Home / বাঘু সিরিজ / জানোয়ার বার্তা ও বাঘুবাবু – মৌসুমী পাত্র

জানোয়ার বার্তা ও বাঘুবাবু – মৌসুমী পাত্র

শিল্পী- সোমক সেনগুপ্ত/ জানোয়ার বার্তা ও বাঘুবাবু
শিল্পী- সোমক সেনগুপ্ত

 

পিঠে থলে ঝুলিয়ে বাঘু চলেছে পাঠশালার পানে। মনে বেশ খুশি খুশি ভাব। একটা গাছের ডালকে লাঠির মতন বানিয়ে নিয়েছে আর ভুলভাল গান ভাঁজতে ভাঁজতে হাতের ডালটা সপাং সপাং এদিক ওদিক চালাচ্ছে। রাস্তার যত ধুলো পাউডারের মতন গায়ে লেপা হয়ে অপরূপ খোলতাই চেহারা হয়েছে বাঘুর, কিন্তু তার সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই!

          হেমন্তকালের এই সময়টা এমনিতে বেশ আরামের। আকাশে যে রাগী রাগী সূর্যস্যার থাকেন, তাঁর ভুরুর ভাঁজগুলো মিলিয়ে গিয়ে চোখমুখ কোমল হয়ে গেছে আর তিনি ঝকঝকে নীল আকাশে মহানন্দে সাঁতার কাটছেন!

          শরতের প্রায় শেষ অব্দিই বৃষ্টির নাচানাচি চলল এবার। বনের গাছপালাগুলোও ইচ্ছেমতন দেদার সবুজ রঙ বুলিয়ে সাজগোজ সেরেছে। উত্তুরে হাওয়ার দাপট এখনো শুরু হয়নি, তবে এলোমেলো হাওয়ার একটা শীতল আমেজ খেলা করে বেড়াচ্ছে বনময়।

          বাঘুর অবশ্য হেলদোল নেই। সে নিবির্বাদে গায়ে যথেচ্ছ ধুলো মেখে যেতে যেতেই হঠাৎ করে ডাক ছেড়ে গান ধরল-

পাঠশালেতে যাই রে আমি

পাঠশালাতে যাই-

যত খুশি ধুলো মাখি

কোন বাধা নাই।

 

আমি হলাম বাঘুবাবু

দুষ্টুমিতে হাবুডুবু-

ফাঁকিবাজির হরেক মজা

প্রাণটি ভরে পাই!

 

দিদিমণি বেজায় কড়া

লেজটি মুলে করান পড়া,

ফাঁকি একটু মারলে ’পরে

লেজবোসটি খাই।

 

বন্ধু আমার আছে চার,

দুশমন কিনা বোঝা ভার-

লিখতে দিয়ে দিদিমণি

তোলেন শতেক হাই!

 

বাঘুর গান বেশ জোরদারই চলছিল, কিন্তু আচমকাই বাঘুর লেজে পেছন থেকে এক হ্যাঁচকা টান! চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখে বাঘু, তার লেজ ধরা শিয়ালনী দিদিমণির এক থাবায়! কোমরে আর এক থাবা দিয়ে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়েছে শিয়ালনী, “অ্যাঁ? এসব কী গান হচ্ছে বাঘু, অ্যাঁ? আমি শতেক হাই তুলি? তোদের লিখতে দিয়ে? অ্যাঁ? নিজেকে তুই কী ভাবিস, বাঘু? অ্যাঁ?”

প্রথমটায় বেজায় ঘাবড়ে গেলেও সামলে নিল বাঘু, “নিজেকে আমি বাঘের বাচ্চা বলেই ভাবি, দিদিমণি!”

“অঅঅ! নিজেকে বাঘের বাচ্চা ভাবিস? তাই না?”

বাঘু চোখদুটো পেয়ারার মতো গোল, “ভুল ভেবে ফেলেছি, দিদিমণি? নিজেকে ইঁদুরের বাচ্চা ভাববো? ঠিকাছে দিদিমণি, বাড়ি ফিরে মাকে বলি বরং নিজেকে ইঁদুর ভাবতে। তবেই তো আমি ইঁদুরের বাচ্চা হবো, তাই না দিদিমণি?”

এতোই রেগে গেছে শিয়ালনী যে তার লেজ ধাঁইধাঁই করে নাচছে, কানের ভেতর সাঁইসাঁই করছে, পেটের ভেতর হাঁইফাঁই করছে, আর গলার ভেতরটা গাঁইগাঁই করছে! বাঘুকে প্রায় ঢুঁসো মারার মতন করেই তেড়ে এসেছে শিয়ালনী, “বাঘু! বাঘুউউউউ! ছি… ছি ছি ছি! আমার নামে গিয়ে এসব উল্টোপাল্টা বলবি? এখনও পাঠশালে ঢুকিনি, এর মধ্যেই বদমাশি শুরু করে দিয়েছিস, না?”

বাঘু সুবোধ জন্তুর মত ঘাড় কাত করল, “ইসসস! তাই তো দিদিমণি! আপনি পাঠশালে ঢোকার পরেই বদমাইশি শুরু করা উচিত ছিল! ভুল হয়ে গেছে দিদিমণি, আর হবে না।”

রাগের চোটে ইড়িং বিড়িং লাফাতেই শুরু করে দিয়েছে শিয়ালনী। কী হতো বলা যায় না, কিন্তু ভাগ্যিস, হাতুশি আর হিনিমিনি পেছন থেকে এসে হাজির বলে শিয়ালনীর রাগ অনেকটাই পড়ে গেল আর পাঠশালাতে গিয়ে ক্লাসও শুরু হল।

 

 

পাঠশালা বসেছে ঠিকই কিন্তু শিয়ালনীর মেজাজ চটিতং! ‘অঙ্ক আবেশ’ বইটা থেকে অঙ্ক শেখাচ্ছে শিয়ালনী। “শোন্‌, তোদের আমি আজ সরল শেখাবো। কারুর যেন কোন বেচাল না দেখি!”

