ধুস! ধুস! ধুস! ‘দূর ছাতা’ বলে যেদিকে দুচোখ যায়, সেদিকে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে বাঘুর!
এইরকম একঘেয়ে দিন কাটানো- এটা আবার একটা জীবন নাকি? রোজ সেই একঘেয়ে ক্লাস করা, দিদিমণির কাছে সেই একঘেয়ে বকুনি! এমনকি নিজের বদমায়েশিগুলো পর্যন্ত আজকাল তার নিজেরই একঘেয়ে ঠেকছে! অনেকদিন জবরদস্ত কোনকিছু ঘটছেও না পাঠশালায়! বেশ একটা রোমাঞ্চকর কিছু, যাতে মনের সুখে ঝামেলা পাকানো যায়! নানান রকম ফন্দিফিকির আঁটা যায়! আচ্ছা, এতরকমের এত পরীক্ষা হয়, দুষ্টুমির কোন পরীক্ষা হয় না কেন? তাহলে বাঘুও সেইসব পরীক্ষায় একটু ফার্স্ট-টার্স্ট হতে পারত! আচ্ছা, বড় হয়ে একটা দুষ্টুমির পাঠশালা খুললে কেমন হয়? জঙ্গলের ছোট ছোট ছানাপোনাদের বেশ হাতেকলমে দুষ্টুমির নানা কায়দা শেখাবে, তার পাঠশালার নাম ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে…। আচ্ছা, পাঠশালার নাম কী রাখা যায়? ‘বাঘুর দুষ্টুমি শিক্ষণ কেন্দ্র’? নাকি ‘বাঘুর বদমাইশাগার’? নাকি, ‘বাঘুর কাছে, দুষ্টুমি আছে?’
এইসব ঘোরতর সুখকল্পনায় বিভোর হয়ে গেছে বাঘু, এহেন সময়েই লেজে এক হ্যাঁচকা টান! চমকে তাকিয়ে দ্যাখে, কোমরে হাত দিয়ে গনগনে চোখে পাশেই দাঁড়িয়ে দিদিমণি! বাঘু প্রায় খাবি খায় আর কী, “আ-আ-আমি তো দুষ্টুমি… মানে দুষ্টুমি শেখাইনি দিদিমণি… এ-একটাও ক্লাস নিই নি এখনো… বি-বিশ্বাস ক-করুন দিদিমণি…”
ঝনঝনে আওয়াজে ফেটে পড়েছে শিয়ালনি, “দুষ্টুমির ক্লাস এমনিতেও তোকে নিতে হবে না, বাঘু! ‘আশ্চর্য আকাশ’ বইয়ের কয়েকটা প্রশ্ন দিয়েছি বোর্ডে, একটাও তো টুকিসনি দেখছি। ওগুলো লিখে নিয়ে উত্তর করবি!”
বাঘু হতভম্বের মতন তাকিয়ে বলল, “‘আশ্চর্য আকাশ’ বইয়ের প্রশ্ন? আশ্চর্য ব্যাপার! আচ্ছা দিদিমণি, ‘আশ্চর্য দুষ্টুমি’ বলে কোন বই হয় না কেন?”
শিয়ালনি এতোই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল যে প্রথমটায় মুখ দিয়ে কোন আওয়াজই বেরোল না! তারপর ঘাড়টাকে হাওয়াতেই একবার সাঁতার কাটানোর চেষ্টা করল এবং সবশেষে বলল, “হয়না তার কারণ তোর পিঠে এখনো আশ্চর্য রকমের কিল পড়া বাকি আছে কিনা- তাই!”
আশ্চর্য কিলের কথায় বাঘু বেজায় দমে গিয়ে বেজারমুখে বোর্ডের প্রশ্ন টুকতে শুরু করে দিল। শিয়ালনিও খানিক দেখেটেখে ফেরত গেল নিজের জায়গায়।
বাঘু এদিকে প্রশ্ন টুকতে শুরু করেছে। প্রথম প্রশ্ন, পৃথিবী যদি সূর্যের চারপাশে ঘোরে, তাহলে পৃথিবীর চারপাশে কে ঘোরে? পৃথিবীর ঘোরা আর নাকে দড়ি দিয়ে কাউকে ঘোরানোর মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
দ্বিতীয় প্রশ্ন, শিলাবৃষ্টি কি শিলা নাকি বৃষ্টি? পিঠে শিল পড়া নাকি পিঠে কিল পড়া- কোনটি তুমি বেশি পছন্দ করবে ও কেন?
তৃতীয় প্রশ্ন, আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে জন্তুজানোয়ারদের কী করা উচিত? তাদের কি ল্যাজ গুটিয়ে পালানো উচিত? পালালে, তারা কোথায় পালাবে?
চতুর্থ প্রশ্ন, আকাশের রামধনু আর দোলের পিচকিরি- এই দুটির মধ্যে মিল বা অমিল কোথায়? তোমার মতামত বিস্তারিত আকারে লিখবে।
চারটে প্রশ্ন লিখেই বাঘুর এত একঘেয়েমি ধরে গেল যে তার গা থসথস, কান কসকস আর পেট ভসভস করতে লাগল! ক্লান্তির চোটে দু-খানা হাই হেউ-উ করে তুলল বাঘু! কিন্তু তাতে তার ক্লান্তি আরও গেল বেড়ে! এসব হাবিজাবি প্রশ্ন কাঁহাতকই বা টোকা যায়! বাধ্য হয়েই বাঘু পাশে বসা হিনিমিনির পিঠে ধাঁইধাঁই করে দু-কিল কষাল!
কিন্তু হিনিমিনিটা এমনই বেরসিক যে বাঘুর কিলের মর্ম তো বুঝলই না, উপরন্তু বাঘুর লেজে এমন দনাদন তিন টান দিল যে বাঘুই ‘আঁই দাদু রে!’ করে আঁতকে উঠল।
কোনমতে সামলে নিয়েই বাঘু তেড়ে গেল হিনিমিনির দিকে, “অ্যাইয়ো, তুই আমার লেজে টান দিলি যে বড়?”
হিনিমিনিও দাঁতমুখ খিঁচিয়ে তেড়ে এল, “তা যাবো না? তুই আমার পিঠে কিল মারলি যে বড়?”
বাঘু লেজে থাবা বুলোতে বুলোতে উত্তর দিল, “সে তো আমার পড়তে ভালো লাগছিল না বলে কিল মেরেছি!”
হিনিমিনিও পিঠ চুলকে জবাব দিল, “সে তো আমিও পড়তে ভালো লাগছিল বলে তোর লেজে টান দিয়েছি!”
তাই শুনে পাশে বসা কুমরু আর ভালকির হুঃ হুঃ হৌ হৌ করে সে কী হাসি! তাও ভাগ্যি ভাল, আগের দিন প্রায় চল্লিশ কিলো আম খেয়ে হাতুশির পেটটা সামান্য ছেড়েছে বলে পাঠশালে আসেনি! নইলে বাঘুর কপালে আরও কী ছিল কে জানে!
