শেষ হেমন্তের পড়ন্ত বেলা। চারিদিকে ছড়ানো পলকা হলদে রোদ – আছে কিন্তু থাকবে না গোছের।
ওরা দুজনে বসেছিল পাড়ার চণ্ডীমণ্ডপের বাঁধানো চাতালে- সোশ্যাল ডিসট্যান্স মেনেই। অনঙ্গদা ও টগরপিসি। দু-একজন পাশ দিয়ে যেতে যেতে স্বভাব-ধর্মে বাঁকা চোখে তাকাচ্ছিল কিন্তু তেমন কিছু মনে করছিল না।
আজ থেকে কুড়ি বছর আগে ওরা এভাবেই বসত সেচ কলোনির মাঠে, ঘাসাসনে, তার সঙ্গে ‘আমি তোমার, তুমি আমার’ গোছের আশ-পাশ গপ্পো। তখন অনঙ্গদা বছর পঁচিশের লাগামছাড়া টগবগে জংলি ঘোড়া, টগর পিসি বছর কুড়ির মোহিনী।
বিকেল হলেই অনঙ্গদা বেরোত সাইকেল নিয়ে। দত্ত- বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় যেন অকারণে সাইকেলের ঘন্টিটা বাজাতো জোরে জোরে। অবশ্য তার দরকার হতো না। অনেক আগে থেকেই টগর পিসি এসে দাঁড়াতো রাস্তার উপর ঝুল বারান্দায়। চিরুনি দিয়ে বেচাল চুলগুলোকে ভদ্রস্থ করার লড়াই চালাতো। অনঙ্গদা চলে গেলেই পিসির মাথা ধরতো, কিংবা দাঁতের ব্যথাটা বাড়তো বা ওই ধরনের কিছু। বেরিয়ে পড়তো বাড়ি থেকে।
কিন্তু ওদের বেদম ভালোবাসার সোনালী সড়ক ছাদনাতলা পর্যন্ত পোঁছোল না, নিদেন পক্ষে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের টেবিল পর্যন্তও না। তারপর- যেমন হয় আর কী, তেমনি হলো। পিসির বাবা ওর বিয়ে দিয়ে শ্বশুরঘর পাঠালেন। না, অনঙ্গদা পিসির শোকে দাড়ি-গোঁফ রেখে, কবিতা লেখার নামে দিস্তে দিস্তে কাগজ খরচ করে হাফ-পাগল হয়নি। দেখেশুনে একটা বিয়ে করে ঘর বাঁধলো। গড়পড়তা ছা-পোষা গেরস্তের মতো ওদের দিনগুলো পিছলে পিছলে কাটতে লাগলো।
টগর পিসির ভাইপোর বিয়ে। পিসির বাবা-মা দুজনেই গত। এসেছে বাপের বাড়ি, এখন ভাইয়ের বাড়ি। না না, বলা ভাল ভাই-বউয়ের জমিদারি, ভাই-ই বলতে গেলে গোমস্তা।
আজ ওরা বসেছে এই চণ্ডীমণ্ডপে, বহু বছর বাদে। একথা, ওকথা, পাঁচ কথার ফাঁকে টগর পিসি বলে- “আচ্ছা অনঙ্গদা, মনে করো আমরা মাঝদরিয়ায় দুটো ডিঙি-নৌকোয় ভাসছি। একটায় আমি আর আমার বর, অন্যটায় তুমি একা। হঠাৎ একটা বেয়াড়া ঢেউ এসে উলটে দিলো আমাদের নৌকো, আমরা দুজনে জলে পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগলাম। তুমি কাকে বাঁচাবে, আমাকে না আমার বরকে? তোমার নৌকোয় কিন্তু তুমি ছাড়া আর একজনকেই নেওয়া যাবে।”
অনঙ্গদা উত্তর দেয়-“তোর বরকে বাঁচাবো।”
-কেন তুমি আমাকে বাঁচাবে না? ভালোবাসো না আমাকে?
-না রে টগরি, তোকে আমি খুব ভালোবাসি। এখনও।
-তাহলে তুমি আমাকে তোমার নৌকোয় তুলবে না কেন?
অনঙ্গদা উত্তর দেয়, “কেন জানিস? আমি তোর বৈধব্য বেশ সইতে পারবো না।”
-ওঃ! অনঙ্গদা, তুমি আমাকে এত ভালোবাসো!
-যাঃ!
তারপর একটু থেমে অনঙ্গদা বলে, “দেখ টগরি, সাঁঝ হয়েছে অনেকক্ষণ। চল্, আমরা ঘরে ঘিরি।”
ওরা দুজনে ফিরলো নিজের নিজের আস্তানায়। ওদের সারা শরীরে লোনাজলের আঁকিবুঁকি!
………০………