Home / বাঘু সিরিজ / কবি সম্মেলনে বাঘুবাবু – মৌসুমী পাত্র

কবি সম্মেলনে বাঘুবাবু – মৌসুমী পাত্র

baghu_kobi sommelan
শিল্পী- পুণ্যতোয়া

 

          পাঠশালায় আসছিল শিয়ালনি। আজ দেরিই হয়েছে কিছুটা। কাল সন্ধেবেলা খরগোশাই ডাক্তারদিদির বাড়ি নিমন্ত্রণ ছিল। জম্পেশ খাওয়াদাওয়া। সেসব সেরে বাড়ি ফিরে ঘুমোতেও দেরি হয়েছে। ফলে সকালে উঠতেও যেমন দেরি, তেমনি একের পর এক সব কাজেই। আর এত তাড়াহুড়োতে সকালবেলায় দাঁত মাজার ফাঁকে টুথপেস্ট অবধি খেতে ভুলে গেছে শিয়ালনি!

          কথাটা যখন মনে পড়ল, ততক্ষণে শিয়ালনি বগলে বইখাতা নিয়ে চোখে রোদচশমা পরে জঙ্গলের আলোছায়া গায়ে মাখতে মাখতে পাঠশালার পানে বেরিয়ে পড়েছে!

          চৈত্রমাস শেষের মুখে। রোদের তেজ বাড়ছে একটু একটু করে। শিমূল, পলাশেরা লাল-কমলা পিচকিরির রঙ ছড়িয়ে যাচ্ছে দেদার। কোমল মখমলের মত বাতাস। পাখিদের কিচিরমিচির। ডানা ঝাপটে উড়ে যাচ্ছে এ ডাল থেকে সে ডালে।

          ফুরফুরে মেজাজে বিভোর হয়ে চারপাশ দেখতে দেখতে এগোচ্ছিল শিয়ালনি। আচমকা পিছন থেকে কে যেন এসে টাঁই করে শিয়ালনিকে এক ধাক্কা মেরে নিজেও খানিক টালমাটাল হয়ে ফের সামলে নিয়ে আবার জোরে জোরে হাঁটতে শুরু করল!

          ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়া বইখাতা কুড়োতে কুড়োতেই বাজখাঁই এক হাঁক দিল শিয়ালনি, “বাঘু! বাঘুউউউউ!”

          বাঘুর সেকথা কানে গেল কি গেল না ঠিক বোঝা গেল না। সে তড়বড় তড়বড় করে পা ফেলে যেমন এগোচ্ছিল, তেমনই এগোতে থাকল।

          শিয়ালনি ফের হাঁক দিল, “বাঘু! দাঁড়া, দাঁড়া বলছি!”

          বাঘুর গতি তিলমাত্র কমল না। শিয়ালনি হাঁফাতে হাঁফাতে ধাওয়া করল বাঘুর পিছন পিছন, “অ্যাইয়ো বাঘু! থাম, থাম বলছি ছাগল!”

          ছাগল বলাতেও বাঘু থামল না। কিন্তু এবারে সত্যিকারের ছাগলের মতোই তিড়িংবিড়িং করে লাফাতে লাফাতে এগোতে থাকল। ছুটতে ছুটতেই আরও একবার বোমফাটানো আওয়াজ ছাড়ল শিয়ালনি, “বাঘু, না থামলে কিন্তু তোর কপালে দুঃখু আছে বলে দিলাম!”

          বাঘু পিছন ফিরে একবার মাত্র তাকাল, তারপর কিসব যেন বিড়বিড় করতে করতে ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রাণপণ ছুটতে থাকল।

          হাতুশি, হিনিমিনি, ভালকি আর কুমরু এদিকে জটলা করছিল নিজেদের মধ্যে। কে কত দূরে লাফাতে পারে, তার প্রতিযোগিতা চলছে। সহসাই পেছন থেকে দিদিমণির হাঁক শোনা গেল, “বাঘু! পালাবি কোথায়? এইবারে তোকে ধরে ফেলেছি!”

          বলতে না বলতেই ওরা দেখে, বাঘু শূন্যপথে ওদের সামনে পড়েই বিশাল এক লাফ দিল। আর শিয়ালনি দিদিমণি ঠিক তার পিছন পিছন একবার মাটিতে ঝাঁপ দিয়েই আরও বিশাল একখানা লাফ দিয়ে একেবারে বাঘুর ঘাড়ে গিয়ে পড়লেন!

          হাতুশি শুঁড় দিয়ে ফুঁ-উ-উ-স করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “দিদিমণিই সবচেয়ে জোরে লাফাতে পারেন!”

বাঘু ওদিকে কাতরাতে শুরু করে দিয়েছে, “হায় হায় হায় হায়! আমার কবিতা পালিয়ে যাচ্ছে গো, হায় হায় হায় হায়! ওগো দিদিমণি গো, এ কী সব্বোনাশ করলেন গো! হায় হায় হায় হায়!”

শিয়ালনি ততক্ষণে গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে কোনমতে উঠে বসেছে। ভালকি এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল, “দিদিমণি, আপনি বাঘুর পিছু পিছু ধাওয়া করছিলেন কেন?”

শিয়ালনি খানিক মাথা চুলকে, খানিক লেজ চুলকে আর খানিক পেট চুলকে উত্তর দিল, “এই রে! কিসের জন্য যেন বেশ… কিসে জন্য যেন বেশ… এই যা! মনে পড়ছে না! ও হ্যাঁ, আসার পথে বাঘু পেছন থেকে এসে আমায় ধাক্কা দিয়েছিল। তারপর ওকে থামতে বললেও থামেনি!”

কুমরু এগিয়ে এল, “হ্যাঁ রে, হ্যাঁ রে, হ্যাঁ রে, দিদিমণি থামতে বললেও তুই থামিস নি বড়ো? অ্যাঁ, বাঘু?”

হিনিমিনি কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল, “কবিতার কথা কী যেন বলছিলিস, বাঘু?”

এ কথায় বাঘু খুচখুচ করে একবার কাঁদল, ফুঁচফুঁচ করে দুবার নাক টানল, সবশেষে ভুসভুস করে তিনবার মুখ দিয়ে হাওয়া ছাড়ল জোর জোর। তারপর বলল, “একখানা জব্বর কবিতা রে… উঁহুঁহুঁহুঁ… পালিয়ে গেল…উঁহুঁহঁহুঁ… দাঁড়া, আগে একটু কেঁদে নি… উঁহুঁহুঁহুঁ।”

বলেই বাঘু উঁহুঁহঁহুঁ করে ফের কান্নার তোড়জোড় করছিল, শিয়ালনি তেড়েই এল একরকম, “দ্যাখ বাঘু, আর একদম মায়াকান্না কাঁদবি না বলে দিলাম! আমাকে ধাক্কা দিয়েও ওনার শান্তি হল না, এবারে মায়াকান্না কাঁদতে লেগেছেন! কবিতার কথা খোলসা করবি ভালোয় ভালোয়? না এক থেকে একশ পর্যন্ত নামতা লিখবি?”

