(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা দিয়েছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ গল্পে। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে পাঠশালার খবর ভেসে আসে মাঝেসাঝেই। পাঠশালাটা কোথায় জানো? বনের ঠিক সেই জায়গায়, যেখানে প্রচুর গাছপালা মিলে মাথার উপরে একটা চাঁদোয়ার মত বানিয়েছে, আর দুটো সেগুনগাছের ইয়া মোটা মোটা গুঁড়ি দুদিক থেকে এসে একটা দরজার মতো তৈরি হয়েছে। জঙ্গলের যত ছানাপোনা জন্তুজানোয়ার, সবাই আজকাল সক্কালবেলা হলেই হাতমুখ ধুয়ে চাট্টি মুড়ি খেয়ে ওখানেই পড়তে যায়। তাদের মধ্যে আছে বাঘিনীর বাচ্চা ছেলে বাঘু, হাতির বাচ্চা মেয়ে হাতুশি আর হনুমানের ছানা মেয়ে হিনিমিনি। এছাড়াও আছে ভালুকের পুঁচকি মেয়ে ভালকি আর কুমীরের বাচ্চা ছেলে কুমরু।)
টিফিনের পরের এই ক্লাসটায় পরীক্ষা-টরিক্ষা না থাকলে ভারি আরাম লাগে ওদের। এই একটা ক্লাস কোনমতে কষ্টেসৃষ্টে কাটিয়ে দিতে পারলেই, ব্যস! ছুটি!
টিফিন শেষের ঘন্টা পড়ে গেছে অনেকক্ষণ। দিদিমণি আজ এত দেরি করছেন কেন কে জানে? হিনিমিনি আর ভালকি একমনে পাঠশালা মহাসভার গল্প শুনছে হাতুশির মুখে, কুমরু একটা কৌটো থেকে চিংড়িমাছের চানাচুর অল্প অল্প করে নিয়ে মুখে ফেলছে। ইদানীং এটাই তার মুখশুদ্ধি। আর বাঘু? একটা শালপাতাকে পাকিয়ে পাকিয়ে সে একটা সরু নলের মতন বানিয়েছে আর থেকে থেকে কুমরুর কানে গোঁজার চেষ্টা করছে। কিন্তু ঠিক সুবিধা করে উঠতে পারছে না।
শিয়ালনী পাঠশালায় ঢুকল হাসি হাসি মুখেই। ওরা উঠে দাঁড়িয়ে সমস্বরে রব তুলল, “দিদিমণি নমস্কার, পড়াটি হোক চমৎকার!”
সবাই বসলে ’পর শিয়ালনী চশমাটাকে নামিয়ে আনল নাকের ডগায়, “বুঝলি রে, মঙ্গলবারের আঁকার ক্লাসটা তো তোদের অনেকদিনই ঠিকঠাক করে হয়নি। আগের সপ্তাহগুলো সব পরীক্ষায় গেল। নে, আজ আঁকার খাতা খোল। যে যেমন খুশি আঁকবি। তবে হ্যাঁ, আমার ছবি আঁকা চলবে না। আর তোরাও একে অন্যের ছবি আঁকবি না মোটে। বুঝলি সবাই? বাঘুউউউ, বুঝলি?”
বাঘু ফুচ ফুচ করে হেসে টকাত করে মাথাটা হেলিয়ে দিল, “সবই তো বুঝলাম দিদিমণি, কিন্তু আমি যদি নিজে নিজের ছবি আঁকি? তাহলে চলবে?”
শিয়ালনী চটেই গেল, “না, নিজের ছবিও আঁকবি না। এত কিছু আঁকার রয়েছে, সেসব বাদ দিয়ে তোর নিজের ছবি আঁকার দরকারই বা কী?”
বাঘু আর কথা না বাড়িয়ে কিসব ভাবতে ভাবতে বেজারমুখে বসে রইলো। শিয়ালনী হাতে ধরা বইটা পড়তে শুরু করল। একটু বাদেই ঝিরিঝিরি হাওয়ায় তার মাথা একপাশে হেলে গেল, চোখের পাতা মুদে এল, আর তার নাক দিয়ে ফুড়ুস ফুঁস করে আওয়াজ বের হতে থাকল।
বাকিরা আঁকার খাতা বের করে পেনসিল বাগিয়ে যে যার মতন আঁকতে শুরু করেছে। আর বাঘু? সে খানিক কান চুলকোল, তারপর নাক চুলকোল, তারপর মাথা চুলকোল, তারপর পেট চুলকোল। শেষে নিজের লেজে নিজেই সুড়সুড়ি দিল। সব চুলকোনো আর সুড়সুড়ি সারা হতে মাথার তলায় একটা থাবা দিয়ে ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাঙ তুলে চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়ল। তাই দেখে ভালকি হাঁক দিল, “বাঘু, ছবি আঁকবি না, আরাম করে শুলি যে বড়?”
তাই শুনে হাতুশি শুঁড়ে পেঁচিয়ে রাখা পেনসিলটা হিনিমিনির লেজে গুঁজে দিয়ে বলল, “বাঘু, উঠে বোস। দিদিমণি দেখলে বকবেন কিন্তু। উঠে বসে ছবি আঁকতে কী হয়?”
তাই শুনে বাঘু নড়েচড়ে আরও ব্যবস্থা করে শুল। তারপর দাঁত খিঁচোল, “তোদের অত মাথাব্যথা লেজব্যথা কিসের র্যা? আমি কি তোদের বলতে গেছি, তোরা না শুয়ে ছবি আঁকছিস কেন? ছবি না আঁকলেই বা কী হয়? তোদের জ্বালায় শান্তিতে একটু ফাঁকিবাজি করার অব্দি জো নেই। তোদের নিজেদের চরকা নেই বুঝি? সেখানে তেল দিতে পারিস না?”
এর ওপর তো আর কথা চলে না। তাই ভালকি আর হাতুশি চুপ করে গেল। বাঘু এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি খেল বারকতক, আকাশের দিকে তাকিয়ে দূরের পাখিগুলোকেই ভ্যাংচাল কয়েকবার। সেদিকে চেয়ে কুমরু ছড়া কাটল, “যেমন খুশি আঁকা, বাঘুর খাতা ফাঁকা!”
তাই শুনে হিনিমিনি ফুট কাটল, “খাবেই খাবে বকা!”
হাতুশি শুঁড় দিয়ে ভুউউউউস করে একটা লম্বা শ্বাস ছাড়ল, “যতই করুক হাঁকাডাকা!”
ভালকি তার আঁকাটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে গম্ভীরচালে মন্তব্য ছুঁড়ল, “বাঘুর কপালে লবডঙ্কা!”
বাঘু বেজায় চটিতং হয়ে কিসব বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় দিদিমণির গলার আওয়াজ পাওয়া গেল, “কই রে তোরা সব? আঁকা হল তোদের? দে দে, খাতা জমা দে।”
তাই শুনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাই। বাঘুও ঝটপট খাতায় কিসব আঁকিবুঁকি টেনে খাতা জমা দিয়ে এল।
একটু বাদেই শিয়ালনী আঁকার খাতা দেখতে শুরু করেছে। হাতুশি এঁকেছে একটা বর্ষাদিনের ছবি। একটা ব্যাঙ মাথায় একটা ব্যাঙের ছাতা দিয়ে রাস্তায় হাঁটছে! ভালকি এঁকেছে একটা পদ্মফুলে ভরা পুকুর আর তার পাশের জামগাছে একটা ইয়া ব্বড়ো মৌচাক! হিনিমিনি এঁকেছে কলার ঝাড়! আর সেখানে থরে থরে কলা ঝুলছে। কুমরু এঁকেছে কাতলামাছের কাসুন্দির ছবি।
এক এক করে ছবি দেখছে শিয়ালনী আর মুখ দিয়ে বাহ্, বাহ্ করছে। সবশেষে বাঘুর খাতা দেখতে গিয়েই কিরকম নাক-মুখ কুঁচকে গেল শিয়ালনীর, “ই কী রে বাঘু? সারা পাতা জুড়ে এইসব গোল্লা গোল্লা, চৌকো চৌকো এসব কী এঁকেছিস?”