শুনেই বাঘু চোখ তুলল আকাশে, “সরল? সরল নাম দিয়ে জটিল জিনিস শেখানোর মতলব নির্ঘাত! বুঝিনা যেন!”

দিদিমণি বোর্ডের দিকে পিছন ফিরে ছিলেন বলে শুনতে পাননি, তাই রক্ষে। কিন্তু হাতুশি শুঁড় বাগিয়ে কটমট করে চেয়ে আছে দেখে বাঘু সামলে নিল। যতোই হোক, ক্লাসের মনিটর! দিদিমণিকে বলে দিলে মুশকিল!

দিদিমণি এদিকে নিয়ম শেখাতে শুরু করেছেন- “শোন্‌, একই অঙ্কে যোগ, বিয়োগ, গুণ আর ভাগ একইসঙ্গে থাকলে সবার প্রথমে হবে…”, বলতে বলতেই শিয়ালনীর চোখ গেছে বাঘুর দিকে। সে তখন একমনে সামনের মাটি আঁচড়াচ্ছে থাবা দিয়ে। শিয়ালনী পড়াতে পড়াতেই তার দিকে চাইল জ্বলজ্বলে চোখে, “সব্বার প্রথমে হবে… বাঘু! বাঘুউউউউ!”

অমনি বাঘু হাঁইমাঁই করে উঠল, “সবার প্রথমে আমি কিছুতেই হব না, দিদিমণি! আপনি করবেন সরল, আর আমি থাকব সবার প্রথমে? এ আবার কিরকম কথা, দিদিমণি? ওই হাতুশিকে রাখুন বরং, ও সরলে প্রথম হোক, দিদিমণি!”

শিয়ালনী রেগেমেগে প্রথমে দুহাত ছুঁড়ল, তারপর দু’পা ছুঁড়ল। তারপর লেজখানাকে কাঁপাতে কাঁপাতে হাঁইহাঁই করে তেড়েই এল বাঘুর দিকে, “বাঘু! বাঘুউউউউ! আমার সঙ্গে কায়দাবাজি? আমার সঙ্গে চালাকি? প্রশ্ন করেছি, সরল অঙ্কে যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ একসঙ্গে থাকলে সবার প্রথমে কোন্‌টার কাজ হবে? অ্যাই অ্যাই অ্যাই… তোরা কেউ বলবি না। যা বলার বাঘু বলবে। বাঘুউউউউ…”

বাঘু বিনয়ের সঙ্গে বলল, “দিদিমণি, সরলের নামে এত জটিল জিনিস কি আর আমি পারি? আপনিই বলুন।”

শিয়ালনী আর কথা না বাড়িয়ে বলল, “ভাগ।”

যেই না বলা, বাঘু অমনি ছুটতে শুরু করেছে। শিয়ালনীসহ সবাই থমকে গেছে প্রথমটায়। যা-যা ধর-ধর রব উঠল একটা। হাতুশি চটপট দৌড়ে গিয়ে বাঘুকে আলতো করে শুঁড়ে পেঁচিয়ে নিয়ে এসে ধমাস করে ফেলল শিয়ালনীর সামনে। শিয়ালনীর চোখদুটো গরম পান্তুয়ার মতো টকটকে লাল, “বাঘু! বাঘুউউউউ! কী ভেবেছিস কী তুই? পড়ার মাঝে অমন হুড়ুদ্দুম করে ছুটলি যে বড়?”

বাঘু লেজখানাকে গালে ঠেকিয়ে ভারি অবাক হবার ভঙ্গি করে বলল, “বা রে, দিদিমণি! আপনিই তো বললেন, ভাগ! তা আপনি ভাগ বললে আমি কি আর আপনার কথার অবাধ্য হতে পারি?”

শিয়ালনী ধাঁই ধাঁই করে বারকয়েক কপাল চাপড়ে ডুকরে উঠল, “ওরে! এ ভাগ সে ভাগ নয়! আমি বলেছি, সরলে যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের মধ্যে সবার প্রথমে আসে ভাগ। তারপরে গুণ, তারপরে যোগ, তারপরে বিয়োগ। বুঝলি?”

ধমকধামক খেয়ে বাঘু সুড়সুড় করে নিজের জায়গায় গিয়ে বসল ঠিকই, কিন্তু পাশে বসা ভালকিকে শুনিয়ে শুনিয়ে সমানে গজগজ করতেই থাকল, “আমার কী দোষ? বলি, আমার দোষটা কোথায়? উনি ভাগ বলবেন, আর ওনার কথামতো ভাগলেও দোষ! আমারই হয়েছে যত জ্বালা! আমি ফাঁকি মারলেও দোষ… লেখাপড়া না করলেও দোষ… ভেগে গেলেও দোষ… ক্লাসের সময় আকাশের দিকে চাইলেও দোষ…অন্যের টিফিন কেড়ে খেলেও দোষ…”

ভালকি বাঘুর কথায় মোটেও পাত্তা দিল না। সে খালি তার ব্যাগের মধ্যে উঁকি মেরে টুথপেস্টটা ঠিকঠাক আছে কিনা একবার দেখে নিল।

দিদিমণি এদিকে বোঝানো শেষ করে বোর্ডে সরলের অঙ্ক বোঝাচ্ছেন। বাঘু খানিকক্ষণ পেনসিলের পেছন চুষল, খানিকক্ষণ খাতায় আবোলতাবোল টুকল, তারপর খাতার পেছনে হাতুশির শুঁড়ের ছবি আর ভালকির পেটের ছবি আঁকল। তারপর খুব মন দিয়ে খাতায় শিয়ালনীর লেজের ছবি আঁকতে শুরু করল।

লেজ আঁকায় বাঘু বিভোর, এমন সময় পাঠশালার বাইরে থেকে মিহি গলায় ডাক ভেসে এল- আচ্ছা, এটাই কি শিয়ালনীর পাঠশালা?