এক থেকে একশ পর্যন্ত নামতা লেখার কথায় বেজায় চুপসে গেল বাঘু। লেজ চুলকোতে চুলকোতে কোনমতে উত্তর দিল, “আসলে দিদিমণি, সকালে একটা জব্বর কবিতা আসছিল মাথায়… ওই কবিতাটা আসলে তাড়াতাড়ি না হাঁটলে বা ছুটলে ঠিকঠাক মাথায় আসেনা কিনা, তাই ছুটছিলাম…। কবিতাটা প্রায় এসেও গিয়েছিল, কিন্তু আপনি পালটা ধাক্কা না দিলে এতক্ষণে বেরিয়েও যেত…উঁহুঁহুঁহুঁ…।”

শিয়ালনি বাঘুর কান্নাকাটিকে আর বিশেষ পাত্তাই দিল না। ধমকধামক দিয়ে ওদের চুপ করিয়ে দিল। প্রার্থনার পর ক্লাসও শুরু হয়ে গেল, অন্যদিন যেমন হয়।

 

টিফিনের সময় হাতুশি, হিনিমিনি, ভালকি আর কুমরু মিলে কিতকিত খেলছিল। হাতুশি একপায়ে ভর দিয়ে তিনপা তুলে কিতকিতের গুটি নিয়ে এগোতে এগোতে টাল সামলাতে না পেরে হুড়মুড়িয়ে গিয়ে উলটে পড়েছে পাশের একটা ঝোপে। অমনি ঝোপ থেকে তারস্বরে আর্তনাদ উঠেছে, “ওরে বাবারে! আকাশ থেকে ইয়েতি এসে ঘাড়ে পড়ল নাকি রে!”

হাতুশি হাঁফাতে হাঁফাতে গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে জবাব দিল, “প্রথম কথা, আমি ইয়েতি নই। আমাকে দেখতেও ইয়েতির মতো নয়। আর দ্বিতীয় কথা, ইয়েতি কি বৃষ্টির জল যে আকাশ থেকে ঝরে পড়বে?”

বাঘু আরাম করে চিৎপটাং হয়ে পায়ের উপর পা তুলে আর মাথার তলায় থাবা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “তা অবশ্য মন্দ বলিসনি, হাতুশি। ইয়েতি বৃষ্টির জলও নয় আর রসগোল্লার রসও নয় যে ঝরে পড়বে! আসলে কী জানিস, কাল একটা কবিতা লিখেছিলাম! লম্বাগুড়ি কবিতা! সেটাই কিছুটা ঠিকঠাক করছিলাম আর কী! তুই আসতে সব গুবলেট হয়ে গেল!”

“লম্বাগুড়ি কবিতা? বলিস কী রে বাঘু? সে আবার কী জিনিস?”, হিনিমিনি ততক্ষণে এসে হাতুশির পিঠে জাঁকিয়ে বসেছে।

ভালকি আর কুমরুও এসে পড়েছে। “হি হি হি হি! লম্বাগুড়ি কবিতা? হো হো হো হো!”

বাঘু ভয়ানক রেগে গিয়ে বলল, “দুত্তোর! তোদের আর শোনাবোই না কিছু! এরপর যখন আমার নামটাম ছড়িয়ে যাবে, জঙ্গলে জঙ্গলে ‘কবিবর বাঘু’ বলে আমার সংবর্ধনার আয়োজন করবে, তখন এই তোরাই হামলে পড়ে আমার পেছন পেছন ঘুরবি! আর তখন সই চাইলেও দেবো না!”

কুমরু কিরকম যেন ঘাবড়ে গেল এ কথায়। কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, “না রে বাঘু, ভুল হয়ে গেছে। রাগ করিস না। তোর ওই লম্বাগুড়ি না হামাগুড়ি, কী যেন কবিতা- শোনা না রে!”

ভালকি হাতুশির দিকে চোখ মিটকে বলল, “আরে না না! ওটা লেপমুড়ি কবিতা! লেপ মুড়ি দিয়ে পড়তে হয়!”

হাতুশি জোরে জোরে শুঁড় নেড়ে প্রতিবাদ জানাল, “আরে দূর! লেপমুড়ি কেন হবে? ওটা বাটিচচ্চড়ি কবিতা!”

হিনিমিনি দেখল, সবাই বলছে যখন, তারও কিছু বলা উচিত! তাই তড়িঘড়ি করে বলল, “দূর! দূর! তোরাও যেমন! ওটা হবে লেজ নাড়ি কবিতা। কবিতার তালে তালে তোর বেশ লেজ নড়বে। তাই না রে বাঘু?”

মারাত্মক খেপে গেল বাঘু। সটান উঠে বসে থাবা টাবা ছুঁড়ে চেঁচাতে চেঁচাতে বলল, “যা যা! তোদের আর কিছু বলবোই না! একটা লম্বাগুড়ি কবিতা শোনাবো ভেবেছিলাম। তোরাই হতিস আমার প্রথম শ্রোতা! ভাবলাম, যত ঝগড়াঝাঁটিই থাক, ক্ষমাঘেন্না করে দি তোদের! তোরা থাকতে অন্য জন্তু এসে আমার কবিতা শুনে বাহবা দিয়ে চলে যাবে, এ ঠিক না। কিন্তু না, তোদের চেয়ে বাইরের জানোয়ারেরাই আমার প্রশংসা করুক, সেই-ই ভালো!”

তা এসব কথায় কারই বা মন ভেজে? বাঘুকে বিস্তর সাধাসাধি করল সবাই, বাঘুও খানিক উদারতা দেখিয়ে বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে। এবারের মতো ছেড়ে দিলাম। সবাই ভালো করে ভক্তিভরে বোস! আমি কবিতা পড়বো।”

ভালকি চটেমটে বলল, “দ্যাখ বাঘু, পড়তে হলে পড়, নইলে আমরা সব চললাম!”

বাঘু দেখে মহা বিপদ! সবাই পালায় পাছে! তাই তড়িঘড়ি করে বলল, “আরে, না না, শোনাবো না তো বলিনি। আমি ইয়ে… মানে এই একটু… মানে ইয়ে… মজাই করছিলাম তোদের সঙ্গে।” বলেই বাঘু শুরু করল। “নমস্কার। কবিবর বাঘু বিরচিত একটি লম্বাগুড়ি কবিতা আমি আপনাদের আজ পাঠ করে শোনাচ্ছি। এই কবিতাটি লম্বাগুড়ি ছন্দে লেখা!”

হিনিমিনি হঠাৎ কোমরে হাত দিয়ে চোখদুটোকে কপালে ঠেলে বলল, “কপিবর? কপি? কপি মানে তো বড়ো হনুমান।

কুমরু কিরকম যেন ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “ফুলকপি না বাঁধাকপি? ফুলকপি দিয়ে কবিতা? মনে হয় খেতে খাসা হবে।”

হাতুশি শুঁড় দোলাল, “আরে, হিনিমিনি! কপিবর নয় রে, ওটা কবিবর। মানে কেউকেটা কবি আর কী!”

বাঘু হিনিমিনির কথায় রেগে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু হাতুশির কথায় খুশি হয়ে মোলায়েম করে লেজখানাকে গায়ে বুলিয়ে শুরু করল কবিতা পড়তে-

এহুম! এহুম! এহুম!

হুহুম! হুহুম! হুহুম!

 

ধর্‌ তুই গদা খেলি,

গদা খেয়ে পড়ে গেলি-

লেজে কালি, মুখে কালি

খেলবি নাকি অমন হোলি?

 

হতে পারে তোর তেজ

তাই বলে টানবি লেজ?

লেজে লেজে চুলোচুলি-

চল্‌, থামি। হোক কোলাকুলি।।

 

          এই পর্যন্ত পড়ে বাঘু থামল। কুমরু বলল, “আমার না কিরকম কিরকম মাথা ঘুরছে আর কান্না কান্না পাচ্ছে!”

          হিনিমিনি ভয়ের চোটে জড়িয়ে ধরেছে, “ওরে বাবা রে, হাতুশি রে! বাঘুর কবিতা তাড়া করেছে! শিগগির পালাই চল্‌! ওরে ভালকি, তোর ভ্যালাটে ভালুক্সিং ঝাড় না!”

ভালকি মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, “এসব কবিতা-রোগ ভ্যালাটে ভালুক্সিং এ সারে না! বরং তোর ‘কদলীরসকর্পূর’ টা কুমরুকে একটু খাওয়া। আমাদেরও দে।”

বাঘু বেজায় খুশিয়াল ভংগিতে মাথা নাড়ল, “এই তো, কবিতার বেশ ফল পাওয়া যাচ্ছে দেখছি। তোরা সবাই কেতরে ছেতরে একাকার! বেশ বেশ, এবার তবে লেজবোস কবিতাটা শুরু করি!”