বাঘু লেজখানাকে গালে ঠেকিয়ে বলল, “বা রে! আপনিই তো বললেন যেমন খুশি আঁকো! আমার যেমন খুশি হয়েছে তেমনই তো আঁকবো!”
একটা মশা পিনপিন করে ঘুরছিল শিয়ালনীর নাকের ডগায়। শিয়ালনী এমন গর্জন ছাড়ল যে মশাটা হাত পা চিতিয়ে উলটে পড়ে অজ্ঞানই হয়ে গেল। “বাঘুউউউ! যেমন খুশি আঁকো মানে এইসব? গোল্লা গোল্লা খুশি, চৌকো চৌকো খুশি?”
বাঘু লেজখানাকে আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে উত্তর দিল, “বা রে দিদিমণি, আমার যদি অমন গোল গোল খুশি, চৌকো চৌকো খুশি হয় তো আমি কি করবো? আপনি আপনার ছবি আঁকতে বারণ করেছিলেন, আঁকিনি। বন্ধুদের ছবি আঁকা মানা, তাও আঁকিনি। আমার যেমন খুশি তেমনই আঁকলাম। আপনি তাতেও আমার দোষ ধরছেন?”
শিয়ালনী ডুকরে কেঁদেই ওঠে প্রায়, “তাই বলে পাতাভর্তি এইরকম গোল গোল চৌকো চৌকো? আর কোন ছবি হয় না? গাছপালা, নদী, বনজঙ্গল- এসব আঁকতে পারলি না? দ্যাখ দেখি, বাকিরা কী সুন্দর এঁকেছে!”
বাঘু ফিচিক করে একটা হাসি দিয়ে বলল, “দিদিমণি, আমাকেই যে ওদের মতন আঁকতে হবে তার কী মানে আছে? ওরাও আমার মতন আঁকার চেষ্টা করুক। কত কম সময় খরচ করে একটা আস্ত ছবি এঁকে দিলুম, তার বুঝি কোন দাম নেই?”
শিয়ালনীর চোখে আকাশের কালো মেঘ নেমে এসেছে, “বাঘু! বাঘুউউউউ! অ্যাঁ, তুই সময় বাঁচালি? সময় বাঁচিয়ে কোন্ মহাকীর্তিটা করলি শুনি? তোর জন্য তাহলে কি বাঘুবেদী স্থাপন করতে হবে? সেখানে ফুল মালা দিয়ে তোকে পুজো করতে হবে? তুই বরং সময় বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে একটা সময়ের ব্যাংক বানিয়ে ফ্যাল, বাঘু! মানুষেরা যেমন ব্যাঙ্কে টাকা রাখে, তেমনি তোর বাঘুব্যাংকে তুই সময় রাখবি! অ্যাঁ? তারপরে যত রাজ্যের গোল গোল খুশি, চৌকো চৌকো খুশি ইচ্ছেমতন জমিয়ে রাখিস তোর বাঘুব্যাংকে।”
বাঘু কিরকম ঘাবড়ে গিয়ে-টিয়ে বলল, “আমি কি তাহলে বাঘুব্যাংকের মালিক হব, দিদিমণি? আর সময়ের গদিতে শুয়ে থাকব?”
শিয়ালনী আর বেশি কথার দিকে আর গেল না। বাঘুর লেজটা একবার মুলে দিয়ে বলল, “এই যে বাঘুব্যাংকের মালিক, এক্ষুণি একটা ভালো দেখে ছবি আঁকুন দেখি। নদী, গাছ- সব যেন থাকে! নইলে কিন্তু এই পাঠশালার মালকিন আপনার কী দুর্দশা করেন দেখতে পাবেন!”
বাধ্য হয়ে বাঘু আঁকার খাতা নিয়ে বসল ঠিকই, কিন্তু সমানে নিজের মনে গজগজ করতেই থাকল, “নাহয় আমার আঁকা পছন্দ হয়নি, তাই বলে উনি আমাকে ‘আপনি’ করে কথা বলবেন? আমি বলে এইটুকুনি একটা বাঘের বাচ্চা! নাহয় বদমায়েশি করেই ফেলেছি, নাহয় কিছুটা ফাঁকিও মেরেছি, নাহয় লেজে লেজে খানিক তক্কোও করেছি- তাই বলে উনি আমাকে এইভাবে ব্যঙ্গ করবেন? আমি কি ব্যাঙাচি? নাকি আমি কুমড়োসেদ্ধ?”
গজগজ করতে করতেই খাতায় কিসব হিজিবিজি টেনে দিদিমণির কাছে নিয়ে গেল বাঘু। দিদিমণি খাতা দেখেই রেগে কাঁই, “এটা কী, বাঘু?”
বাঘু ভালো জন্তুর মত উত্তর দিল, “এটা আঁকা, দিদিমণি।”
“হতভাগা, এটা আঁকা হল? কিসব কাকের ঠ্যাঙ, বকের ঠ্যাঙের মত হিজিবিজি কেটে বলছিস আঁকা?”
বাঘু গালে লেজ ঠেকিয়ে আলুর মতন গোল গোল চোখ করে বলল, “অমন করে বলবেন না, দিদিমণি! কত্ত সুন্দর নদী, গাছপালা এঁকে আনলাম- আপনি যেমনটি বলেছিলেন! দুটো অন্ততঃ ভালো কথা বলুন!”
“ও তাই? এই সরু নীল দাগটাকে নিশ্চয়ই তুই নদী বলবি? আর এই সবুজ দাগগুলো তোর গাছপালা নির্ঘাত?”
বাঘু একগাল হেসে বলল, “ঠিক তাই, দিদিমণি। আপনি কী সুন্দর ঝটপট সব বুঝে গেলেন! সাধে কি আর আপনি আমাদের গুরুজন্তু!”
হাতুশি পাশ থেকে উঁকি মেরে দ্যাখে, বাঘুর খাতায় তেমন কোন ছবিই নেই। খালি একটা নীল রঙের সরু দাগ আর কিছু সবুজ রঙের দাগ দেখা যাচ্ছে। বাঘু এদিকে প্রবল উৎসাহে বুঝিয়ে যাচ্ছে, “দিদিমণি, এই যে নীল দাগ দেখছেন, এটা হচ্ছে নদী। অনেক দূরে কিনা, তাই অত সরু লাগছে। একদম কাছে চলে এলে অত বড় নদী কি আর এই একটা ছোট পাতায় আঁটত? আপনিই বলুন না! তারপরে, এই যে গাছগুলো, এগুলো সব লতানে গাছ। তাই সরু সরু লাগছে। তারপরে একদিকে এই লাইনটা… এটাও একটা গাছ, পাতাগুলো সব ঝরে গেছে কিনা…”
সহসা বিকট এক গর্জন করে প্রবল এক লাফ দিল শিয়ালনী, আর লাফের চোটে সোজা গিয়ে পড়ল বাঘুর পিঠে। হাঁউমাঁউ করে উঠে ভয়ের চোটে তিড়িংবিড়িং লাফ দিল বাঘু আর বাঘুর লেজ পাকড়ে ধরে শুরু হল শিয়ালনীর তর্জন, “আগামীকাল একখানা ভালো ছবি এঁকে নিয়ে আসবি, এই বলে দিলাম। আর ফের যদি উল্টোপাল্টা ছবি এঁকে এনেছিস, তাহলে আমিই তোর একটা ছবি এঁকে নীচে ‘গোরু’ বলে লিখে দেব। মনে থাকে যেন!”
বাঘু জড়োসড়ো হয়ে বলল, “দিদিমণি, আর যদি ভুল করে ভালো এঁকে ফেলি? তাহলে?”
শিয়ালনী বাঘুর পিঠ থেকে থেমে এল ধীরেসুস্থে। হামাগুড়ি দেবার ভংগি করে দাঁড়াল বাঘুর মুখোমুখি, “যদিইইই তুউউউই কাআআআআল ভুউউউউল করে ভাআআআআলো এঁএএএকে আনিইইইইস বাঘুউউউউ, তাহলেএএএ কাআআআল তোকে আমিইইইই মাথার উপর তুলেএএএএ ধেইধেই করে নৃত্য করবোওওওও। হয়েছেএএএএ?”
বাঘু ঘাড় হেলিয়ে দিল, “হ্যাঁঅ্যাঅ্যাঅ্যা, দিদিমণিইইইই! হয়েছেএএএএ!”