শিয়ালনী কেন, ওরা সবাই-ই ঘাবড়ে গিয়ে বাইরের দিকে চাইল। তাকিয়ে দেখে, সবাই-ই তাজ্জব! পাঠশালার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বেশ চকরাবকরা জামা আর খাটো প্যান্ট পরা এক হরিণী, আর তার মাথার শিং-এ আটকানো একটা সানগ্লাস। হাতে একটা পেন আর নোটবুক নিয়ে সে বেশ উদগ্রীব ভঙ্গিতে চেয়ে আছে। আর তার পাশেই একটা মোটাসোটা চেহারার সজারু। সে পরে আছে একটা হাতকাটা গেঞ্জি আর পাশবালিশের খোলের মতন পাজামা। তার হাতে তাক করা একখানা জবরদস্ত ক্যামেরা। কাঁধে একটা ঝোলা। সে খচাখচ এপাশ ওপাশের ছবি তুলছে।

শিয়ালনী বেজায় অবাক হয়ে ভুরু তুলল, “হ্যাঁ, এটাই শিয়ালনীর পাঠশালা। কিন্তু আ… আপনাদের তো ঠিক চিনলাম না…!”

ক্যামেরাবিদ সজারু এদিকে পটাপট ছবি তুলেই যাচ্ছে শিয়ালনীর হাঁ হওয়া মুখের। তাই দেখে বাঘু ভেতরদিকে সরে গিয়ে থাবা দিয়ে মাথা গোঁফ লেজ ঝেড়েমুছে যথাসম্ভব পরিপাটি হয়ে শিয়ালনীর পিছনে গিয়ে উঁকি মারল। এদিকে নোটবই হাতে হরিণী এগিয়ে এসেছে ততক্ষণে, “নমস্কার, নমস্কার! আপনিই নিশ্চয়ই শিয়ালনী দিদিমণি। ঠিকই ধরেছি… হুঁ হুঁ…”, বলেই পাশে দাঁড়ানো শজারুর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসল।

অমনি বাঘু ফস করে বলে বসল, “কাকে ধরেছেন? আমাদের দিদিমণিকে ধরার চেষ্টা করলে কিন্তু ছেড়ে কথা কইব না, বলে দিলাম।” হরিণী ভুরু কুঁচকে তার দিকে চাইল, “ও! তুমিই নিশ্চয় বাঘু! তাই-ই তো? ঠিক ধরেছি!”, বলেই সজারুর দিকে তাকিয়ে মিচিক মিচিক হাসি দিল।

ভালকি কোমরে থাবা দিয়ে জ্বলজ্বলে চোখে চাইল, “আমাদের দিদিমণিকে ধরছেন, বাঘুকেও ধরছেন- এ আবার কেমন কথা? আপনারা কি জন্তুধরা? মানে মানুষদের ছেলেধরার মতন? মানুষদের দেওয়া নাম আমরা নিই না কিনা, তাই জন্তুধরা বললাম।”

শিয়ালনী সামলানোর চেষ্টা করল পশুয়াদের, “থাম দেখি তোরা। আমাকে দেখতে দে।”, বলেই হরিণীর দিকে ফিরল শিয়ালনী, “দেখুন, এই জঙ্গলে একটাই পাঠশালা। শিয়ালনীর পাঠশালা। কাজেই আমি যে শিয়ালনী এটা বোঝারই কথা। কিন্তু আপনাদের পরিচয়, আগমনের উদ্দেশ্য এসব জানলে কিঞ্চিৎ বাধিত হই।”

হরিণী শিং থেকে চশমা নামিয়ে গলায় ঝোলাল। তারপর গলা খেলিয়ে বলল, “আমি হলাম ‘জানোয়ার বার্তা’র সাংবাদিক হরিণচূড়া। আমার সঙ্গে আছেন আমাদের ‘জানোয়ার বার্তা’র চিত্র-সাংবাদিক সজারুপুট।”

শিয়ালনী কোনমতে খালি বলতে পারল, “ও হো হো হো!”

বাঘু এক ঠেলা দিল হাতুশিকে, “হ্যাঁ রে, চিত্র-সাংবাদিক কী রে? নাম বলছে আবার সজারুপুট! পুট করে কাঁটা বিঁধিয়ে দেবে না তো?”

হাতুশি ফিসফিস করে বলল, “দূর, কী যে বলিস ঠিকঠিকানা নেই। কাঁটা কেন বেঁধাবে? চিত্র সাংবাদিক মানে খবরের সঙ্গে যিনি ছবি তোলেন।”

বাঘু প্রকাণ্ড একটা হাই তুলে বলল, “অ।”

হরিণচূড়া এদিকে বলে চলেছে, “আপনি যখন এতবড় একটা দিদিমণি, ‘জানোয়ার বার্তা’র নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন?”

‘এতবড় একটা দিদিমণি’ শুনে শিয়ালনী বেজায় ঘাবড়ে টাবড়ে গিয়ে কোনমতে খালি বলতে পারল, “হ্যাঁ… মানে আমি জানোয়ার… ইয়ে মানে জানোয়ার বার্তা… হুনেছি ইয়ে মানে হুড়েছি…”

হিনিমিনি চাপা গলায় বলল হাতুশিকে, “হ্যাঁ রে, দিদিমণির ‘শুনেছি’ যে ‘হুনেছি’ হয়ে গেল রে!”

হাতুশিও শুঁড় ঠেকাল হিনিমিনির কানে, “‘পড়েছি’টাও ‘হুড়েছি’ হয়ে গেছে! হিহি!”