            বলেই বাঘু শুরু করল-

গোলাপী আকাশে পেঁচা মেঘ,

আহা! যেন ঝোলে কার লেজ-

ঘাসে মুখ দিয়ে চলি,

কবিতায় কথা বলি।

 

          আর্তনাদ উঠল একটা, “ওরে, আমার কাঁটা সব ভয়ে খাড়া হয়ে যাচ্ছে!”

          হাতুশি শুঁড় উঁচিয়ে এক ধমক দিল বাঘুকে, “বাঘু! তুই থামবি? দেখছিস না, কুমরুর ভয় লাগছে!”

          বাঘু চোখমুখ কুঁচকোল, “তোদের মতন বেরসিকদের কাছে আমার কবিতা পড়াটাই ভুল হয়েছে! থাক, তোদের কাছে আর পড়বোই না!”

          ভালকি আর হিনিমিনি একযোগে মাথা ঝাঁকাল, “তোর কবিতা আমরা শুনছি না, শুনবোও না।”

          বেজায় রেগেমেগে বাঘু দুমদাম পা ফেলে চলে গেল। টিফিন শেষের ঘন্টাও ওদিকে বাজিয়ে দিয়েছেন দিদিমণি।

 

          বাঘু কিন্তু দমল না মোটেই। বরং ঘোরতর উৎসাহে কবিতা লেখা চালিয়ে যেতে থাকল। সেদিন বাঘুর অংকখাতা দেখতে গিয়ে দিদিমণি দেখলেন, লেখা আছে-

 

ফাঁকি দাও ফাঁক বুঝে!

আঁক কষো মুখ বুজে,

অতো সোজা? জ্বালাতন অঙ্কে

এ বিপদে বাঁচায় কে?

তাই লিখি কবিতা-

যত খুশি, যা তা!

 

কবিতা পড়েই শিয়ালনির লেজ ঢুসঢুস করতে লাগল, কান কুসকুস করতে লাগল আর নাক ভুসভুস করতে লাগল। আর তার মাথা চক্কর কেটে ঘুরতে থাকল তো ঘুরতেই থাকল। বাঘু পাশে গিয়ে ভারি মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞেস করল, “দিদিমণি, আর একটা কবিতা শুনবেন বুঝি? তা বললেই তো হয়! আচ্ছা বেশ, শোনাচ্ছি।”

          বলতে না বলতেই বাঘু তার লেজে বেঁধে রাখা একতাড়া কাগজ খুলে পড়ার উদ্যোগ করতে করতে বলল, “এই হয়েছে আজকাল বিপদ! এত কবিতা পড়ার অনুরোধ আসছে যে আর সামলেই উঠতে পারছি না! যাক্‌, কী আর করা যাবে? বড় কবিদের ওটুকু একটু আধটু সইতে হয়!”

          শিয়ালনির মাথা আরেকবার চক্কর কাটতে যাচ্ছিল, কিন্তু বাঘুর কথাগুলো শুনেই কিরকম যেন তালগোল পাকিয়ে গেল। গনগনে চোখে ধেয়ে এল শিয়ালনি, “বাঘু! বাঘুউউউউ! বলি, মশকরা হচ্ছে, মশকরা? অ্যাঁ? আর ফের যদি তুই একটা কবিতাও উচ্চারণ করেছিস ক্লাসে পড়ার সময়, তাহলে কিন্তু একটা লঙ্কাকাণ্ড কি ঢ্যাঁড়সকাণ্ড বেধে যাবে, বলে দিলাম!”

          দিদিমণির এহেন গুরুতর বচনে মুখ গোঁজ করে বসে পড়তেই হয়! বাঘুও বসল, বাধ্য হয়েই। কিন্তু মুখ গোঁজ করে গজগজ করতেই থাকল, “শুনলি, ভালকি? শুনলি? এমন একটা পাঠশালা যে কবিদের দুটো কবিতা পর্যন্ত স্বাধীনভাবে আওড়াবার জো নেই! যে পাঠশালায় কবিদের দুটো কদর অবধি জোটে না, সেটা আবার পাঠশালা হল? কিছু বলার নেই, বুঝলি!”

          ভালকি কটমট করে বাঘুর দিকে চেয়ে চাপাস্বরে বলল, “কিছু বলার নেই বলে তো গুচ্ছখানেক কথা বলেই দিলি! আর তুইও শুনে রাখ, ফের যদি আর একটাও কবিতা বলার ধান্দা করেছিস, তাহলে কিন্তু ভালুক্সিং ঝেড়ে তোকে ফুলকপিবর কি বাঁধাকপিবর বানিয়ে দেবো! এই বলে দিলাম!”

          ভালকির ভয়ে বাঘু আর বিশেষ ট্যাঁ ফোঁ করল না ঠিকই, কিন্তু মনে মনে চটল চরম! আর তাই টিফিনে খাবার আগে ভালকি যখন থাবা ধুতে গেল, বাঘু তখন মহানন্দে ভালকির মধুর হাঁড়িতে যথেচ্ছ বালি ভরে দিল, আর তার বাড়ির থাবালেখার খাতায় কবিতা লিখল-

ভালকি রে ভালকি!

(দেখিস) করি তোর হাল কী!

তোর ভ্যালাটে তুই-ই খা,

সঙ্গে দু পিস আমলকি!

          শুধু কি তাই? কুমরুর ইদানীং একটু সর্দির ধাত হয়েছে বলে গলায় রুমাল বেঁধে আসছে। আর তার থলেতে সবসময়ই একটা রুমাল রাখা থাকে বাড়তি। সেই রুমালে বাঘু কাঁটাফল আটকে দিল খানকতক। হিনিমিনি কলা খেয়ে খোসাগুলো রোজই এককোণায় জড়ো করে রাখে। সেই খোসাগুলোকে নিয়ে গেঁথে গেঁথে মালা বানাল সময়মতো হিনিমিনিকে পরাবে বলে! আর পাঠশালা শেষে দিদিমণি যখন উঠে গেলেন, হিনিমিনিও উঠব উঠব করছে, সেই ফাঁকে গিয়ে হিনিমিনির গলায় টুপ করে কলার খোসার মালাও ঝুলিয়ে দিল পিছন থেকে! তারপরই থলে কাঁধে দে ছুট! আর হ্যাঁ, হাতুশির টিফিনের কলাগাছেও নিমপাতার রস ঢেলে বিচ্ছিরি রকমের তেতো করে রাখল!

          ফলে বাঘু চলে যাবার পরপরই বৈঠক বসল ওদের। বাঘুকে জব্দ করার ফন্দিফিকির নিয়ে আলোচনাও চলল বহুক্ষণ! শেষে শিয়ালনি দিদিমণি বেরোনোর মুখে ওদের দেখতে পেয়ে তাড়া দিয়ে ভাগালেন সবাইকে!

            পরের দিনই অন্য একটা ঘটনায় শোরগোল পড়ে গেল জঙ্গলে। দাঁত মুখ মেজেটেজে জন্তুরা সব হাওয়া খেতে কি কাজেকর্মে বেরিয়ে দেখল, বনের বড় ছোট গাছেদের গলায় মালার মতন রঙিন রঙিন সব কাগজ ঝুলছে আর এলোমেলো হাওয়ায় পতাকার মতো কাগজগুলো উড়ছে পতপত করে।

          হাতুশি শরীর ফিট রাখার জন্য রোজ প্রাতঃভ্রমণে বেরোচ্ছে আজকাল। থাবায় সাদা মোজা পরে, গলায় সাদা রুমাল আর সাদা একটা স্কার্ট পরে জগিং করতে করতে তারও নজরে এল বিষয়টা। হাতের লাফদড়িটাকে শুঁড়ে ঝুলিয়ে কোমরে একটা থাবা দিয়ে হাতুশি পড়তে শুরু করল-

  ফূর্তির খবর!   জবর খবর!                                                                      জবর খবর! ফূর্তির খবর!   