শিয়ালনি দিদিমণির ‘ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ’ করে নাকডাকার আওয়াজ ভেসে আসছে। সেদিকে তাকিয়ে বাঘু আর উত্তর লেখার দিকে গেলই না। পেনসিলটা মুখে নিয়ে বারকয়েক চুষল। তারপর রাবার দিয়ে লেজের ঘাম মোছার চেষ্টা করল। তারপর একদম শেষের পাতার একখানা কাগজ ছিঁড়ে নলের মতন বানিয়ে সেটায় মুখ দিয়ে ‘ড় ড় ড় ড় ড়ম্’ করে বিকট একখানা আওয়াজ তুলল। শিয়ালনি দিদিমণি ঘুমের ঘোরেই অল্প একটু চমকে উঠে পাশে বসা ভালকিকে ঘুমের ঘোরেই বালিশ ভেবে আরাম করে কাঁধে মাথা রাখলেন। ওপাশ থেকে কুমরু ফিসফিস করে বলল, “খবরদার ভালকি, এতটুকুও নড়িস না। আমি আর হিনিমিনি বরং দিদিমণি ঘুমোতে ঘুমোতেই একদান কাটাকুটি খেলে নি।”
ভালকি খুব আস্তে করে বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু তুই পরের দিন বালিশ হবি। আর আমি কাটাকুটি খেলব। ঠিক আছে?”
বাঘু চোখের কোণ দিয়ে একবার তাকাল। তারপর লেজে একটা গিঁট বেঁধে তার মধ্যে পেনসিলটাকে গুঁজল। তারপর আয়েস করে চিৎপাত হয়ে শুয়ে খাতাটাকে মুখের উপর রাখল। তারপর আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতেই আচমকা গলা ছেড়ে গান ধরল-
ট্যাঁ রে ট্যাঁ রে ট্যাঁ! প্যাঁ রে প্যাঁ রে প্যাঁ!
রাতের বেলা কেন আমার
ভেংচি কাটা পায়-
ওরে, ভেংচি কাটা পায়…
দুক্কুর বেলা গরমে যে
ঘুমোনোই দায়!
হায় হায়, ঘুমোনোই দায়…
বিকেল বেলায় লেজটি আমার
কীর্তন যে গায়,
উঁহু হুঁহুঁ, কীর্তন যে গায়…
আর…
সকাল বেলায় মনটি আমার
কাতুকুতু খায়…
আহা, কাতুকুতু খায়
হায় হায়, ঘুমোনোই দায়…
হায় হায়, ঘুমোনো যে দায়…
মনের সুখে গলা ছেড়ে গাইছে বাঘু, তার আর কোন হুঁশ নেই! সহসাই পাশ থেকে আকাশ ফাটানো চিৎকার, “বাঘু! বাঘুউউউউ! বলি, এসব হচ্ছেটা কী? এটা কি পাঠশালা নাকি গানের আসর?”
দিদিমণিকে দেখেই জিভ টিভ কেটে তাড়াতাড়ি করে উঠে বসল বাঘু। তারপর ভারি বিনীত ভঙ্গিতে বলল, “ও দিদিমণি, আপনি? আপনার ঘুম ভেঙে গেছে?”
শিয়ালনি দাঁত কিড়মিড় করতে করতে এক হুঙ্কার দিল, “আমি ঘুমোচ্ছিলাম, হতভাগা? আমার খালি চোখটা একটু লেগে গিয়েছিল, এই যা! ওকে ঘুমোনো বলে?”
বাঘু সুবোধ জন্তুর মত জবাব দিল, “কী বলে না বলে আমি কি আর অতশত জানি দিদিমণি? আমি বলে নেহাতই সরল সাধাসিধে বাঘছানা- ফাঁকি টাকি মারি আর বকা খাই! আর একটু গান বাজনার চর্চা করি এই আর কী!”
“গানবাজনা? ওকে গানবাজনা বলে?”, ঝাঁঝিয়ে উঠল শিয়ালনি, “তারস্বরে চিৎকার করে আমার ঘুমের… ইয়ে, মানে চোখ লাগার বারোটা বাজিয়ে দিলি! ওটাকে যদি গান বলিস বাঘু, তাহলে বাজ পড়লেও সেটা নিশ্চয়ই কোকিলের কুহুতান! আমার মেজাজ খারাপ করিস না বাঘু, তোর খাতা জমা দে। উত্তরগুলো কী করেছিস দেখি?”
বাঘু লেজ থেকে পেনসিল বের করে পেনসিলটাকে কানের পিছনে গুঁজে লেজটাকে আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে ভারি লজ্জার সুরে বলল, “উত্তর? উত্তর তো নেই, দিদিমণি।”
“উত্তর নেই কেন? বলি, খাতায় উত্তর লিখিস নি কেন? উত্তর দে। পইপই করে বলে গেলাম, তাও লিখিসনি?”
বাঘু বেজায় অবাক হবার ভান করে বলল, “আপনি খাতায় উত্তর লিখতে বলেছিলেন, দিদিমণি। সেটা ঠিকই। কিন্তু কবে লিখবো, সেটা তো কই বলেননি। তা সে যাই হোক, আপনি গুরুজন্তু। আপনার কথার একটা দাম আছে। আপনার কথা তো আর আমি একেবারে ফেলে দিতে পারিনা। তা ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি করেই লিখে জমা দেব দিদিমণি।”
রাগের চোটে শিয়ালনির ভুরু তিড়িংবিড়িং নাচছে, নাকের ডগা কাঁপছে পিড়িংপিড়িং করে। তারস্বরে এক হাঁক দিল শিয়ালনি, “বাঘু! বাঘুউউউউ! ইয়ার্কি পায়া হ্যায়? কায়দাবাজি পায়া হ্যায়?”
বাঘু মুখচোখ কাঁদোকাঁদো করে বলল, “কোথায় আর পাবো, দিদিমণি? এই দেখুন না, আপনার ঘুমের সময়… না মানে ঘুমের সময় না… চোখ লাগার সময়… ওরা যে কাটাকুটি খেলছিল, আমি এট্টুও খেলতে পেলাম না গো-ও-ও-ও! ও হো হো হো! আমাকে একবার বললও না গো-ও-ও-ও! ও হো হো হো!”
শিয়ালনির মুখচোখ কেমন যেন শুকনো চিঁড়ের মতো হয়ে গেল, “কাটাকুটি? খেলছিলিস নাকি?”, বলেই একটা নাকটানার মত আওয়াজ পাওয়া গেল, “কাটাকুটি? আহ্-হা, কাটাকুটি! শোন্, বড়দের না খেলতে দিয়ে নিজেরা এসব একা-একা খেলা খুব অন্যায়! আমি মোটেও সমর্থন করি না এসব। যা, হিনিমিনি আর কুমরু, দুজনে দশবার করে কাটাকুটিগুড়ি… ইয়ে মানে লম্বাগুড়ি দিবি যা!”