শিয়ালনী ততক্ষণে কিছুটা সামলেছে নিজেকে, “কিন্তু আমার পাঠশালায়… মানে আমার পাঠশালায় সাংবাদিক… মানে এখানে আবার খবর তেমন কিছু… মানে ঠিক বুঝতে পারছি না…”

হরিণচূড়া এক গাল হাসল, “আরে, সেসবই তো বলতে এলাম। আমাদের ‘জানোয়ার বার্তা’র সম্পাদক ভালুপ্রাণিকা সমাচারিকা আমাকে ডেকে বললেন, “ওরে, ‘শিয়ালনীর পাঠশালা’ নিয়ে একটা প্রতিবেদন তো এবারে না বের করলেই নয়! আমাদের পশুকুলের বদনাম হয়ে যাচ্ছে!”

শিয়ালনী হতভম্ব হয়ে বলল, “কিন্তু… আমি… আমি তো তেমন কিছু খারাপ কাজ করিনি। পাঠশালে আসি, ওদের পড়াই টড়াই, চলে যাই। ওদের জন্তুর মতন জন্তু গড়ে তোলার চেষ্টা করি, এই যা।”

হরিণচূড়া শিং-র অদৃশ্য ধুলো কিঞ্চিৎ সাফ করে বলল, “আহা! খবর মানেই কি খারাপ? ভালো খবরও তো হয়! আপনি জানেনই না, আপনার পাঠশালা নিয়ে বাইরে মানুষদের জগতে কী চলছে!”

শিয়ালনীর নাকের চশমা ঝুলে ঠোঁটের কাছে প্রায় নেমে এসেছে, “সে কী কথা? আমার পাঠশালা নিয়ে?”

হরিণচূড়া মিটিমিটি হাসল, “হ্যাঁ, আপনার পাঠশালা নিয়ে। মানুষের জগতে আপনার পাঠশালার খবর বেরিয়ে গিয়ে বেজায় হইচই বেধে গেছে। আপনার পাঠশালার কাণ্ডকারখানা নিয়ে মানুষেরা কত গল্প ফেঁদেছে জানেন! তারপর এই যে বাঘু… বাঘুর গল্প শুনতে মানুষের বাচ্চারা মুখিয়ে থাকে সেকথা জানেন? আবার আপনার পাঠশালার কাহিনী নিয়ে বইও বের করার তোড়জোড়ও করছে শুনছি মানুষেরা।”

শুনেই শিয়ালনীর গালে থাবা, “সে কী কথা? কী সাঙ্ঘাতিক!”

হরিণচূড়া সায় দিল, “সাঙ্ঘাতিক বলে সাঙ্ঘাতিক!”

সজারুপুট এতক্ষণ ধরে এপাশ ওপাশের ছবি তুলে যাচ্ছিল খচাক খচাক করে। এবারে এগিয়ে এল, “হ্যাঁ, ওইজন্যি তো। সম্পাদক মহোদয়া বল্লেন, বল্লেন কী- ওরে সজারুপুট, তুই যা। হরিণচূড়ার সাথে। তুই ছাড়া অম্নি ভালো ছবি কে আর তুলবে বল? তা আমিও অম্নি চটপট ক্যামেরাখানা গুছিয়ে ফেল্লুম- হুঁ হুঁ অ্যায়সান ক্যামেরা এ তল্লাটে পাবেন না। ধারেকাছে ভূত পেলে ভূতের ছবি অব্দি তুলে দিতে পারি! হে হে!”, বলেই সজারুপুট বেশ গর্ব গর্ব চোখে ইতিউতি চাইল।

হাতুশির বেজায় হাসি পাচ্ছিল, হিনিমিনির কাঁধে শুঁড় রেখে ফুচ ফুচ করে দু’বার হেসে নিল। ভালকিও হাসতে যাচ্ছিল কুমরুর থাবা ধরে। কিন্তু কাঁটার ভয়ে কুমরুর লেজের ডগা ধরেই ফিকফিক করে হেসে নিল। খালি বাঘুই একখানা লাফ মেরে সোজা গিয়ে পড়ল সজারুপুটের সামনে আর শুরু হয়ে গেল তার কথার ফুলঝুরি, “ইসসস, তুমি ক্কী ভালো গো, সজারুপুটদাদা! আমার না ক্যামেরায় ছবি তোলার খুব শখ! নেহাত কোথাও কোন ক্যামেরা পাইনি বলে আজ অব্দি কারুর ছবি তুলতে পারিনি। তা সজারুপুটদাদা, তুমি কত্তো ভালো গো! তোমার ভুঁড়িটা কত্তো সুন্দর গো! দাও না দাদা, তোমার ক্যামেরাটা। ধারেকাছে দু-চার পিস ভূত পাই তো ছবি তুলি!”

সজারুপুট শশব্যস্ত হয়ে নিজের ক্যামেরাটা আগলে নিয়ে বলল, “না না বাঘু, তোমায় ভরসা কত্তে পারছিনি। যা সব ইন্তিড়ি বিন্তিড়ি কাণ্ড শুনি তোমার… কোথায় প্যাট করে ভেঙে ফেলবে আমার এত সাধের ক্যামেরা…”

বাঘু ক্যামেরার স্ট্র্যাপটা ধরে টানাটানি করতে করতে বলল, “না না, সজারুপুটদাদা, প্যাট করে কেন ভাঙবো? তোমার নাম তো সজারুপুট… ভাঙতে হলে পুট করেই ভাঙবো… প্যাট করে ভাঙলে কি ভালো দেখায়, তুমিই বলো?”

সজারুপুটের তো শুনেটুনে আক্কেলগুড়ুম! ক্যামেরাটাকে আঁকড়ে ধরে রীতিমতো কাঁপতে কাঁপতে বললো, “এইজন্যি… এইজন্যি আমি আসতে চাইনি এখেনে… আমি পইপই করে বল্লুম মহোদয়াকে… ওখেনে বাঘু আছে… আমার ক্যামেরা সুস্থ শরীলে ফিরলি হয়… তা তিনি সে কতা কানে নিলে তো!”