পরের দিন পাঠশালায় বাঘু ঢুকতেই হামলে পড়ল সকলে। সবাই জানে, বাঘু কিছু না কিছু জবরদস্ত ছবি এঁকে আনবেই। বাঘু কিন্তু দেখাল না কাউকেই। তার সাফ কথা- “আঁকতে বলেছেন দিদিমণি, তোরা তো আর বলিসনি!” ভালকি বোঝানোর চেষ্টা করল, “দ্যাখ বাঘু, তোর আঁকা তোরই থাকবে। আমরা কি আর কেড়ে নেব? নাকি নিজেদের নাম দিয়ে চালানোর চেষ্টা করব?”
কিন্তু ওসব ভালো ভালো কথায় কি আর বাঘু ভোলে? সে মুরুব্বির চালে ব্যাগখানাকে আঁকড়ে ধরে বলল, “শোন্, আমি মাথা খাটিয়ে একখানা ভালো ছবি এঁকেছি। বেশি দেখলে তোরা যদি শিখে ফেলিস!”
বলতে না বলতেই দিদিমণি এসে পড়লেন। ওরাও ঝটাঝট দাঁড়িয়ে পড়ল প্রার্থনার লাইনে। নতুন আরেকটা প্রার্থনার গান শিখিয়েছেন দিদিমণি ক’দিন আগে। শুরু হয়ে গেল সেই গান-
বনের ছাওয়ায়, হাওয়ায় হাওয়ায়-
মোরা যত জানোয়ার রে…
বনের ছাওয়ায়, হাওয়ায় হাওয়ায়-
মোরা যত জানোয়ার রে…
খেলি ঘুরি ফিরি, নাচি গাই
খেলি ঘুরি ফিরি, নাচি গাই
কত সুখে থাকি মোরা রে…
কত সুখে থাকি মোরা রে…
বনের ছাওয়ায়, হাওয়ায় হাওয়ায়-
মোরা যত জানোয়ার রে…
বড় বড় গাছ, করে সবে নাচ,
বাতাসেতে দোলায় মাথা-
পাখি কত শত, মেতে ওঠে যত,
পাখি কত শত, মেতে ওঠে যত,
তানে তানে ভরে মন রে…
রোদ জল ঝড়, সারা দিন ভর
রঙে রঙে ভরে প্রাণ রে…
রোদ জল ঝড়, সারা দিন ভর
রঙে রঙে ভরে প্রাণ রে…
বনের ছাওয়ায়, হাওয়ায় হাওয়ায়-
মোরা যত জানোয়ার রে…
বনের ছাওয়ায়, হাওয়ায় হাওয়ায়-
মোরা যত জানোয়ার রে…
প্রার্থনার পর যথারীতি ক্লাস শুরু হল। ‘বন পরিচয়’, ‘সবুজ পাঠ’, ‘আশ্চর্য আকাশ, ভূগোল ভাবনা’, ‘অঙ্ক আবেশ’ ইত্যাদি বই পরপর সব পড়া হতে থাকল। পড়ার এক ফাঁকেই শিয়ালনী চশমাটা কিঞ্চিৎ নামিয়ে ওপরের ফাঁক দিয়ে তাকাল, “বাঘু! কালকে যে ছবি এঁকে আনতে বলেছিলাম, এনেছিস?” বাঘু আহ্লাদী আহ্লাদী গলায় বলল, “হ্যাঁ, দিদিমিণি, এনেছি। বের করবো?”
শিয়ালনী কী ভেবে বলল, “না, থাক্। টিফিনের পর আজ তোদের থাবালেখার ক্লাস। তখনই বরং বের করিস।”
টিফিনের পর থাবালেখার ক্লাসের শুরুতে অন্যদিন বেশ হইহল্লা চলে, আজ বেশ একটা থমথমে ভাব। কী হয়, কী হয় এরকম একটা ব্যাপার! শিয়ালনী ঢুকেই থাবালেখার জন্য দুটো লাইন বোর্ডে লিখে দিল- পড়ার নামে ঘুম, ফাঁকিবাজির ধুম! আরও একটা লাইন দিল শিয়ালনী, ভয়ঙ্কর কাণ্ড, আঁকলেই লণ্ডভণ্ড!
থাবালেখা শুরু হতে না হতেই গমগমে গলায় ডাকল শিয়ালনী, “বাঘু, তোর আঁকার খাতা নিয়ে আয়। কী ছবি এঁকেছিস দেখি।”
আঁকার খাতা নিয়ে গুটিগুটি থাবায় দিদিমণির দিকে এগিয়ে গেল বাঘু। ছবি দেখে দিদিমণির আক্কেলগুড়ুম। বাঘুর খাতায় আঁকা একটা কালো মতন কিছু, আর তার পাশে একটা গোরু বা ষাঁড়। শিয়ালনী বলে, “ই কী ছবি এঁকেছিস রে বাঘু? গোরুর গোবর না ষাঁড়ের গোবর? গোরুর গোবর হয় জানি, কিন্তু ষাঁড়ের গোবর মানে তো অপদার্থ!”
বাঘু খুব ক্ষুণ্ণ হয়ে বলল, “দিদিমণি, আপনি আমার এই অপরূপ চিত্রকলার মর্মই বুঝলেন না?”
শিয়ালনী তাকাল চশমার ফাঁক দিয়ে, “বটে? কী মর্ম শুনি?”
বাঘু বেশ বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব করে বলল, “দিদিমণি, এটা বাদাম আর ওটা কাঠবিড়ালী। কাঠবিড়ালী বাদাম খাচ্ছে।”
শিয়ালনী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বাঘুর আঁকা দেখছিল। বাঘুর কথা শুনে তার চোখ টম্যাটোর মত লাল টকটকে হয়ে উঠল, নাকের ডগা বেগুনের মত বেগুনি হয়ে উঠল আর তার মুখ কমলালেবুর মতন কমলা রঙ হয়ে গেল। বাঘু দিদিমণির মুখের রঙবদল দেখতে দেখতে ঘাড় হেলিয়ে বলল, “খুব ভালো ছবি এঁকেছি, না দিদিমণি? আমাকে কী প্রাইজ দেবেন তাই ভাবছেন বুঝি? তা দিদিমণি, আমার বিশেষ লোভ নেই। যা দেবেন, তাতেই খুশি। তবে নেহাতই যদি দিতে চান, তাহলে… ”
“অ্যাঁওওওওও! ঘ্যাঁঅ্যাঁওওওওও!”, বিকট এক আওয়াজ ছাড়ল শিয়ালনী, “ব্যাঘোওওওওও! তোকে প্রাইজ দিতে হবে না? প্রাইজ? অ্যাঁ? এটা কাঠবিড়ালী? এটা যদি কাঠবিড়ালী হয়, তাহলে আমিও ডাইনোসর! আর এটা বাদাম? অ্যাঁ? এটা বাদাম না আস্ত কুমড়ো!”
বাঘু বলল, “আস্ত কুমড়ো না দিদিমণি, ভগ্নাংশ কুমড়ো! দেখছেন না, এট্টুখানি ভাঙা আছে। কুমরু খুব ভগ্নাংশের অঙ্ক ভালোবাসে কিনা, তাই ভগ্নাংশ রেখেছি। কুমরু, হিসেব করে বল তো, কাঠবিড়ালীটা কত ভগ্নাংশ বাদাম খেয়েছে?”
ভগ্নাংশের অঙ্কের গন্ধে কুমরু এগিয়ে এসেছে গুটিগুটি। শিয়ালনী চেঁচিয়ে উঠল, “খবরদার কুমরু, বাঘুর অঙ্ক করবি না বলে দিলাম। তাহলে তোকেই আমি ভুসকুমড়ো বানিয়ে দেব!”
ভুসকুমড়ো কী জিনিস না বুঝলেও কুমরু ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে ফেরত গেল। বাঘু এদিকে অন্য একটা খাতার পাতায় সমানে নীল রঙ ঘষছে তো ঘষেই যাচ্ছে। শিয়ালনী চোখ পাকাল, “বাঘু! বাঘুউউউউউ! পাতাজুড়ে অমন কিসব নীল রঙ ঘষছিস?”