দুম করে লাফিয়ে উঠল বাঘু, “ইয়ে… মানে দিদিমণি, ওরা বরং বসুক। কাটাকুটি খেলে হাঁফিয়ে গেছে কিনা। ওদের জায়গায় আমিই বরং কুড়ি পাক লম্বাগুড়ি দিয়ে দিই। আমার আজকাল লম্বাগুড়ি দিতে বেজায় ভালো লাগে কিনা!”
হিনিমিনি ভেংচি কাটল, “অত লম্বাগুড়ি দিতে হয় না বাঘু! শেষকালে দেখা যাবে তোর গলাটা লম্বা হয়ে জিরাফের মতন হয়ে যাবে!”
শিয়ালনির মুখ-চোখ কেমন যেন হয়ে গেল কথাটা শুনেই, “জিরাফ? ক্কী, কী বললি, হিনিমিনি? জিরাফ?”, বলেই জিভ কাটল, “এই দ্যাখ, তোদের আসল কথাটাই বলতে ভুলে গেছি!”
অমনি থাবা মুড়ে এগিয়ে এল সকলে, “কী আসল কথা, দিদিমণি?”
শিয়ালনি গ্যাঁট হয়ে বসল ওদের মধ্যিখানে। তারপর হাত নেড়ে কদমফুলের মতন চোখ করে বলতে শুরু করল, “বিদেশি গণ্যমান্য জানোয়ারেরা আসছেন রে! আমাদের এই জঙ্গলে। কয়েকদিন থাকবেন। চারিদিক দেখবেন, ঘুরবেন। আমাদের পাঠশালাতেও আসবেন। আচ্ছা, তোরা জানিস কী, যাঁরা দেশে-বিদেশে নানান জায়গা ঘোরেন, তাঁদের কী বলে?”
ভালকি লাফিয়ে উঠল, “আমি জানি, দিদিমণি। পর্যটক।”
হাসি হাসি মুখে ঘাড় নাড়ল শিয়ালনি, “ইয়েস, পর্যটক। আর এঁরা হলেন পশু পর্যটক। বাইরে থেকে আমাদের দেশে আসছেন, আমাদের অতিথি। আর অতিথিদের যথাযোগ্য আদর-আপ্যায়ন করা আমাদের জন্তুকুলের পরম ধর্ম। মানুষেরা অবিশ্যি এসব রীতিনীতি ভুলেই মেরে দিয়েছে। তা মানুষদের কথা ছাড়। আমাদের জন্তুকুলের নিয়ম অনুযায়ী, তাঁদের সংবর্ধনা দেওয়া থেকে শুরু করে তাঁদের ব্যবস্থাপনায় কোথাও যেন কোন ত্রুটি না থাকে, তার বন্দোবস্ত করতে হবে। মেলা কাজ। তোরা সবাই কিন্তু খুব ভদ্রসভ্য হয়ে চলবি। আমাদের পাঠশালার তরফে একদিন একটা বিশেষ অনুষ্ঠানও করা যেতে পারে। দেখি।”
কুমরুর একটু সর্দিমতন হয়েছে। একটা রুমালে নাক মুছে ধরা ধরা গলায় বলল, “আচ্ছা দিদিমণি, কে কে মানে কোন্ কোন্ জন্তুরা আসবেন?”
শিয়ালনি সামান্য একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিল। তারপর বলল, “কে কে আসবেন, তাইতো রে? শোন্, যাঁরা আসছেন, তাঁরা কিন্তু বেশ নামডাকওয়ালা। প্রথমে আছেন জিরাফ মহোদয়া, তারপর আছেন জেব্রা মহোদয়। আর একজন আছেন লামা মহাশয়া।”
পাশ থেকে ফুট করে কে বলে উঠল, “লামা? মানে দক্ষিণ আমেরিকার?”
ওরা চমকে দেখে, হাতুশি! সে কখন এসে চুপচাপ গাছের গুঁড়ির সঙ্গে মিশে গিয়ে কথা শুনছে, কেউ খেয়ালই করেনি। শিয়ালনি অবাক হয়ে বলল, “এ কী রে? তুই? চলে এলি?”
হাতুশি হাসি হাসি মুখে মাথা নাড়ল, “ওই তো, মা খরগোশাই ডাক্তারদিদির থেকে কিসব ওষুধ এনে খাওয়ালো, ব্যস, চাঙ্গা লাগছে। ঘরে থেকে আর কী করবো? চলেই এলাম!”
শিয়ালনি বলল, “যাক্, ভালোই হল। তুই নেই বলে আমারও কিরকম ফাঁকা ফাঁকা ঠেকছিল। এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে! দু-জন আফ্রিকার, একজন দক্ষিণ আমেরিকার। তোদের আমি এই ক-দিন একটু একটু করে ইংরেজিও পড়াবো ঠিক করেছি। নইলে বিদেশি জানোয়ার মহোদয়-মহোদয়াদের সঙ্গে ভালোমত কথাও কইতে পারবি না, কিছু বললেও বুঝতে পারবি না। দিন সাতেক সময় আছে। কাল থেকেই পড়ানো শুরু করবো।”
পরের দিন সকালেই ইংরেজি পড়ানো শুরু করে দিল শিয়ালনি। প্রথমে এটা সেটা বোঝাল খানিকক্ষণ। তারপর বলল, “শোন্, ওঁরা এসেই নিশ্চয়ই প্রথমে সবার নাম জানতে চাইবেন। সেইজন্য আমি তোদের একে একে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করবো, হোয়াট ইজ ইয়োর নেম? তোরাও একে একে উত্তর দিবি।”
এই বলেই শিয়ালনি ফিরল বাঘুর দিকে, “হোয়াট ইজ ইয়োর নেম?”
বাঘু বেশ কায়দা করে মাথা হেলাল, “টাইগারু!”
শিয়ালনি এতই হাঁ হয়ে গেল যে সেই হাঁ-এর মধ্যে একটা মাছি বেশ খানিকক্ষণ মনের সুখে নাচানাচি করে উড়ে পালাল। একটু পরে সবেদার মত ঘোলাটে চোখে তাকাল শিয়ালনি, “বাঘু! টাইগারুটা আবার কিরকম কায়দা?”
বাঘু মুখ গোঁজ করল, “বা রে! আপনিই তো বললেন, নিজের নাম ইংরিজি করে বলতে! তা আমি বাঘ, আর বাঘের ইংরিজি টাইগার। তাহলে তো বাঘুর ইংরেজি টাইগারুই হবে!”