তা এসব কথায় কি আর বাঘু ভোলে? সে ক্যামেরা ধরে টানাটানি করতেই থাকল সমানে, “ও দাদা গো… ক্যামেরা দাও গো…তোমার দুটি পায়ে পড়ি গো… না না, পায়ে না, ভুঁড়িতে পড়ি গোওওও…”

বেগতিক দেখে এক হুংকার দিল শিয়ালনী, “বাঘু! বাঘুউউউউ! কী হচ্ছে, এদিকে আয়! বলি, ইদিকে আয়! ওঁরা এসেছেন পাঠশালার খবরাখবর নিতে। আর তুই সেখানে বদমাশি শুরু করেছিস! ছি ছি! পাঠশালার বদনাম না করে ছাড়বি না দেখছি। এদিকে আয়। বলি, ইদিকে আয়! নো চালাকি, নো কায়দাবাজি!”

ধমক খেয়ে বাঘু নিজেই নিজের লেজ মুলতে মুলতে সুড়সুড় করে ফেরত এল। হরিণচূড়া বাঘুর দিকে খানিকক্ষণ অপলকে চেয়ে থেকে বলল, “দিদিমণি, চলুন, আমরা বরং বসি। আপনার সাক্ষাৎকার নেবো। একে একে ওদের সবারও নেবো। জম্পেশ করে একটা খবর করতে হবে। অ্যাইয়ো পশুয়ারা, দিদিমণির সঙ্গে আমি কথা বলছি। তোমরা বরং ততক্ষণে খেলাধুলো করো।”

শিয়ালনী আঁতকে উঠে বলল, “সে কী কথা? পাঠশালে পড়ার সময়ে খেলাধুলো করবে কি? ওদের আমি বরং কিছু থাবালেখা দিই, ওরা করতে থাকুক। আপনি সামান্য বসুন বরং।”

এই বলে শিয়ালনী ওদের সবাইকে বসিয়ে দুখানা জবরদস্ত থাবালেখা দিল। প্রথমটা হল-

দুর্গম কন্টকময় গহীন অরণ্য/ ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত যত বন্য।

আর দ্বিতীয় থাবালেখা দিয়েছে শিয়ালনী-

ধায় ষণ্ড, বেগে প্রচণ্ড, করে সব লণ্ডভণ্ড,/ হাসে ভণ্ড, দেখে কাণ্ড, এতদূর পাষণ্ড!

থাবালেখা নিয়ে রীতিমতন ঘামছে সবাই। বাঘু আবার লেজ দিয়ে নিজের কপালের ঘাম মুছতে গিয়ে ভুল করে হিনিমিনির কপালের ঘামই মুছে ফেলল। হিনিমিনি হাঁইহাঁই করে উঠছিল ঠিকই, কিন্তু হাতুশির চোখের ইশারায় চুপ করে গেল।

হাতুশির ইশারা করার কারণ আছে। ওদিকে সাক্ষাৎকার শুরু হয়ে গেছে। শিয়ালনী বসে আছে হরিণচূড়ার মুখোমুখি আর সজারুপুট নানান দিক থেকে নানান কোণে একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছে। শিয়ালনীও মাঝেমধ্যেই ঘাম মুছছে।

সাক্ষাৎকার হল এরকম-

হরিণচূড়াঃ দিদিমণি, আচ্ছা, এই পাঠশালার ভাবনা আপনার মাথায় কিভাবে এল?

শিয়ালনীঃ (এহুম এহুম করে বারকয়েক কেশে) আসলে ব্যাপারটা হল, আমার মায়েরও পাঠশালা ছিল। সেখানে আমি পড়তাম। এখন এই যে পশুয়াদের দেখছো, ওদেরও বাবামায়েরা অনেকেই পড়ত। তো যাই হোক, আমরা সবাই বড় হতে সে পাঠশালার ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেল। তারপর এরা সব জন্মাল, কিছুটা বড় হল। তখন আমি আবার নতুন করে পাঠশালা খুললাম।

হরিণচূড়াঃ আচ্ছা, আপনার পাঠশালা কিছুদিন আগে ‘সেরা পাঠশালা সম্মান’ পেল না পাঠশালা মহাসভায়?

শিয়ালনীঃ (চোখ বড়ো বড়ো করে) ব্বাব্বা, সে খবরও রাখো? শোনো, কী হয়েছিল বলি। ওই যে হাতুশিকে দেখতে পাচ্ছো তো? একমনে থাবালেখা করছে? তো ও হচ্ছে আমার পাঠশালার সেরা পশুয়া। তার সঙ্গে মনিটরও। তো ওকেই আমি পাঠশালা মহাসভায় পাঠাতে চেয়েছিলাম কারণ, আমি জানতাম যে পুরস্কার আনতে পারলে ওই পারবে। বাঘু অবশ্য যেতে চেয়েছিল এটা ঠিক, ওর জেদাজেদিতে একটা ভোটাভুটিও হয়েছিল, সেটাও ঠিক। সেটাতেও হাতুশিই জিতেছিল। বাঘু জিতলেও ওর সঙ্গে হয়তো হাতুশিকেও পাঠাতে হত, বিশেষ অনুমতি নিয়ে।

হরিণচূড়াঃ আচ্ছা, এবারে আসি বাঘুর কথায়। বাঘু নাকি খুব দুষ্টু, ক্লাসে খালি উৎপাত করে আর আপনার বকুনি খায়? একথা কি সত্যি?