বাঘু একগাল হাসল, “দিদিমণি, এবারে আর আমার আঁকার কোন ভুল ধরতে পারবেন না। আমি আকাশের ছবি আঁকছি।”
শিয়ালনীর মুখ একেবারে কলাগাছের ফলন্ত মোচার মতন ঝুলে পড়ল, “মানে? পাতাজোড়া নীল রঙ ঘষে নিশ্চয়ই বলবি না যে এটা আকাশ?”
বাঘুর মুখে স্বর্গীয় হাসি, “আপনি সব কিছুই এত ঝটপট বুঝে যান না দিদিমণি! দেখুন কী সুন্দর আকাশ! আহা, পুরো নীলে নীল! কী অপরূপ দৃশ্য! আহা! নিজেই নিজের পিঠ চাপড়াতে ইচ্ছে করছে দিদিমণি!”
“আহা? নীলে নীল? অপরূপ দৃশ্য? আজ যদি না আমি তোকে ভুষোকালি মাখিয়ে কালোয় কালো করেছি, তবে তোর একদিন কি আমারই একদিন!”
হিনিমিনি ফিকফিক করে হেসে বলল, “তার চে’ দিদিমণি, বরং টুথপেস্ট মাখিয়ে বাঘুকে সাদায় সাদা করে দিন। ভালকির কাছে তো টুথপেস্ট আছেই।”
টুথপেস্ট খোওয়া যাবার আশংকায় ভালকি বেজায় মুষড়ে পড়ে নিজের ব্যাগখানাকে আঁকড়ে ধরে বলল, “না না, বিশ্বাস করুন দিদিমণি, আমার টুথপেস্টটার সকাল থেকে খুব জ্বর!”
শিয়ালনী কপালে ধাঁই ধাঁই করে দু’খানা চাপড় মেরে হাঁউমাঁউ করে উঠল, “ওরে, কী সব আপদের পাল্লায় পড়েছি রে! আঁকতে দিলে একজন পাতা জুড়ে নীল রঙ করে বলে কিনা আকাশ, আর একজনের টুথপেস্টের আবার নাকি জ্বর! হায় হায় হায় হায়! কী সব পশুয়াদের পাল্লায় পড়লাম রে!”
হাতুশি এগিয়ে এসে ভারি মোলায়েম গলায় বলল, “দিদিমণি, ওদের কথা ছাড়ুন। আপনি বরং আমার পিঠে চাপুন। আমি আপনাকে বন পরিক্রমা করে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি! দেখবেন কতো ভালো লাগবে!”
হিনিমিনি লাফিয়ে উঠল, “ইয়াহু! আমি বরং তোর পিঠে দিদিমণিকে ধরে বসে থাকবো। নইলে তো দিদিমণি পড়ে যেতে পারেন!”
কুমরু দেখল তারও কিছু বলা দরকার। তাই তাড়াতাড়ি করে বলল, “শুভস্য শীঘ্রম্। নিন দিদিমণি, আপনি চটপট করে হাতুশির পিঠে চেপে পড়ুন দেখি।”
কোমরে থাবা দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আগুনে চোখে তাকিয়েছে শিয়ালনী, “অ্যাঁ? কী ভেবেছিস কী তোরা? ফাঁকি মারার নিত্যনতুন ফিকির বের করা হচ্ছে, না? এটা কি পাঠশালা না ফাঁকিশালা?”
বাঘু খুব দুখী দুখী মুখ করে বলল, “তা আর আপনি ফাঁকি মারতে দ্যান কোথায়? আঁকার ক্লাসে অব্দি ফাঁকি মারার জো নেই- এমনই পাঠশালা!”
জ্যৈষ্ঠমাসের গনগনে আঁচ শিয়ালনীর গলায়, “বাঘু! বাঘুউউউউ! ফের যদি বেশি গোলমাল পাকাতে আসিস না, তাহলে কিন্তু তোর লেজের ছবি তোকে দিয়েই একশ আট বার আঁকাবো। মনে থাকে যেন! আর এই যে বাকি বাছাধনেরা! থাবালেখা ফেলে ফূর্তি হচ্ছে? অ্যাঁ? নিজের নিজের খাতায় থাবালেখা কর সবাই। বাঘু, তুইও করবি। নো চালাকি, নো কায়দাবাজি!”
পরের দিন প্রার্থনার পর শিয়ালনী ক্লাসে ঢুকল বেশ হাসি হাসি মুখে। তাই দেখে হাতুশি জিজ্ঞেস করল, “দিদিমণি, ভালো কিছু খবর আছে বুঝি?”
শিয়ালনী এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ল, “হুমম। হামম। ভালো খবর? তা বলতেই পারিস। খবরটা হচ্ছে যে একটা আঁকার প্রতিযোগিতা হবে। শিয়াল সমিতি আর গণ্ডার সংগঠন মিলে যৌথভাবে আয়োজন করেছে। সামনের রোববার। সকাল ন’টায়। ঝেঁওপাতি জংগলে। আঁকার কাগজ ওরাই দেবে। বাকি আঁকার সরঞ্জাম তোদেরকেই নিয়ে যেতে হবে। প্রাইজ থাকবে- যারা ভালো আঁকবে, তাদের জন্য।”
কুমরু লাফিয়ে উঠল, “দিদিমণি, আমি নাম দেবো।”
হিনিমিনি লেজ ঝাঁকাল, “দিদিমণি, আমিও যাবো।”
হাতুশিও মুখ হাঁ করতে যাচ্ছে, শিয়ালনী বলল, “অত উতলা হবার কিছু নেই। তোদের সবারই নাম দেবো। মায়, বাঘুবাবুরও। কী রে বাঘু, কথা কানে ঢুকল?”
একেই ‘বাঘুবাবু’ বলায় বাঘুর বেজায় গোঁসা হয়েছে, তার উপর কানে ঢোকার কথা বলায় বাঘু পুরোদস্তুর খাপ্পা হয়ে বলল, “হ্যাঁ দিদিমণি, কান দিয়েই ঢুকেছে, লেজ দিয়ে তো আর ঢোকেনি!”
শিয়ালনী চটেমটে হয়তো বাঘুকে ‘লম্বাগুড়ি’ দিতেই বলছিল, কিন্তু তার আগেই হাতুশির হাঁ পুরো খুলে গেল, “দিদিমণি, আঁকার বিষয় কী? মানে কী নিয়ে আঁকবো?”
শিয়ালনী একগাল হেসে বলল, “আঁকার বিষয়? কী নিয়ে আঁকবি? যা খুশি আঁকবি। যেমন মন চায় আঁকবি। যারে কয়, যেমন খুশি আঁকো!”
তাই শুনে বাঘু আহ্লাদের চোটে লাফিয়ে প্রায় দিদিমণির কোলে এসে পড়ে আর কী, “তাই নাকি, দিদিমণি? যা খুশি, যেমন খুশি আঁকা যাবে? কী মজা! হুঃ হাঃ!”
শিয়ালনী ভুরু কুঁচকে চোখ সরু করে তাকাল, “দ্যাখ বাঘু! যদি তুই ওইরকম উষ্টুম ধুষ্টুম ছবি এঁকেছিস, তাহলে সামনের ওই গাছের ডালে লেজ বেঁধে তোকে ঝুলিয়ে রেখে সেই ছবি আমি আঁকবো। বুঝেছিস? নো চালাকি, নো কায়দাবাজি!”
বাঘু ভুউউস করে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে শুকনো মুখে বলল, “বুঝেছি, দিদিমণি। আমার কপালটাই খারাপ। এট্টুখানি ছবি আঁকবো, তাতেও চালাকি আর কায়দাবাজি করার জো নেই। ও হো হো হো হো!”