তাই শুনে শুঁড় দুলিয়ে হাতুশির সে কী হো হো হাসি, “ওহ! তার মানে আমি নিশ্চয়ই এলিফ্যান্টাসি!”
হিনিমিনি এক লাফে হাতুশির পিঠে চড়ে বসল, “আর আমি মাংকিমিনি!”
ভালকি গালে থাবা ঠেকাল, “আমার নাম তাহলে বিয়ারকি!”
কুমরুর কেমন যেন কান্না কান্না পাচ্ছিল। সেসব সামলে সুমলে বলল, “আমি তার মানে ক্রোকোডাইলু!”
শিয়ালনি হঠাৎ করে চোখদুটো লাট্টুর মতো ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, “আর আমি? আমি তাহলে কী হব? অ্যাঁ? ফক্সিনী?”
বাঘু বেজায় বিজ্ঞের মত বলল, “তা দিদিমণি, ফক্সিনী নামটা মন্দ না। বেশ একটা বিদেশি-বিদেশি গন্ধ ছাড়ছে! এক কাজ করুন। আপনি বরং আপনার নামটা বদলে ফক্সিনীই করে ফেলুন!”
“ক্কী? আমার নাম বদলাবো? কভি নেহি। বাঘুউউউ, তোর ফন্দিফিকির আমি বুঝি। ক্লাস পণ্ড করার মতলব, না? উটি হচ্ছে না, বাঘু বাছাধন! চল্, গিয়ে বোস যে যার জায়গায়। প্রশ্ন উত্তর লিখে ঝটপট জমা দে।”
পরের কয়েকটা দিন জঙ্গলে সাজো-সাজো রবই পড়ে গেল একরকম। জন্তু জানোয়ারেরা সব শশব্যস্ত হয়ে এধার সেধার দৌড়ে বেড়াচ্ছে, হ্যালো, হাই, থ্যাংক ইউ, বাই-এর ফোয়ারা ছুটছে চারিদিকে। জংগলের উঁচু উঁচু গাছের পাতায় বেশি লাফানো ঝাঁপানো কিছুদিনের জন্য কম করতে বলা হয়েছে সকলকে। জিরাফ মহোদয়ার জন্য উঁচু উঁচু গাছের ভালো ভালো কচি পাতা রেখে দেওয়া হয়েছে। জেব্রা মহোদয়ের জন্য বনের আনাচে কানাচে নানা ক্যানভাস রঙ তুলি ইত্যাদি রাখা আছে। যাতে তিনি ইচ্ছেমতন যখন খুশি যেখানে খুশি ছবি আঁকতে পারেন।
লামা মহোদয়ারও খবর পাওয়া গেছে। তিনি নাকি রেগে গেলে পুচ করে জল ছিটিয়ে সামনের লোককে ভিজিয়ে দেন। শিয়ালনি বাঘুকে পইপই করে সাবধান করে দিয়েছে। কিন্তু বাঘু তো বাঘুই। সে একটা জলের বোতল গলায় ঝুলিয়ে রাখছে সর্বক্ষণ আর মাঝেমধ্যেই একমুখ জল নিয়ে পুচ করে জল ছিটিয়ে অভ্যেস করছে। লামা ম্যাডাম ওকে ভিজিয়ে দিলে সেও তাঁকে পালটা পুচ করে জল ছিটিয়ে ভেজাবে! এদিকে শিয়ালনি দিদিমণি আজকাল পাঠশালে আসছেন হলুদ রঙের একটা বড়োসড় টাই পরে। তাঁর দেখাদেখি বাঘুও মাথায় টুপি আর গলায় টাই বেঁধে আসছে। বাকি পশুয়ারাও বাড়িতে আজকাল যথাসাধ্য টাই পরার চেষ্টা করছে। খালি হাতুশির গলার মাপমতো টাই ঠিকঠাক পাওয়া যাচ্ছে না। হাতুশি একদিন জিজ্ঞেস করতেও গিয়েছিল দিদিমণিকে যে একটা গামছাকে টাইয়ের মত বেঁধে গলায় ঝোলালে চলবে কিনা। তাইতে শিয়ালনি ওকে এমন ঝাড় দিয়েছিল যে হাতুশি বেচারি হিনিমিনির কাঁধে শুঁড় রেখে ফুঁৎ ফুঁৎ করে কেঁদেছিল অনেকক্ষণ।
ভালকি এদিকে হাজার চেষ্টা করেও কিছুতেই টাই পরে থাকতে পারছে না। তার খালি গলা কুটকুট করে। বাধ্য হয়ে সে এখন খালি গায়ের ওপরই সাদা রঙ দিয়ে সাদা হাতার বর্ডার, বুকের ওপর সাদা টাই, প্যান্টের সাদা বর্ডার- এসব বানিয়ে নিয়েছে। তাই দেখে বাকি পশুয়ারা হাসাহাসি করলেও ভালকির তেমন একটা হেলদোল নেই। হিনিমিনি টাই পরছে, কিন্তু টাইতে প্রায়ই কলার রস লেগে একাকার হয়ে যাচ্ছে। কুমরুর কিছুটা সুবিধা হয়েছে বরং। বড় একটা রুমালকে টাইয়ের আকারে গলায় বেঁধেছে আর দরকারমতো তাইতেই নাক মুছে নিচ্ছে।
বিদেশি পর্যটকেরা আসার আগের দিন শেষবারের মত পশুয়াদের সবকিছু ঝালিয়ে দিচ্ছে শিয়ালনি। পশুয়াদের ডেকে বলল, “মনে আছে তো সবার, হাউ আর ইউ জিজ্ঞেস করলে কী বলবি?”
সকলে ঘাড় হেলাল। ভালকি বলল, “হ্যাঁ দিদিমণি। মনে আছে। বলতে হবে- আই অ্যাম ফাইন। থ্যাংক ইউ। হাউ আর ইউ?”
বাঘু জোরে জোরে লেজ ঝাঁকাল, “না দিদিমণি, আমি মোটেই ফাইন নেই। বলছিলাম কী দিদিমণি, আমি মোটেও ভালো নেই, বেজায় গরম পড়েছে- এটার ইংরেজিটা একটু শিখিয়ে দিন না! তাহলে সেটাই বলবো!”
শিয়ালনি চটে লাল, “ওসব বলে না, বাঘু। ইংরেজিতে ওসব বলার নিয়ম নেই। ভালো থাকিস না থাকিস, ইংরেজিতে ওই উত্তরই দিতে হয়!”