শিয়ালনীঃ (ঈষৎ থতমত খেয়ে) দেখুন, বকুনি দেওয়া দিদিমণির ধর্ম। পালক ছাড়া যেমন পাখি হয়না, তেমনি বকুনি ছাড়া দিদিমণি হয় না! আর বাঘুর বদমায়েশি নিয়ে যদি আপনার বেশি জানার ইচ্ছে থাকে, তাহলে বাঘুকে আমি দিনসাতেকের জন্য আপনাদের ‘জানোয়ার বার্তা’র দফতরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আশা করি তার পরে আর আমাকে বিশদে ব্যাখ্যা করতে হবে না।

হরিণচূড়াঃ (এতক্ষণে প্রথম ঘাবড়ে গিয়ে) না না, কী দরকার? আপনাকে না পেয়ে বাঘু যদি কেঁদে ফেলে? আমি আবার বাচ্চাদের কান্নাকাটি মোটে সহ্য করতে পারি না।

পাশ থেকে সজারুপুটঃ (ছবি তোলা থামিয়ে) দিদিমণি, বাঘুর লেকাপড়া কামাই হবে, সে কি ঠিক হবে? তাপ্পর আমার ক্যামেরা ভেঙে ফেল্লে সম্পাদক মহোদয়া যদি রেগে যান? ক্যামেরা ভাঙলে তাঁর রাগ হতিই পারে! আর রাগ হলি যদি বাঘু কানমলা, নাকমলা, লেজমলা খেয়ে যায়, সে কি ভালো হবে, দিদিমণি? তার চে’ বাঘু এইখেনেই থাক। পরে আমি একপিস খেলনা ক্যামেরা নিয়ে ওকে বাঘ-ভুলানো করে যাবো বরং!”

হরিণচূড়াঃ (তাড়াতাড়ি করে সজারুপুটকে থামিয়ে) আহা, সজারুপুট, বাঘুর কথা এখন থাক। দিদিমণি, বাকিদের সাক্ষাৎকার সেরে নিই পরে আবার আপনার সঙ্গে বসবো।

 

বাকি পশুয়াদের সাক্ষাৎকারের সময় বিশেষ ঝামেলা হয়নি। খালি ভালকিকে টুথপেস্টের কথা জিজ্ঞেস করায় ভালকির মুখ শুকনো হয়ে গিয়েছিল। নেহাত শিয়ালনী দিদিমণি তড়িঘড়ি এসে পড়ে বললেন, “আহহা, ওকে আবার ওসব বলা কেন, হরিণচূড়া? বাচ্চা ভালুক, একটু আধটু মন তো যেতেই পারে। বড়দেরই তো…”, এই বলেই শিয়ালনী কে জানে কেন থেমে গেল।

বাঘুর সাক্ষাৎকার সবার শেষেই রেখেছিল হরিণচূড়া। বাঘুর সাক্ষাৎকার শুরু হতে না হতেই সকলে তটস্থ! বাঘু এদিকে বসেছে খোশমেজাজে একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে।

হরিণচূড়া মুখে একটা বড়সড় হাসি ঝুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী গো বাঘু, কেমন আছো?”

বাঘু একটা হাই তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে উত্তর করল, “আর কেমন থাকবো? এই খাচ্ছি দাচ্ছি, পাঠশালে আসছি, ফাঁকিবাজি করছি, তার জন্য বকুনিও খাচ্ছি, লম্বাগুড়ি দিচ্ছি, মাঝেমধ্যে মনের দুঃখে নিজের লেজ নিজে মুলছি- এইসব আর কী!”

হরিণচূড়া খানিক ঘাবড়ে গেলেও সামলে নিল, “শুনতে পাই, তুমি নাকি খুব দুষ্টু?” বাঘু মুখচোখ কাঁদোকাঁদো করে বলল, “কোথায় আর দুষ্টুমি করতে পাই? সারাদিনে বলে একটুও দুষ্টুমি করতে পাই না। এই সকাল থেকে মোটে দুবার হিনিমিনিকে ভেংচি কেটেছি, কুমরুর লেজ ধরে তিনবার টেনেছি আর ভালকিকে পাঁচ কিল দিয়েছি। তাতে ভালকি আমাকে নাকে অ্যায়সান ভালুক্সিং দিয়েছে যে এই দেখুন, নাকটা এমনি ফুলে আছে।” তারপরই গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল বাঘু, “শোনো, তোমরা একটু লিখো আমাকে যেন দুষ্টুমি করতে দেয়। দিদিমণির এমনি কড়া নজর যে এট্টুও ভালো লাগে না। এত নজর রাখার কী আছে, তোমরাই বলো।”   

“আচ্ছা বাঘু, তুমি কি জানো যে মানুষের বাচ্চারা তোমার গল্প পড়তে খুব পছন্দ করে?”

বাঘু আরও হেলান দিয়ে গাছের গুঁড়িতে মাথা দিয়ে চিৎপাত হয়ে শুয়ে মন্তব্য করল, “না, তা আর জানবো কোত্থেকে? এ তো আর পাঠশালের বইতে লেখাও নেই, আর দিদিমণি বোর্ডে আঁক কষে বুঝিয়েও দেননি- তাহলে আর জানবো কোত্থেকে?”

হরিণচূড়ার মুখ দিয়ে ‘মিনিৎ কিৎ’ গোছের বিচিত্র একখানা আওয়াজ বেরোল আর তার সঙ্গেই সে চোখ বড়ো বড়ো করে জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে ফেলতে পরের প্রশ্নে গেল, “আচ্ছা বাঘু, বড় হয়ে তুমি কি হতে চাও?”

“আমি? বড় হয়ে?”, বাঘু বেজায় কায়দা করে কাঁধ ঝাঁকাল, “এ আবার একটা প্রশ্ন হল? বাঘের বাচ্চা বড় হয়ে কী হবে? বাঘ হবে। মানুষের বাচ্চা বড় হয়ে মানুষ হবে, হাতির বাচ্চা বড় হয়ে হাতি হবে, শিয়ালের বাচ্চা বড় হয়ে শিয়াল হবে। এই যেমন আমাদের দিদিমণি হয়েছেন…”

বাঘু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, হরিণচূড়া তড়বড় তড়বড় করে তাকে থামাল, “তোমার পাঠশালায় পড়তে কেমন লাগে বাঘু?”