 

  

লিখতে থাকো দিনভর-

হয়ে যাও কবিবর!

 

 

কবি সম্মেলন!     কবি সম্মেলন!        কবি  সম্মেলন!                                           

 

         এতদ্দ্বারা বনের সকল পশুকে অবগত করা যাচ্ছে যে আগামী পয়লা বৈশাখ এক মহতী কবি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। ‘পশুর প্রাণ, কবিতায় চান’– এই মূল ভাবনা মাথায় রেখেই আয়োজন করা হয়েছে এই সম্মেলনের। জঙ্গলের সব জানোয়ারেরাই জানেন যে জন্তুমাত্রেই অল্পবিস্তর কবি। কিন্তু বেদানার (বেদনা বেশি হলে তাকে বলে বেদানা) বিষয়, মানুষেরা মোটেই তা মনে করে না। তাদের ধারণা, দুনিয়ায় তারাই একমাত্র কবি! সময় সমাগত। মানুষদেরও বোঝানোর দরকার, আমরাও কবি হতে পারি, অমন ঝোলা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে আমরাও ঘুরতে পারি। উত্তরীয়ও পরতে পারি। লেজ উস্কোখুস্কো রাখতেই পারি। করি না, নেহাত আমাদের গরম লাগে তাই।

        যাইহোক, বন্ধুরা, হও সবে আগুয়ান, কবিতায় রাখো মান। লিখতে থাকো কবিতা, আর যোগ দাও কবি সম্মেলনে। ছোট বড়ো সকলের সমান প্রবেশাধিকার।

        আর হ্যাঁ, সফল কবিদের জন্য প্রচুর উপহার আর আগত সকল পশুর জন্য ভোজনের ব্যবস্থা তো রইলই।

 

কবি সম্মেলনের স্থানঃ-  

‘কবিতার কালোয়াতি’

৪নং ঘাঁতঘোঁত পথ,

কেলেঙ্কারি বাগিচা,

বিষম বনানী,

জানোয়ার তালুক।

ক্ষণঃ আগামী পয়লা বৈশাখ (বৈকাল ৪ ঘটিকা)

পুঃ- কবি সম্মেলনে নাম দিতে ইচ্ছুক কবিরা পয়লা বৈশাখের পূর্বে কবি সম্মেলনের উক্ত স্থানে উপস্থিত হয়ে নিজ নিজ নাম নথিভুক্ত করাতে পারবেন।

 

সৌজন্যেঃ- ‘কবি কানন’ গোষ্ঠীর দিকপাল জানোয়ার কবিরা

                                                                                                                          /পশুস্বার্থে প্রচারিত/

 

 

 

          পড়তে পড়তে কখন হাতুশির শুঁড় ঝুলে গিয়ে লাফদড়ি মাটিতে লাফিয়ে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে, হাতুশি নিজেই জানে না। লাফদড়িটা তুলতে গিয়ে হাতুশি দেখে, ঠিক তার পাশেই একইরকম রঙিন কাগজ গড়াগড়ি খাচ্ছে একটা। হাতুশি শুঁড়ে তুলে নিল। বন্ধুদের দেখাবে। মাথায় একটা ঝিলিকও দিল হাতুশির! দি আইডিয়া!

 

বাঘুর মনটা আজ বেশ খুশি খুশি। পাঠশালায় আসার পথে কবি সম্মেলনের কাগজ চোখে পড়েছে তারও। একটা কাগজ ছিঁড়েও নিয়েছিল। সেটাই একটা ঝোপের আড়ালে বসে মন দিয়ে পড়ছিল বাঘু! হুঁ হুঁ বাবা! মানপত্র গলায় ঝুলিয়ে যখন ফিরবে না, তখন হাতুশি-হিনিমিনি-কুমরু-ভালকির লেজ একেবারে ল্যাংচা হয়ে যাবে! আচ্ছা, লেজ কি ল্যাংচা হয়? হতে পারে?

          এইসব গুরুতর ভাবনার মাঝেই বাঘুর কানে এল, কারা যেন কথা বলছে! যা ভেবেছে ঠিক তাই! হাতুশি, হিনিমিনি, কুমরু আর ভালকি! বাঘু উঁকি মেরে কান পেতে খুব মন দিয়ে শুনতে থাকল ওদের কথা।

          হিনিমিনি লেজখানাকে গালে ঠেকিয়েছে, “তোর কি মনে হয় হাতুশি, বাঘু কবি সম্মেলনে যাবে?”

          হাতুশি শুঁড় দুলিয়ে হাসল, “যাবে তো বটেই। কিন্তু গিয়ে যে কী করবে, সেটাই ভাবনা!”

          ভালকি বলল, “হুঁ হুঁ বাবা! কবি সম্মেলনে পুরষ্কার পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়! ওর আলাদা কায়দা আছে।”

          কুমরু এগিয়ে এল ভালকির কাছে, “বল্‌ না রে, বল্‌ না রে, কী কায়দা?”

          ভালকি গোপন কথা ফাঁস করার ভঙ্গিতে মিচিক মিচিক হাসি দিল, “আমাদের জঙ্গলের বাইরের দিকে ওই যে জায়গাটা… ওই যে প্রচুর অশোক গাছ আছে… কী নাম কী নাম যেন… ও হ্যাঁ, বনকুসুমতলা… ওই বনকুসুমতলাতেই একটা খ্যাপা ষাঁড় থাকে। তার নাম বলীবর্দ। একটা পুরনো অশোক গাছের তলাতেই বেশিটা সময় কাটায়। তা ওই বলীবর্দের পিঠে কেউ চাপলে বলীবর্দ তাকে পাঁইপাঁই করে চরকিপাক খাইয়ে মাটিতে ফেলবেই। এখন কেউ যদি ওই বলীবর্দের পিঠে চাপে আর বলীবর্দ যদি তাকে হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও না ফেলতে পারে, তাহলে কবি সম্মেলনের শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার তার বাঁধা।”

          শুনেই বাঘুর চোখ পুরো কাঁচাগোল্লা! বলে কী? এইরকম ব্যাপার? এরা তো এতসব কিছু জানায়নি! না না, কালকেই চাপতে হবে খ্যাপা ষাঁড়ের পিঠে!

          পরের দিন পাঠশালা শেষ হতে না হতেই বাঘু ছুটল বনকুসুমতলার দিকে। গিয়ে দেখে, যা শুনেছে হবহু তাই। পুরনো একটা অশোক গাছের তলায় আরাম করে ঘুমোচ্ছে একটা বিশাল চেহারার ষাঁড়। নির্ঘাত বলীবর্দ! বাঘু গুটি গুটি থাবায় এগিয়ে গেল সেদিকে। আর তারপরই… সহসা এক লাফ মেরে সটান গিয়ে বসল বলীবর্দের পিঠে।

          দুপুরবেলায় জমাটি ভোজ সেরে বলীবর্দ শান্তিতে ঘুমোচ্ছিল। আচমকা বাঘু এসে তার পিঠে পড়ায় সে প্রথমটা গেল ঘাবড়ে, তারপরই গেল খেপে। আর খেপে গেলেই তার অভ্যেস হচ্ছে বাঁইবাঁই করে চরকিপাক ঘোরা। আর ভয়ংকর সেই চরকিপাকের ঠ্যালায় একটু বাদেই বাঘুর মাথা টাঁইটাঁই করে ঘুরতে শুরু করল, তার পেট কাঁইকাঁই করতে থাকল, আর তার লেজ সাঁইসাঁই করে নাগরদোলার মতন ঘুরতে থাকল তো ঘুরতেই থাকল। বেগতিক দেখে বাঘু প্রাণপণে বলীবর্দের শিং চেপে ধরল আর তাতে বলীবর্দ গেল চরম খেপে। কালবৈশাখীর ঝড়ের মতো ভোঁস ভোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে গোটা শরীর উথালপাথাল করতে থাকল সমুদ্রের প্রলয়ংকর ঢেউয়ের মতো। আর তার পরেই বাঘু আকাশপথে ছিটকে গিয়ে পড়ল বেশ কিছু দূরে ঘন ঘাসে ঢাকা একটা জায়গায়। ঘাসপাতার উপর পড়েছিল বলে বাঘুর তেমন একটা লাগেনি। গায়ে থাবাটাবা বুলিয়ে বাঘু যখন চারপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে যে ব্যাপারটা ঠিক কী হল, ঠিক তখনই মাথার উপর থেকে ভেসে আসা হি হি হাসির শব্দে চমকে তাকিয়ে দেখে হিনিমিনি! একটা কচি অশোক গাছের ডাল ধরে ঝুলছে। হিনিমিনি হাসতে হাসতেই বলল, “কী ব্যাপার রে, বাঘু? তুই এখানে কী করছিস?”