শুনেই বাঘুর গালে থাবা, “সে কী কথা দিদিমণি? ইংরেজি তো বহুত বিচ্ছিরি জিনিস দেখছি। আমার যদি পেট খারাপ হয় কি দাঁতে ব্যথা হয় কি থাবায় চুলকুনি হয়- সেসব কিচ্ছু বলতে পারব না? দিদিমণি, আপনার ওই বিদেশি জন্তুদের বলে দিন- ভালো করে বাংলা শিখে নিতে। শান্তিতে দুটো খেয়ে পরে বাঁচবে।”
শিয়ালনি কিরকম যেন ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “সে ওদের একটা স্পোকেন বেংগলি ক্লাস করাবো ভেবেই রেখেছি। যাকগে, আজ যা করিস করিস, কাল থেকে কিন্তু সামলে-সুমলে চলিস।”
বলতে না বলতেই কোন্দিক থেকে প্রবল একটা আওয়াজ উঠলো। খরগোশাই ডাক্তারদিদিকে দেখা গেল বুকে স্টেথোস্কোপ নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতন ছুটছেন। কাছুয়াকেও দেখা গেল তড়বড় তড়বড় করে সাইকেল চালিয়ে যেতে। ওদের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে হাত নাড়ল, “দিদিমণি, তাড়াতাড়ি আসুন। চলে আয় রে তোরা সব।”
কেউই কিছু বুঝছে না। এ ওর মুখের দিকে চায়। আরও দু-চারজন জন্তুজানোয়ারকে দেখা গেল হন্তদন্ত হয়ে দৌড়োতে। কারুরই দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলার ফুরসতটুকু নেই।
শিয়ালনি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তখনই চোখে পড়ল বড়ো বড়ো পা ফেলে ওদের দিকেই এগিয়ে আসছে ভালকির মা ভালকিন। ভালকিন হল বিদেশি বন্যপ্রাণী অভ্যর্থনা মণ্ডলীর সভানেত্রী। দূর থেকেই চেঁচাতে শুরু করেছে সে, “কই গো, শিয়ালনি, শিগগির চলো। ওদের পশু-প্লেন ঢুকে পড়লো বলে। একদিন আগেই এসে পড়ছে ওরা। চটপট পা চালিয়ে চলো সব! অভ্যর্থনা সংগীত মোটামুটি মুখস্থ হয়েছে তো তোদের?”
প্রাণপণ ছুটতে ছুটতে পশু-প্রান্তরে গিয়ে ওরা দ্যাখে, পশু-প্লেন সবে নেমেছে। বিদেশি জন্তু, তাদের ব্যাপার স্যাপারই আলাদা! পরপর বেরিয়ে এল তিনজন- জিরাফজোলা, জেব্রাকোফি আর লামাএম্মা।
কাতারে কাতারে জন্তুরা সব ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। বিদেশিদের দেখেই বিশাল একটা উল্লাসের রব উঠল! শিয়ালনি ভিড়ের মধ্যে দিয়েই কোনরকমে পশুয়াদের নিয়ে গিয়ে দাঁড়াল বিদেশিদের সামনে। ভালকিন আর তার সংগীসাথীরা ফুলের তোড়া নিয়ে বরণ করল ওদের। পশু পর্যটকেরা করমর্দন করলেন ওদের সবার সঙ্গে একে একে। যে যার নাম বলছে। শিয়ালনি করমর্দন করে যখন নিজের নাম বলল, জিরাফজোলা ঠিকঠাক শুনতে পাননি। তিনি ভুরু কুঁচকোতেই শিয়ালনি তড়িঘড়ি বলল, “শিয়ালনি… ইয়ে মানে… মাই নেম ইজ ফক্সিনী।”
জিরাফজোলা কী বুঝলেন ঠিক বোঝা গেল না। কারণ তাঁর গলা এতটাই লম্বা যে অত উপরে যে কী চলছে, ভালোমত ঠাহর করা যায় না। কিন্তু চোখের সানগ্লাসটাকে মাথার উপরদিকে ঠেলে দিয়ে তিনি মৃদু হেসে যে ‘আই সি’ বললেন, এটা বেশ বোঝা গেল।
জেব্রাকোফির চেহারা বেজায় উস্কোখুস্কো, এলোমেলো। একটা শিল্পী-শিল্পী ভাব। একসঙ্গে এত জন্তুর ভিড় দেখা অভ্যেস নেই, ঘাবড়েই গেছেন কিছুটা। অন্যমনস্কভাবে হাতের তুলিটাই বারদুয়েক চিবিয়ে ফেলেছেন এর মধ্যে। বরং লাম্মাএম্মাকে দেখে মনে হচ্ছে বেশ ধীর- স্থির। বেশ শান্ত মেজাজে চুইংগাম চিবোতে চিবোতে তিনি চারপাশে তাকিয়ে সবটা যেন মেপেজুপে নিচ্ছেন। বাঘু নিজের গলার জলের বোতলটা একবার টেনেটুনে ঠিকঠাক করে নিল!
করমর্দন সারা হতে শিয়ালনি চোখের ইশারা করল ওদের। সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল অভ্যর্থনা-সংগীত। বাঘু তার গলার বোতলটা শিয়ালনিকে দিয়ে গলায় একটা ঢোলক ঝুলিয়েছে, হাতুশি একটা হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে প্যাঁ প্যাঁ প্যাঁ প্যাঁ করে রিড টিপছে, হিনিমিনি মুখে বাঁশি নিয়ে পুঁ পুঁ পুঁ করে বাজাচ্ছে, আর ভালকি একখানা ড্রাম নিয়ে ধাঁই ধাঁই করে পেটাচ্ছে। সর্দিবসা গলা খেলিয়েই গান জুড়ল কুমরু। তার মুখের সামনে ধরা একটা চোঙা। গান শুরু হল-
আজিকে এ জঙ্গলে-
ভরা ফুলে ফলে
এসো হে, এসো হে, এসো হে…
বিদেশি পশু তিনজনা
রীতিনীতি নাই জানা,
ক্ষমো হে, ক্ষমো হে, ক্ষমো হে…
তোমাদেরি লেজ
আছে যত তেজ-
ভরো হে, ভরো হে, ভরো হে…
বিদেশিরা কতটুকু বুঝছে কে জানে, কিন্তু তাদের মাথা আর ঘাড় ঘনঘন নড়ছে। ওদিকে বাঘু উৎসাহের চোটে এত জোরে জোরে ঢোলক বাজাচ্ছে যে ঢোলকের দড়িফড়ি ছিঁড়ে ঢোলকখানা গড়্গড়িয়ে সোজা ধাক্কা খেল জেব্রাকোফির গায়ে। তিনি সম্ভবতঃ মনে মনে কোন ছবি আঁকছিলেন কারণ তাঁর তুলি হাওয়ায় কিসব হিজিবিজি কাটছিল। আচমকা ঢোলকখানা পায়ে এসে পড়ায় কী হল কে জানে, তিনি ধাঁই করে একখানা শট পিটলেন ঢোলকে! তাঁর শটের চোটে ঢোলকটা সোজা গিয়ে জমা হল ভালকিনের পায়ে। ভালকিনও সব ভুলে ধাঁই করে একখানা শট দিল ঢোলকের গায়ে। লামাএম্মা হতভম্ব হয়ে দেখছিলেন, আচমকা হয়তো তাঁর মনে হল, তাঁরও খেলা উচিত বা হয়তো এই জঙ্গলের রীতিই অমনি। সেইসব ভেবে তিনিও ছুটে এসে ঢোলকটাকে লাথি কষাতে গেলেন, আর এদিক থেকে বাঘুও গেছে ছুটে। কারুরই পা আর ঢোলক অবধি তো পৌঁছোলই না, উপরন্তু দুজনেই দুজনের পায়ে জড়িয়ে চিৎপটাং। এদিকে হিনিমিনি গাছ বাওয়ার মতন করে জিরাফজোলার গলা বেয়ে তাঁর মুখের কাছাকাছি পৌঁছে বাঁশিটা তাঁর মুখে দিয়ে দিয়েছে। তিনিও ভেবেছেন, এখানকার এমনধারাই নিয়ম! ফলে তিনিও পুঁ পুঁ করে বাঁশি বাজাতে লেগেছেন!