বাঘু চোখ পিটপিট করল, “কেমন লাগে? তাহলে বলি? দিদিমণির কাজ হচ্ছে পড়ানো, তাই উনি পড়ান। আর ওদের কাজ হচ্ছে পড়া করা, তাই ওরা পড়ে। আর আমার কাজ হচ্ছে ফাঁকি মারা, তাই আমি ফাঁকি মারি!”, বলতে বলতেই বাঘু এক হাঁক দিয়েছে, “ও সজারুপুটদাদা, এদিকে এসে আমার জব্বর দেখে একটা ছবি তুলে দাও তো!”

সজারুপুট এতক্ষণে সামলে সুমলে একটু দূর থেকেই বাঘুর ছবি তুলছিল। বাঘুর কথা শুনে তার একদম সামনে এসে হাঁটু মুড়ে বসে ক্যামেরা তাক করে ছবি তুলতে গেল। বাঘু ছিল অপেক্ষায়। তৎক্ষণাৎ সজারুপুটের ক্যামেরার স্ট্র্যাপে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে চেঁচিয়ে উঠেছে, “হা রে রে রে রে রে, ছবি তুলব এবার রে!”

বলেই ক্যামেরা নিয়ে দে দৌড়! সজারুপুটের মুণ্ডু গোড়ায় চরকির মত চাঁই করে ঘুরে গেল বটে, কিন্তু তার পরই সেও ছুটল বাঘুর পিছু পিছু।

বাঘু ছুটছে বেগে। তার পেছনে সজারুপুট হাঁফাতে হাঁফাতে পিছু ধাওয়া করেছে। তারও পিছন পিছন শিয়ালনী আর পাঠশালার বাকিরা। সজারুপুট ধুপধাপ করে দৌড়োতে দৌড়োতেই বিলাপ করছে, “এইজন্যি… এইজন্যি… বাঘুর নাম শুনেই আমি আর আসতে চাইনি মোট্টে… কী বিচ্ছু বাঘের বাচ্চা রে বাবা… ওরে… থাম! থাম বলচি। আমার ক্যামেরা দে… দে বলছি। আমার ক্যামেরা ভাঙবিনি মোটে…আমার বলে এখনো ভূতের ছবি তোলা হয়নি…”

কিন্তু ওসব কথায় কি আর বাঘু ভোলে? সে ক্যামেরাটাকে মাথার ওপর ঘোরাতে ঘোরাতে ছুটতে ছুটতে গান জুড়েছে- হা রে রে রে রে!/ যত খুশি ছবি তুলি রে/ ভূতের ছবি দু-চার পিস রে/  কে বা আমায় ধরে/রে রে রে রে রে

বলতে বলতেই একখান পাথর বা নুড়িতে হোঁচট খেয়ে দমাস করে পড়ল বাঘু। সঙ্গে পড়ল তার হাতে ধরা ক্যামেরাটা। সজারুপুটও পুঁইইইইই করে দৌড়ে এসে টান মেরেছে ক্যামেরায় আর… ব্যস! পুট করে লেন্সখানাই গেল ভেঙে!

হায় হায় হায় হায় রব উঠল একটা আর সেই সঙ্গে শোনা গেল সজারুপুটের আর্তনাদ, “আমার ক্যামেরা! আমার ক্যামেরাখান গেল গোওও! কী বিচ্ছিরি বেয়াক্কেলে বাঘবাচ্চা রে বাবা! আমার ক্যামেরা গোওওও! এইজন্যি… এইজন্যি আমি আসতে চাইনি গোওওও…এই বিটকেল বাঘুর ভয়ে গোওও… এখন আমার ক্যামেরার কী হবে গোওও…”

শিয়ালনী লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এসে বাঘুর লেজ ধরে অবলীলাক্রমে শূন্যে তুলে বাতাসেই বারকয়েক পাঁইপাঁই করে চরকিপাক খাইয়ে দিল। তারপরেই বোমা ফাটানো হাঁক ছাড়ল, “বাঘু! বাঘুউউউউ! পাঠশালায় তুই যা করিস করিস, তাই বলে তুই ক্যামেরার কাঁচ ভাঙবি? ক্যামেরাটা ভাঙচুর করবি? কত ক্ষতি করে দিলি জানিস? ভয়ানক বিটকেল তুই…”

ঝুলন্ত অবস্থাতেই কান্না জুড়ে দিল বাঘু, “নাআআআআ দিদিমণি… আমি ইচ্ছে করে মোটেও ভাঙিনি দিদিমণি গোওওও… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… সজারুপুটদাদা টানল বলেই তো ভাঙল গোওওও… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… আমি তো খালি ছবি তুলতে চেয়েছিলাম গোওওও…আমাকে গোড়াতে ছবি তুলতে দিলেই আর ল্যাঠা ছিল না গোওওও… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)…”

হরিণচূড়া হাঁফাতে হাঁফাতে এগিয়ে এসেছে ততক্ষণে, “আহহা! বাঘু! কাঁদিস নে রে, কাঁদিস নে! বাচ্চাদের কান্না আমার আবার মোটে সহ্য হয় না”, বলেই ফুঁচ ফুঁচ করে দুবার নাক টানল সে, “অত কান্নার কী আছে? আর সজারুপুট, আরেকটা বাড়তি ক্যামেরা ভালুপ্রাণিকা সমাচারিকা মহাশয়া দিলেন না? ওটা দিয়েই কাজ চালাও।”

সজারুপুট মুখ গোঁজ করে বলল, “কিন্তু ওই ক্যামেরাটা ছোট আর মোটে ভালো ছবি ওঠে না… এটায় কত কত ভালো ছবি তুলেছিনু…”

হরিণচূড়া এক ধমক দিল, “আরে, রাখো তো তোমার ভালো ছবি… যা ছবি হয় তাই-ই তোলো… জন্তুরা তো পড়বে আমার লেখা…”

বেচারি সজারুপুট আর কী বা করে? বাধ্য হয়ে ঝোলা থেকে একখানা ছোট ক্যামেরা বের করে ছবি তুলল যেমন পারে। শিয়ালনীর পাঠশালার সকলের গ্রুপ ফটোও উঠল একটা।

 

দিন সাতেক পরে। পাঠশালা বসতে না বসতেই হাসিহাসি মুখে ঢুকল শিয়ালনী। হাতে ধরা একখানা খবরের কাগজ। দেখেই হইহই করে উঠল সকলে- “জানোয়ার বার্তা! জানোয়ার বার্তা!”