          বাঘু গোড়ায় একটু ভেবলে গেলেও জোর সামলে নিল, “আমি? আমি মানে এই ইয়ে… মানে একটু কবিতা লিখছিলুম।”

          “কবিতা? বলিস কী রে? তা তোর কাগজ-খাতা-কলম এইসব কোথায়?”

          “কাগজ-খাতা-কলম?”, বাঘু একটু হকচকিয়েই গেল, “আমি… ইয়ে মানে, মনে মনে লিখছিলুম কিনা… হ্যাঁ হ্যাঁ মানে মনে মনেই লিখছিলুম… ইয়ে মানে মনে মনেই লিখি আজকাল… মনে মনেই লিখি… মনে মনেই রেখে দিই। এই জায়গাটা নিরিবিলি কিনা… কবিতা ভাবার সুবিধে হয় বেশ…”।

          বাঘুর কথা ফুরোতে না ফুরোতেই হাতুশিও হাজির। বাঘু চমকে গিয়ে বলল, “কী ব্যাপার? তুইও যে?”

          হাতুশি মুখ খোলার আগেই মুখ খুলল হিনিমিনি, “ইয়ে মানে, আমরা ভাবছিলাম যে কবি সম্মেলনে… না না, কবি সম্মেলনে না… মোটেই যাবার কথা ভাবিনি… ওই মানে খ্যাপা ষাঁড়… না মানে বলীবর্দও নয়… ওর পিঠও নয় মোটেই… মানে পিঠে চাপাও নয়… ইয়ে মানে ওই আর কী… মানে, হি হি হি।”

          ব্যস! বাঘুর তো বোঝা হয়ে গেল যা বোঝার। তার মানে ওরাও কবি সম্মেলনে যাবে, আর তার জন্য বলীবর্দের পিঠে চাপতে এসেছে!

          কিন্তু এখন বলীবর্দের পিঠে চাপার আর উপায় নেই। বড্ডো ভিড় হয়ে গেছে। দূরে কুমরু আর ভালকিকেও দেখা যাচ্ছে। বাঘু আর তাই কথা না বাড়িয়ে পিঠটান দিল।

          সেদিন পিঠটান দিল বটে বাঘু, কিন্তু পরের দিন সকালেই ফের হাজির হল বলীবর্দের আস্তানায়। যেভাবেই হোক, বাঘুকে তার পিঠে চাপতেই হবে! নইলে কবি সম্মেলনের উপযুক্ত কবিতা বেরোবে না।

          বলীবর্দের মনমেজাজ সেদিন সকাল থেকেই খারাপ। সে রোজ সকালে পাঁচ কিলো করে গোবর দেয়। সেদিন সকালে দিয়েছে মোটে দু কিলো। একটা থুত্থুড়ে বুড়ি প্যাঁচার সঙ্গে তার চুক্তি আছে। একে প্যাঁচা, তায় তার বয়স হয়েছে। প্যাঁচাকুলের নিয়ম মাফিক তাকে রাতে জাগতেই হয়, অথচ চোখে তত ভালো দেখতে পায়না। সে তাই জোনাকি পোকা ধরে ধরে গোবরে সাঁটিয়ে রাখে, তার কোটরে আলো হয় বেশ। রাতে জেগে কাজকর্ম সারতে পারে দিব্যি। সে প্রতিদিন সকালে এসে ওই পাঁচ কিলো করে টাটকা গোবর নিয়ে যায়। প্রতি কিলো গোবরের দাম দুই বস্তা করে ঘাস। তা সেই বুড়ি প্যাঁচা, যার নাম প্যাঁচাফুল্লরা, সকালে এসে পাঁচ কিলোর পরিবর্তে দু কিলো গোবর পেয়ে আচ্ছাসে খানকতক কথা শুনিয়ে দিয়ে গেছে বলীবর্দকে। বাসি গোবর খানিকটা দিতেও চেয়েছিল বলীবর্দ, প্যাঁচাফুল্লরা রাজি হয়নি।

          বলীবর্দ তাই মুখ গোমড়া করে বসে আকাশপাতাল ভাবছিল। কালকে যদি ঠিকঠাক গোবর না দিতে পারে, তাহলে প্যাঁচাফুল্লরা অন্য কোন ষাঁড়ের কাছে যাবে পরের দিন থেকে। সেরকমই শাসিয়ে গেছে।

          বলীবর্দ ভেবে ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছে না, হেনকালে বাঘু হড়কা বানের মতো ধেয়ে এসে ঝটাকসে চেপে পড়ল বলীবর্দের পিঠে। সাতসকালে এহেন আক্রমণের জন্য বলীবর্দ মোটেই প্রস্তুত ছিল না। বাঘুকে পিঠ থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্য সে লাট্টুর মত বনবন করে পাক খেতে থাকল তো খেতেই থাকল। এবং শেষকালে বাঘুকে ছুঁড়ে ফেলল দূরে মাটির ওপর, যেখানে তখনো মাটিতে বেশ খানিকটা পুরনো গোবর লেগে ছিল। ব্যস, বাঘু সত্যিকারেরই ল্যাজেগোবরে হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ।

          গোবরে মাখামাখি হয়ে বাঘু যখন উঠে দাঁড়াল, তখন সে বাঘু নাকি বাঘুর ভূত বোঝা দায়! তার চেহারা যেমন খোলতাই হয়েছে তেমনই পচা গোবরের খুশবুও বেরোচ্ছে চমৎকার! বাঘুর বিপদ আরও বাড়ল, যখন দূর থেকে দেখতে পেল ভালকিকে। ভালকিকে দেখতে পেয়েই বাঘু তড়িঘড়ি করে পাশের একটা পচা ডোবায় ঝাঁপ দিল। তাতে বাঘুর গায়ের গোবর কতটা দূর হল বোঝা গেল না, কিন্তু ডোবার পাঁক সারা গায়ে লেগে বাঘুর চেহারা আরও খোলতাই হয়ে গেল।

          এই করতে করতেই কবি সম্মেলনের দিন এগিয়ে এল। বাঘু নিয়মিত বলীবর্দের কাছে গিয়ে পিঠে চাপার কসরত করেই যাচ্ছে এবং যথারীতি নাস্তানাবুদও হচ্ছে। কিন্তু হাল ছাড়ছে না। কবি সম্মেলন যে বেশ জোরদার হবে, সেও বেশ বোঝা যাচ্ছে। বাইরের নানা জঙ্গল থেকে বাঘা বাঘা সব পশু কবিরা নাকি হাজির হবে। হাতুশিও সেদিন গল্প করছিল, তার বড়মাসি হস্তীমল্লিকা আর মেসো হস্তীপদ নাকি তাদের ছেলে হাতিখালিকে নিয়ে এসেছে। হাতিখালি নাকি বেজায় উঁচুদরের কবি। সে যখন উঁচুস্বরে কবিতাপাঠ করে, তখন বনের গাছপালার উঁচু ডালগুলো সব নাকি মড়মড় করে ভেঙে যায়! হাতুশিদের বাড়ির ছাদে যে কয়েকটা টিকটিকি ছিল, তারা নাকি হাতিখালির কবিতার ভয়ে কোথায় লুকিয়েছে, তার কোন ঠিকঠিকানা নেই!