ব্যাপার কতদূর কী গড়াত কে জানে, ঢোলকবল খেলার লোকজন ক্রমশঃ বাড়ছে দেখে টনক প্রথমে নড়ল শিয়ালনিরই। সকলকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে খেলা থামিয়ে পশু পর্যটক আবাসে নিয়ে গিয়ে তোলা হল। পরের দিন সকালেই তাঁদের কর্মসূচী পাঠশালা পরিভ্রমণ।
পরের দিন সকালে পাঠশালায় ঢুকে শিয়ালনির পোশাক দেখে সকলেই তাজ্জব! লাল টকটকে একটা টাই পরে এসেছে শিয়ালনী। লেজে ফুলের বদলে একখানা বেল্ট, কোমরে আরেকখানা। বাম ডান দুহাতেই দুখানা ঘড়ি। এই গরমেও দুপায়ে মোজা আর বুটজুতো। তবে বাকিরা চমকালেও বাঘু তত চমকায়নি। নিরাপদে থাকার জন্য বাঘুর গলার সামনে পিছনে দু-খানা জলের বোতল। গলায় টাই, মাথায় টুপি তো তার আছেই, উপরন্তু পাছে ফুটবল খেলতে হয়, সেই ভেবে সাদা মোজা আর কেডসও পরে এসেছে সে। ভালকি অতশত ঝামেলায় যায়নি। সে তার গায়েই সাদা রঙ দিয়ে শার্ট, প্যান্ট, টাই, মোজা, জুতো সব বানিয়ে নিয়েছে।
পাঠশালায় ঢুকেই এমন পোশাক আশাক দেখেই হয়তো, বিদেশিরা চমকে গেলেন বেজায়! পাঠশালার চারিদিক সুন্দর করে রঙিন ফুল, কাগজ, লতাপাতা দিয়ে সাজানো। ওরা সকলে বাহারি আলপনাও দিয়েছে।
জিরাফজোলা হাসলেন, “হামি এটু এটু বান্লা জানি।”
জেব্রাকোফি সায় দিলেন, “হাঁ। আসার আগে বান্লা জানলাম।”
লামাএম্মা কিছু বললেন না, খালি ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন। তাঁর হয়তো ‘বান্লা’ মানে বাংলাটা তত রপ্ত হয়নি। শিয়ালনি চটপট চটপট হাত নেড়ে বলল, “ও নিয়ে কিচ্ছু ভাববেন না। যে ক-দিন আছেন, আমি রোজ পড়িয়ে দেব। সাত দিনেই চমৎকার বাংলা বলতে শিখে যাবেন।”
বাঘু পাশ থেকে ফিসফিস করে বলল, “তাহলে তো বাঁচি! আমাদের জ্বালাটা কমে!”
শিয়ালনির কানে গিয়েছে কথাটা। কটমট করে চাইল বাঘুর দিকে। কিন্তু আর কিছু বলল না।
লামাএম্মাও বেশ জুলজুল করে বাঘুকে দেখছেন। বোঝাই যাচ্ছে আগের দিন বাঘুর পায়ে ঠোকর খেয়ে পড়ে যাওয়াটা খুব ভুলতে পারেননি। যাই হোক, কিছুক্ষণ পরে ওঁদের সঙ্গে পশুয়াদের বেশ ভাব হয়ে গেল। জিরাফজোলার লম্বা গলাটা হিনিমিনির ভারি পছন্দ হয়ে গেছে। সে খালি ওঁর লম্বা গলা বেয়ে একবার করে ওপরে ওঠে আর নিচে নামে। একটু পরেই জিরাফজোলা তাকে নিয়ে চললেন সামনাসামনি লম্বা গাছপাতার খোঁজে।
শিয়ালনি লামাএম্মার সঙ্গে কিসব কথাবার্তা বলছে ইংরেজিতে। হাতুশি জেব্রাকোফিকে দেখিয়ে বাকিদের বলল, “এই যে দেখেছিস, ওঁর গায়ে কিরকম সাদা-কালো ডোরাকাটা। মানুষদের যেগুলো বড় বড় শহর হয় না, সেখানকার রাস্তায় এইরকম সাদা-কালো দাগ দেওয়া থাকে। তাকে বলে জেব্রা ক্রসিং। ওই ওঁদের থেকেই শিখেছে। মানুষদের নিজেদের গায়ে দাগকাটা খাঁজকাটা কিছু নেই কিনা, সব জন্তদের থেকে আইডিয়া ধার করে!”
বাঘুর মাথায় কী ভূত চাপল কে জানে, সঙ্গে সঙ্গে পোঁ ধরল, “আমি জেব্রা ক্রসিং খেলব! চল্ না, সবাই মিলে বেশ জেব্রা ক্রসিং জেব্রা ক্রসিং খেলি! একদম নতুনরকম হবে।”
বলেই জেব্রাকোফির গলা ধরে ঝুলে পড়ল বাঘু, “ও জেব্রাকোফিদাদা, চল না দাদা, লক্ষ্মী জেব্রাকোফিদাদা আমার, চলো না, জেব্রা ক্রসিং খেলি! তুমি বেশ শুয়ে থাকবে, আর আমরা তোমার ওপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে যাওয়া আসা করবো।”
জেব্রাকোফি যে কিছুই বোঝেননি, সে তাঁর মুখ দেখেই মালুম হল। কিন্তু বাচ্চারা তাঁকে ঘিরে ধরেছে, গলা ধরে ঝুলে পড়ছে, কিছু একটা বলছে আর তাতে যে তিনি মজা পেয়েছেন, এটা পরিষ্কার। যাইহোক, সবাই মিলে টানতে টানতে তাঁকে নিয়ে চলল শিয়ালনির চোখের আড়ালে।
সেই বুড়ো বটগাছের তলায় নিয়ে গিয়ে হাতুশি তাঁকে শোয়ার ইঙ্গিত করল। জেব্রাকোফিও দিব্যি শুয়ে পড়লেন। এরপর শুরু হয়ে গেল খেলা। জেব্রাকোফির দুপাশে দুটো লাইন টানা হয়েছে। এপাশের লাইন থেকে ওপাশের লাইন টপকে পেরোতে হবে। না হলেই আউট। ওরা চারজনে আরামসে লাফিয়ে লাফিয়ে ডিঙোতে থাকে জেব্রাকোফিকে। হাতুশির চেহারা ভারি বলে তারই যা একটু সমস্যা হচ্ছিল। এদিকে শুয়ে থেকে থেকে ঘুমই ধরে গেছে জেব্রাকোফির। হাতুশি জোর করে লাফাতে গেছে একবার, আর হবি তো হ, সেই সময়ই জেব্রাকোফি ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরতে গেছেন! আর যায় কোথা? হাতুশি পায়ে জড়িয়ে ধড়াম করে পড়ল তাঁর গায়ে। বাকিরা কোথায় গিয়ে দুজনকে টেনে তুলবে তা না, সমস্বরে চেঁচানি শুরু করে দিয়েছে, “হাতুশি আউট! হাতুশি আউট!”
