই সাজো সাজো রব। সকালে দুটো নতুন আসন শেখানো হল ওদের – মানুষমুখাসন আর লাঙ্গুলথাবাসন। শিয়ালমঞ্জরী শেখাতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘লাঙ্গুল’ মানে কে জানে? হাতুশি চটপট শুঁড় তুলে উত্তর দিয়ে দিল লাঙ্গুল মানে লেজ।

          পশুয়াদের সবাইকে একটা করে মানপত্র দেওয়া হল পাঠশালা মহাসভার তরফে আর তার সঙ্গে স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে একটি করে মাটির লেজ। শিয়ালসাই পণ্ডিতধাঁই বললেন, এবারে কেউ একজন এগিয়ে এসে বলো, প্রথম দিন থেকে আজ অব্দি এখানে এসে কী কী দেখলে, কী কী শুনলে, তোমার কেমন লাগল। এক কথায় তোমার এই কয়েকদিনের অভিজ্ঞতা।     

          কেউ ওঠে না প্রথমটায়। হাতুশির শুঁড়ের ভিতর কী সব যেন পাক খেতে থাকল, গলার কাছটা সুড়সুড় করতে থাকল। প্রথম দিন থেকে যা যা হয়েছে সব ছবির মতন ভেসে উঠছে ওর চোখের সামনে। হাতুশি উঠে দাঁড়াল। পেছন থেকে গাধুয়া বলল, “বসে পড় হাতি! কিছু দেখতে পাচ্ছি না।”

          হাতুশি না তাকিয়ে ধীরে ধীরে গিয়ে উঠল মঞ্চে। সভার সবাই তখন তাকে একদৃষ্টে দেখছে। হাতুশি দাঁড়িয়ে সবাইকে নমস্কার জানিয়ে শুরু করল তার কথা। প্রথমদিন থেকে ও যা যা দেখেছে, বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ পরিচয়, সন্ধের অনুষ্ঠান, সকালের আসন, খরগোরেস-কচ্ছপিকার প্রতিযোগিতা, ‘আহা রে! আহারে!”-র খাওয়াদাওয়া – কিছুই বাদ গেল না। সবাই মন্ত্রমুগ্ধ। তার বলা যখন শেষ হতে না হতেই প্রবল থাবাতালি!

          শিয়ালিকা বিদ্যাচন্দ্রিকা অব্দি উঠে দাঁড়িয়ে থাবাতালি দিলেন। বললেন- অপূর্ব!

          এদিকে হাতুশি নিচে গিয়ে বসতে না বসতেই সিংহালু আর বাঘনির সে কী আনন্দ। হাতুশিকে জড়িয়ে ধরে আদর করে টরে একাকার! ওদিকে শিয়ালিকা বিদ্যাচন্দ্রিকা তখন বক্তব্য রাখতে শুরু করেছেন- আজকের এই মহতী অনুষ্ঠানে আমাদের একটি বিশেষ পুরষ্কার আছে। আমরা জানোয়ারকুলের সব পাঠশালাকেই চিঠি পাঠিয়েছিলাম সবচেয়ে উপযুক্ত পশুয়াকে প্রেরণের জন্য। গত সাতদিন ধরে আমরা তাদের পর্যবেক্ষণ করেছি। এবারে সবচেয়ে উপযুক্ত পশুয়ার থাবায় তুলে দেওয়া হবে ‘সেরা পাঠশালা সম্মান।’ কিন্তু… এখন না। পশুয়ারা, ভোজন সমাধা করে এসো। তারপর… এই বিষয়ে পরবর্তী ঘোষণা…”।

 

          এদিকে যখন এইসব চলছে, তখন শিয়ালনীর পাঠশালায় সকাল থেকেই সবাই মনমরা। এমনকি, বাঘুও। পাঠশালা শুরু হতে না হতেই শিয়ালনী বলেছে, “হ্যাঁ রে, হাতুশির খবর জানিস? সেই যে কাছুয়া এসে সেদিন যা খবর দিয়ে গেল, আর কোন খবরই নেই। কেমন আছে, কী করছে, কে জানে?”

          বাঘু সায় দিল, “হ্যাঁ দিদিমণি, আমারও কিরকম খালি খালি লাগছে। মোটে দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে করছে না! একটু আগে ভাবছিলাম, হিনিমিনির গায়ে কালি ছিটিয়ে দেব, সেটাও মন গেল না। এ কি মোটে ভালো কথা হল, দিদিমণি? আমি ভাবছি আমার শরীর খারাপ হল নাকি!”

          কুমরু চেঁচিয়ে উঠল, “দিদিমণি, কাছুয়াদিদি আসার সময় এই চিঠিটা আপনাকে দিতে বলল। ভুলেই গেছি।”

চিঠি পড়েই শিয়ালনীর চোখমুখ গোলগোল, “ওরে, শিগগির চল্‌। পাঠশালা মহাসভা। আজ শেষদিনের অনুষ্ঠানে আমাদেরও আমন্ত্রণ। পা চালিয়ে চল্‌ রে সবাই। পৌঁছে যাবো।”

 খাওয়াদাওয়ার শেষে সভাঘরে উপস্থিত সকলে। শিয়ালিকা বিদ্যাচন্দ্রিকা নাটকীয় ভঙ্গিতে বলছেন, “এখানে অনেকেই আছে যারা এই পুরষ্কারের যোগ্য। শিয়ালকিত, সিংহালু, শজারুই, হাতুশি, বাঘনে, বাঘনি, হনুমনু, – তোমরা সবাই-ই এই পুরষ্কারের যোগ্য। গাধুয়া, তোমার কথা একেবারেই ভাবা হচ্ছে না। পশুয়া হিসেবে তুমি মোটেও যোগ্য নও। আর হরিণী, রাতদিন সাজুগুজু ছেড়ে লেখাপড়ার দিকে মন দাও। যাই হোক, আমাদের আজকের পুরষ্কার… যাচ্ছে…”

সহসা হাতুশির খুব চেনা গলায় প্রবল এক আওয়াজ উঠল পেছন থেকে, “শিয়ালনীর পাঠশালা! শিয়ালনীর পাঠশালা!”