দেখতে দেখতে পরের রবিবার এসেও গেল। ঝেঁওপাতির জঙ্গলে একটা বড়সড় ছাতিম গাছের ছায়ায় বসেছে আঁকার আসর। শিয়ালনী সকাল সকালই সব পশুয়াদের নিয়ে হাজির। এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখছে ওরা। এই জঙ্গলটায় পুরনো আর বিশাল গাছের সংখ্যা বেশি। হিনিমিনির মহানন্দ। সে গাছের ডালপালা পাতার আড়ালে কোথায় যে সেঁধিয়ে গেছে আসার পর থেকেই, তার আর পাত্তা নেই। হাতুশি আর ভালকি ঘুরে ঘুরে চারপাশ দেখছে। ঝিরিঝিরি হাওয়া, ডালে ডালে পাখিদের কিচিমিচি আর এদিক ওদিক থেকে ভেসে আসা বনজ ঘ্রাণ। বাঘু আর কুমরুকেও ডেকেছিল ওরা। বাঘুর নাকি লেজখানা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাই লেজকে আরাম দেবার জন্য বাঘু একটা গাছের আড়াল দেখে উপুড় হয়ে শুয়ে লেজখানাকে মাথায় তুলে রেখেছে। কুমরু এল না, সে একটা কৌটো খুলে মন দিয়ে কচুরির কেলেংকারি আর পুঁটিমাছের পুলটিশ খাচ্ছে। তার নাকি কাল রাতে ল্যাগব্যাগে লুচি আর ডানপিটে ডিম দিয়ে খাওয়াটা মোটেই জমেনি!
গল্প করতে করতে ভালকি জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ রে হাতুশি, এই বিশাল গাছগুলোকে কী যেন বেশ বলে রে? দিদিমণি সেদিন কী একটা বললেন না?”
হাতুশি শুঁড় দোলাল, “মহীরুহ।”
ভালকি মিটিমিটি চাইল, “বল তো দেখি, যে গাছ একবার ফল দিয়ে মরে যায়, তাকে এককথায় কী বলে?”
হাতুশি যেই না বলেছে ‘ওষধি’, অমনি ওপরের গাছপালায় মটমটাৎ শব্দ আর তার সংগেই হুড়মুড় করে একগাদা ডালপালা ভেঙে হাতুশির পিঠে এসে পড়ল হিনিমিনি। আর তার সংগেই তারস্বরে চিৎকার, “ওরে আমার মর্তমান কলা, কাঁঠালি কলা রে! ওরে আমার সিঙ্গাপুরি কলা রে! ওরে আমার চাপাকলা রে! ওরে হাতুশি রেএএএএ! আমাকে বাঁচা রেএএএএএ!”
হিনিমিনির ধাক্কায় হাতুশির মোটামুটি হাঁসফাঁস অবস্থা! ভালকি এক দাবড়ানি দিল, “কী শুরু করেছিস, হিনিমিনি? কী হয়েছে বলবি তো?”
হিনিমিনি আরও জোরে হাতুশিকে জড়িয়ে ধরল, “উহুহুহুহু! গণ্ডারনী দিদিমণি! উরি ব্বাব্বা রে!”
হিনিমিনিকে কায়দা করতে না পেরে হাতুশি এদিক ওদিক শুঁড় ঝাঁকাতে ঝাঁকাতেই জবাব দিল, “দিব্যি জায়গা… খাসা ছাওয়া… নরম নরম হাওয়া… এর মধ্যে গণ্ডারনী দিদিমণি এলেন কোত্থেকে?”
হিনিমিনি হুহু করে কাঁপতে কাঁপতেই উত্তর দিল, “এলেন নয়, আসছেন! আমি উই অশ্বত্থ গাছের মগডাল থেকে দেখলাম। গণ্ডারনী দিদিমণি আর তাঁর সঙ্গে চারটে আমাদের বয়সী গণ্ডার।”
ভালকি শুকনো মুখে বলল, “তুই ঠিক বলছিস তো?”
হিনিমিনি গা ঝাড়া দিয়ে একটা লাফ দিয়ে বলল, “ঠিক বলছি মানে? কাঁচকলার দিব্যি বলছি!”
‘কাঁচকলার দিব্যি’র ওপর তো আর কথা চলে না। তাই হাতুশি আর ভালকি চুপ করে গেল। একটু বাদে হাতুশি শুঁড়খানাকে বেজায় গম্ভীর করে মন্তব্য করল, “দ্যাখ, আবার কী গণ্ডগোলিক্স হয়!”
ভালকি বলল, “তাই তো রে! সেটাই ভাবছি। তবে চ, আর দেরি করা ঠিক হবে না। আঁকা হয়তো শুরু হয়ে যাবে।”
আঁকার জায়গায় ওরা পৌঁছোনোর প্রায় সাথে সাথেই গণ্ডারনী দিদিমণি তার পশুয়াদের নিয়ে উপস্থিত! গণ্ডামণ্ডা, গণ্ডারপুঁ, গণ্ডারগোঁ আর গণ্ডারিকা। তাদের সঙ্গে আলাপও হল ওদের। অবশ্য পাঠশালা মহাসভার সময় হাতুশির সঙ্গে গণ্ডামণ্ডার পরিচয় হয়েছিল। কিন্তু এখন সে এমন ভাব করল যেন হাতুশিকে চেনেই না!
গণ্ডারনী দিদিমণিও দেখলেন ওদের। তারপর গম্ভীরচালে শিয়ালনী দিদিমণির দিকে তাকিয়ে খড়্গ উঁচিয়ে গলায় বেশ দেমাকি সুর খেলালেন, “এই যে শিয়ালনী! তোমার ওই বিচ্ছু ছানাপোনা সবকটাকেই এনেছো দেখছি। তা ভালো। আমি বাবা অমন পারি না! দেখেশুনে রীতিমতো ঝাড়াই বাছাই করে এনেছি। তা দ্যাখো, যদি একটা থার্ড-টার্ড প্রাইজ পাও!”
শিয়ালনী দিদিমণি উত্তরে চশমার ফাঁক দিয়ে হাসলেন, “প্রাইজ পাওয়াটাই তো বড় কথা নয়, গণ্ডারনী। ওদের কাউকেই আমি প্রাইজ পাওয়ার ব্যাপারে কোন চাপ দিইনি। আর দেবই বা কেন? আঁকা, গান গাওয়া, লেখা- এসব তো মনের আনন্দের জিনিস। আনন্দটাই চলে গেলে সে তো শুকনো খড়ের আঁটি হয়ে দাঁড়ায়। ওরা যে যেমন পারে আঁকবে। তাতে প্রাইজ পেলে ভালো, না পেলেও ক্ষতি নেই। ওরা একটা নতুন জায়পগায় এল, ঘুরল, মেলামেশা করল সবার সঙ্গে, যেমন খুশি আঁকল- এইটাই অনেক পাওয়া নয় কি?”
গণ্ডারনী ঘোঁত ঘোঁত করে কিসব গজগজ করল, কিছু বোঝা গেল না। তার পরপরই জোর আওয়াজ শোনা গেল তার, “কই রে গণ্ডামণ্ডা, গণ্ডারপুঁ, গণ্ডারগোঁ আর গণ্ডারিকা, কোন্দিকে গেলি? আজ যদি প্রাইজ টাইজ না পেয়েছিস- তোদের একটাকেও আমি আর আস্ত রাখবো না!”