সে যাই হোক, কিছুক্ষণ পরে উঠে বসেছে দুজনেই। জেব্রাকোফি নিজের গায়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে খুব খেদের সঙ্গে বললেন, “ওনলি ব্ল্যাক অ্যাণ্ড হোয়াইট! নো কালার।”
মানে, তাঁর শরীর শুধুই সাদা আর কালো, কোন রঙ নেই! ভালকি গালে আঙুল ঠেকাল, “এই কথা! দাঁড়ান! ওয়েট!”
কুমরু আর হাতুশি ঝটপট ঝটপট পাঠশালা থেকে রঙ তুলি নিয়ে এসে হাজির। আর তারপরই জেব্রাকোফিকে ঘিরে চারজনে বসে দেদার রঙ মাখাতে শুরু করল।
জেব্রাকোফিকে রঙ মাখানো সবে শেষ হয়েছে, এমন সময় শিয়ালনি ওদের খুঁজতে খুঁজতে লামাএম্মাকে নিয়ে হাজির! এদিকে সারা শরীরে যথেচ্ছ রঙ মেখে জেব্রাকোফির চেহারা যা খোলতাই হয়েছে, তাতে তাঁকে চেনাই দুষ্কর! শিয়ালনি আর লামাএম্মা কেউই চিনতে পারেনি জেব্রাকোফিকে। শিয়ালনি আবার হাতুশিকে একপাশে ডেকে এনে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ রে, ইনি আবার কে? চেহারার আদলটা জেব্রাকোফির মতোই, কিন্তু তাঁর দেহের রঙ আলাদা। ইনি কে? আর জেব্রাকোফিই বা গেলেন কোথায়?”
হাতুশিও শুঁড় বাগিয়ে চাপাস্বরে উত্তর দিল, “দিদিমণি, ইনি জেব্রাকোফিই। ওঁর বর্ণ পরিবর্তন হয়েছে। মানে গাত্রবর্ণ!”
শিয়ালনি একটু হাসতে গিয়েও গম্ভীর হয়ে গেল। ওদিকে লামাএম্মা জেব্রাকোফির চারপাশে ঘুরে ঘুরে খুব মনোযোগ সহকারে দেখছেন। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না যে ব্যাপারটা ঠিক কী হয়েছে! এমন সময় বাঘু একটা তুলি উঁচিয়ে ধেয়ে এসেছে, “এই যে জেব্রাকোফিদাদা, তোমার বাঁ ভুরুর খানিকটা রঙ উঠে গেছে। চলো, তোমাকে একটু ভুরুপালিশ করে দিই।”
বলেই বাঘু জেব্রাকোফির ভুরুপালিশ করতে বসতে যাবে, এমন সময় লামাএম্মা প্রবলবেগে ঘাড় নাড়লেন, “নো! নো! নো! নো কালার অন জেব্রাকোফি!”
বাঘুও ছাড়ার পাত্র নয়। সে জেব্রাকোফির পাশের খালি জায়গা দেখিয়ে বলল, “সিট! ভুরুপালিশ… ইউ!”
মানে, এখানে বসুন, আপনারও ভুরুপালিশ করে দেবো। তা লামাএম্মা কি আর বাঘুর ইংরেজি অতশত বুঝবেন? তিনি কী বুঝলেন তিনিই জানেন, কিন্তু বাঘুর থাবার তুলি ধরে টানাটানি শুরু করলেন। কিন্তু বাঘু তো বাঘুই। তার রোখ চেপে গেল। সে তুলিটাকে রঙে আচ্ছা করে চুবিয়ে স্যাটাস্যাট দু পোঁচ রঙ বুলিয়ে দিল লামাএম্মার গলায়, ঘাড়ে! ব্যস, লামাএম্মা জ্বলন্ত চোখে চাইলেন বাঘুর দিকে। বেগতিক বুঝে বাঘু গলার জলের বোতলে থাবা দিতে না দিতেই… পুউউউচ! লামাএম্মার মুখ থেকে জলীয় পদার্থ এসে সটান ভিজিয়ে দিল বাঘুকে। বাধ্য হয়েই বাঘু জলের বোতল খুলে মুখে জল পুরতে যাবে, এমন সময় শিয়ালনি এসে বাঘুর লেজ পাকড়ে ধরল, “বাঘু, একদম ওঁকে জল ছেটাবি না বলে দিলাম! তাহলে কিন্তু তোর একদিন কি আমারই একদিন!”
বেচারি বাঘু আর কী করে? মুখ গোঁজ করে জলের বোতল থেকে জল নিয়ে মুখচোখ ধুয়ে নিল ভালো করে । তারপর মুখ দিয়ে হুঁ-হুঁ-হুঁ-হুঁ আওয়াজ করে কিসব মতলব ভাঁজতে লাগল।
বাঘু যে কী মতলব ভাঁজছিল সেটা বোঝা গেল বিকেলবেলায়। বিশেষ বিশেষ উপলক্ষ্যে পশু প্রান্তরে সব জন্তুরা একসঙ্গে মিলে গোল হয়ে একজন আরেকজনের লেজ বা থাবা ধরে ঘুরে ঘুরে গান করে-
আয় তবে লেজ ধরি
গোল হয়ে ঘুরি ফিরি।
থাবা থাবায় মেলামেলি
হয়ে যাক কোলাকুলি…
হো হো হো হো…
ও হো হো হো হো…
জান আছে, যেটা দরকার-
তাই মোরা জানোয়ার…
দুখে দুখে থাকি কাছে
দিলটা যে খোলা আছে-
হো হো হো হো…
ও হো হো হো হো…
এই নাচগান করতে গিয়েই হল বিপত্তি! নাচের সময় বাঘু ইচ্ছে করে লামাএম্মার পাশে গিয়ে তাঁর থাবা ধরল। যথারীতি নাচ শুরু হয়ে গেল একটু পরেই। বাঘু এদিকে করেছে কী, নাচ শুরুর আগেই মুখে জল ভর্তি করে নিয়েছে! এ নাচের নিয়ম হচ্ছে, ‘হয়ে যাক কোলাকুলি’র জায়গাতে যে যার পাশের জনকে জড়িয়ে ধরে। যেই না লামাএম্মা জড়িয়ে ধরতে গেছে বাঘুকে, অমনি বাঘু মুখভর্তি জল পুচ করে ছিটিয়ে ভিজিয়ে দিল লামাএম্মাকে। লামাএম্মা খানিক হতভম্ব হয়ে থেকে যেই না বাঘুকে উলটে ভেজাতে যাবেন, ততক্ষণে বাঘু পগার পার!