শিয়ালনীও হাসল, “ইয়েস! জানোয়ার বার্তা!”

বাঘু বলল, “দিদিমণি, আমার হাতে দিন। আমি দেখবো আগে।”

শিয়ালনী গম্ভীর সুরে বলল, “না, কাগজ আমার হাতেই থাকবে। এই আমি রাখছি এখানে। সবাই মিলে একসঙ্গে দেখা হবে। নো চালাকি, নো কায়দাবাজি!”

 

তারপর? তারপর সকলে মিলে একসঙ্গে ঝুঁকে পড়তে থাকল কাগজখানা-

পাঠশালা মহাসভায় পুরস্কার পাব, জানাই ছিলঃ শিয়ালনী
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ সম্প্রতি আমরা গিয়েছিলাম শিয়ালনীর পাঠশালায়। নানা কারণে এই পাঠশালাটি এখন বহু আলোচিত। আমরা সেখানেগিয়ে পাঠশালার সকল পশুয়া এবং পাঠশালার কর্ণধার মাননীয়া শিয়ালনী দিদিমণির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। পাঠশালার পশুয়া বর্তমানে মোট পাঁচজন- হাতুশি, হিনিমিনি, ভালকি, কুমরু এবং বাঘু। হাতুশি ক্লাসের মনিটর এবং পড়াশুনোতেও সে-ই সেরা। ভালকি টুথপেস্ট খেতে ভালোবাসে, কিন্তু দিদিমণি কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণ করেন। বাঘু দুষ্টুমি করতে ও ফাঁকি দিতে ভালোবাসে, কিন্তু দিদিমণির কড়া নজরদারিতে বিন্দুমাত্রও ফাঁকি দেবার জো নেই। শিয়ালনী দিদিমণি আমাদের জানান যে,

(এরপর পাঁচের পাতায়…)

বাঘুর নবতম কীর্তি, চিত্রগ্রাহকের ক্যামেরার দফারফা
 নিজস্ব সংবাদদাতাঃ বাঘুর অনেক কীর্তির কথাই পশুমুখে পরিচিত। কিন্তু সেই সকল কর্মকাণ্ডের হোতা বাঘুর সম্মুখীন হয়ে নিজেরা যে এরকম ঘোরতর বিপদে পড়ে যাবো, সেকথা ঘুণাক্ষরেও আগে থেকে আঁচ করতে পারিনি। বাঘুকে সেদিন বেশ খোশমেজাজেই পাওয়া যায় এবং সে দস্তুরমতো থাবালেখাও করছিল। এমনিতে কথাবার্তার সময় যদিও তাকে রীতিমতো ভদ্র বাঘবাচ্চা বলেই মনে হয়েছিল, কিন্তু তার আসল রূপের পরিচয় পাওয়া গেল আরেকটু পরে। যখন সে আমাদের চিত্রগ্রাহকের ক্যামেরা নিয়ে টানাটানি শুরু করে। তাকে নাকি ক্যামেরায় ছবি তুলতে দিতেই হবে। স্বাভাবিকভাবেই, আমাদের চিত্রগ্রাহক রাজী হননি। শিয়ালনী দিদিমণিও বকাবকি করেন। কিন্তু বাঘু যে তাতে ভোলেনি, বলাই বাহুল্য।

(এরপর পাঁচের পাতায়…)



………০………

অংকনঃ সোমক সেনগুপ্ত

বাঘু সিরিজের অন্যান্য গল্পগুলি থাবাছানি দিচ্ছে নিচের লিঙ্কেঃ-

১। বাগে এলো বাঘু

২। গিঁটের গেরোয় বাঘু

৩। বাঘু খেল ঘাস

৪। বাঘু হলেন মনিটর

৫। শিয়ালনী কুপোকাত

৬। অযোধ্যা পাহাড়ে বাঘু 

৭। পরীক্ষা দিলেন বাঘু

৮। গণ্ডারনী ও গণ্ডগোলিক্স

৯। নামতা শেখেন বাঘুবাবু

১০। শিয়ালনীর পাঠশালায় সিংহালু

১১। বাঘু হল চিৎপটাং 

১২। ঘুম দিলেন বাঘুবাবু  

১৩। পাঠশালায় ধুন্ধুমার

১৪। বাঘুবাবু ও জান্তা জট 

১৫। বনভোজনে বাঘুবাবু

১৬। হোলি খেলল হিনিমিনি      

১৭। ভোটে দাঁড়ালেন বাঘুবাবু

১৮। পাঠশালা মহাসভায় হাতুশি   

১৯। বাঘুর ল্যাজলজ্জা

২০। ছবি আঁকেন বাঘুবাবু         

Leave a comment

Check Also

বিদেশি মোলাকাতে বাঘু- মৌসুমী পাত্র

            ধুস! ধুস! ধুস! ‘দূর ছাতা’ বলে যেদিকে দুচোখ যায়, সেদিকে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে …

baghu_kobi sommelan

কবি সম্মেলনে বাঘুবাবু – মৌসুমী পাত্র

            পাঠশালায় আসছিল শিয়ালনি। আজ দেরিই হয়েছে কিছুটা। কাল সন্ধেবেলা খরগোশাই ডাক্তারদিদির বাড়ি নিমন্ত্রণ …

উল্কার কবলে বাঘু

উল্কার কবলে বাঘু – মৌসুমী পাত্র

(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা  তোমাদের দিযছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ …

ছবি আঁকেন বাঘুবাবু- মৌসুমী পাত্র

ছবি আঁকেন বাঘুবাবু – মৌসুমী পাত্র

(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা দিয়েছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ গল্পে। …