গণ্ডারনী তার পশুয়াদের একরকম তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে বসালো আঁকার জায়গায়। হাতুশিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসল যে যার ইচ্ছেমতো। বাঘু তার ব্যাগ খুলে কিসব কারিকুরি করছিল, সে বসল খানিক দূরে, বাকিদের থেকে পিছন ঘুরে। তার নাকি আবার নিরিবিলি জায়গা না হলে ঠিকঠাক আঁকা আসে না।
আঁকার প্রতিযোগিতাও শুরু হয়ে গেল। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী বাইসনবন্তী এসেছেন বিচারক হয়ে। ওদের আঁকার জায়গা থেকে সামান্য দূরে চেয়ার টেবিল পেতে আয়োজক আর দিদিমণিদের সঙ্গে তাঁর বসার ব্যবস্থা হয়েছে।
আয়োজকদের মধ্যে শিয়ালসাই পণ্ডিতধাঁই আর শিয়ালমঞ্জরী ধাঁইকিড়িকে দেখতে পেল হাতুশি। তাঁরাও দেখেছেন হাতুশিকে। চিনতে পেরে কাছে এসে দু-চার কথা বলে গেলেন। আরও দু-চারজন গণ্ডারকে ইতিউতি ঘুরতে দেখল হাতুশি। তবে তাদেরকে ঠিক চেনে না ও।
আঁকার কাগজে যে যার মত এঁকে চলেছে একমনে। খালি বাঘু দূরে বসে তার ঝোলা থেকে একের পর এক হরেক কিসিমের কৌটো বের করছে তো করেই যাচ্ছে। একটা গোল মত কিছু আঁকল প্রথমে। তারপর একটা কৌটো খুলে বেশ কিছু গাছের পাতা বের করে চিটিয়ে দিল। তারপর একটা লম্বা শুকনো খয়েরি রঙের পাতা সেঁটে দিল সবুজ পাতাগুলোর তলায়। ব্যস, বাঘুর একপিস গাছ রেডি। আরও গোটা দুই গাছ বানাল বাঘু। তারপর কাগজের তলার দিকে যথেচ্ছ আঠা ঢালল। একটা কৌটো থেকে কাদা- মাটি-ধুলো ঢেলে চেটাল। সেসব হবার পর মনের সুখে ডাল-পাতা চেটাল এদিক ওদিক। তারপর মাটির ওপর একটা শামুক আর এদিক সেদিক কিছু পোকামাকড় চিটিয়ে দিল ইচ্ছেমতন। সবশেষে আকাশ। আকাশে অবশ্য রঙ করল বাঘু। করেটরে মশারির ছবি দেওয়া একটা কৌটো থেকে একটা একটা করে মশা বের করল। আরাম করে গান ভাঁজতে ভাঁজতে মশাগুলোকে এক এক করে আটকে দিল আকাশের গায়ে। কয়েকটা মশা ওরই মধ্যে বেঁচে ছিল। তারা প্রাণপণে ডানাও ছুঁড়তে শুরু করে দিল। এইসব করে বাঘুর খেয়াল পড়ল, এই যা, পুকুরটারই ব্যবস্থা করা হয়নি! ব্যস, সে ফের লেগে পড়ল পুকুরের ব্যবস্থা করতে।
বাকিদেরও আঁকা ততক্ষণে শেষের পথে। আয়োজকেরা মাঝেমাঝেই এসে এর ওর আঁকা দেখে যাচ্ছেন। খালি বাঘু এমনভাবে পিছন ফিরে ওর আঁকা আড়াল করে রেখেছিল যে ওরটাই খালি কেউ আগেভাগে দেখতে পেল না।
বিচারক বাইসনবন্তীর কাঁধ থেকে পেছনদিকে একটা চিত্রবিচিত্র আলখাল্লা গোছের পোশাক। মাথার চুলে হরিণের শিং-মার্কা ডালপালা গোঁজা। সেসব ডালপালায় বাঁধা সুতো থেকে নানা ধরনের ছোটোবড়ো পাথর ঝুলছে। তার গালে কপালে লাল, নীল, হলুদ, সবুজ নানা রঙ খাবল খাবল লাগানো। গলায় পায়ে রঙবেরঙা পুঁতির মালা। একটা কাঠবিড়ালী আবার তাঁর পোশাকের পিছনদিকটা উঁচু করে ধরে আছে। সব মিলিয়ে বেশ একটা শিল্পী- শিল্পী ভাব।
কাঠবিড়ালীটাকে ভালো করে দেখল হাতুশি। ও মা, এ যে কাঠচশমালী! দিব্যি মজাই লাগল অনেকদিন পর দেখে।
প্রতিযোগিতা শেষের ঘন্টা পড়তেই বাইসনবন্তী বেশ মেজাজে হাতে একটা তুলি নিয়ে তুলিটাকে তরোয়ালের মত ঘোরাতে ঘোরাতে দুলকি চালে হাঁটা দিল। তার পিছনের প্রথম সারিতে শিয়ালসাই পণ্ডিতধাঁই আর শিয়ালমঞ্জরী ধাঁইকিড়ি। পিছনের দ্বিতীয় সারিতে শিয়ালনী আর গণ্ডারনী।
প্রথমেই গণ্ডারছানাদের দলবলের কাছে গেল বাইসনবন্তী। কিছু বলার আগেই গণ্ডামণ্ডা তার আঁকার কাগজখানা সগর্বে মেলে ধরল। সে এঁকেছে একটা কালো বড় ঢিপির মতন কিছু আর তার সামনে একগাদা গোল গোল নুড়ির মতন কী যেন।
বাইসনবন্তী ভুরুটুরু কুঁচকে তুলিখানা গালে ঠেকাল, “ও! আচ্ছা। এটা নুড়ি আর পাহাড়? তা ভালো ভালো।”
গণ্ডামণ্ডা তারস্বরে গাঁকগাঁক করে উঠল, “নুড়ি আর পাহাড় কেন হতে যাবে দিদিমণি? এই কালোমতনটা একটা গণ্ডার আর সে বসে বসে মণ্ডা খাচ্ছে।”
তাই শুনে বাইসনবন্তীর মুখ একখানা ঝিঙের মতোই ঝুলে গেল। গণ্ডারনী এগিয়ে এল সামনে, “আহা! কী দারুণ একেছিস রে গণ্ডামণ্ডা! আহহা!”
বাইসনবন্তীর মুখ দিয়ে খালি আওয়াজ বেরোল, “বুক্কুস বুঁ!”
গণ্ডারনী তার খড়্গের তলায় একটা বিটকেল হাসি দিল, “দেখেছিস? কত্ত ভালো আঁকা হয়েছে! দিদিমণি একেবারে বাক্যিহারা!”
শিয়ালসাই পণ্ডিতধাঁই আর শিয়ালমঞ্জরী ধাঁইকিড়ি এগিয়ে এসে না সামলালে কী হত বলা মুশকিল! পরের কাগজ এগিয়ে ধরল গণ্ডারপুঁ। সেটাতেও ওই একইরকম কালোমতন একটা ঢিপি, খালি সেটার থেকে একটা লম্বা লাঠির মতন যেন কী বেরিয়ে আছে। লাঠিও হতে পারে, ল্যাজও হতে পারে!
বাইসনবন্তী এখনো আগের ছবির ধাক্কাই সামলে উঠতে পারেনি! অবস্থা দেখে শিয়ালসাই পণ্ডিতধাঁই-ই প্রশ্ন করল, “এটা কি এঁকেছো, গণ্ডার মনা?”
গণ্ডারপুঁ খড়গ উঁচিয়ে জবাব দিল, “আমার নাম মোটেই গণ্ডার মনা নয়। আমার নাম গণ্ডারপুঁ। আর এই যে ছবিটা এঁকেছি, এটা একটা গণ্ডার। আপনমনে পুঁ পুঁ করে বাঁশি বাজাচ্ছে!”
সহসাই ধপাস করে একটা শব্দ! বাইসনবন্তী মাটিতে পড়ে কাদায় লুটোচ্ছে। যাইহোক, ধরাধরি করে বাইসনবন্তীকে তো তোলা হল। গণ্ডারনীর বিকার নেই। সে বলে চলেছে, “অহহা! অপূর্ব! কী অপরূপ চিত্রকলা! দেখেছিস, বিচারক বাইসনবন্তী ছবি দেখে আনন্দে ডিগবাজি খাচ্ছেন! তোর ফার্স্ট প্রাইজ পুরো বাঁধা!”
বাইসনবন্তীর সঙ্গে কাঠচশমালীও মাটিতে পড়ে লুটোপুটি খাচ্ছিল। সে তাড়াতাড়ি করে তার চশমাটা কুড়িয়ে চোখে ভালো করে এঁটে এবার এগিয়ে এল সামনে, “কই হে, দেখি, তোমাদের বাকি কাগজগুলো আমার হাতে দাও দিকিনি। দুটো ছবিতেই এই অবস্থা, বাকি ছবিতে না জানি কী হবে?”
বাইসনবন্তী তখনো মাটিতে ভোম্বল হয়ে বসে আছে আর ফ্যালফ্যাল করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কাঠচশমালী গণ্ডারগোঁর আঁকার কাগজটা নিয়ে তার মুখের সামনে বারকতক নাড়াল, “এই যে মশয়া! এই আঁকাটা দেখুন।”
হাতুশি দূর থেকে নজর করছিল সবকিছু। ‘মশয়া’ কথাটা অনেকদিন পর শুনে তার বেশ ফূর্তিই হল। কাঠচশমালী ওদিকে আঁকার কাগজ মেলে ধরে আছে বাইসনবন্তীর সামনে। তিনি শিউরে উঠলেন, “বাবা গো! গণ্ডার গো! গণ্ডারের ছবি গো!”