তারপর থেকে লামাএম্মাও তক্কে তক্কে আছেন! ওই বিচ্ছু বাঘছানাটার কিছু একটা ব্যবস্থা না করলেই নয়! এদিকে বাঘু সেদিনের পর থেকেই কেন কে জানে, কাঁধে একটা ঝোলা নিয়ে ঘোরে সবসময়! তা লামাএম্মার সামনে সুযোগও এল। বিদেশি অতিথি জানোয়ারদের সম্মানে একটা সমবেত দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রার আয়োজন করেছিল অভ্যর্থনা সমিতি। শিয়ালনি সহ পাঠশালার পশুয়াদেরও আমন্ত্রণ ছিল। ব্যবস্থাপত্র বেশ ভালোই ছিল। ঝিরিঝিরি গাছের ছায়ায় নরম গদিওলা বিছানা, বেলফুল-জুঁইফুলের মনকাড়া সৌরভ, নেপথ্যে ঝিঁঝিঁপোকার মৃদুস্বরে গান- সব মিলিয়ে ঘুম যেন আঁচল পেতে বসেই আছে!
লামাএম্মা বেছে বেছে গিয়ে শুলেন বাঘুর পাশেই। এদিকে বাঘুও দুষ্টুমিতে নেহাত কম যায় না। লামাএম্মার চোখ বুজে আসতেই সে লামাএম্মার চাদর ধরে দিল এক টান! লামাএম্মা কিন্তু ঘুমোননি। কিন্তু সাথে সাথেই চেয়েছেন চোখ মেলে। আর চোখ মেলতেই দেখেন বাঘু পিটপিট করে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকেই। ব্যস, প্রবল রাগে উঠে পড়লেন তিনি এবং সঙ্গে সঙ্গেই পু-উ-উ-উ…
কিন্তু না! বাঘুও তৈরি ছিল। তার কাঁধের ঝোলা থেকে ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে একটা ছাতা। লামাএম্মা যেই না প্রবল এক দম নিয়ে পু-উ-উ করেছেন, বাঘু ততক্ষণে হাতের ছাতার সুইচ টিপে ছাতা মেলে ধরেছে। ফলে লামাএম্মা পুচ করলেন বটে, কিন্তু তাঁর মুখের জলীয় পদার্থ বাঘুর মুখ না ভিজিয়ে ছাতায় গেল আটকে! ছাতার আড়াল থেকে মুখ বাড়াল বাঘু, “টুকি!”
লামাএম্মা ‘টুকি’ বোঝেন না ঠিকই, কিন্তু এমনতরো অপদস্থ হওয়াটা দিব্যি বুঝেছেন! ঘুমটুম ভুলে তিনি গিয়ে ঘুমন্ত শিয়ালনিকে জাগিয়ে তুলে আধা বাংলা আধা ইংরেজিতে তড়বড় করে বলতে লাগলেন, “ইয়োর পাঠশালা… দ্যাট বাঘু… ওই টাইগার স্টুডেন্ট… হি হামাকে… আই স্লিপ… এমনি (ঘাড়ে হাত দিয়ে ঘুমের ভান দেখালেন)… দ্যাট নটি বাঘ… হামার বেড… গেভ হ্যাঁচকা টান!”
‘হ্যাঁচকা টান’ শব্দটা ঠিকঠাক বলা সত্ত্বেও শিয়ালনি সেটাকে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনলেন না। দুমদাম পা ফেলে এগোতে থাকলেন বাঘুর দিকে।
বাঘু ছুটছে ছাতা হাতে। পেছন পেছন লামাএম্মা! তার পেছনে শিয়ালনি। তার পেছন পেছন কাঁচা ঘুমভাঙা চোখে হাতুশি, হিনিমিনি, কুমরু, ভালকি। তারও পেছনে বাকি পশুরা। জিরাফজোলা আর জেব্রাডেব্রা বাদে। জেব্রাডেব্রার গায়ে তেলরং দিয়ে সকালেই ভালকি আর কুমরু ভালোটি করে পাকা রঙ করে দিয়েছে। মহাশান্তিতে তিনি তাই ঘুমোচ্ছেন। আর জিরাফজোলার গলা রাখার জন্য আলাদা করে একটা গলাবালিশ বানানো হয়েছে। তাইতে গলা রেখে তিনিও চমৎকার ঘুম দিচ্ছেন।
লামাএম্মা দৌড়োতে দৌড়োতে বারকয়েক পুউউউচ করেছেন বটে, কিন্তু প্রতিবারেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছেন। আর এত ধকল কি আর তাঁরই পোষায়? বাধ্য হয়ে জিরোবার জন্য বসলেন তিনি। তাই দেখে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থেকে বাঘু কোমরে থাবা দিয়ে দাঁড়িয়ে হ্যা হ্যা করে হাসতে লাগল লামাএম্মার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে!
বাঘু খেয়াল করেনি। শিয়ালনি দিদিমণি ছুটতে ছুটতে এসে গেছেন বাঘুর একদম কাছেই! বোমা ফাটানোর মতোই আওয়াজ হল একটা, “বাঘু! বাঘুউউউউ! তোকে পইপই করে বলা সত্ত্বেও এইসব বদমায়েশি! হতভাগা, দেখ আজ তোর কী দশা হয়!”
সভয়ে বাঘু তাকিয়ে দেখে, বাঘুর ছেড়ে আসা সেই জলের বোতলটা শিয়ালনি দিদিমণির থাবাতেই। তিনি মুখভর্তি জল নিলেন, বাঘুর দিকে তাক করলেন এবং…
পু-উ-উ-উ-উ-চ!
……০……
অংকনঃ গুঞ্জা
বাঘু সিরিজের অন্যান্য গল্পগুলি থাবাছানি দিচ্ছে নিচের লিঙ্কেঃ-