হাতুশি হতবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে, বাঘু প্রবল বিক্রমে গলার শিরা ফুলিয়ে চেঁচাচ্ছে, “শিয়ালনীর পাঠশালা!” আর পেছনে শিয়ালনী দিদিমণি বাঘুর লেজ টেনে তাকে থামানোর আপ্রাণ প্রয়াস করে যাচ্ছেন।

শিয়ালিকা বিদ্যাচন্দ্রিকা ঈষৎ থমকালেন, “ওই যে বাঘের বাচ্চা! তুমি কী করে জানলে যে শিয়ালনীর পাঠশালাই পুরষ্কার পাচ্ছে?”

বাঘু বলল, “দিদিমণি, আমি হলাম বাঘু। বাঘুউউউউ! আর আমার পাঠশালা হল শিয়ালনীর পাঠশালা। আর এখানে এসেছে কে? না হাতুশি! যদিও আমি নিজে আসিনি, কিন্তু হাতুশির উপর ভরসা আছে। তা আমরা না জিতলে জিতবে কে?”

শিয়ালিকা বিদ্যাচন্দ্রিকা রাগলেন না। প্রশ্রয়ের হাসি হাসলেন, “তা হাতুশির কথাই বলি। ওকে দেখে আমরা মুগ্ধ। সময়ের কাজ সময়ে করে, সবার সঙ্গে মেশে, মন দিয়ে পড়া-খেলা সবই করে, রোজ ফাঁক পেলেই এটাসেটা গল্পের বই পড়ে, ডাইরি লেখে। এখানকার ‘পশু পাঠাগারে’ তো ও ছাড়া আর কাউকেই যেতে দেখলাম না। তার উপর খাবারদাবার নিয়ে না আছে বায়নাক্কা, না কোন অপচয় করে! নাচও করেছে একদিন। আর আজ? যা বক্তৃতা করেছে- অসাধারণ! ফলে সেরা পাঠশালার সম্মান পাচ্ছে…”

শিয়ালিকা বিদ্যাচন্দ্রিকাকে আর কথা শেষ করতে হল না। বাঘু আর তার দলবল আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল, “শিয়ালনীর পাঠশালা!”

হাতুশির পাশে বসা শজারুই হাতুশির কানে কানে বলল, “বুঝলি রে, আমি আগেই জেনে গেছিলাম! কিন্তু তোকে বলিনি। যাতে মজাটা থাকে।”

তারপর আর কী? দুর্দান্ত সব পুরষ্কার অপেক্ষা করেছিল ওদের জন্য! তারই এক ফাঁকে বাঘু বলল হাতুশিকে, “বুঝলি রে, আমিও কিন্তু আমার ভোটটা তোকেই দিয়েছিলাম! অবশ্য… ইয়ে… মানে, মনে মনে। আসলে নিজের ভোটটা নিজেকে না দিলে খারাপ দেখায় কিনা… তাই আর কী… হিহি… হিহি… ইয়ে মানে, বুঝতেই পারছিস!”

……০……

অংকনঃ গুঞ্জা 

বাঘু সিরিজের অন্যান্য গল্পগুলি থাবাছানি দিচ্ছে নিচের লিঙ্কেঃ-

১। বাগে এলো বাঘু

২। গিঁটের গেরোয় বাঘু

৩। বাঘু খেল ঘাস

৪। বাঘু হলেন মনিটর

৫। শিয়ালনী কুপোকাত

৬। অযোধ্যা পাহাড়ে বাঘু 

৭। পরীক্ষা দিলেন বাঘু

৮। গণ্ডারনী ও গণ্ডগোলিক্স

৯। নামতা শেখেন বাঘুবাবু

১০। শিয়ালনীর পাঠশালায় সিংহালু

১১। বাঘু হল চিৎপটাং 

১২। ঘুম দিলেন বাঘুবাবু               

১৩। পাঠশালায় ধুন্ধুমার

১৪। বাঘুবাবু ও জান্তা জট 

১৫। বনভোজনে বাঘুবাবু

১৬। হোলি খেলল হিনিমিনি      

১৭। ভোটে দাঁড়ালেন বাঘুবাবু

Leave a comment

Check Also

বিদেশি মোলাকাতে বাঘু- মৌসুমী পাত্র

            ধুস! ধুস! ধুস! ‘দূর ছাতা’ বলে যেদিকে দুচোখ যায়, সেদিকে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে …

baghu_kobi sommelan

কবি সম্মেলনে বাঘুবাবু – মৌসুমী পাত্র

            পাঠশালায় আসছিল শিয়ালনি। আজ দেরিই হয়েছে কিছুটা। কাল সন্ধেবেলা খরগোশাই ডাক্তারদিদির বাড়ি নিমন্ত্রণ …

উল্কার কবলে বাঘু

উল্কার কবলে বাঘু – মৌসুমী পাত্র

(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা  তোমাদের দিযছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ …

শিল্পী- সোমক সেনগুপ্ত/ জানোয়ার বার্তা ও বাঘুবাবু

জানোয়ার বার্তা ও বাঘুবাবু – মৌসুমী পাত্র

  পিঠে থলে ঝুলিয়ে বাঘু চলেছে পাঠশালার পানে। মনে বেশ খুশি খুশি ভাব। একটা গাছের …