কাঠচশমালী অভয় দিল, “কিচ্ছুটি ভয় পাবেন না, মশয়া। আমি তো এতক্ষণ ধরে দেখছি এই আঁকাটা। কই আমার তো বুক ধড়ফড়, পেট পড়পড়, নাক গড়গড়, কান কড়কড়- কিচ্ছুটি হচ্ছে না!”
বাইসনবন্তী একটু যেন ভরসা পেয়ে ফ্যাকাশে হাসলেন, “ভয় নেই, বলছো? কই দাও, দেখি ছবিটা।”
কাঠচশমালী এগিয়ে দিল ছবিটা। বাইসনবন্তী দুই খুরে ছবিটাকে ধরলেন। ছবি দেখেই থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছেন বাইসনবন্তী। একটা নীল রঙের আকাশ। আর সেই আকাশে আগের ছবিগুলোর মতোই একখানা কালো ঢিপির মত কিছু। নীচে মাটিতেও একই ধরনের কালো একটা কিছু।
বাইসনবন্তী থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “ওরে, বাবা রে! মাটিতেও গণ্ডার, আকাশেও গণ্ডার!” বলতে বলতেই ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে চোখ বুজে গোঁ গোঁ করতে লাগলেন। গণ্ডারনী এগিয়ে এসেছে, “যা একখান এঁকেচিস না, গণ্ডারগোঁ! বিচারকের সারা গায়ে পুলকে শিহরন দিচ্ছে!”
কাঠচশমালী চশমাটাকে মাথায় তুলে গম্ভীরভাবে মন্তব্য করল, “হুঁ হুঁ বাবা! গণ্ডারগোঁর আঁকা কিনা। দেখলে ’পরে গোঁ গোঁ করতে হবেই!”
গণ্ডারগোঁ গোমড়া মুখে বলল, “ওপরেরটা গণ্ডার কোথায়? ওটা তো কালো মেঘ। নীচেরটা গণ্ডার।”
অবশ্য তার কথা বাইসনবন্তীর কানে গেল কিনা সন্দেহ। খানিকক্ষণ কেঁপেঝেঁপে তারপর স্থির হলেন তিনি। ততক্ষণে কাঠচশমালী বাড়িয়ে ধরেছে গণ্ডারিকার আঁকা কাগজ।
কাগজটাকে খুরে নিয়েই একবার শিউরে উঠল বাইসনবন্তী। তারপর কাগজের দিকে না তাকিয়ে কাঠচশমালীর দিকে অদ্ভুত চোখে চাইল, “এটায় তেমন কিছু নেই তো?”
কাঠচশমালী অভয় দিল, “না না, মশয়া! এটা একেবারে বুনোঘাস! কোন পোকামাকড় নেই।”
বাইসনবন্তী অতি ধীরে কাগজখানা খুলল। কালো ঢিপি কিছু নেই এটাতে। তার বদলে আছে পাতাখোলা একটা বই, কলম, পেনসিল, রাবার। আর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক খাতাবই।
বাইসনবন্তী কিছু বলার আগেই খড়্গ কুঁচকে টুঁচকে ঝাঁঝিয়ে উঠল গণ্ডারনী, “ছ্যা ছ্যা ছ্যা ছ্যা! এটা একটা আঁকা হল? কোন গণ্ডার নেই! পইপই করে বলেছিলাম, একটা না একটা গণ্ডারের ছবি আঁকতে। ছ্যা ছ্যা! এই এঁকে প্রাইজ পাবি? কভি নেহি!”
বাইসনবন্তী কিছু না বলে কাগজখানা ফেরত দিল। তারপর এগিয়ে চলল হাতুশি হিনিমিনিদের দিকে। বাঘু ওদিকে ঠায় সেই দূরেই বসে আঁকার কাগজ আড়াল করে কিসব কারিকুরি করে যাচ্ছে তো করেই যাচ্ছে। চারপাশে যে এত সব বিপর্যয় ঘটে যাচ্ছে, সেদিকে তার কোন হুঁশই নেই।
হাতুশির আঁকা সত্যিই তারিফ করার মতো। সে এঁকেছে একটা উড়ুক্কু যান। আকাশপথে একটা হুডখোলা গাড়ি, তার দুপাশে দুটো দুটো চারটে ডানা। গাড়ির সামনের ড্রাইভারের সিটে একটা কচ্ছপ, আর তার পাশে একটা হরিণ। আর পেছনের সিটে একটা খরগোশ আরাম করে শুয়ে আছে। নীচে মাটিতে একটা মানুষ চশমাটাকে মাথার উপর তুলে ঘাসের উপর শুয়ে।
গণ্ডারনী খড়্গ বাঁকাল, “হুঃ! এটা নাকি আঁকা? এটা যদি আঁকা হয়, তাহলে গঙ্গাফড়িঙও বাইসন!”
‘বাইসন’ শুনে বাইসনবন্তী কটমট করে পিছনে তাকাল। গণ্ডারনী কিরকম একটা থতমত খেয়ে চুপ করে গেল।
হিনিমিনি এঁকেছে সমুদ্রের বেলাভূমিতে একটা হনুমান হাতকাটা গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পরে একটা ছাতার তলায় মৌজ করে বসে কলা খাচ্ছে। তবে কিনা, তার আঁকাটা তেমন জুতের হয়নি। তার ছাতাটাকে লাগছে রুমালের মত, হাতে ধরা কলাটাকে লাগছে একটা পাশবালিশের মত আর হনুমানটাকে লাগছে একটা উচ্চিংড়ের মতন!
ভালকি এঁকেছে একটা স্কার্ট পরা বাচ্চা মেয়ে ভালুক লাফদড়ি হাতে নিয়ে টুথপেস্ট খাচ্ছে। ভালকির আঁকা দেখে আপনমনেই ঘাড় নাড়ল বাইসনবন্তী। গণ্ডারনীকে কিছু কথা বলতেই হয়! তাই সে বলল, “হুঁ! আঁকা না আস্তাবল!”
কুমরু এঁকেছে একটা মোটাসোটা কুমীর গদিতে তাকিয়া ঠেসান দিয়ে বসে বসে টাকার বাণ্ডিল গুনছে। আর তার চারপাশে রাশি রাশি টাকার বাণ্ডিল ছড়ানো। কুমরুর আঁকাটাও দেখতে ভালোই লাগছে, তবে কিনা বাইসনবন্তী তার আঁকা দেখে চোখমুখ কুঁচকে দুর্গন্ধ শোঁকার ভঙ্গি করল।
বাঘুর কারিকুরি ততক্ষণে শেষ। বাইসনবন্তী ও তার দলবলকে এগিয়ে আসতে দেখে বাঘু তার এতক্ষণের পরিশ্রম বিজয়গর্বে জয়পতাকার মতন তুলে ধরল।
তা দূর থেকে বাঘুর আঁকার কাগজটাও দেখাচ্ছে ভারি চমৎকার। নীচে জলে চকচকে মাছ, ডাঙায় কিসব জন্তু আর আকাশে একপাল কালো কালো পাখি- আর সবই বেজায় জীবন্ত! বাইসনবন্তীর মুখ দিয়ে আপনা থেকেই বেরিয়ে গেল- ‘বাঃ!’
গণ্ডারনী কোমরে থাবা দিয়ে গাঁক গাঁক করে আওয়াজ ছাড়ল, “এ আবার কিরকম ছবি? গণ্ডার নেই, হাতি নেই, এমনকি একটা বাইসন অব্দি নেই!”
বাইসনবন্তী পেছন ফিরে ফের কটমট করে তাকাতেই গণ্ডারনী আবার চুপ করে গেল। বাইসনবন্তী ক্রমশঃ কাছে এগিয়ে আসছেন দেখে বাঘু হাঁইমাঁই করে উঠল, “কাছে আসবেন না, দিদিমণি! এ আঁকা দূর থেকে দেখতে হয়, নইলে বিপদে পড়তে হয়!”
বাইসনবন্তী ঘাড় নাড়িয়ে মিষ্টি সুরে বললেন, “এত দারুণ এঁকেছো! কাছে গিয়ে না দেখলে নম্বর দেবো কি করে শুনি?”