          শিয়ালনি দিদিমণিও বলছিলেন, সিংহালু নাকি আসছে তার সিংহাইমাসিকে  নিয়ে। সিংহাইমাসির বেশ কয়েকটা কবিতার বইও নাকি বেরিয়ে গেছে। যে বইটার নাম ‘কাব্য ক্রন্দন’, সেটা পড়লে নাকি সারাদিন খুচখুচ করে কাঁদতে হয়! যে বইটার নাম ‘কাব্য উল্লম্ফন’ সেটা পড়লে সারাদিন ধাঁইধাঁই করে লাফাতে হয়। যে বইটার নাম ‘কাব্য শিহরন’ সেটা পড়লে গায়ের সব লোম নাকি কাঁটার মত দাঁড়িয়ে যায়! তবে শজারু বা কুমীরের মত জন্তু-জানোয়ার যাদের গায়ে এমনিতেই কাঁটা থাকে, তাদের ঠিক কী হবে বোঝা যাচ্ছে না। তাদের কাঁটা ঝরেও যেতে পারে। এবারের কবি সম্মেলনে নাকি সেটারও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে। সেই শোনা ইস্তক কুমরু ভয়ানক দুশ্চিন্তায় আছে!

              কবি সম্মেলনের দিন হাতুশি-হিনিমিনি-কুমরু-ভালকি গিয়ে দেখে, সে এক হইহই রইরই ব্যাপার! বিশাল শামিয়ানার তলায় মঞ্চ বাঁধা। মাইকে কবিতাপাঠ হবে। শ্রোতাদের আর আগত কবিদের জন্য শতরঞ্চি পেতে বসার ব্যবস্থা। সিড়িংগে কবি, নাদুসনুদুস কবি, আলসে কবি, ব্যস্তসমস্ত কবি, কেতাদুরস্ত কবি, অগোছালো কবি- সব মিলিয়ে হরেক কিসিমের কবির মেলা! সেই গণ্ডারনী দিদিমণিকেও এক ঝলক দেখতে পেল ওরা। কাঁধে একটা ঝোলা নিয়ে হন্তদন্ত ভঙ্গিতে কোন্‌দিকে যেন যাচ্ছেন! ওদের দেখে না চেনার ভান করলেন! ওদিকে সিংহালুকে দেখা গেল মঞ্চে। উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কিসব কথা বলছে। তার পাশেই মোটাসোটা একজন সিংহী, হাতে খানকতক বই। দেখেই মনে হচ্ছে কেউকেটা কবি। নিশ্চয়ই সিংহাইমাসী। সিংহালু ওদের দেখতে পেয়ে মঞ্চ থেকেই হাসি হাসি মুখে মাথা নাড়ল। হাতুশির হাতিখালি দাদাকেও দেখতে পেল ওরা। একপাশে একটু আলাদা হয়ে বসে হাতের খাতা দেখে বিড়বিড় করে কবিতা আওড়াচ্ছে। ‘জানোয়ার বার্তা’ পত্রিকার সেই সাংবাদিক হরিণী আর ক্যামেরা হাতে শজারুকেও দেখল ওরা। শজারু এদিক ওদিক পটাপট ছবি তুলছে আর হরিণী এর ওর সাক্ষাৎকার নিচ্ছে!

          কিন্তু বাঘু গেল কোথায়? গত কয়েকদিন ধরেই বাঘু রীতিমতো একটা কবি-কবি ভাব নিয়ে পাঠশালায় আসছিল। লেজের চুল উস্কো খুস্কো, চোখে উদাস চাহনি, গলায় উত্তরীয়। কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ সবসময়। ঝোলা ব্যাগ ছাড়া নাকি কবি-কবি ভাবটা ঠিক আসে না! একটা পাঞ্জাবিরও বায়না দিয়েছে বাঘু, সেটা পরেই নাকি তার কবি সম্মেলনে আসার কথা।

দেখতে দেখতে অনুষ্ঠান শুরুও হয়ে গেল! ‘কবি কানন’ গোষ্ঠীর দিকপাল জানোয়ার কবিরা মঞ্চ আলো করে বসেছেন। একেএকে সংবর্ধনা জানান হল তাঁদের। গণ্ডারটিকা কাব্যকুসুমিকা, ভালুকপ্রিয় কাব্যচঞ্চু, কাব্যময়ূরী কলমধারী, শিয়ালকাত চিৎপাত, বাঘতটিনী কবিতাজিনি- একের পর এক নাম ঘোষণা হতে থাকল মাইকে। ময়ূরাট নর্তনসম্রাটের নাচও হল।  পাঠশালা মহাসভার অধ্যক্ষা শিয়ালিকা বিদ্যাচন্দ্রিকা কবি সম্মেলনের উপকারিতা নিয়ে তিনি বেজায় জোরালো বক্তব্য পেশ করলেন। সেসব সারা হতে শুরু হল মূল পর্ব- কবিতাপাঠ।

          পাঠশালা মহাসভার সেই কাঠবিড়ালী, যার নাম কাঠচশমালী, সে অনুষ্ঠানের ঘোষক। সে কবিদের নাম এক এক করে ঘোষণা করছে আর তাঁরা এসে কবিতা পড়ছেন। হাতিখালির নাম ডাকা হল সবার প্রথমে। হাতিখালি এগিয়ে গিয়ে মাইকের সামনে বীরদর্পে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় শুরু করল-

ভসভস করে মনটা-

কিসে যে হবে ঠাণ্ডা?

নিয়ে আয় গোটা দুই ডাণ্ডা

মুলেই দি তোর কানটা!

 

গর্জন ঝনঝন অতি ভয়ংকর

এসে গেল হাতিখালি কবিবর!

মড়মড় মড়মড় মড়াৎ!

ভাঙবে মাথার উপর ছাদ-

          এই অবধি সবে পাঠ করেছে হাতিখালি, অমনিই মড়মড় মড়মড় মড়াৎ! বিকট শব্দে মঞ্চের একপাশের বাঁশের খুঁটি হেলে গিয়ে মাথার উপরের শামিয়ানা জোর আওয়াজে পড়ল দিকপাল কবিবরদের মাথার ওপর! অনুষ্ঠানের ঘোষক কাঠচশমালী কিন্তু তার কর্তব্য ভোলেনি। সে মাইকে বলেই যাচ্ছে, “চিন্তার কিছু নেই, মান্যগণ্য উপস্থিত জানোয়ার মহোদয় ও মহোদয়ারা। আমরা এটাই ধরে নেব যে স্বয়ং কাব্যসরস্বতী এই কবিকুলের মাথায় ভর করেছেন! এ আশীর্বাদ আমরা মাথা পেতে নিচ্ছি!”

          অবশ্য মাথা পেতে না নেওয়া ছাড়া উপায়ও ছিল না বিশেষ। মঞ্চের কবিকুল একরকম কুপোকাতই বলা যায়! খালি হাতিখালি নির্বিকার! তার কবিতা শেষ হয়নি। সে পরের লাইনগুলো বলার তোড়জোড় করতেই তাকে সবাই মিলে হাঁ হাঁ করে থামিয়ে দিল। হাতুশি দুখী দুখী মুখে বলল, “এরকম না ঘটলে হাতিখালি দাদাই প্রাইজটা পেয়ে যেত রে!”

          আরও কিছু কবিতার পর নাম ঘোষণা হল গণ্ডারনীর। গণ্ডারনী এসেই তেড়েফুঁড়ে কবিতা বলতে শুরু করল-

যত সব বদমাশ, আর যত ভণ্ড,

কবিতার নামে হয় সব কাজ পণ্ড!

মনে হয় ঘুঁষি দি মুখে দুই চারিটা-

তবে যদি শান্ত হয় মোর কলিজাটা।

 

তুই হাবা চেয়ে দ্যাখ, গবা দ্যাখ তুই-ও,

গালে তোর চুনকালি পড়বেই যদিও।

 

যত সব অপোগণ্ড, জুটেছে মেলাতে-

কাজ নেই, কাম নেই- হইহই খেলাতে!

 

‘কবি কানন’ কানন নয়, ফাঁকিবাজির আখড়া-

সেখানেই মিলেছে যত সব দামড়া।

          গণ্ডারনী এই অবধি পড়েছে, অমনিই মহা শোরগোল বেঁধে গেল! শ্রোতাদের মধ্যে জোরালো প্রতিবাদের ঝড় উঠল একটা। উদ্যোক্তাদের এক-দুজন গণ্ডারনীর কাছে গিয়ে চাপাস্বরে কিছু বললেন দেখা গেল। কাঠচশমালী ওদিকে মাইকে বলছে ততক্ষণে, “অনিবার্য কারণবশতঃ গণ্ডারনী মহোদয়া তাঁর কবিতাপাঠ শেষ করতে পারলেন না। এজন্য আমরা উপস্থিত সকল বন্ধুদের থেকে মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি।”

          গণ্ডারনীকে দেখা গেল দুমদুম পা ফেলে মঞ্চ থেকে নেমে আসতে। নেমে এসেই ঝোলাঝুলি পোঁটলাপুঁটলি পিঠে নিয়ে চারিদিকে বাঁকা চাউনি মেলে তাকাতে তাকাতে আর তড়বড় তড়বড় পা ফেলে উধাও হয়ে গেল!

          যাই হোক, কবি সম্মেলন শুরু হল পুনরায়। আরও কয়েকজন কবির কবিতাপাঠের পর মঞ্চে ঘোষণা হল- কবিবর সিংহালু!

          মিষ্টি মেয়ে সিংহালুকে দেখেই হাততালির ঝড় বয়ে গেল। সিংহালু হাসি হাসি মুখে গিয়ে মাইকের সামনে গিয়ে বলতে শুরু করল-

অচিনপুরে যাই যে ভেসে,

স্বপ্ন-ভেলায়, নিরুদ্দেশে।

 

রঙের মায়া, ঢেউয়ের ছায়া-

অবুঝ চোখে সবুজ পাওয়া।

 

সুরের নদী ভাসায় যদি-

মনকেমনের ছন্দে মাতি।

 

জলফড়িং-র ডানায় কাঁপন,

মাটির টানে, সবাই আপন।।

          সিংহালুর কবিতা পড়া শেষ হতেই আরও একবার বন-ফাটানো করতালির আওয়াজ উঠল। কুমরু ঘাড় নাড়িয়ে লেজ ঝাঁকিয়ে মন্তব্য করল, “দ্যাখ, আমি তোদের বলে রাখছি, সিংহালু পুরষ্কার পাবেই। দেখছিস, মঞ্চের কবিবরেরা কেমন মাথা দোলাচ্ছে!”

          তা ঠিক। প্রবল ঝড়ে সারি সারি নারকেল গাছ যেমন মাথা ঝাঁকিয়ে দুলতে থাকে, মঞ্চের কবিবরদের মাথাও তেমনি তালে তালে ঝুলছে!

          তবে ওদের খুব ভালো লেগে গেল এর পরের কবিতাটা। ভালুকঝুলুক নামের গোলগাল এক ভালুক কবি পাঠ করল কবিতাটা-

রোগা যদি হতে চাও মোটা হও তবে,

ভালো কিছু যা পাও, পেটপুরে খাবে ।

ভোজন ভজন সম, পেটপূজা কয়-

উদরখানা পূরিলে মনে শান্তি রয়।

যেইজন দেখিবে রোগা কাঠি কাঠি,

ধাঁ করিয়া পিঠে দিবে একখানা লাঠি ।

সেই সব জিমকুমারী পায় জিরো ফিগার-

সারাদিন পেট মাপে, খালি শুচিবিকার।

 

অতএব জীবনে কোরো নাকো খেদ,

খাইবে মনের সুখে, বাড়ুক বাড়ে মেদ।

মিষ্টি-পায়েস-ঘুগনি-চাটনি যখনি যা পাবে-

খেয়েদেয়ে ভুঁড়িতে হাত বুলাইবে।

কত কিছু খাদ্য আছে, আহা, এ ভবে-

না খাওয়ার খেদ কেন জীবনেতে রবে?

 

          শুনেটুনে ভালকি বলল, “যাই বলিস আর তাই বলিস, এরই কিন্তু প্রাইজ পাওয়া দরকার!” হাতুশি নিজের পেটে থাবা বুলোতে বুলোতে বলল, “বেড়ে কবিতা রে! আমার শুনেই কিরকম খিদে-খিদে পেয়ে গেল!”

          যাই হোক, এর পরেই সিংহাইমাসী। ওরা জড়োসড়ো হয়ে বসল। বলা যায় না, কখন কী ঘটে!

ঝড়ে যদি ভাঙে ঘর, তবু তুমি জেনো-

ঠাঁই আছে আর কোথা, মানো নাই মানো।

কালো যদি থাকে তবু, সাদাও যে আছে-

রাত এলে জেনে রাখো, দিন আসে পাছে।

 

          হাতুশি শুনতে শুনতে বলেই ফেলল, “কবিতাটা ভালোই। কিন্তু কী জানিস, ঠিক সিংহাইমাসী মার্কা নয়!”

          হিনিমিনি সায় দিল, “যা বলেছিস! আমি তো ভয়ে ভয়েই ছিলাম!”

          ভালকি ভাবতে ভাবতে বলল, “আমার মনে হয়, ইচ্ছে করেই ওইসব কবিতা পড়ছে না সিংহাইমাসী। এখানকার সবাই যদি একযোগে কাঁদে কি হাসে কি লাফায়, তাহলে কী হবে ভাব তো দেখি!”

          ওদের আলোচনা চলতে চলতেই সিংহাইমাসীর বলা শেষ। হাততালিও উঠল, তবে সিংহালুর বেলায় যতটা উঠেছিল, ততটা জোরালো নয়। 

          এরপরে যার নাম ভেসে এল, শুনে ওদের আক্কেল গুড়ুম। কবিতাপাঠে আসছেন- কবিবর শিয়ালনি! কারুরই মুখে আর কথা সরে না! হাতুশির শুঁড় কেতরে গিয়ে পড়ল হিনিমিনির ঘাড়ে, হিনিমিনির লেজ সপাং করে গিয়ে লাগল ভালকির গালে, আর ভালকির আনমনে ছোঁড়া একটা ভ্যালাটে গিয়ে গদাম করে লাগল কুমরুর পিঠের কাঁটায়। ভালকি আর কুমরু- দুজনেরই গলা থেকে দুপিস আর্তনাদ বেরোল কিন্তু সেসব চাপা পড়ে গেল শিয়ালনির গমগমে কণ্ঠস্বরে! শিয়ালনি শুরু করে দিয়েছে-

উড়তে থাকে চৈতি হাওয়ায়
বছরশেষের ধুলো-
আকাশনীল দোলায় চেপে
চোখটা এবার খুলো।

চড়কশেষের গাজন হাসে,
প্রদীপ নিভে এলো-
নতুন সলতে পাকায় যে ওই
নতুন দিনের আলো।

ছুটুক দুঃখ, ঘুচুক ব্যথা,
মনখারাপের বিদায়-
চৌকাঠেতে নতুন বছর
উঁকি যে দিয়ে যায়।

হালখাতার হিসেব নিকেশ
বাদ দিয়ে দাও আজ-
নতুন দিনে নতুন শপথ
সাজছে নানা সাজ।
তাই তো হাসি, তাই তো বলি,
গাঁথো রঙীন মালা-
বেলফুলের পসরা নিয়ে
সাজাও বরণডালা।
আজকে এসো ভাগ করে নি
কান্না, দুঃখ, হর্ষ-
প্রীতিভরা শুভেচ্ছা নিয়ে
জানাই শুভ নববর্ষ।