বাঘু অদম্য, “না, দিদিমণি, কাছে আসবেন না। কাছে এলে আঁকাগুলো চলে যেতে পারে।”
বাইসনবন্তী মুখ খোলার আগেই নাকের খড়্গটাকে বারকতক তুড়ুক তুড়ুক করে নাচিয়ে আর কপালটাকে বারকয়েক তিড়িক তিড়িক করে নাচিয়ে মুখ খুলল গণ্ডারনী, “অ্যাই, তুই সেই বিচ্ছু বাঘটা না? বেঘো না কী যেন নাম? খালি বদমাশি করে বেড়াস?”
বাঘু অদম্য, “খালি বদমাশি করবো কেন, দিদিমণি? তাই করতে আছে বুঝি?”, বলেই বাঘু জিভ কাটল, “বদমাশি করি, ফাঁকি মারি, পড়ার নামে নানারকম কায়দাবাজি করি, এর ওর খাবার ফাঁক পেলেই খেয়ে নি, বেঘোসংগীত বাঘাকীর্তন, বাঘিশি এইসব নাচগানও করি। তাপ্পরে ধরুন…”
সহসাই তেড়ে এল বাইসনবন্তী, “ফালতু ভ্যাজরভ্যাজর না করে তোমার কাগজটা দাও। দেরি হচ্ছে। আমার আবার ‘জানোয়ার জীবন’ নিয়ে একটা চিত্রপ্রদর্শনী আছে আজ। তোমাদের সাথে বকবক করলে তো আর আমার চলবে না!”
বলতে না বলতেই বাইসনবন্তী ধেয়ে এসেছে আঁকার কাগজখানা নেবার জন্য। কিন্তু বাঘুও তৈরিই ছিল। সেও আঁকার কাগজ মাথার উপর তুলে গান গাইতে গাইতে ছুট দিল- যতোই করো তাড়া, দৌড়ে বাঘু সেরা!
বাঘু ছুটছে, তার পিছন পিছন ধাওয়া করেছে গণ্ডারনী আর বাইসনবন্তী। ভালকি আর কুমরুও ছুটছে যথাসাধ্য। শিয়ালনী হাল ছেড়ে দিয়ে মাটিতে শিবনেত্র হয়ে বসে পড়েছে। হাতুশি দিদিমণির গালে কপালে মাথায় শুঁড় বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
এমন সময় হিনিমিনি কোত্থেকে এসে ঝুপ করে নামল দিদিমণির কাছে। নেমেই সদর্প ঘোষণা, “চিন্তা করে না দিদিমণি, বাঘুকে হাজির করছি এখনি।”
হাতুশি শুঁড় দুলিয়ে সায় দিল, “হিড়হিড় করে লেজে টানি!”
শিয়ালনী ভুউউউস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, “কী হয়, কী জানি!”
হিনিমিনি ততক্ষণে ডালে-ডালে পাতায়-পাতায় রওনা দিয়েছে। বাঘু মনের আনন্দে ছুটছিল, অকস্মাৎ আকাশ ফুঁড়ে তার পিঠের ওপর এসে পড়ল হিনিমিনি এবং বাঘু ‘ক্যাঁক’মাত্র শব্দ করে ধরাশায়ী হল ভূতলে। আর সঙ্গে সঙ্গেই বাইসনবন্তী লাফিয়ে এসে ছোঁ মেরে আঁকার কাগজখানা ছিনিয়ে নিল। কাগজটার উপর চোখ বুলিয়েই তার মুখ কলসীর মুখের মতনই গোল হয়ে গেল আর বাঘুর আঁকার কাগজ থেকে একটা মশা মুক্তি পেয়ে মহানন্দে সেই গোলের মধ্যে ঢুকে গেল!
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বাইসনবন্তী শামুকটার গায়ে খুর বুলিয়ে দেখতে গেল। ততক্ষণে গণ্ডারনীও এসে পড়েছে সামনে আর শামুকটা বাইসনবন্তীর খুরের ধাক্কায় ছিটকে গিয়ে পড়ল গণ্ডারনীর খড়্গের উপর। কাঠচশমালী খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞের সুরে বলল, “তা নেহাত খারাপ লাগছে না। আপনি বরং খড়্গের ঠিক ডগায় শামুকটাকে রাখুন দিদিমণি, খাসা লাগবে!”
কাঠচশমালীর কথা শেষ হতে না হতেই কয়েকটা মশা ফরফর করে উড়ে গেল বাঘুর কাগজ থেকে। আঠার বন্ধনদশা থেকে মুক্তি পেয়ে একের পর এক মাছ ঝরে পড়ছে মাটিতে। কুমরু হাঁইহাঁই করতে করতে এগিয়ে এসেছে, “মাছ!!! আমি মাছ খাবো! বাঘু, বড় ভালো কাজ করলি রে!”
ভালকির মুখ শুকনো। হতাশ ভংগিতে বলল, “এ ভারি অন্যায়! আমি আসার আগেই খেলা শেষ? না মধু, না টুথপেস্ট! যা বাঘু, একটু মধু আর টুথপেস্ট নিয়ে এসে খাতায় লাগিয়ে তোর আঁকাজোকা সেরে ফ্যাল দেখি!”
পিছন থেকে আকাশবাতাস কাঁপিয়ে গর্জন উঠল একটা, “বাঘু! বাঘুউউউউ! আমার পাঠশালার নাম তুই ডোবালি! অ্যাঁ? আঁকার নামে মাছ চেটানো? শামুক চেটানোটা আঁকার মধ্যে পড়ে? মশা সাঁটিয়ে তুই পাখি বানিয়েছিস? হতভাগা! আমার বলে এত সাধের পাঠশালা… সেই পাঠশালার পশুয়া হয়ে তুই… ও হো হো হো!”
শিয়ালনী প্রায় কেঁদেই ফেলে আর কী! বাইসনবন্তী ফিক করে হাসল, “মন খারাপ কোরো না, শিয়ালনী! তোমার পাঠশালাই তো ফার্স্ট!”
হতভম্বের মত তাকাল শিয়ালনী। গণ্ডারনী থম মেরে গেছে। বাইসনবন্তী ফের হাসল, “তোমার পাঠশালার হাতুশি। আহা! কী দারুণ এঁকেছে! ওই-ই প্রথম। তারপর তোমার ভালকি। সে দ্বিতীয়। আর তৃতীয় তোমার কুমরু আর গণ্ডারনীর পাঠশালার…”
গণ্ডারনী ফস করে শুধোল, “গণ্ডামণ্ডা?”
“ঘন্টা!”
“গণ্ডারপুঁ?”
“উঁহু।”
“গণ্ডারগোঁ?”
“মোটেই নয় গো।”
“তাহলে… বাকি রইল একা…”
“ইয়েস, গণ্ডারিকা!”
বাঘু এতক্ষণ গোমড়ামুখে সব শুনছিল। দুম করে এরকম বিপর্যয় ঘটে যাবে ভাবতেও পারেনি। এবারে কোনমতে হিনিমিনির বজ্রআঁটুনি থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে এক লাফ দিয়ে থামল বাইসনবন্তীর সামনে, “আর আমি?”
বাইসনবন্তী ফিকফিক হাসল, “সবার শেষে তুমি… আঁকার নামে মিচকেমি!”
গণ্ডারনী রাগে ফুলছিল। এবারে মন্তব্য করল, “বেয়াদব বাঘু!!”
শিয়ালনী লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসছে বাঘুর দিকে। বেচারি বাঘু আর কী করে? হাঁউমাঁউ করে কান্নাই জুড়ে দিল একতাল, “ওগো, আমি বেয়াদব নই গোওওওও… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… মানে, মাঝে মাঝে অল্প অল্প বেয়াদবি করি গো… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… ওরে আমার এ কী হল রে… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… ওরে, আমি যে খালি মজা করতে চেয়েছিলুম রে… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… মানে ঠিক মজাও করতে চাইনি রে… মানে, ফার্স্ট হতে চেয়েছিলুম রে… মানে ঠিক ফার্স্ট হতেও চাইনি রে… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… কিন্তু তাই বলে কি একেবারেই লাস্ট হবো রে… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)…।”
……০……
অংকনঃ গুঞ্জা
বাঘু সিরিজের অন্যান্য গল্পগুলি থাবাছানি দিচ্ছে নিচের লিঙ্কেঃ-