 

          এবারে যে হাততালি উঠল, তা যেন আর থামতেই চায় না! পশুয়ারা সবাই তাজ্জব! ওদের দিদিমণি এত ভালো কবিতা লেখেন, ওরা জানেই না! ওদিকে শিয়ালনি দিদিমণি সকলকে নমস্কার জানিয়ে বলতে শুরু করেছেন, “আজকের কবিতাপাঠের আসরে আমার কবিতা যদি আপনাদের ভালো লেগে থাকে, তাহলে তার মূল কৃতিত্ব আমারই পাঠশালার পশুয়া, বাঘুর! সেই আমার অনুপ্রেরণা। পরমাণুপ্রেরণাও বলা যায়! কারণ সে এইটুকুনি পুঁচকে বাঘ। তার কবিতার ঠ্যালায় নাজেহাল হয়ে তাকে কতই বকাবকি না করেছি!”, বলেই শিয়ালনি ফোঁতফোঁত করে দুফোঁটা চোখের জল ফেলে গলার উত্তরীয়তে চোখ মুছল। তারপর ধরা ধরা গলায় শুরু করল, “কিন্তু তারপরে আমার যে কী হল- আমারও কবিতা আসতে থাকল। ওরে বাঘু রে! তুই কোথা রে? আয় বাবা, বুকে আয়!”

          বলতে বলতেই কোলাহল উঠল একটা। হাতুশিরাও এদিক-ওদিক তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করল। নাহ্‌, বাঘু নেই। কাঠচশমালীও হাতের কাগজ দেখল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আজকের কবি সম্মেলনের সর্বশেষ কবিতা পাঠ করে শোনাবেন, কবিবর বাঘু! কবিবর বাঘু, আপনি যেখানেই থাকুন, অনুগ্রহ করে মঞ্চে এসে কবিতা পাঠ করে শোনান। আমরা সকলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি।”

          বলতে না বলতেই, ভয়ানক একটা গুড়গুড় আওয়াজ ভেসে এল দূর থেকে। যেন একটা ঘূর্ণিঝড় কিংবা দাবানল ধেয়ে আসছে দূর থেকে। ‘বাঁচাও, বাঁচাও’, ‘পালাও, পালাও’ রব উঠল একটা। পশুরা যে যেখানে পারে ছিটকে পালাতে থাকল! আর তারই মাঝে শিং উঁচিয়ে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ের মত ধেয়ে এসে বলীবর্দ সোজা মঞ্চের কাছে গিয়ে পিঠের ওপর চেপে বসে থাকা বাঘুকে ফেলে দিল মঞ্চে। একেবারে শিয়ালনির বুকে!

          তারপরেই চক্রাকারে ঘুরতে থাকল বলীবর্দ। একে গুঁতোয়, তাকে ঢুঁসো মারে- বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড একেবারে। হিনিমিনি ভয় পেয়ে সোজা উঠল গিয়ে মঞ্চে। তার পিছু পিছু বাকিরাও! বাঘু এদিকে শিয়ালনি দিদিমণির কোলে এমন সেঁটে বসেছে যে তাকে আর নামানোও যায় না! দিকপাল কবিবরেরাও বেগতিক দেখে সটকে পড়েছেন যে যেখানে পারেন! রয়ে গেছে খালি কাঠচশমালী। সে এগিয়ে এসেছে, “বাঘু, তুমি বরং তোমার কবিতা ঝটপট সেরে নাও! আমি অনুষ্ঠান সমাপ্ত করে দিই!”

          বাঘু কাঁদোকাঁদো মুখে বলল, “নেই।”

          সবাই হতবাক। “কী নেই, বাঘু?” বাঘু ঘাড় নাড়তে নাড়তে বলল, “কবিতা নেই।”

          শিয়ালনি বাঘুকে এতক্ষণে কোল থেকে নামাতে পেরে হাঁসফাঁস করতে করতেই বলল, “কবিতা কী হল?”

          বাঘু ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “বলীবর্দ খেয়ে নিয়েছে।”

          হাতুশি-হিনিমিনি-ভালকি-কুমরু এগিয়ে এল চারপাশ থেকে, “বাঘু, মন খারাপ করিস না। তুই আরও ভালো ভালো কবিতা লিখবি। এটাই তো আর শেষ কবি সম্মেলন নয়! আবার হবে।”

          কাঠচশমালী লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে এল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, আসছে বছর আবার হবে। এখন চলো তো দেখি সব। খাবার জায়গায়। ষাঁড়টাও পালিয়েছে! চলো, নববর্ষের ভোজ সেরে ফেলা যাক। কী কী আছে জানো? ছানার হতভম্ব, আলুর কাতুকুতু, কাঁচকলা মারকাটারি, কুমড়োর কুস্তি, ইলিশমাছের জলকেলি, মাংসের দাবানল, মোরব্বার মহানন্দ, রসগোল্লার হামাগুড়ি, পাঁপড়ের ঝম্পড়াপড়…।”

                        ………০………

অংকনঃ পুণ্যতোয়া

বাঘু সিরিজের অন্যান্য গল্পগুলি থাবাছানি দিচ্ছে নিচের লিঙ্কেঃ-

১। বাগে এলো বাঘু

২। গিঁটের গেরোয় বাঘু

৩। বাঘু খেল ঘাস

৪। বাঘু হলেন মনিটর

৫। শিয়ালনী কুপোকাত

৬। অযোধ্যা পাহাড়ে বাঘু 

৭। পরীক্ষা দিলেন বাঘু

৮। গণ্ডারনী ও গণ্ডগোলিক্স

৯। নামতা শেখেন বাঘুবাবু

১০। শিয়ালনীর পাঠশালায় সিংহালু

১১। বাঘু হল চিৎপটাং 

১২। ঘুম দিলেন বাঘুবাবু  

১৩। পাঠশালায় ধুন্ধুমার

১৪। বাঘুবাবু ও জান্তা জট 

১৫। বনভোজনে বাঘুবাবু

১৬। হোলি খেলল হিনিমিনি      

১৭। ভোটে দাঁড়ালেন বাঘুবাবু

১৮। পাঠশালা মহাসভায় হাতুশি 

১৯। বাঘুর ল্যাজলজ্জা

২০। ছবি আঁকেন বাঘুবাবু         

২১। জানোয়ার বার্তা ও বাঘুবাবু

২২। উল্কার কবলে বাঘু

Leave a comment

Check Also

বিদেশি মোলাকাতে বাঘু- মৌসুমী পাত্র

            ধুস! ধুস! ধুস! ‘দূর ছাতা’ বলে যেদিকে দুচোখ যায়, সেদিকে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে …

উল্কার কবলে বাঘু

উল্কার কবলে বাঘু – মৌসুমী পাত্র

(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা  তোমাদের দিযছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ …

শিল্পী- সোমক সেনগুপ্ত/ জানোয়ার বার্তা ও বাঘুবাবু

জানোয়ার বার্তা ও বাঘুবাবু – মৌসুমী পাত্র

  পিঠে থলে ঝুলিয়ে বাঘু চলেছে পাঠশালার পানে। মনে বেশ খুশি খুশি ভাব। একটা গাছের …

ছবি আঁকেন বাঘুবাবু- মৌসুমী পাত্র

ছবি আঁকেন বাঘুবাবু – মৌসুমী পাত্র

(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা দিয়েছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ গল্পে। …